স্বাধীনতার পর থেকে সামাজিক উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) থেকে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে পুরো বিশ্বে বন্ধ করে দিয়েছেন সব অনুদান। এতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, জ্বালানি, জলবায়ু, পরিবেশ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ সামাজিক খাতে চলমান সব ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম স্থগিত করেছে ইউএসএআইডি।

উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ নানা কারণে গত বছর থেকে এক প্রকার চাপে দেশের মানুষ। গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অর্থনীতির ক্ষতগুলো ফুটে উঠতে শুরু করে, যা সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। এর মধ্যে ইউএসএআইডির কার্যক্রম বন্ধ হওয়ায় সামাজিক নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন খাতে বড় চাপে পড়তে পারে দেশ।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশে কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী সব অংশীজনকে সব প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ অথবা স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছে ইউএসএআইডি। গত শনিবার পাঠানো চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়। চিঠিতে অংশীদারদের ইউএসএআইডির অধীন সব চুক্তি, কার্যাদেশ, মঞ্জুরি, সহযোগিতামূলক চুক্তি কিংবা অন্য প্রকল্পের সব ধরনের কাজ বন্ধ, জব্দ বা স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে অংশীদারদের তাদের জন্য বরাদ্দ খরচ কমাতে সব যুক্তিসংগত পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পরবর্তী নির্দেশ (উল্লিখিত নির্দেশনা বাতিল করার) লিখিত আকারে না পাওয়া পর্যন্ত অংশীজনকে কাজ আবার শুরু না করতে বলা হয়েছে। তবে বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ বজায় রাখবে যুক্তরাষ্ট্র। এমন নির্দেশনার পর বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার মানবিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে। এতে হুমকিতে পড়তে পারে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, জ্বালানি, পরিবেশ, খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি, পরিবেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ খাতসহ সার্বিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা। মার্কিন তহবিলপ্রাপ্ত বিভিন্ন প্রকল্পের অংশীদার বাংলাদেশ। এর মধ্যে মার্কিন অনুদানপ্রাপ্ত অনেক এনজিও এবং সরকারি সংস্থা রয়েছে। তারা এ আদেশের প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন। অনিশ্চয়তায় পড়েছে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো। এতে অন্যান্য খাতের পাশাপাশি দেশের স্বাস্থ্য খাত কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে জানিয়েছেন উন্নয়ন সহযোগীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে ইউএসএআইডি সবচেয়ে বেশি অর্থায়ন করেছে। পাশাপাশি উন্নয়ন সংস্থাগুলো ইউএসএআইডির অর্থায়নে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। হঠাৎ করে কার্যক্রম স্থগিত করায় কর্মসূচিগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় পড়ে গেল। এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ জরুরি।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) মা ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞানী আহমদ এহসানুর রহমান সমকালকে বলেন, যক্ষ্মার সমস্যা মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের তালিকায় ছিল বাংলাদেশ। গত এপ্রিলে বাংলাদেশে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য, ওয়ান হেলথ প্রকল্প চালু করেছিল ইউএসএআইডি। এ প্রকল্পের অধীনে পাঁচ বছরে ২ কোটি ৬০ লাখ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল সংস্থাটির। এ ছাড়া স্বাস্থ্যে গুরুত্বপূর্ণ জরিপগুলো বাস্তবায়নে অর্থায়ন করে থাকে এই সংস্থা। চলমান এসব প্রকল্পের কার্যক্রম এখন বন্ধ থাকবে। সরকারি প্রকল্পগুলো সচল রাখতে না পারলে স্বাস্থ্য খাতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে ইউএসএআইডি এই ধরনের অর্থায়ন করে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ইউএসএআইডি কার্যক্রম বন্ধে নানা দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ। যেমন– তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর কল্যাণ ও সুরক্ষা এবং উন্নয়নে ৯০ শতাংশ প্রকল্প ইউএসএআইডির। এসব প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। এ ছাড়া শিক্ষায় অনেক প্রকল্প চলমান।

ইউএসএআইডি গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশকে প্রায় ২০ কোটি ২২ লাখ ডলার অর্থ সহায়তা দেওয়ার চুক্তি করে। এর আগে ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১-২০২৬ সালের জন্য বাংলাদেশ ও ইউএসএআইডির মধ্যে একটি নতুন ডিওএজি (ডেভেলপমেন্ট অবজেক্টিভ গ্রান্ট অ্যাগ্রিমেন্ট) সই হয়। এর মাধ্যমে ইউএসএআইডি ৯৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পঞ্চম সংশোধনী পর্যন্ত ইউএসএআইডি সাড়ে ৪২ কোটি ডলার দিয়েছে। ১৯৭৪ সালে সই হওয়া ‘অর্থনৈতিক প্রযুক্তিগত ও সম্পর্কিত সহায়তা’ চুক্তির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন খাতে ৮০০ কোটি ডলারের বেশি তহবিল দিয়েছে।
‘ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স ডট গভ’ ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্নভাবে বাংলাদেশে ২০২১ সালে ৫০০ মিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালে ৪৭০ মিলিয়ন ডলার, ২০২৩ সালের ৪৯০ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২৪ সালে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর থেকে ওয়াশিংটন বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। গত কয়েক বছরে মার্কিন সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ ১০-এ ছিল বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ইউএসএআইডির মাধ্যমে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ সম্প্রসারণ ঘটানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নত করেছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও চর্চা বেড়েছে। পরিবেশকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহিষ্ণুতা বাড়িয়েছে। নতুন এই আদেশের কারণে বাংলাদেশে এসব কর্মকাণ্ডে ধাক্কা লাগতে পারে।
দেশের স্বাস্থ্য খাত কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এর প্রভাবে মা ও শিশুমৃত্যুর উচ্চহার, ব্যাপক অপুষ্টি, যক্ষ্মা রোগের প্রাদুর্ভাব (টিবি) এবং ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ সংস্থা বছরের পর বছর ধরে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে। পাশাপাশি মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনার কার্যক্রম, অপুষ্টির বিরুদ্ধে প্রতিরোধসহ যক্ষ্মার মতো সংক্রামক রোগ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ ছাড়া সংস্থাটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সহজীকরণ করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু যুগান্তকারী অর্জনে অবদান রাখতে সহায়তা করেছে। দেশের বৃহত্তম রপ্তানি খাত ওষুধ শিল্পের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেশে অপুষ্টির মাত্রা বাড়ানো, শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব এবং লাখ লাখ দুর্বল ব্যক্তিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেবে। নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানিতেও (এসএমসি)। এর মাধ্যমে দেশের মানুষ স্বাস্থ্যপণ্য সাশ্রয়ী মূল্যে পেত। 
এইচআইভি/এইডসবিরোধী কর্মসূচি পিইপিএফএআরের অধীনে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অ্যান্টি-রেট্রোভাইরাল ওষুধ সরবরাহ করা হয়। ২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের শাসনামলে চালু হওয়া এ কর্মসূচি প্রায় ২৬ মিলিয়ন মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় স্বাস্থ্য খাতে যে সহায়তা দেওয়া হতো, বাংলাদেশে তাও বন্ধ হতে পারে। এনজিওগুলোর উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ইউএসএআইডি বড় সহায়তা দিচ্ছে। এখন শত শত সংস্থার কর্মসূচি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।

বাংলাদেশ-আমেরিকা মৈত্রী প্রকল্পের পক্ষ থেকে স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করা ১৮টি বেসরকারি সংস্থাকে (এনজিও) ২০২৪ অর্থবছরের জন্য অনুদান দিয়েছে ইউএসএআইডি। ব্র্যাক এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। অনুদানপ্রাপ্ত স্থানীয় এনজিওগুলো কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিশু অধিকার ও সুরক্ষাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কাজ করছে। ইউএসএআইডির কার্যক্রম স্থগিতের কারণে এ রকম বহু কর্মসূচি হুমকির মুখে।

বাংলাদেশের কৃষি, মৎস্য, প্রাণী, পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক করতে উন্নত গবেষণা কার্যক্রম ও উন্নত প্রযুক্তির বিষয়ে সহযোগিতা করছে ইউএসএআইডি। কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা রূপান্তরে চালু থাকা প্রকল্পগুলো অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে।
এ নিয়ে সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক সাকিব আলী বলেন, ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এটা সাময়িক, তিন মাসের জন্য। আসলে তাদের দেওয়া অর্থ বিভিন্ন দেশে সঠিকভাবে খরচ হচ্ছে কিনা এবং যৌক্তিক কিনা, তা মার্কিন নাগরিকদের দেখাতে চান।
তবে ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের তহবিল সংকট হতে পারে বলে জানান বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো.

আইনুল ইসলাম। তিনি বলেন, এখনও রোহিঙ্গাদের জন্য যে সহায়তা পাওয়া যায়, এর মধ্যে শীর্ষ দাতা দেশ যুক্তরাষ্ট্র। তাদের সহায়তা বন্ধ হলে ১৪-১৫ লাখ রোহিঙ্গার খাদ্যসহ অন্যান্য প্রয়োজন কীভাবে মিটবে? এর মধ্যে মানবিক ও মানবাধিকারের বিষয় আছে। 

তবে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর গতকাল রোববার এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ইউএসএআইডিসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে (এনজিও) অর্থ সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। তবে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ বজায় রাখবে। 
বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশনের (বিএনএনআরসি) প্রধান নির্বাহী এ এইচ এম বজলুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশের বিশ্বস্ত উন্নয়ন অংশীদার। এই তিন মাস বিভিন্ন দেশে উন্নয়ন সহায়তা যাচাই করবে যুক্তরাষ্ট্র। তারপর বোঝা যাবে কোন দেশে তার উন্নয়ন সহায়তা কতটুকু থাকবে, কতটুকু বাদ যাবে। আর তা থেকে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতি স্পষ্ট হবে।

কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ইউএসএআইডির স্থগিতাদেশ সাময়িক। এই নির্দেশনা সারা পৃথিবীর জন্য। আমরা নির্দেশনার পর আজ (রোববার) বৈঠক করেছি। ইউএসএআইডি কৃষিতে কিছু প্রকল্পে সহায়তা দিচ্ছে। বেশির ভাগ কারিগরি সহায়তা। কোনো প্রভাব পড়বে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করছি। আপাতত চূড়ান্ত নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি। পরিস্থিতি বুঝে পদক্ষেপ নেব।


 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: পর ব শ প রকল প র দ র জন য ব যবস থ পর ব শ সহয গ এনজ ও বছর র সরক র ধরন র চলম ন

এছাড়াও পড়ুন:

ছয় কোটি শ্রমিক রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার বাইরে

দেশের মোট শ্রমিকের ৮৪ দশমিক ১ শতাংশের কোনো দায়দায়িত্ব নেয় না রাষ্ট্র । শ্রমিক হিসেবে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। কোনো রকম আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা নেই। কর্মস্থলের পরিচয়পত্র নেই। কাজের ক্ষেত্রে অন্যায়ের শিকার হলে তাদের শ্রম আদালতে মামলা করার সুযোগও নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী,  অপ্রাতিষ্ঠানিক এই শ্রমিকের সংখ্যা ৫ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার।

বিশালসংখ্যক শ্রমিকের প্রতি রাষ্ট্রের এ রকম অবহেলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সরকারের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গত ২১ এপ্রিল পেশ করা কমিশনের ২৫ সুপারিশের মধ্যে প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। 

দেশের শ্রম খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত করা এবং শ্রমিকের অধিকার ও জীবনমান উন্নয়নে সুপারিশ প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গঠিত ১৯ সদস্যের কমিশনপ্রধান ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। জানতে চাইলে গতকাল তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমরা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। শ্রম আইনে অন্য সব শ্রমিকের মতো একই অধিকার এবং সুযোগসুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে তাদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছি। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় তাদের জন্য ভাতার কথা বলেছি। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের জন্য এ সুবিধার সুপারিশ করা হয়নি। কারণ, তারা চাকরি শেষে কমবেশি কিছু আর্থিক সুবিধা পান।’ 

কমিশনের এ সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে নিয়মিত নজরদারি রাখার কথাও জানান তিনি। 

এ বাস্তবতায় আজ বৃহস্পতিবার মহান শ্রমিক দিবস পালন করা হচ্ছে। আজ সরকারি ছুটি থাকবে। এ দিনও কাজ করতে হবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দিবসটি পালনের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’। 

বিবিএসের গত নভেম্বরে প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১২ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার। তাদের মধ্যে শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। মোট শ্রমশক্তির ৮৪ দশমিক ১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। 

দেশে শ্রমশক্তি বলতে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে যারা কর্মে নিয়োজিত এবং বেকার জনগোষ্ঠীর সমষ্টিকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর মানদণ্ড অনুযায়ী, যারা সাত দিনে কমপক্ষে ১ ঘণ্টার বেতন, মজুরি বা মুনাফার বিনিময় অথবা পরিবারের নিজস্ব ভোগের জন্য পণ্য উৎপাদনের কাজ করেছেন জরিপে তাদের কর্মে নিয়োজিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আবার যারা কর্মক্ষম কিন্তু কোনো কাজে নিয়োজিত নন, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ খুঁজে বেড়ান এবং ওই সময়ে কাজের সুযোগ পেলে সে কাজ করতে প্রস্তুত তাদের বেকার বলা হয়েছে। এ হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৪ লাখ ৬০ হাজার। 

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক কারা 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর আন্তর্জাতিক শ্রম পরিসংখ্যানবিদের সম্মেলন ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব লেবার স্ট্যাটিসিয়ান্স–আইসিএলসির সংজ্ঞা অনুযায়ী, বেসরকারি অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা খানামালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, যেগুলোর আইনি সত্তা নেই, পরিপূর্ণ হিসাব নেই, উৎপাদনের হিসাব দিতে হয় না এবং বেসরকারি ও অনিবন্ধিত–এরকম খাতকে অনানুষ্ঠানিক খাত এবং এ খাতের শ্রমিকদের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক বলা হয়। 

মূলত কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক বেশি। কৃষিতে ৯৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক। শিল্প খাতে ৮২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের বড় অংশই গ্রামে থাকেন। 

বিবিএস বলছে, গ্রামের মোট শ্রমিকের ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। সংখ্যায় তারা ৪ কোটি ৬১ লাখ ১০ হাজার। শহরের শ্রমিকদের এ হার কিছুটা কম। ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সংখ্যায় এক কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার। নারী শ্রমিকদের ৯৫ দশমিক ৭ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে থাকেন।

শ্রম আইনে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকেও অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ কমিশনের 

শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহশ্রমিক, অভিবাসী, স্বনিয়োজিত শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জন্য শ্রম আইনে সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে শ্রমিকদের কাজের স্বীকৃতি, পরিচয়পত্র, নিরবচ্ছিন্ন কাজ এবং আয়ের নিশ্চয়তা, মর্যাদাকর শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, এসব শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা হিসেবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সব অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় থেকে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলাদা অফিস অথবা ডেস্ক স্থাপন করতে হবে। শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং কল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সব ধরনের তথ্য নিয়ে তথ্যভান্ডার করা, পরিচয়পত্র দেওয়া এবং অবসর ভাতা চালুসহ বেশ কিছু সুপারিশ করে কমিশন। 

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রবীণ শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতার সুপারিশ 

রাষ্ট্রের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের আওতায় বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকেন প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা। অবসরের পরও কিছু সুবিধা পান তারা। তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা সারা জীবন খাটুনির পর প্রবীণ বয়সে আরও কষ্টে থাকেন। কারণ সামান্যতম কোনো সুবিধা পান না তারা। এ বিবেচনা থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতা বা তাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার সুপারিশ করেছে কমিশন। তাদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্ধারণের কথা বলা হয় এতে। দরিদ্র বেকার শ্রমিকদের বয়স্কভাতা এবং তাদের প্রতিদিনের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও অন্যান্য চাহিদা বিবেচনায় বয়স্কভাতার পরিমাণ নির্ধারণের কথা বলেছে কমিশন। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের পেশা ও খাত অনুযায়ী সংগঠিত হওয়া, প্রতিনিধিত্ব করা ও নিয়োগকারী, তাদের সমিতি করার সুযোগ দেওয়ার কথাও বলা হয় কমিশনের সুপারিশে। 

প্রাতিষ্ঠানিকের ৫৫ খাতেও ন্যূনতম মজুরি নেই 

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে কিছুটা ভালো হলেও প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অবস্থাও খুব বেশি ভালো নয়। এখনও অনেক শিল্প খাতকে ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর আওতায় আনা হয়নি। মালিকপক্ষ যা দেয়, তা মেনে নিয়ে কাজ করেন শ্রমিকরা। এরকম অন্তত ৫৫টি খাতে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়নি। 

শ্রম মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের স্বীকৃত শিল্প আছে ১০২টি। 

টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের মজুরি বোর্ড হয় সর্বশেষ ১৯৮৩ সালে। অর্থাৎ, গত তিন যুগ ধরে একই মজুরি চলছে এ খাতে। জানতে চাইলে সরকারের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা ইসলাম গতকাল সমকালকে বলেন, ন্যূনতম মজুরি কাঠামোতে বর্তমানে ৪৭টি শিল্প রয়েছে। নতুন করে দুটি শিল্পকে ন্যূনতম মজুরির আওতায় আনা হবে। আরও ২০ শিল্পকে এর আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি জানান, পেট্রোল পাম্পের শ্রমিকদের মজুরি পুনঃনির্ধারণে বোর্ড গঠন হয়েছে। মালিক পক্ষ এ-সংক্রান্ত সভায় আসছে না। এ অবস্থায় করণীয় জানতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চেয়েছে মজুরি বোর্ড। 

টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পে তিন যুগ ধরে একই মজুরির বিষয়ে জানতে চাইলে রাইসা ইসলাম বলেন, টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের আর অস্তিত্ব নেই। খাতটি হয়তো বিলুপ্ত ঘোষণা করা হবে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ