জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বৃহস্পতিবার বিকেলে সর্বদলীয় বৈঠক করেছেন। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনরা উপস্থিত ছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে আয়োজিত এ বৈঠকের পর আলোচনার বিষয় নিয়ে নিজ নিজ দলের পক্ষ থেকে নানা মতের কথা তুলে ধরেছেন এতে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলের নেতারা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং আইন উপদেষ্টা সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন নিচে সংক্ষিপ্তভাবে তা তুলে ধরা হলো- 

সাড়ে পাঁচ মাস পর ঘোষণাপত্রের প্রয়োজন ছিল কিনা প্রশ্ন বিএনপির 
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ জাতীয় ঐক্যকে গণঐক্যে রূপ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ধরে রাখতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন,  ‌‘আমরা বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছি। ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে যাতে জাতীয় ঐক্যে কোনো ফাটল তৈরি না হয়, সে বিষয়ে নজর রাখতে বলেছি। বিএনপি দলগতভাবে প্রস্তাবনা দিয়েছে।’সাড়ে পাঁচ মাস পরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের কোনো প্রয়োজন ছিল কিনা, সে প্রশ্নও রাখেন বিএনপির এই নেতা। 

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, যদি কোনো রাজনৈতিক দলিল ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হয়, সেই দলিলটাকে বিএনপি অবশ্যই সম্মান করে। কিন্তু সেটা প্রণয়ন করতে গিয়ে যাতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাদের পরামর্শ নেওয়া হয়, সেই পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি। তিনি বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী যে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে, সেই ঐক্যকে গণঐক্যে রূপান্তরিত করে সেটাকে আমরা যাতে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে চর্চা করতে পারি, সেই ঐক্যকে ধরে রেখে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি, সেটাই আমাদের এখনকার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক বক্তব্য আমরা দিতে চাই। কোনো ফ্যাসিবাদী শক্তি বা ফ্যাসিবাদের দোসরেরা যাতে আমাদের ভেতরে অনৈক্যের বীজ বপন করতে না পারে, সেদিকে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা আজ আমাদের আহ্বান করেছিলেন, আমরা এসেছি, কথা বলেছি। আমরা আমাদের পরামর্শ, রাষ্ট্র পরিচালনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে যেসব চিন্তাভাবনা আমাদের দেওয়া প্রয়োজন, সেটা আমরা দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানসম্পর্কিত ঘোষণাপত্র নিয়ে কিছু আলোচনা হয়েছে। সব রাজনৈতিক দলের নেতারা তাঁদের পরামর্শমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। আমরা প্রশ্ন করেছি, আসলে সাড়ে পাঁচ মাস পরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের কোনো প্রয়োজন ছিল কিনা। যদি থেকে থাকে, সেটার রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক এবং আইনি গুরুত্ব কী, সেগুলো নির্ধারণ করতে হবে। এ ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে যাতে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও আমাদের লক্ষ রাখতে হবে।’

জামায়াতে ইসলামী সরকারকে সহযোগিতা করে যাবে
দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ গোলাম পরওয়ার বলেছেন, আমরা চার সদস্যের প্রতিনিধি এসেছিলাম। সর্বদলীয় বৈঠকে আমরা মতামত দিয়েছি। উপস্থিত সব দল জাতীয় ঐক্য ধারণ করে জুলাই ঘোষণাপত্রের ব্যাপারে সম্মত হয়েছি। সাবজেক্ট টু সাবজেক্ট আলোচনার সুযোগ আজ ছিল না। আমরা পরামর্শ দিয়েছি, যাতে কোনো অস্থিরতা এই দলিল তৈরির ক্ষেত্রে না থাকে। ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে যে চেতনা তৈরি হয়েছে, সঠিক ইতিহাস যাতে বাদ না পড়ে সে বিষয়ে আলোকপাত করেছি। সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে কিছু অসংলগ্নতা ছিল। আজকের বৈঠকটি ছিল প্রাথমিক একটি বৈঠক। জামায়াতে ইসলামী সরকারকে সহযোগিতা করে যাবে।

দলিল তৈরিতে পদ্ধতিগত প্রস্তাব গণসংহতি আন্দোলনের
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেছেন, কীভাবে দলিলটি হতে পারে সে বিষয়ে জানিয়েছি। ড্রাফট কমিটি করা দরকার। যেখানে সকলের মতামতকে যুক্ত করে যথাযথ সময় নিয়ে দলিলটি তৈরিতে আমরা পদ্ধতিগত প্রস্তাব দিয়েছি।

সংবিধান সংস্কার কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া যায় কিনা প্রস্তাব এবি পার্টির
আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি) সেক্রেটারি জেনারেল আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেছেন, ‘সব দলের একমত হওয়া কঠিন। তবে প্রক্রিয়ার ব্যাপারে, উপকরণের ব্যাপারে একমত হওয়া যেতে পারে। সংবিধান সংস্কার কমিশনকে এ দায়িত্ব দেওয়া যায় কিনা সে প্রস্তাব দিয়েছি। 

জুলাই ঘোষণাপত্র কারা লিখেছে জানতে চেয়েছে গণঅধিকার পরিষদ
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন মুহাম্মদ রাশেদ খান বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য শুনে হতাশ হয়েছি। ৩৬ দিনের আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতন হয়নি। এর পেছনে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন হয়েছে। সেসব আন্দোলন ঘোষণাপত্রে সংযুক্ত করতে বলেছি। যে ঘোষণাপত্র দেখানো হয়েছে তা কারা লিখেছে, সে জিজ্ঞাসার কোনো সদুত্তর পাইনি। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার ও তাদের দল যাতে নির্বাচনে আসতে না পারে তা অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছি। ঘোষণাপত্রের জন্যআরেকটি জাতীয় কমিটি বা কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছি।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব দূরত্ব কমিয়ে আনতে বলেছে ইসলামি আন্দোলন 
ইসলামি আন্দোলনের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব কাজী আতাউর রহমান বলেছেন, ‘ছাত্রদের কেন জুলাই বিপ্লব ও ৫ আগস্টের জন্য ঘোষণাপত্রের জন্য আল্টিমেটাম দিতে হয়। সে প্রশ্ন প্রধান উপদেষ্টাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কেন দূরত্ব তৈরি হচ্ছে বর্তমান সরকারের? তাঁর কারণ খুঁজে বের করে দূরত্ব কমিয়ে আনতে বলেছি। ঘোষণাপত্র লিখতে হলে মৌলিক জায়গায় এক হতে হবে। সেটা জানিয়েছি।’

সংবিধান সংশোধন করতে বলেছে খেলাফতে মজলিস
খেলাফতে মজলিসের মহাসচিব আহমদ আব্দুল কাদের বলেছেন, ডকুমেন্টসে কিছু ভুল-ত্রুটি আছে। সেগুলো ঠিক করতে বলেছি। সংবিধান সংশোধন করতে বলেছি।

শাপলা চত্বরের ঘটনা উল্লেখ করার কথা বলেছে হেফাজতে ইসলাম 
হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মো.

জুনায়েদ আল হাবিব বলেছেন, ‘যে খসড়া আমরা দেখেছি তাতে অনেকগুলো ‘যেহেতু’ দেখেছি। সেখানে শাপলা চত্বরের ঘটনা উল্লেখ করার কথা বলেছি। ৫ মাসের বিপ্লবের সরকারের কার্যক্রম সেভাবে দেখিনি। সেটা বলেছি।’

সরকারকে সহযোগিতা করবে খেলাফতে আন্দোলন
খেলাফতে আন্দোলনের মহাসচিব মুফতি ফখরুল ইসলাম বলেছেন, যে ঘোষণাপত্র আসতে চলেছে আমরা তার সাথে একমত। সরকারকে সহযোগিতা করবো।

সকল ছাত্রদের অন্তর্ভুক্তি চেয়েছে এনডিএম
এনডিএম মহাসচিব মোমিনুল আমিন বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলতে আমরা বুঝি সকল ছাত্রদের অংশগ্রহণ। কিন্তু তা হয়নি। আমরা সকল ছাত্রদের অন্তর্ভুক্তি চেয়েছি।

কোনো ডেডলাইন দেয়নি জাতীয় নাগরিক কমিটি
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার কাছে সময় চেয়েছেন অন্যরা। সময়ক্ষেপণ যাতে না হয় প্রধান উপদেষ্টা সেদিকে লক্ষ্য রাখতে বলেছেন। আমরা ধৈর্য ধরছি। আমরা সবাই পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে আছি। কোনো ডেডলাইন নাই। তবে দ্রুত ঘোষণাপত্র হবে সে ব্যাপারে আশাবাদী।

অভ্যুত্থানকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতির আশা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের   
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব আরিফ সোহেল বলেছেন, ‘সরকার ১৫ তারিখের মধ্যে ঘোষণাপত্র দেবে বলে আশা করেছিলাম। তা হয়নি। তবে আজ ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আলোচনা জারি থাকবে। আশা করি, এই অভ্যুত্থানকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিতে পারবো।’

একতাই আমাদের শক্তি: প্রধান উপদেষ্টা
সর্বদলীয় বৈঠকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, একতা থেকেই এই সরকার গঠিত হয়েছে। একতাই আমাদের শক্তি। আমরা কীভাবে আমাদের একতাকে সামনে এগিয়ে নেব, ৫ আগস্টকে রি-ক্রিয়েট করবো সে লক্ষ্যেই আজকের বৈঠক।

সময় নেওয়া হবে: আসিফ নজরুল
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঘোষণাপত্র আরও ফলপ্রসূ করতে আরও আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সর্বসম্মতিক্রমে ডকুমেন্টেড করতে সময় নেওয়া হবে।

বৈঠক শুরুর আগে অনিশ্চয়তা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিএনপির প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধি দল বৈঠকে যোগ দেন। বৈঠকে অংশ নেওয়া অন্য দলের নেতাদের মধ্যে ছিলেন- গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মাদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল ও সংগঠনটির মূখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসুদ।

খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বে তিন সদস্য, ইসলামি আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমানের নেতৃত্বে দুই সদস্য, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম বৈঠকে অংশ নিয়েছেন। এছাড়া যোগ দিয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ মার্কসবাদীর সমন্বয়ক মাসুদ রানা ও জাতীয় গণফ্রন্টের কামরুজ্জামান।
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সরক র র প ন সরক র র দল র ন ত সহয গ ত র সদস য সদস য স ক র পর ত হয় ছ র জন য ক ত কর ইসল ম ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

ছুটিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর লম্বা মিছিল

তিন দিন পর অবশেষে শুক্রবার ১৩ জুন দুই বোনের লাশ মেহেন্দীগঞ্জের গজারিয়া নদীতে ভেসে ওঠে। রাইসা ও জান্নাত মামাতো-ফুফাতো বোন। তারা আর হাসবে না। বই–খাতা, স্কুলড্রেস সব আছে, শুধু তারা তারা হয়ে গেছে দূর আকাশে। ১৩ বছরের জান্নাত ঢাকার গেন্ডারিয়া থেকে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ গিয়েছিল ঈদের ছুটিতে। তার এক বছরের ছোট মামাতো বোন রাইসার সঙ্গে খুব খাতির। ঈদ উপলক্ষে একসঙ্গে হাতে মেহেদিও দিয়েছিল দুজন। নানার বাড়ির কাছেই গজারিয়া নদী। সেখানে তারা বুধবার ১১ জুন যায় গোসল করতে। বলা হচ্ছে স্রোতের টানে ভেসে গিয়ে তারা নিখোঁজ হয়। ঈদের ছুটির আগে-পরে (৫ জুন-১৪ জুন) এ রকম প্রায় ৬৬টি ঘটনায় ৭৮ জন ডুবে মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। মর্মান্তিক সব মৃত্যুর খবর এখনো আসছে।

যেকোনো বড় ছুটিতে ‘বাড়ির’ জন্য রওনা দিলেই সবাই পৌঁছাতে পারে না, আবার পৌঁছালেও সবার আর ফেরা হয় না কর্মস্থলে, স্কুলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, খেলার মাঠে বন্ধুদের কাছে। সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণহানি ঘটে। শিশুরা এ সময় বেশি মারা যায় পানিতে ডুবে। এবার সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হয়েছে পানিতে ডুবে মৃত্যুর মিছিল। গণমাধ্যমের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত উল্লিখিত ৭৮ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে স্থানীয় হাসপাতাল আর পুলিশ কর্তৃপক্ষ।

৭৮টি মৃতদেহের মধ্যে মাত্র ১২টি হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের। বাকি ৬৬ জনই শিশু–কিশোর। এদের বয়স ১০ মাস থেকে ১৭ বছর। ৬৬ জনের মধ্যে অর্ধেকের বয়স ৫ বছরের নিচে। বাংলাদেশে এখন ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ) হচ্ছে পানিতে ডুবে মৃত্যু।

ভারতের জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য অনুসারে, দেশটিতে প্রতিবছর ৩৮ হাজারের বেশি মানুষ ডুবে মারা যায়। এটি সে দেশের মোট দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর প্রায় ৯ শতাংশ। অন্যদিকে গত বছর ইউনিসেফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৪ হাজারের বেশি শিশু ডুবে মারা যায়। অর্থাৎ দিনে মারা যায় প্রায় ৪০ জন।

এটা জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে বাংলাদেশে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা ভারতের চেয়ে বেশি।

বেসরকারি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি) বাংলাদেশের ডিরেক্টর ড. আমিনুর রহমান মনে করেন, সবাই বলে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় বেশি শিশু মারা যায়। আসলে বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে।

টিকা দিয়ে বা সময়মতো চিকিৎসায় ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের অকালমৃত্যু ঠেকানো গেলেও ‘লাভের গুড় পিঁপড়ে’ মানে পানিতে খেয়ে যাচ্ছে। শিশুরা ডুবে মারা যাচ্ছে পানির বালতিতে, ডোবায়, পুকুরে, খালে, নদীতে।

একে অপরকে বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যু

রাইসা আর জান্নাতের মতো কমপক্ষে ১৬ জন মারা গেছে, যারা একে অপরের বোন বা ভাই। মেহেন্দিগঞ্জে রাইসা ও জান্নাতের ক্ষেত্রে ঠিক কী ঘটেছিল, তা জানা না গেলেও ফরিদপুরের সালথায় তানহা নিজের ভাই তালহাকে বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিল। তখন তানহা নিজেও পানিতে ডুবে যায়। যে কজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ডুবে মারা গেছেন, তাঁদের অনেকেই প্রিয়জনদের বাঁচাতে গিয়ে মারা গেছেন। যাঁরা সাঁতার জানেন, তাঁদের বিশ্বাস, তাঁরা ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধার করতে পারবেন। আসলে ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধারের কৌশল জানা না থাকলে শুধু সাঁতারের জ্ঞান দিয়ে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রাণঘাতী প্রচেষ্টার নামান্তরমাত্র। একইভাবে আমি সাঁতার জানি বলেই আরেকজনকে সাঁতার শেখাতে পারব, এমন ভাবনার কোনো মানে নেই। সব খেলোয়াড় যেমন কোচ হতে পারেন না, তেমনি সব সাঁতারুই সাঁতারের প্রশিক্ষক হওয়ার উপযুক্ত নন। এবার যে চারজন অভিভাবক ডুবে মারা গেছেন, তাঁরা সবাই সাঁতার শেখাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। সাঁতার শেখানো কোনো তামাশা বা ফান নয়। এটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে।

এত মৃত্যুর কারণ কী

এই প্রশ্নের বিজ্ঞানভিত্তিক উত্তর পেতে হলে আমাদের ধারাবাহিক গবেষণা দরকার।

যেসব কারণ কথিত বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করে থাকেন, তা নিতান্তই অনুমাননির্ভর। গত শুক্রবার (১৩ জুন) দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় তিন শিশু (রাফা (২), তাসিব (২) ও তুহিন (৫) ডুবে মারা গেলে সংবাদকর্মীরা স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি অনুমাননির্ভর ধারণা থেকে জানান, শিশুর মৃত্যুর জন্য মূলত অভিভাবকেরাই অনেকটা দায়ী। পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেশি হওয়ায় অভিভাবকেরা শিশুদের প্রতি তেমন নজর দিতে পারেন না। এ ছাড়া প্রতিটি ঘরের পাশেই পুকুর বা ডোবা রয়েছে। শিশুদের প্রতি অভিভাবকদের নজরদারির অভাবে প্রায় পুকুরে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

এবারের মৃত্যুতালিকা দেখলে জানা যাবে অনেকেই তাঁদের একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন। কাজেই ছেলেমেয়ে বেশি, তাই নজরদারি নেই, এমন সরলীকরণ করা ঠিক হবে না। প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত হওয়া উচিত। ময়নাতদন্ত হওয়া উচিত। ওয়ারিশজনিত জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে খুনখারাবি, শিশুহত্যা এ দেশে নতুন কিছু নয়। বড় ছুটির সুযোগ কেউ নিচ্ছে না তো?

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর নানা কারণ আমাদের প্রকল্পনির্ভর গবেষকেরা খুঁজে বের করেছেন। মা ও অভিভাবকদের গাফিলতি আর সাঁতার না জানাকেই মূল কারণ হিসেবে শনাক্ত করে ব্যবস্থাপত্র জারি হয়েছে। পানিতে ডুবে মৃত্যু ঠেকাতে গ্রামে গ্রামে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র চালু করা, ছয় বছর বা তার চেয়ে বড় শিশুদের জন্য সাঁতার শিক্ষার ব্যবস্থার কথাও বলা হচ্ছে। দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলো কি বড় ছুটিতে খোলা থাকবে? ছুটিতে যখন গ্রামে শিশুর সংখ্যা বেড়ে যাবে তখন কি তাদের দিবাযত্ন কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হবে? এসব প্রশ্নের কেউ জবাব দেওয়ার নেই।

গত কয়েক বছরের পানিতে ডোবার ঘটনাগুলো একটু খতিয়ে দেখলে অন্য একটা কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুঃখজনকভাবে সেই কারণটি আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে। বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরাম জানাচ্ছে, হঠাৎ খিঁচুনি দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঝোঁক আছে, এমন শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা একেবারেই কম নয়। খিঁচুনির নানা ধরন থাকলেও আমাদের দেশে সাধারণভাবে এটা মৃগীরোগ নামে পরিচিত। বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরাম ২০২০ সালে পানিতে ডুবে মৃত ২২ জনের বিস্তারিত খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখে এদের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচজনের খিঁচুনি বা মৃগীরোগের প্রভাব ছিল।

গত মে মাসে বড় জোয়ারের সময় মহেশখালীতে যে তিনজন (জামাল মিয়া, দানু মিয়া, ঝুমু) পানিতে ডুবে মারা যান, তাঁদের প্রত্যেকের মৃগীরোগের প্রভাব ছিল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

যুক্তরাজ্যের ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজির বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট ড. লে সানডার এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত যে মৃগীরোগের উপসর্গ থাকলে শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। ২০১৪ সালে তিনি ও তাঁর দল ৮৮টি পানিতে ডোবার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, পাঁচজন ছাড়া বাকি সবাই মৃগী বা মৃগীরোগ-সংক্রান্ত কোনো না কোনো জটিলতায় ভুগছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অনলাইন পত্রিকা মেডপেজ টুডে লে সানডার–এর গবেষণার সূত্র ধরে জানিয়েছে, অন্যদের চেয়ে মৃগীরোগীদের পানিতে ডোবার আশঙ্কা ২০ গুণ বেশি। আবার বিশেষ ধরনের মৃগীরোগীর ক্ষেত্রে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৭ গুণ।

মৃগীরোগীর সংখ্যা কম নয়

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের মৃগীরোগের উপসর্গ নিয়ে অনেক শিশু আমাদের পরিবারে, পাড়ায়, সমাজে অবহেলায় বেঁচে আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কম বয়সের শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ—সবাই মৃগীরোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে শিশুদের মধ্যে এই রোগের প্রভাব বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আগ্রহে এবং আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত একটি জরিপ চালানো হয়। এটাই ছিল মৃগীরোগীর সংখ্যা নিরূপণের প্রথম জরিপ। কাকতালীয়ভাবে এই জরিপের ফলাফলের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার মৃগীরোগীর তথ্য হুবহু মিলে যায়। শ্রীলঙ্কার মতো আমাদের দেশেও প্রতি হাজারে ৯ জন মৃগীরোগী আছে বলে এই জরিপে জানা যায়। সেই হিসাবে বাংলাদেশে মোট মৃগীরোগীর সংখ্যা কমপক্ষে ২০ লাখের মতো। বলে রাখা ভালো, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মৃগীরোগীর গড় সংখ্যার ব্যাপক তারতম্য আছে।

শিশুর মধ্যে কী কী আলামত দেখলে প্রাথমিকভাবে মৃগীরোগের সন্দেহ করা করা যায়:

এক. হঠাৎ করে কোনো শিশু চোখ-মুখ উল্টিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে আর তার সঙ্গে সারা শরীরে ঝাঁকুনি বা খিঁচুনি শুরু হলে।

দুই. কোনো শিশু যদি চোখের পলক না ফেলে হঠাৎ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে বা অন্যমনস্ক হয়ে গেলে। অনেক ক্ষেত্রে হাতে কিছু থাকলে হঠাৎ করেই পড়ে যায়। (অভিভাবকেরা অনেক সময় ভাবেন, এটা শিশুর কাব্যিক ভাব। সন্তান তার কবি হয়ে উঠছে।)

তিন. আপাতদৃষ্টে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ এক শিশু যদি হঠাৎ করে অস্বাভাবিক ব্যবহার শুরু করে। মুখভঙ্গির পরিবর্তনসহ অস্বাভাবিক হাঁটাচলা করে। আবোলতাবোল কথা বলতে শুরু করে। আবার কয়েক মিনিট পর আগের মতো সুস্থ হয়ে যায়।

চার. পানি বা আগুনের কাছে গেলেই হঠাৎ খিঁচুনি ওঠে।

পাঁচ. শিশু চোখেমুখে অন্ধকার দেখার কথা বলে। চোখে আলোর ঝিলিক দেখে, তারপর আর কিছু বলতে পারে না।

এসবের কোনোটাই আমাদের উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে, মৃগী কোনো অভিশাপ নয় বা দৈব কোনো রোগ নয়। মৃগীরোগ মস্তিষ্কের একটি অসুখ, যা মাথায় কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের তারতম্যের কারণে হয়। কোলের শিশু থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সের শিশু এমনকি বয়স্ক মানুষেরও এটা হতে পারে।

পানিতে নামতে না দেওয়া ছাড়াও এ ধরনের শিশুদের গাছে চড়তে দেওয়া ঠিক নয়। যেসব শিশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাচ্ছে, তাদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার সময় ওষুধ সঙ্গে রাখতে হবে।

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর স্রোত নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কি

নিয়ত ঠিক থাকলে অবশ্যই সম্ভব। ২০১৯ সালে জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। ৮৮ শতাংশের বেশি কমিয়ে আনা কোনো কঠিন কাজ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে তিনটি কৌশল সবচেয়ে কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয়। এগুলো হচ্ছে, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী শিশুযত্নের সুযোগ সৃষ্টি করা। পানিতে সুরক্ষা ও নিরাপদ উদ্ধারের ওপর জোর দিয়ে ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের সাঁতার শেখার সুযোগ বৃদ্ধি করা। শিশুদের নিরাপত্তাঝুঁকি এবং তা হ্রাস করার পদ্ধতি সম্পর্কে জনসাধারণ ও মা-বাবাদের সচেতনতা বাড়ানো।

গ্রামে আগে শিশুদের কোমরে পিতলের একটা ছোট্ট ঘণ্টি বেঁধে দেওয়া হতো। এটা কোনো অলংকার ছিল না। কর্মব্যস্ত মায়ের কান থাকত সেই ঘণ্টির দিকে। সচেতন অভিভাবকেরা বাড়ির আশপাশের পুকুরে বাঁশের বা টিনের ঘেরা দিতে পারেন। এতে একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, যেটা পেরিয়ে শিশু পুকুরে যেতে পারবে না।

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ২০২২ সালে ২৭১ কোটি ৮২ লাখ ৫৭ হাজার টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। একই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশুযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার সুবিধা প্রদান’ শীর্ষক প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। জানুয়ারি ২০২২ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের আওতায় ২ লাখ শিশুকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে শিশুযত্ন কেন্দ্র স্থাপন এবং পরিচালনা, ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের জন্য ১ হাজার ৬০০টি ভেন্যুতে সাঁতার প্রশিক্ষণ সুবিধার ব্যবস্থা এবং সুইমসেফ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৩ লাখ ৬০ হাজার শিশুকে সাঁতার শেখানোর কথা। দেশের ৮টি বিভাগের ১৬টি জেলাকে এ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এখন প্রয়োজন এসব প্রকল্পের স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে স্থানীয় অভিভাবক ও তরুণদের সম্পৃক্ত করে তাদের নেতৃত্বে একটি টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

লেখক গবেষক: [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ