“মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, মানুষের ঘরে তুই মানুষ হ”-লালন সাঁইয়ের এই অমর বাণী যেন নতুন করে জেগে উঠেছে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩২ একরে। বিকেলের সোনালী আলোয় কড়ই পাতার ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়া রোদের নিচে একদল তরুণ-তরুণী গেয়ে উঠলেন মানবতার গান। তাদের চোখে ছিল শান্তি, কণ্ঠে ছিল আত্ম-অন্বেষণের সুর।

লালন সাঁইয়ের ১৩৫তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছে প্রথমবারের মতো ‘লালন স্মরণোৎসব’। বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সপোর্ট চত্বরের সেই পুরোনো কড়ই গাছতলা যেন গানের মন্দিরে পরিণত হয়েছে। গাছের নিচে অস্থায়ীভাবে সাজানো হয়েছে মঞ্চ।

আরো পড়ুন:

হাজার প্রদীপে আলোকিত গণ বিশ্ববিদ্যালয়

গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যান্সার চিকিৎসায় অবদান নিয়ে সেমিনার

বিকেল ৪টা বাজতেই শুরু হয় অনুষ্ঠান। শুরুতেই আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সুপ্তির কণ্ঠে ভেসে আসে— ‘মিলন হবে কতো দিনে.

..’। গানের শুরু হতেই যেন সময় থেমে যায়। সেই মঞ্চে কোথাও নেই জাঁকজমক, নেই কোলাহল—শুধু মানুষ, সুর, আর ভাবনার মুক্তি।

গানের ফাঁকে ফাঁকে চলে প্রবন্ধ পাঠও। কেউ পাঠ করেছেন লালনের জীবনদর্শন নিয়ে, কেউ আলোচনা করেছেন তার মানবতাবাদী ভাবনা ও সমাজভাবনা নিয়ে। তারই মাঝে প্রতিধ্বনিত হয় সাঁইজির কালাম— ‘আমি রাসুল রাসুল বলে ডাকি…’। উপস্থিত দর্শক-শ্রোতারা যেন মুহূর্তেই ডুবে যান ভক্তি ও ভাবনায়। লালনের দর্শনের সঙ্গে আজকের সময়ের যোগসূত্র খুঁজে দেখার সেই পাঠে যেন দর্শন ও সংস্কৃতির এক মিলন ঘটেছে।

দর্শক সারিতে বসা শিক্ষার্থী সবুজ মনি দাস বলেন, “লালন সাঁই শুধু গানের মানুষ নন, তিনি এক দর্শন। লালনের গান শুনলে মনে হয়, মানুষ হয়ে ওঠার এক শিক্ষা পাই। তিনি আমাদের শেখান, ধর্ম নয়—মানুষই সবকিছুর কেন্দ্র।”

এক শিক্ষার্থীর তখন গেয়ে ওঠেন— ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে…’। চারপাশের বাতাসও যেন থেমে শুনছে সেই সুর। পাশে বসা শিক্ষার্থীরা মৃদু তালে হাত দিচ্ছে, কেউ আবার গামছা দিয়ে মুখ মুছে গভীর মনোযোগে শুনছে। যেন প্রতিটি শব্দই কোনো অন্তর্গত জিজ্ঞাসার উত্তর।

গান চলতে থাকে একটার পর একটা। কেউ গাইছে, কেউ চোখ বন্ধ করে শুনছে। কেউ হয়তো নিজের ভেতরের মানুষটাকে চিনে নিচ্ছে, আবার কেউ কেবলই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। বাতাসে ভেসে আসে দোতারার টুংটাং।

আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ওহিদুজ্জামান বলেন, “লালন আমার খুব প্রিয়। তার গান ও দর্শন আলাদাভাবে দাগ কাটে। লালনের গান শুনলে এক অপ্রতিরোধ্য অনুভূতি জাগে। আমরা চাই, এই আয়োজনের মাধ্যমে লালনের দর্শন বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারে ছড়িয়ে পড়ুক। এমন আয়োজন যেন প্রতি বছর স্মরণীয় হয়ে থাকে।”

দেখতে দেখতে সময় গড়ায়। শেষ বেলার আলো আর গানের সুরে যেন লালনের দর্শন জীবন্ত হয়ে ওঠে। তখন একজন গেয়ে ওঠেন— ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়…’।

আয়োজন নিয়ে ছাত্র সংসদের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক মো. মারুফ বলেন, “আজ গণ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে এটি আমাদের প্রথম আয়োজন। আমরা আশা করছি, ভবিষ্যতেও এমন সুন্দর সাংস্কৃতিক আয়োজন অব্যাহত রাখতে পারব। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্বপ্নের মতোই ‘গ্রাম বাংলার সংস্কৃতি’ তুলে ধরা এবং শিক্ষার্থীদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য।”

গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের এই সরলতা, গানের গভীরতা, আর অংশগ্রহণের উচ্ছ্বাসে এটি শুধু একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নয়— যেন একটা বোধের যাত্রা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার এনামুল হক বলেন, “লালন ছিলেন বৈষম্যবিরোধী মানুষ। আজো তার দর্শন প্রাসঙ্গিক। জাতিগত ও ধর্মীয় বিভাজন দূর করতে লালনের শিক্ষা অনুসরণ করা জরুরি। আমরা চাই, তার দর্শনের আলোয় ক্যাম্পাসে মমতা ও সম্প্রীতির বন্ধন আরো দৃঢ় হোক।”

ঢাকা/মেহেদী

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর

এছাড়াও পড়ুন:

হাজার প্রদীপে আলোকিত গণ বিশ্ববিদ্যালয়

সন্ধ্যার আকাশ ঢেকে গেছে নরম কুয়াশায়। আকাশের বুক জুড়ে নরম কুয়াশার পরত, আর মাটির উপর ঝলমলে হাজার প্রদীপের সারি। সব মিলিয়ে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ধ্যা যেন আজ অন্যরকম।

ট্রান্সপোর্ট চত্বর থেকে শুরু করে বাদামতলা হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট প্রদীপ—যেন কারো সূক্ষ্ম আঁচড়ে আঁকা আলোর নদী। প্রতিটি শিখা যেন অন্ধকারকে ভাঙতে চায়, হৃদয়ের অজানা এক অদৃশ্য পথ দেখায়।

আরো পড়ুন:

সুন্দরবনে রাসপূজায় যেতে বন বিভাগের ৫ রুট, মানতে হবে যেসব নির্দেশনা

লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে গোপালগঞ্জে বসেছে প্রতিমার হাট

প্রথমবারের মতো ২০১৯ সালে ক্যাম্পাসে দীপাবলি উদযাপন করা হয়। দীর্ঘ সময় পর সোমবার (২০ অক্টোবর) দ্বিতীয়বারের মতো এবার শ্যামা কালীপূজাকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বারের মতো এ দীপাবলি উৎসবের আয়োজন করে ‘বাণী অর্চনা সংঘ’। শিক্ষার্থীদের হাতে তৈরি আলপনা আর মাটির প্রদীপে আজ আলোকিত হয়ে উঠেছে পুরো ক্যাম্পাস।

এর আগে, বিকেল থেকেই শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে শুরু করেন ট্রান্সপোর্ট চত্বরে। কেউ হাতে প্রদীপ নিচ্ছেন, কেউ ঝাড়বাতি জ্বালাচ্ছেন, কেউবা বন্ধুর সঙ্গে হাসিতে মেতে উঠছেন।

সন্ধ্যা নামতেই এক জাদুকরী দৃশ্যে রূপ নেয় পুরো ক্যাম্পাস। সারি সারি প্রদীপের আলোয় ক্যাম্পাসের লাল ইটের পথ হয়ে ওঠে সোনালি। বাতাসে ভেসে আসছে ধূপের গন্ধ। হাসির ঝলক আর আলোর মায়ায় মুহূর্তগুলো থেকে যায় স্মৃতির ভাঁজে।

এক শিক্ষার্থী বললেন, “সারা বছর ক্লাস, পরীক্ষা, ব্যস্ততা— আজকের এই সন্ধ্যা যেন একটু থেমে থাকার দিন। প্রদীপ জ্বালানোটা শুধু ধর্মীয় আয়োজন নয়, বরং একসঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার একটা উপলক্ষ।”

বাণী অর্চনা সংঘের সভাপতি অনিক মালো বলেন, “ক্যাম্পাসে দীপাবলীর উৎসব উদযাপন করতে পেরে নিজের কাছে খুব উৎফুল্ল মনে হচ্ছে। প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে সব অপশক্তি দূর হবে, এটা আশা করি।”

মূল ফটকের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি প্রদীপের আলো বাতাসে কাঁপছে, যেন এক জীবন্ত শিখা। কেউ বাজি ফুটাচ্ছে, কেউ কেউ শাড়ি পরে এসেছে–মনোযোগ ভালো ছবির ফ্রেমে। সেলফি তুলছে। তবে উৎসবের মধ্যে কোথাও নেই বিশৃঙ্খলা— আছে শুধু উচ্ছ্বাস আর আলোর স্নিগ্ধতা। মিষ্টিমুখ চলছে, কেউ মিষ্টি মুখে তুলে বলছে, “এত সুন্দর ক্যাম্পাস আগে দেখিনি!”

ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সাইন্সেস অনুষদের শিক্ষার্থী ঋতু রানী বলেন, “পরিবারের বাইরে প্রথমবারের মত দীপাবলি পালন করছি। সবারর অংশগ্রহণে বেশ আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ হচ্ছে।”

ট্রান্সপোর্ট চত্বরে তখন চলছে আরেক দৃশ্য। গানের আসর বসেছে ছোট করে। কেউ গিটার হাতে, কেউ তাল দিচ্ছে তালি দিয়ে। লালন গীতির সুরের ভেলায় মিলেমিশে যাচ্ছে দীপের আলো আর তারুণ্যের হাসি। রাত যত গভীর হচ্ছে, প্রদীপগুলো তত নিভে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের চোখে তখনও জ্বলছে আলো। সেই আলো শুধু প্রদীপের নয়। একাত্মতার, সৌন্দর্যের, আর জীবনের প্রতি ভালোবাসার আলো।

রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী সৌরভ রায় বলেন, “শ্যামা পূজায় পৃথিবীর সকল অশুভ শক্তি বিরুদ্ধে আমরা প্রদীপ প্রজ্বলন করি। আমরা চাই এই প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে সব খারাপ শক্তির বিনাশ হোক।”

আজকের এই এক হাজার প্রদীপের সন্ধ্যা যেন শুধু আলোর উৎসব নয়, বরং শিক্ষার্থীদের অন্তরের এক দীপান্বিত যাত্রা। প্রতিটি শিখা যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে, জীবন ছোট ছোট আলোয় পূর্ণ, আর সেই আলোর উষ্ণতায় আমরা সবাই এক।

ঢাকা/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এক ঘন্টায় ২০ লাখ রিয়্যাক্ট! প্রথমবার কন্যার মুখ দেখালেন দীপিকা–রণবীর
  • রিশাদকে সুপার ওভারে না দেখে অবাক হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ
  • আইসল্যান্ডে প্রথমবারের মতো মশার সন্ধান
  • ওয়ানডে ক্রিকেটে বিশ্বরেকর্ড, প্রথমবার ৫০ ওভার করলেন স্পিনাররা
  • জাপানের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হলেন সানায়ে তাকাইচি
  • হাজার প্রদীপে আলোকিত গণ বিশ্ববিদ্যালয়