ইউক্রেন জয়ের কোনো পরিকল্পনা নেই পুতিনের
Published: 18th, November 2025 GMT
আগামী বছরের জুন মাসের ১০ তারিখে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ ছাড়িয়ে যাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়সীমা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধও নাকি কয়েক সপ্তাহেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে সেই যুদ্ধও থমকে গিয়েছিল রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের মতো। সামরিক নেতৃত্বের একের পর এক ব্যর্থতায় নষ্ট হয়েছিল অসংখ্য সেনার জীবন।
১৯১৮ সালের আগস্টে মিত্রশক্তির নতুন কৌশল সক্ষম হয়েছিল জার্মানদের প্রতিরক্ষা ভেদ করতে; কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা ভিন্ন। ইউক্রেন আত্মসমর্পণ করবে না। রাশিয়ারও ধারণা নেই, কীভাবে জয়ী হবে।
একনায়কতান্ত্রিক শাসনেও যখন কোনো নেতার বিজয়ের স্পষ্ট পরিকল্পনা না থাকে, তখন তিনি নিজের জন্যই বিপদ ডেকে আনেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার নিকোলাস দ্বিতীয় অনেক মূল্য দিয়ে তা শিখেছিলেন। আজ পুতিন যতটা অর্থহীনভাবে রুশ সেনাদের জীবন নষ্ট করছেন, আগামী দিনে তিনি তত বড় সংকটের মুখোমুখি হবেন।
আরও পড়ুনপুতিন এবার ন্যাটোর সঙ্গে ভয়ংকর জুয়া খেলতে শুরু করেছেন২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫পুতিনের মূল সমস্যা হলো, তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনকে পরাজিত করতে পারেননি। ২০২৫ সালের গ্রীষ্মে তাঁর তৃতীয় ও সবচেয়ে বড় আক্রমণও চরম ব্যর্থতায় শেষ হয়েছে। রাশিয়ার কৌশল হলো ছোট ছোট দলকে মৃত্যুঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পাঠানো। কিন্তু কেউ যদি কোনোভাবে এগোতেও পারে, বাকি সেনারা সেই অগ্রগতির সুযোগ নিতে পারে না। কারণ, তারা যদি একসঙ্গে জড়ো হয়, মুহূর্তেই ধ্বংস নেমে আসে।
গত বছরের মাঝ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে রাশিয়ার হতাহতের সংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়ে এখন ৯ লাখ ৮৪ হাজার থেকে ১৪ লাখ ৩৮ হাজারের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে মৃতের সংখ্যাই প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার থেকে ৪ লাখ ৮০ হাজার। ধারণা করা হয়, প্রত্যেক ইউক্রেনীয় সৈন্যের মৃত্যুর বিপরীতে প্রায় পাঁচজন রুশ সেনা মারা যাচ্ছেন। তবু পুরো গ্রীষ্মে পুতিনের সেনারা একটি বড় শহরও দখল করতে পারেননি।
রাশিয়া সামান্য অগ্রসর হচ্ছে ঠিকই, তবে যে চারটি অঞ্চল তারা নিজেদের বলে দাবি করছে, সেগুলো পুরোপুরি দখল করতে আরও পাঁচ বছর লাগবে। আর হত্যাযজ্ঞ যদি ২০২৫ সালের গতিতে চলতে থাকে, তবে মোট রুশ হতাহত প্রায় ৪০ লাখে গিয়ে পৌঁছাবে।
পুতিন আশা করেছিলেন যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর পক্ষে পাল্লা ভারী করবেন। গোয়েন্দা তথ্য ও আকাশ প্রতিরক্ষা বন্ধ করে দিলে ট্রাম্প সত্যিই ইউক্রেনকে বাধ্য করতে পারেন একটি অস্বস্তিকর শান্তিতে। ২০২৫ সালের শুরুর দিকে তিনি সামান্য সময়ের জন্য এমন চেষ্টা করেছিলেন।এই অগ্রগতির অভাবই ব্যাখ্যা করে কেন পুতিন ইউক্রেনের শহর ও অবকাঠামোতেও হামলা করছেন। তাঁর লক্ষ্য হলো ইউক্রেনের কিছু অংশকে বসবাসের অযোগ্য করে মানুষের মনোবল ভেঙে ফেলা। রাশিয়া এখন আসন্ন ভয়াবহ শীতের কথাও তুলে ধরছে। ইউক্রেনের মানুষ আগেই জানে যে রাশিয়া নির্মম। প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র যখন বেসামরিক স্থানে আঘাত হানে, তা প্রমাণ করে—পুতিন জিতলে তাদের আরও অনেক কিছু হারাতে হবে।
অন্যদিকে রাশিয়ার ভেতরে ইউক্রেনের হামলাগুলো রুশদের মনোভাব বদলাতে পারে। জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ রুশ নাগরিক এই যুদ্ধকে সমর্থন করছে। তবে এদের মধ্যে মাত্র পাঁচজনের একজন প্রকৃত অর্থে যুদ্ধের দৃঢ় সমর্থক। বাকিরা শুধু বাস্তবতা ভাবতে না চাওয়ার সহজ পথটাই বেছে নিয়েছে। কিন্তু যখন অর্থনীতি দুর্বল হচ্ছে ও বাজেট কমছে, সেই সময়ে ইউক্রেন জ্বালানি স্থাপনা ও বিমানবন্দর লক্ষ্য করে হামলা চালানোয় রুশদের বাস্তবতার মুখোমুখি হতে বাধ্য করতে পারে।
আরও পড়ুনপুতিন এমন কিছু চান, যা তিনি কখনোই পাবেন না৩১ জুলাই ২০২৫পুতিন আশা করেছিলেন যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর পক্ষে পাল্লা ভারী করবেন। গোয়েন্দা তথ্য ও আকাশ প্রতিরক্ষা বন্ধ করে দিলে ট্রাম্প সত্যিই ইউক্রেনকে বাধ্য করতে পারেন একটি অস্বস্তিকর শান্তিতে। ২০২৫ সালের শুরুর দিকে তিনি সামান্য সময়ের জন্য এমন চেষ্টা করেছিলেন।
কিন্তু এখন সেই কৌশল সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। হোয়াইট হাউসের ‘শান্তিদূত’ ট্রাম্প এখনো ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে মন্দ-ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। কারণ, তিনি তাঁকে পছন্দ করেন না।
ট্রাম্প বুঝতে পেরেছেন যে ইউক্রেনকে রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দিলে তাঁর নোবেল পুরস্কারজয়ী রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার স্বপ্ন ভেস্তে যাবে। এমনকি অক্টোবরে তিনি রাশিয়ার দুই বড় তেল কোম্পানি, লুকয়েল ও রসনেফটের ওপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেন।
শেষ পর্যন্ত পুতিন আশা করতে পারেন, ইউক্রেনের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অর্থ সহায়তা আগামী ফেব্রুয়ারিতেই শেষ হয়ে যাবে।
আরও পড়ুনপুতিন একটা মহাযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন?২৬ এপ্রিল ২০২৫যেসব জনতুষ্টিবাদী সরকার ক্রেমলিনের প্রতি তুলনামূলক সহনশীল, তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্ষমতায় আসার মুখে ঝুলে আছে। বিভক্ত ও অকার্যকর ইউরোপ যুদ্ধ শেষে ইউক্রেনকে দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা দিতে হিমশিম খেতে পারে। তবে এটি যুদ্ধের চরম পরিস্থিতিতে ইউক্রেনকে ত্যাগ করার মতো নয়। ইউরোপের নিরাপত্তার চাবিকাঠি যে ইউক্রেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যদি কিয়েভ পতন হয়, তবে পুতিন ইউরোপের সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনী ও শক্তিশালী অস্ত্রশিল্পের নিয়ন্ত্রণ পেয়ে যাবেন।
রাশিয়ার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা ছাড়াও বহু বছরের জন্য টেকসই অর্থায়নের একটি বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ চলছে। এটি সফল হলে পুতিন বুঝবেন, ইউক্রেনের অর্থনীতি রাশিয়ার চেয়ে বেশি সময় টিকে থাকতে সক্ষম।
অনেকে মনে করেন, রুশ প্রেসিডেন্ট নিশ্চয়ই ভাবছেন সময় তাঁর পক্ষেই, তা না হলে এত দিনে শান্তি আলোচনায় বসতেন। কিন্তু ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান ও ইরাক আমাদের শেখায়, নেতারা শেষ পর্যন্ত অনড় থাকেন। তাঁরা আশায় থাকেন যে কিছু একটা পরিবর্তন ঘটবে।
আরও পড়ুনপুতিন না ট্রাম্প— কে কাকে আসলে ফাঁদে ফেলছেন১৩ আগস্ট ২০২৫তাই সম্ভাবনা বেশি যে ২০২৬ সালেও পুতিন লড়াই চালিয়ে যাবেন। অপেক্ষা করবেন, তাঁর জেনারেলদের নতুন যুদ্ধকৌশল বের করার। তিনি অপেক্ষায় থাকবেন, ইউক্রেনের জনবল কমে যাওয়ার, জেলেনস্কির সরকার ভেঙে পড়ার অথবা ট্রাম্প কিংবা ইউরোপের ধৈর্য হারাবার।
কিন্তু যদি এগুলোর কোনোটিই না ঘটে, তবে পুতিন নিজেই নিজের জন্য ভয়ংকর পরিণতির বোঝা জমা করে রাখবেন। রাশিয়া তার অর্থনীতিকে বন্ধক রেখেছে, ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে ন্যাটোতে ঠেলে দিয়েছে, চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এবং এক প্রজন্মের তরুণদের জীবনযাত্রা ধ্বংস করেছে। কিন্তু কিসের জন্য?
যেই মুহূর্তে রুশ জনগণের মনে এই প্রশ্ন জাগবে, বিশ্ব একটি নতুন ঝুঁকির মুখোমুখি হবে। পুতিন তখন বিদেশে পরাজয় মেনে নিয়ে দেশে ভয়ংকর দমন-পীড়ন চালাতে পারেন। অথবা তিনি বেছে নিতে পারেন উত্তেজনা বাড়ানোর পথও।
• এডওয়ার্ড কার দ্য ইকোনমিস্টের উপসম্পাদক
দ্য ইকোনমিস্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজিতে থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ২০২৫ স ল র ইউক র ন র কর ছ ল ন ইউর প র র জন য আরও প
এছাড়াও পড়ুন:
আসিফের মন্তব্যে বাফুফের কাছে বিসিবি সভাপতির দুঃখ প্রকাশ
বাংলাদেশের ফুটবল ও ফুটবলারদের নিয়ে বিসিবি পরিচালক আসিফ আকবরের অবমাননাকর মন্তব্য নিয়ে নিজেদের বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কাছে দুঃখপ্রকাশ করে চিঠি দিয়েছে বাংরাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। বাফুফের পাঠানো চিঠির উত্তর চারদিন পর দিয়েছে বিসিবি।
গত ৯ নভেম্বর ক্রিকেট কনফারেন্সে ফুটবলারদের ব্যবহার খারাপসহ আরও মাঠ দখলের মতো বিষয়ে মন্তব্য করে আলোচনায় আসেন বিসিবির পরিচালক আসিফ। বিসিবির আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে আসিফের ফুটবল নিয়ে মন্তব্যের প্রতিবাদ জানান বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়াল। তিনি বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল বরাবর চিঠি দেন। ফিরতি চিঠি পেয়েছে বাফুফে।
আরো পড়ুন:
সাংবাদিকদের কাছে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইলেন আমিনুল
বিসিবির আয়োজন সাংবাদিকদের বয়কট
বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়াল বরাবর পাঠানো চিঠিতে লেখা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট কনফারেন্স ২০২৫ অনুষ্ঠানে যে তথাকথিত বক্তব্যটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, সেই বক্তব্যটি তিনি প্রদান করেছিলেন জেলা প্রতিনিধিত্বকারী কাউন্সিলর হিসেবে, একজন বোর্ড পরিচালক হিসেবে নয়। আমার জানা মতে, তিনি তার নিজ জেলার ক্রিকেট কার্যক্রম ও মাঠ ব্যবহার–সংক্রান্ত কিছু দীর্ঘদিনের হতাশা ও জটিলতা থেকে ব্যক্তিগত ক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভবত উক্ত বক্তব্য প্রদান করেছেন।’
আসিফের মন্তব্যের সঙ্গে ক্রিকেট বোর্ডের সংশ্লিষ্টতা নেই, বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলামের স্বাক্ষরিত সেই চিঠিতে এমন বার্তাও দেওয়া আছে, ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত মতামত কখনোই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অবস্থানকে প্রতিফলিত করে না। আপনার অবগতির জন্য আমি সুদৃঢ়ভাবে আরও জানাতে চাই, বাংলাদেশ ক্রিকেট কনফারেন্স ২০২৫–এ প্রদানকৃত বক্তব্যটি ছিল সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি এবং সেটিকে বাংলাদেশে ক্রিকেট বোর্ডের বক্তব্য হিসেবে বিবেচনা করা সম্ভব হবে না।’
পাশাপাশি দুঃখও প্রকাশ করেছেন বিসিবি সভাপতি, ‘যদি উক্ত বক্তব্যের কারণে ফুটবল পরিবার বা ভক্তদের মনে কোনো ধরনের আঘাত বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়ে থাকে, তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।’
গত রোববার বিসিবির কনফারেন্সের উদ্বোধনী দিনে বক্তব্যে ক্রিকেটকে ‘আভিজাত্যের খেলা’ আখ্যা দেন আসিফ। তিনি বলেছিলেন, ‘‘ক্রিকেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষজন একটু ভদ্র স্বাভাবিকভাবেই, আভিজাত্যের ইস্যু আছে এখানে। আমার আবার একটু সমস্যা আছে। আমি আবার অত ভদ্র না। যেহেতু আমি অবসরপ্রাপ্ত ক্রিকেটার, অনেক আগের.. সুযোগ পাইনি নিজেকে ফোকাস করার… যদি ফুটবল মারমিট করে, আমিও মারপিট করব, নো প্রোবলেম…যে যেমন, তার সঙ্গে তেমন করতে হবে। আমরা তো চাঁদা চাচ্ছি না, কিডনি চাচ্ছি না, হার্ট-চোখ চাচ্ছি না, আমরা চাচ্ছি খেলার অধিকার।”
এরপর থেকে আসিফের মন্তব্য নিয়ে কড়া সমালোচনার ঝড় উঠে। বাফুফের প্রতিবাদ জানানোর পর বিসিবি আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনল।
ঢাকা/ইয়াসিন/আমিনুল