পোষা প্রাণীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নতুন কিছু নয়। অনেক প্রাণী তার মনিবের কথা বুঝতে পারে। তাঁর কথামতো নানা কসরত করে থাকে। তবে ভারতের উত্তর প্রদেশের রায়বেরলিতে একটি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বানরের অসাধারণ সম্পর্ক অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে। ওই বানরের নাম দেওয়া হয়েছে রানি। সে অন্যান্য বানরের চেয়ে অনেকটা আলাদা। পরিবারের নানা কাজ সে করে দেয়। এ কারণে তাকে ‘কাজের বানর’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
রায়বেরলির সাদওয়া গ্রামের কৃষক বিশ্বনাথের পরিবারে আট বছর আগে আনা হয় রানিকে। তখন থেকেই তাঁর পরিবারের সদস্যরা ওই রানিকে লালন–পালন করতে থাকেন।
জানা যায়, আট বছর আগে ওই গ্রাম দিয়ে বানরের একটি দল যাচ্ছিল। ওই সময় দলের অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রানি। তখন তাকে একা পেয়ে বিশ্বনাথের স্ত্রী ঘরে নিয়ে আসেন।
রানি বিশ্বনাথের পরিবারে নতুন এক পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়। হয়ে যায় ওই পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সে দ্রুতই মানুষের আচার–আচরণ রপ্ত করে নেয়। পরিবারের অন্যদের মতো সে–ও একই খাবার–পানীয় খেতে শুরু করে। ঘরের দৈনন্দিন কাজও রপ্ত করে নেয়।
রুটি বানানোসহ বিশ্বনাথের পরিবারের নানা কাজ করে দেওয়ার সুবাদে সবার ভালোবাসা অর্জন করে। তার ডাক নাম দেওয়া হয় ‘কাজের বানর’। এমনকি অবসর সময়ে মুঠোফোনে নানা ভিডিও দেখে থাকে রানি। রানির বুদ্ধিমত্তা আর আচরণ আশপাশের মানুষকে মুগ্ধ করে তোলে।
বিশ্বনাথের ছেলে আকাশ রানির নানা কর্মকাণ্ডের ভিডিও করে ইউটিউব চ্যানেল ‘রানি ব্লগ আরবিএল’–এ দিতে থাকে। দ্রুতই এই চ্যানেলের লাখ লাখ ভিউ হয়। রানির ব্যতিক্রমী কাজের দক্ষতা আর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার সম্পর্কের ভিডিও বিশ্বজুড়ে দর্শক–শ্রোতাকে মুগ্ধ করে।
মানুষের সঙ্গে রানির দারুণ বন্ধনের জন্য তাকে অবশ্য মূল্যও দিতে হয়েছে। বানরের দল এখন তাকে আর তাদের দলে নিচ্ছে না। কারণ, সে এখন বানরদের চেয়ে ভিন্ন রকম আচার–আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে এখন রানি পুরোপুরি মানব পরিবারের ওপর নির্ভরশীল।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
এত বছর পর ‘নতুন কুঁড়ি’, বিচারকদের আচরণ নিয়ে নানা অভিযোগ
কোনো কোনো বিচারক মনোযোগ দিয়ে প্রতিযোগীর পরিবেশনা দেখেননি। কেউ প্রতিযোগীর সঙ্গে রূঢ় আচরণ করেছেন। কখনো ৩০ সেকেন্ডের কম সময় পরিবেশনার সুযোগ পেয়েছে প্রতিযোগী। আবার প্রতিযোগীর উচ্চারণ বা সাজ নিয়ে কটু মন্তব্য করেছেন কোনো বিচারক। এতে প্রতিযোগীরা মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছে। এমনকি বাছাইকক্ষ থেকে চোখের পানি ফেলে বের হয়েছে কয়েকজন প্রতিযোগী।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) ‘নতুন কুঁড়ি’ প্রতিযোগিতার বিভাগীয় পর্যায়ের বাছাইপর্বের কোথাও কোথাও বিচারকেরা এমন আচরণ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রতিযোগীদের অভিভাবকদের দিক থেকে এসব অভিযোগ উঠে আসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে, ‘নতুন কুঁড়ি বিটিভি’ নামের পেজে।
তবে বিচারকেরা বলছেন, প্রস্তুতি না নিয়ে আসা প্রতিযোগীদের অভিভাবকদের অভিযোগই বেশি। বরং কখনো কখনো অভিভাবকদের আচরণেই বিচারকেরা বিব্রত হয়েছেন।
বিটিভির শিশু-কিশোরদের প্রতিভা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা ‘নতুন কুঁড়ি’। শুরু থেকেই ব্যাপক সাড়া ফেলে এই আয়োজন। এই অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে উঠে আসেন অসংখ্য গুণী শিল্পী। তবে ২০০৬ সালে হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায় এই অনুষ্ঠান। প্রায় দুই দশক পর বিটিভিতে আবার শুরু হয়েছে নতুন কুঁড়ি।
প্রতিযোগিতার বিভাগীয় পর্যায়ের বাছাইপর্ব শুরু হয় ৪ অক্টোবর। শেষ হয় ১১ অক্টোবর। আঞ্চলিক পর্যায়ে ‘ইয়েস কার্ড’ পাওয়া প্রতিযোগীরা আট বিভাগের বিভাগীয় পর্যায়ের বাছাইপর্বে অংশ নেয়।
বিটিভির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, বিভাগীয় পর্যায়ের প্রতিযোগীসংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৩১৯ জন। বয়সভিত্তিক দুটি শাখায় প্রতিযোগীরা অংশ নেয়। ‘ক’ (৬-১১ বছর), ‘খ’ (১১-১৫ বছর)।
প্রতিযোগিতায় আবৃত্তি, নৃত্য, সংগীত, গল্পবলা, অভিনয়, কৌতুকের মতো বিষয় আছে। নিয়ম হলো, প্রত্যেক প্রতিযোগী সর্বোচ্চ তিনটি বিষয়ে অংশ নিতে পারবে।
ঢাকা, বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহী বিভাগের অন্তত ৪০ জন অভিভাবক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিচারকদের আচরণ নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্তত সাতজনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো।
বরিশালের মাধবপাশা চন্দ্রদ্বীপ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক ফারজানা নীপু প্রথম আলোকে বলেন, বিচারকদের একজন তাঁর সন্তানের পরিবেশনার কিছুই না শুনে নম্বর দিয়েছেন। পরিবেশনার সময় বিচারক মুঠোফোনে ব্যস্ত ছিলেন।
এই অভিভাবকের অভিযোগ, তাঁর সন্তান কার কাছ থেকে গল্প বলা শিখেছে, সেই গুরুকেই আগে শিখে আসতে হবে—এমন মন্তব্য করেন বিচারক। এ কথা শুনে সন্তান মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নওগাঁর একজন অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেন, বিচারকদের একজন আমার সন্তানকে তুচ্ছ করে কথা বলেছেন। বাচ্চা কাঁদতে কাঁদতে বের হয়েছে। ক শাখার শিশুকে ‘তুমি তো কিছুই পার না’ এভাবে বলতে পারেন না বিচারক।’
ঢাকা বিভাগের বাছাইপর্বে অংশ নিতে নরসিংদী থেকে আসা এক প্রতিযোগীর অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সন্তান নজরুল গীতিসহ গানের দুটি শাখায় অংশ নেয়। বাছাইপর্বে বিচারকেরা যেভাবে ‘কিছুই হচ্ছে না’ বলে মন্তব্য করেন, তা হতাশাজনক। এসব মন্তব্য বাচ্চাদের মনে প্রভাব ফেলে। অথচ তাঁরা খুব খুশি হয়েছিলেন, নতুন কুঁড়ি চালুর কথা শুনে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মরিয়া আজাদ মৌমি নামের একজন অভিযোগ করেন, রাজশাহীতে প্রচুর অনিয়ম হয়েছে। কোনো বিষয়ে বিচারকদের ৫ মিনিট শোনার ধৈর্য দেখেননি। তবে মধ্যাহ্নবিরতিতে তিন ঘণ্টা সময়ও কাটিয়েছেন তাঁরা।
অ্যানজেল ঝরনা নামের এক অভিভাবক বিচারকদের ‘কঠোর’ আচরণের অভিযোগ তুলে নতুন কুঁড়ি বয়কটের ঘোষণা দেন ফেসবুকে।
রংপুর বিভাগে ক শ্রেণির এক প্রতিযোগীর মা আয়েশা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সন্তানের সঙ্গে বিচারকেরা বাজে আচরণ করেন। এ জন্য শিশুটি কবিতা আবৃত্তির পর কাঁদতে কাঁদতে ফিরেছে। তাই তিনি এবারের নতুন কুঁড়ি বর্জনের কথা লিখেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
বিচারকদের আচরণে সন্তানের ‘আপসেট’ হওয়া দেখে তৎক্ষণাৎ নিজেরা ভেঙে পড়েছিলেন বলে উল্লেখ করেন বরিশাল ও সিলেট বিভাগের দুই প্রতিযোগীর অভিভাবকেরা। তবে তাঁরা বলেন, বিচারকদের পরামর্শকে তাঁরা সন্তানের জন্য গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন।
ঢাকা বিভাগের এক প্রতিযোগীর অভিভাবক ফেসবুকে অভিযোগ করেন, তাঁর সন্তান নৃত্য বিভাগে বাছাইয়ে অংশ নেয়। অডিশন চলাকালে তাঁর সন্তানের পরচুলা নিয়ে এক বিচারক কটু মন্তব্য করেন। ১২ বছরের শিশুকে প্রেম করে কি না—এমন প্রশ্ন করেন বিচারক।
অনলাইনে আক্রমণের মুখে এই অভিভাবক পরে তাঁর পোস্টটি সরিয়ে নেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নতুন কুঁড়ি নিয়ে কোনো কথা বলতে আর রাজি হননি।
ময়মনসিংহ বিভাগে সংগীতের তিনটি শাখার বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সাংবাদিক শারমিন রিনভী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এমন দু-একটি অভিযোগের কথা শুনেছি। এটা একদমই অন্যায্য, যদি ঘটে থাকে। তবে এর ভিন্ন চিত্রও আছে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তির বাচ্চার অডিশনের পর আবার সবার সামনে গাইয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে, তাঁর সন্তান উত্তীর্ণ হওয়ার মতো না। বিচারকদের মধ্যে কোনো একজন কম নম্বর দিলে সেটা নিয়েও বিচারকদের জবাবদিহি করার ঘটনা ঘটেছে।’
শারমিন রিনভী আরও বলেন, প্রতিযোগিতায় ৭ বছরের শিশুর কণ্ঠে ‘দুঃখ আমার বাসর রাতের কলঙ্ক’ এমন জটিল সুরের গান শুনতে হয়েছে। সব মা মনে করেন, তাঁর সন্তান সবচেয়ে ভালো পারফরমার। কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা তেমন নয়, এটি বুঝতে হবে।
নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ নৃত্য বিভাগে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বিভাগীয় পর্যায়ে। বিচারকদের আচরণ নিয়ে অভিভাবকদের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিচারকের এত রূঢ় হওয়ার সুযোগ নেই, যাতে বাচ্চারা মনে কষ্ট পায়। প্রতিযোগিতার কক্ষে আরও দুজন বিচারক, ক্যামেরাম্যান উপস্থিত থাকেন। যে বাচ্চারা প্রস্তুতি নিয়ে আসে, তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে অভিযোগ আসে না। বরং নাচ না শিখে আসা প্রতিযোগীদের অভিভাবক মনে করেন, তাঁর সন্তান সহজে উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। তখন মার্কস না পেলেই বিচারকদের নিয়ে অভিযোগ শুরু হয়।’
অভিনয়শিল্পী রুমানা রশীদ ঈশিতা গত শতকের আশির দশকে নতুন কুঁড়িতে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুবার এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। প্রথমবার কিছুই পাননি। তখন বিচারকেরা যে সিদ্ধান্ত দিতেন, অভিভাবকেরা তা গ্রহণ করতেন। বাসায় এসে আরও অনুশীলন করাতেন। এখনকার শিশুরা অনুশীলনের জন্য পর্যাপ্ত সময় পায় কি না, তা তাঁর জানা নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের শাসন করার ধরনেরও পরিবর্তন এসেছে। তাই তাঁদের সময়ের বিচারকদের আচরণ দিয়ে এখন কথা বলাটা ঠিক হবে না।