ভারতের আরজি কর হাসপাতালে নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় তিনটি ধারায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়। সিবিআই মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানালেও শেষমেশ আমৃত্যু কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক অনির্বাণ দাস। সঙ্গে জরিমানা করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। খবর হিন্দুস্তান টাইমস ও আনন্দবাবাজার পত্রিকা।

জরিমানার অর্থ দিতে না পারলে আরও পাঁচ মাসের কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় শিয়ালদহ আদালত। এ ছাড়াও ধর্ষণের জন্য ৭ লক্ষ এবং হত্যার জন্য ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিচারক বলেন, ‘রাষ্ট্রের দায়িত্ব ভুক্তভোগীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার।’

এদিকে সাজা ঘোষণার আগে আবারও বিস্ফোরক আর্তি জানিয়েছে দোষী সাব্যস্ত সঞ্জয়। তিনি বলেন, ‘আমি খুন বা ধর্ষণ কোনটাই করিনি। বিনা কারণে ফাঁসানো হয়েছে। আমি যদি ধর্ষণ-খুন করে থাকতাম, তাহলে কি রুদ্রাক্ষের মালা নষ্ট হত না? আমি নির্দোষ। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমাকে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করা হয়েছে। মারধর করা হয়েছে। পুলিশের কাছ থেকে যখন সিবিআই-এর কাছে যাই। আমি কিছু করিনি।’

যার উত্তরে বিচারক বললেন, ‘কী হয়েছে, সেটা আপনার থেকে ভালো কেউ জানে না। আমার কাছে বিচার্য হল প্রমাণ। আপনি যা যা বলেছেন, শুনেছি। কিন্তু সিবিআই যা প্রমাণ দিয়েছে, তাতে আমি নিশ্চিত, আপনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক।’

যদিও তারপরেও দোষী সাব্যস্ত সঞ্জয় বলতে থাকে, ‘আমি দোষ করিনি। তাও দোষী প্রমাণ করা হয়েছে। আমি আর কী বলব! আপনি যা বিচার করার করুন।’

এদিন আদালতে সিবিআই ফের আরজি কর-কাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত সঞ্জয়ের ফাঁসির পক্ষেই জোর দাবি জানায়। সিবিআই বলে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা আছে। কোন ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে। এটা বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনা। মানুষকে পরিষেবা প্রদানের জন্যই ৩৬ ঘণ্টা ধরে ডিউটিতে ছিলেন। মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। তার মৃত্যু শুধুমাত্র পরিবারের ক্ষতি নয়, সমাজেরও ক্ষতি। 

সিবিআই এদিন আরও বলে, বহু মেয়ে উচ্চশিক্ষা ও চাকরির জন্য লড়ে যাচ্ছে। সেখানে যদি সুরক্ষা না থাকে, তবে সমাজব্যবস্থা ব্যর্থ বলে পরিগণিত হবে। সমাজ তার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে চাইছে। সুরক্ষা চাইছে।

আরজি কর-কাণ্ডে রায় শুনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, তিনি দোষীর ফাঁসি চেয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ফাঁসির দাবি করেছিলাম। কী করে জানি না.

.. আমাদের হাতে কেসটা থাকলে অনেক আগেই ফাঁসির অর্ডার করে নিতাম।’

ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪, ৬৬ এবং ১০৩ (১)— এই তিনটি ধারায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়। সিবিআই মৃত্যুদণ্ডের জন্য দাবি করলেও শেষমেশ আমৃত্যু কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন বিচারক অনির্বাণ দাস। সঙ্গে জরিমানা করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। জরিমানার অর্থ দিতে না পারলে আরও পাঁচ মাসের কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় শিয়ালদহ আদালত। এ ছাড়াও ধর্ষণের জন্য ৭ লক্ষ এবং হত্যার জন্য ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিচারক বলেন, ‘রাষ্ট্রের দায়িত্ব ভুক্তভোগীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার।’

আদালতের নির্দেশ শুনে কাঁদো কাঁদো দেখা গেল দোষী সঞ্জয় রায়কে। বিড়বিড় করে কিছু বলতে থাকেন তিনি। সঞ্জয়ের আইনজীবী তাকে বলেন, ‘আপনার মৃত্যুদণ্ড নয়, আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হল।’ তার প্রেক্ষিতে সঞ্জয় বলেন, ‘আমার তো বদনাম হয়ে গেল।’

ভুক্তভোগীর বাবা জানান, ক্ষতিপূরণ চান না। তার উদ্দেশে বিচারক বলেন, ‘আপনি মনে করবেন না টাকা দিয়ে ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাকে এমন বলা হলে আমিও তাই করতাম।’

বিচারক সঞ্জয়কে বলেন, আপনাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জেলে থাকতে হবে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: কলক ত র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

দেশে প্রথমবারের মতো ২৫টি ‘বেশি বিপদজনক’ বালাইনাশক চিহ্নিত

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে কৃষিতে হাইব্রিড ও উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসলের ব্যবহার বাড়ছে। এর ফলে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রোগ ও পোকা। আবার এসব রোগ ও পোকা দমনে বেড়েছে অনিয়ন্ত্রিত বালাইনাশকের ব্যবহার। মাত্রাতিরিক্ত এসব বিষাক্ত বালাইনাশক ব্যবহার সরাসরি প্রভাব ফেলছে কৃষক, ভোক্তা ও পরিবেশের ওপর। ক্যান্সারসহ নানা দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন কৃষকরা।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জরিপ (২০১৫–১৭) অনুযায়ী, তাদের হাসপাতালে ক্যান্সারে আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের মধ্যে প্রায় ৬৪ শতাংশ কৃষির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এ তথ্যই প্রমাণ করছে—বিষ কীভাবে খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে মানুষ ও পরিবেশে বিপর্যয় ডেকে আনছে।

এ নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. গোপাল দাসের নেতৃত্বে গবেষণা করে দেশে প্রথমবারের মতো বেশি বিপদজনক বালাইনাশক চিহ্নিত করেছেন একদল গবেষক। 

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) নির্ধারিত আটটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে দেশে নিবন্ধিত ৩৪৩টি সক্রিয় উপাদান বিশ্লেষণ করে মোট ২৫টি বেশি বিপদজনক বালাইনাশক চিহ্নিত করেন তারা। এই ২৫টি বালাইনাশকের মধ্যে ১১টি কীটনাশক, সাতটি ছত্রাকনাশক, পাঁচটি আগাছানাশক এবং দুইটি ইঁদুরনাশক। প্রায় ৮ হাজার বাণিজ্যিক পণ্যে এসব উপাদান ব্যবহৃত হয়।

বুধবার (৩০ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকায় অবস্থিত তুলা ভবনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ‘বাংলাদেশে অধিক বিপদজনক বালাইনাশক ও রাসায়নিকের উন্নত ব্যবস্থাপনার জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক কর্মশালায় গবেষণায় প্রাপ্ত এসব তথ্য তুলে ধরেন প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. গোপাল দাস।

গবেষণায় দেখা গেছে, মাঠপর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত নয়টি বেশি বিপদজনক বালাইনাশক হলো- এবামেকটিন, ক্লোরপাইরিফস, প্যারাকুয়াট, গ্লাইফোসেট, গ্লুফোসিনেট অ্যামোনিয়াম, কার্বেন্ডাজিম, প্রোপিকোনাজোল, জিঙ্ক ফসফাইড ও ব্রোমাডিওলন। এছাড়া আরও কিছু বালাইনাশকের মধ্যম বা সীমিত ব্যবহার দেখা গেছে।

অন্যদিকে, সাইফ্লুথ্রিন, বিটা-সাইফ্লুথ্রিন, ট্রায়াজোফস, এডিফেনফস, ফ্লুলসিলাজোল নামক বালাইনাশকের তেমন কোনো মাঠ পর্যায়ে ব্যবহার পাওয়া যায়নি, যা এখনই নিষিদ্ধ করা সম্ভব বলে মত দেন গবেষকগণ।

এসব বালাইনাশকের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে ড. গোপাল বলেন, “এগুলো মানবদেহে ক্যান্সার, কিডনি বিকলতা, হৃদরোগ, ফুসফুসের জটিলতা এমনকি প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। শুধু মানুষ নয়, প্রাণীকূল এবং পরিবেশেও দীর্ঘস্থায়ী বিষক্রিয়া তৈরি করে। এসব বালাইনাশকের একটি বড় অংশ স্থায়ী জৈব দূষক হিসেবে পরিবেশে জমে থাকে বছরের পর বছর।”

গবেষণা শেষে ড. গোপাল দাসের নেতৃত্বে দেশব্যাপী ১৪টি অঞ্চলে দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ, র‌্যালি, মাঠ প্রদর্শনী ও ১০টি আঞ্চলিক কর্মশালার আয়োজন করা হয়। কৃষক, বালাইনাশক ডিলার ও কৃষি কর্মকর্তাদের সচেতন করতে নেওয়া হয় কার্যকর উদ্যোগ।

এ নিয়ে গবেষক ড. গোপাল দাস বলেন, “সরকারের উচিত, বেশি বিপদজনক বালাইনাশকের রেজিস্ট্রেশন বাতিল বা নবায়ন বন্ধ করতে হবে এবং বিকল্প নিরাপদ বালাইনাশক ব্যবহারে প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ডিলারদের লাইসেন্স কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এছাড়াও কৃষি কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। মাঠপর্যায়ে বর্তমান আইন বাস্তবায়ন করতে পারলে এই ক্ষতির হাত থেকে দেশের কৃষক ও কৃষি খাতকে রক্ষা করা সম্ভব।”

বেশি বিপদজনক বালাইনাশকের এই চিহ্নিতকরণ ও সুনির্দিষ্ট সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে টেকসই কৃষি, নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যতের দিকেই এগিয়ে যাবে বলে আশাবাদী বাকৃবির এই গবেষক।

বাকৃবির কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. সাইফুল আলম। 

সম্মানিত অতিথি ছিলেন, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বাংলাদেশ অঞ্চলের জ্যোষ্ঠ কারিগরি ও নীতি উপদেষ্টা মারটিজিন ভন দে গ্রোয়েপ। বিশেষ অতিথি ছিলেন, ডিএই এর প্লান্ট কোয়ারেন্টাইন উইংয়ের পরিচালক মো. আব্দুর রহিম, বাকৃবি রিসার্চ সিস্টেমের (বাউরেস) পরিচালক অধ্যাপক ড. এম. হাম্মাদুর রহমান।

কর্মশালায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন বাকৃবির কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষকদলের সদস্য অধ্যাপক ড. মো. রমিজ উদ্দিন।

এ সময় দেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞানীগণ, ডিএই কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন কীটনাশক কোম্পানির প্রতিনিধি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, কৃষক ও আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মহাপরিচালক মো. সাইফুল আলম বলেন, “আমরা বর্তমান প্রচলিত বালাইনাশক আইনের সংস্কারের লক্ষ্যে কাজ করছি, যাতে জনগণকে নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে পারি। তবে আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা আমরা অকপটে স্বীকার করি। এ সমস্যা সমাধানে শিক্ষক, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।”

তিনি আরো বলেন, “ক্ষতিকর কীটনাশকের অতি ব্যবহারের ফলে জনস্বাস্থ্যের উপর গুরুতর প্রভাব পড়ছে। এগুলো ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টি করতে পারে। তাই এসব বালাইনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা ২০২৫ সালে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছি। আমরা অবশ্যই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে চাই। তবে তা যেন পরিবেশের ক্ষতি করে না হয়, সেদিকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এজন্য জৈব কীটনাশক ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করছি।”

ঢাকা/লিখন/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ