সামাজিক নিরাপত্তা স্বাস্থ্য শিক্ষা কৃষি পরিবেশে বড় ধাক্কা
Published: 27th, January 2025 GMT
স্বাধীনতার পর থেকে সামাজিক উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) থেকে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে পুরো বিশ্বে বন্ধ করে দিয়েছেন সব অনুদান। এতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, জ্বালানি, জলবায়ু, পরিবেশ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ সামাজিক খাতে চলমান সব ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম স্থগিত করেছে ইউএসএআইডি।
উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ নানা কারণে গত বছর থেকে এক প্রকার চাপে দেশের মানুষ। গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অর্থনীতির ক্ষতগুলো ফুটে উঠতে শুরু করে, যা সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। এর মধ্যে ইউএসএআইডির কার্যক্রম বন্ধ হওয়ায় সামাজিক নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন খাতে বড় চাপে পড়তে পারে দেশ।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশে কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী সব অংশীজনকে সব প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ অথবা স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছে ইউএসএআইডি। গত শনিবার পাঠানো চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়। চিঠিতে অংশীদারদের ইউএসএআইডির অধীন সব চুক্তি, কার্যাদেশ, মঞ্জুরি, সহযোগিতামূলক চুক্তি কিংবা অন্য প্রকল্পের সব ধরনের কাজ বন্ধ, জব্দ বা স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে অংশীদারদের তাদের জন্য বরাদ্দ খরচ কমাতে সব যুক্তিসংগত পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পরবর্তী নির্দেশ (উল্লিখিত নির্দেশনা বাতিল করার) লিখিত আকারে না পাওয়া পর্যন্ত অংশীজনকে কাজ আবার শুরু না করতে বলা হয়েছে। তবে বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ বজায় রাখবে যুক্তরাষ্ট্র। এমন নির্দেশনার পর বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার মানবিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে। এতে হুমকিতে পড়তে পারে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, জ্বালানি, পরিবেশ, খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি, পরিবেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ খাতসহ সার্বিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা। মার্কিন তহবিলপ্রাপ্ত বিভিন্ন প্রকল্পের অংশীদার বাংলাদেশ। এর মধ্যে মার্কিন অনুদানপ্রাপ্ত অনেক এনজিও এবং সরকারি সংস্থা রয়েছে। তারা এ আদেশের প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন। অনিশ্চয়তায় পড়েছে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো। এতে অন্যান্য খাতের পাশাপাশি দেশের স্বাস্থ্য খাত কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে জানিয়েছেন উন্নয়ন সহযোগীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে ইউএসএআইডি সবচেয়ে বেশি অর্থায়ন করেছে। পাশাপাশি উন্নয়ন সংস্থাগুলো ইউএসএআইডির অর্থায়নে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। হঠাৎ করে কার্যক্রম স্থগিত করায় কর্মসূচিগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় পড়ে গেল। এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ জরুরি।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) মা ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞানী আহমদ এহসানুর রহমান সমকালকে বলেন, যক্ষ্মার সমস্যা মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের তালিকায় ছিল বাংলাদেশ। গত এপ্রিলে বাংলাদেশে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য, ওয়ান হেলথ প্রকল্প চালু করেছিল ইউএসএআইডি। এ প্রকল্পের অধীনে পাঁচ বছরে ২ কোটি ৬০ লাখ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল সংস্থাটির। এ ছাড়া স্বাস্থ্যে গুরুত্বপূর্ণ জরিপগুলো বাস্তবায়নে অর্থায়ন করে থাকে এই সংস্থা। চলমান এসব প্রকল্পের কার্যক্রম এখন বন্ধ থাকবে। সরকারি প্রকল্পগুলো সচল রাখতে না পারলে স্বাস্থ্য খাতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে ইউএসএআইডি এই ধরনের অর্থায়ন করে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ইউএসএআইডি কার্যক্রম বন্ধে নানা দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ। যেমন– তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর কল্যাণ ও সুরক্ষা এবং উন্নয়নে ৯০ শতাংশ প্রকল্প ইউএসএআইডির। এসব প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। এ ছাড়া শিক্ষায় অনেক প্রকল্প চলমান।
ইউএসএআইডি গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশকে প্রায় ২০ কোটি ২২ লাখ ডলার অর্থ সহায়তা দেওয়ার চুক্তি করে। এর আগে ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১-২০২৬ সালের জন্য বাংলাদেশ ও ইউএসএআইডির মধ্যে একটি নতুন ডিওএজি (ডেভেলপমেন্ট অবজেক্টিভ গ্রান্ট অ্যাগ্রিমেন্ট) সই হয়। এর মাধ্যমে ইউএসএআইডি ৯৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পঞ্চম সংশোধনী পর্যন্ত ইউএসএআইডি সাড়ে ৪২ কোটি ডলার দিয়েছে। ১৯৭৪ সালে সই হওয়া ‘অর্থনৈতিক প্রযুক্তিগত ও সম্পর্কিত সহায়তা’ চুক্তির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন খাতে ৮০০ কোটি ডলারের বেশি তহবিল দিয়েছে।
‘ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স ডট গভ’ ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্নভাবে বাংলাদেশে ২০২১ সালে ৫০০ মিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালে ৪৭০ মিলিয়ন ডলার, ২০২৩ সালের ৪৯০ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২৪ সালে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর থেকে ওয়াশিংটন বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। গত কয়েক বছরে মার্কিন সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ ১০-এ ছিল বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ইউএসএআইডির মাধ্যমে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ সম্প্রসারণ ঘটানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নত করেছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও চর্চা বেড়েছে। পরিবেশকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহিষ্ণুতা বাড়িয়েছে। নতুন এই আদেশের কারণে বাংলাদেশে এসব কর্মকাণ্ডে ধাক্কা লাগতে পারে।
দেশের স্বাস্থ্য খাত কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এর প্রভাবে মা ও শিশুমৃত্যুর উচ্চহার, ব্যাপক অপুষ্টি, যক্ষ্মা রোগের প্রাদুর্ভাব (টিবি) এবং ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ সংস্থা বছরের পর বছর ধরে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে। পাশাপাশি মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনার কার্যক্রম, অপুষ্টির বিরুদ্ধে প্রতিরোধসহ যক্ষ্মার মতো সংক্রামক রোগ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ ছাড়া সংস্থাটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সহজীকরণ করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু যুগান্তকারী অর্জনে অবদান রাখতে সহায়তা করেছে। দেশের বৃহত্তম রপ্তানি খাত ওষুধ শিল্পের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেশে অপুষ্টির মাত্রা বাড়ানো, শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব এবং লাখ লাখ দুর্বল ব্যক্তিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেবে। নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানিতেও (এসএমসি)। এর মাধ্যমে দেশের মানুষ স্বাস্থ্যপণ্য সাশ্রয়ী মূল্যে পেত।
এইচআইভি/এইডসবিরোধী কর্মসূচি পিইপিএফএআরের অধীনে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অ্যান্টি-রেট্রোভাইরাল ওষুধ সরবরাহ করা হয়। ২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের শাসনামলে চালু হওয়া এ কর্মসূচি প্রায় ২৬ মিলিয়ন মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় স্বাস্থ্য খাতে যে সহায়তা দেওয়া হতো, বাংলাদেশে তাও বন্ধ হতে পারে। এনজিওগুলোর উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ইউএসএআইডি বড় সহায়তা দিচ্ছে। এখন শত শত সংস্থার কর্মসূচি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
বাংলাদেশ-আমেরিকা মৈত্রী প্রকল্পের পক্ষ থেকে স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করা ১৮টি বেসরকারি সংস্থাকে (এনজিও) ২০২৪ অর্থবছরের জন্য অনুদান দিয়েছে ইউএসএআইডি। ব্র্যাক এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। অনুদানপ্রাপ্ত স্থানীয় এনজিওগুলো কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিশু অধিকার ও সুরক্ষাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কাজ করছে। ইউএসএআইডির কার্যক্রম স্থগিতের কারণে এ রকম বহু কর্মসূচি হুমকির মুখে।
বাংলাদেশের কৃষি, মৎস্য, প্রাণী, পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক করতে উন্নত গবেষণা কার্যক্রম ও উন্নত প্রযুক্তির বিষয়ে সহযোগিতা করছে ইউএসএআইডি। কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা রূপান্তরে চালু থাকা প্রকল্পগুলো অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে।
এ নিয়ে সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক সাকিব আলী বলেন, ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এটা সাময়িক, তিন মাসের জন্য। আসলে তাদের দেওয়া অর্থ বিভিন্ন দেশে সঠিকভাবে খরচ হচ্ছে কিনা এবং যৌক্তিক কিনা, তা মার্কিন নাগরিকদের দেখাতে চান।
তবে ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের তহবিল সংকট হতে পারে বলে জানান বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো.
তবে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর গতকাল রোববার এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ইউএসএআইডিসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে (এনজিও) অর্থ সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। তবে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ বজায় রাখবে।
বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশনের (বিএনএনআরসি) প্রধান নির্বাহী এ এইচ এম বজলুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশের বিশ্বস্ত উন্নয়ন অংশীদার। এই তিন মাস বিভিন্ন দেশে উন্নয়ন সহায়তা যাচাই করবে যুক্তরাষ্ট্র। তারপর বোঝা যাবে কোন দেশে তার উন্নয়ন সহায়তা কতটুকু থাকবে, কতটুকু বাদ যাবে। আর তা থেকে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতি স্পষ্ট হবে।
কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ইউএসএআইডির স্থগিতাদেশ সাময়িক। এই নির্দেশনা সারা পৃথিবীর জন্য। আমরা নির্দেশনার পর আজ (রোববার) বৈঠক করেছি। ইউএসএআইডি কৃষিতে কিছু প্রকল্পে সহায়তা দিচ্ছে। বেশির ভাগ কারিগরি সহায়তা। কোনো প্রভাব পড়বে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করছি। আপাতত চূড়ান্ত নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি। পরিস্থিতি বুঝে পদক্ষেপ নেব।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর ব শ প রকল প র দ র জন য ব যবস থ পর ব শ সহয গ এনজ ও বছর র সরক র ধরন র চলম ন
এছাড়াও পড়ুন:
এসএসসিতে অনুপস্থিতির বড় কারণ বাল্যবিবাহ
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীন এ বছরের এসএসসি পরীক্ষায় ছয় হাজারের বেশি পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্য থেকে পাওয়া ১ হাজার ২০৩ জনের তথ্য বলছে, প্রায় ৪০ শতাংশের (৪৮১) বিয়ে হয়ে গেছে।
বিয়ে হওয়ার এ হার মেয়ে ও ছেলে মিলিয়ে। এ ছাড়া ৭ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল পারিবারিক অসচ্ছলতার জন্য কর্মক্ষেত্রে যোগ দেওয়ার কারণে। বাকিরা অসুস্থতা, প্রস্তুতি ভালো না থাকাসহ নানা কারণে পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।
উদ্বেগের বিষয় হলো অনুপস্থিত ওই সব পরীক্ষার্থীর মধ্যে যাদের তথ্য পাওয়া গেছে, তাদের প্রায় ৫১ শতাংশ আর পড়াশোনা করবে না। বাকিরা বলেছে, পরবর্তী বছরে পরীক্ষা দেবে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ তাদের অধীন বিদ্যালয়গুলো থেকে এসব তথ্য পেয়েছে। এখন এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হবে।
সারা দেশে এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ফরম পূরণ করা পরীক্ষার্থীর সংখ্যা গতবারের চেয়ে প্রায় এক লাখ কম ছিল। বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা দিয়েছে।
বিয়ে হওয়ার এ হার মেয়ে ও ছেলে মিলিয়ে। এ ছাড়া ৭ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল পারিবারিক অসচ্ছলতার জন্য কর্মক্ষেত্রে যোগ দেওয়ার কারণে। বাকিরা অসুস্থতা, প্রস্তুতি ভালো না থাকাসহ নানা কারণে পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।আবার এবার পরীক্ষার ফরম পূরণ করে অংশ না নেওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ছিল অন্যান্যবারের তুলনায় বেশি। ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীন এসব পরীক্ষার প্রথম দিনেই অনুপস্থিত ছিল ২৬ হাজার ৯২৮ পরীক্ষার্থী। অথচ গত বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রথম দিনে অনুপস্থিত ছিল ১৯ হাজার ৩৫৯ পরীক্ষার্থী।
প্রতিবছরই শিক্ষার্থীরা অনুপস্থিত থাকে, কিন্তু কারণ জানা হয় না। এ জন্য বিশেষজ্ঞরা অনুপস্থিতির প্রকৃত কারণ বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের বোর্ডের অধীন পরীক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির কারণ অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেয় ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। এ জন্য অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীদের তথ্য নির্ধারিত গুগল ফরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। অনুপস্থিতির কারণ জানার জন্য পরীক্ষার্থী বা অভিভাবকের সঙ্গে সশরীর বা মুঠোফোনে যোগাযোগ করে তথ্য সংগ্রহ করা এবং কোন কোন পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত, তা জানার জন্য সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে নির্দেশ দিয়েছিল ঢাকা বোর্ড।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এবার তাদের বোর্ডের অধীন ৬ হাজার ৩৮৯ পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। তাদের সবার তথ্য জানা যায়নি। ১ হাজার ২০৩ পরীক্ষার্থীর অনুপস্থিতির কারণসহ তথ্য পেয়েছে ঢাকা বোর্ড। তার ভিত্তিতে একটি খসড়া প্রতিবেদন করা হয়েছে। এসব পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ফরম পূরণ করেও পরীক্ষা দেয়নি।
দেশে সাধারণত মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার হয়। অনেক ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের পড়াশোনা বাদ দিতে হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা দেখেছেন, অনুপস্থিত মেয়ে পরীক্ষার্থীদের পাশাপাশি কিছু ছেলেরও বিয়ে হয়েছে।ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, খসড়া প্রতিবেদন অনুযায়ী তথ্য পাওয়া ১ হাজার ২০৩ জন অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের। ২৩ শতাংশ মানবিক বিভাগের ও ১৭ শতাংশ বিজ্ঞান বিভাগের। সাধারণত বিদ্যালয়গুলোয় পড়াশোনায় তুলনামূলকভাবে এগিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার কম।
অনুপস্থিত থাকাদের মধ্যে নিয়মিত পরীক্ষার্থী প্রায় ৭০ শতাংশ। বাকি ৩০ শতাংশ অনিয়মিত পরীক্ষার্থী। উল্লেখ্য, আগের বছর অকৃতকার্য বা দু–এককটি বিষয়ে অকৃতকার্য হয়ে যারা এবার পরীক্ষা দিয়েছে, তাদের অনিয়মিত পরীক্ষার্থী বলা হয়।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এবার তাদের বোর্ডের অধীন ৬ হাজার ৩৮৯ পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। তাদের সবার তথ্য জানা যায়নি। ১ হাজার ২০৩ পরীক্ষার্থীর অনুপস্থিতির কারণসহ তথ্য পেয়েছে ঢাকা বোর্ড।ঢাকা বোর্ডের তথ্য বলছে, গ্রাম এলাকার শিক্ষার্থীরাই বেশি অনুপস্থিত থাকে। তথ্য প্রাপ্ত ১ হাজার ২০৩ জনের মধ্যে ৭৬ শতাংশের বেশি গ্রাম এলাকার শিক্ষার্থী। প্রায় ২৪ শতাংশ শহর এলাকার। সমতল এলাকায় মোট পরীক্ষার্থী বেশি হওয়ায় অনুপস্থিতিও সেখানে বেশি।
জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা যেসব তথ্য পেয়েছেন, সেগুলো প্রতিবেদন আকারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন, যাতে পরবর্তী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
যেসব কারণে অনুপস্থিতিযেসব কারণে পরীক্ষার্থীরা অনুপস্থিত ছিল, সেগুলোও জানার চেষ্টা করেছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের তথ্য পাওয়া গেছে (১ হাজার ২০৩ জন), তাদের প্রায় ৪০ শতাংশের বিয়ে হয়েছে।
দেশে সাধারণত মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার হয়। অনেক ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের পড়াশোনা বাদ দিতে হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা দেখেছেন, অনুপস্থিত মেয়ে পরীক্ষার্থীদের পাশাপাশি কিছু ছেলেরও বিয়ে হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে কতজন মেয়ে এবং কতজন ছেলে, তা উল্লেখ করা হবে।
প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ২১ জন (প্রায় ২ শতাংশ) মেয়ে পরীক্ষার্থী গর্ভধারণের কারণে পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল।
আইনানুযায়ী, বাংলাদেশে মেয়েদের ১৮ বছর ও ছেলেদের ২১ বছরের নিচে বিয়ে হলে সেটিকে বাল্যবিবাহ বলা হয়। এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বয়স সাধারণত ১৮ বছরের নিচে হয়। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে।
নিজের অসুস্থতার জন্য ২৪ শতাংশের (১ হাজার ২০৩ জনের মধ্যে) বেশি পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। আর প্রস্তুতি ভালো না থাকার কারণে অনুপস্থিত ছিল ১১ শতাংশের বেশি। দারিদ্র্যের কারণও উঠে এসেছে এ তথ্যে। ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ শিক্ষার্থী পারিবারিক অসচ্ছলতার জন্য কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়েছে। অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ১৭ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া পরিবারের কোনো সদস্যের অসুস্থতা, মৃত্যুসহ অন্যান্য কারণে বাকিরা অনুপস্থিত ছিল।
এবার যারা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, তারা ২০২০ সালে যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল, সেই বছরই দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়। এর প্রভাবে একবার টানা দেড় বছর এবং পরে আবারও কয়েক মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। সেই ক্ষতির রেশ দীর্ঘ মেয়াদে পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। করোনার প্রভাবের কারণে অনেকেই বিভিন্ন স্তরে ঝরে পড়েছে। এসবের পাশাপাশি বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রমসহ একাধিক কারণের কথা বলে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা। এখন অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের তথ্য পাওয়া গেছে, তাদের বড় অংশেরই বিয়ে হয়ে যাওয়ার তথ্য পেল ঢাকা শিক্ষা বোর্ড।
প্রথমত, সরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে অনুপস্থিতির কারণ জানার প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাই। কারণগুলো চিহ্নিত করতে পারলে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়।সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী‘সরকারকেই বেশি উদ্যোগী হতে হবে’বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ একটি বড় সমস্যা। আফ্রিকার কয়েকটি দেশ ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও বাংলাদেশের মতো এত বেশি বাল্যবিবাহ নেই।
জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএর বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশের ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ১৮ বছর হওয়ার আগেই। আবার ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী এক হাজার মেয়ের মধ্যে ৭১ জন এক বা একাধিক সন্তানের মা। গত মঙ্গলবার ইউএনএফপিএর বৈশ্বিক জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৫–বিষয়ক এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
এবার যারা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, তারা ২০২০ সালে যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল, সেই বছরই দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়। এর প্রভাবে একবার টানা দেড় বছর এবং পরে আবারও কয়েক মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। সেই ক্ষতির রেশ দীর্ঘ মেয়াদে পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথমত, সরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে অনুপস্থিতির কারণ জানার প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাই। কারণগুলো চিহ্নিত করতে পারলে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়।’ তিনি বলেন, বাল্যবিবাহের পেছনে অসচ্ছলতা একটি বড় কারণ। এখনো দেখা যায়, অনেক অভিভাবক মেয়েদের জন্য বেশি ব্যয় করার চেয়ে ছেলে সন্তানের পেছনে ব্যয় করাকে বেশি প্রাধান্য দেন। আবার নিরাপত্তাহীনতাও মেয়েদের বাল্যবিবাহের একটি অন্যতম কারণ।
বাল্যবিবাহ রোধে সরকারকেই বেশি উদ্যোগী হতে হবে উল্লেখ করে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, এ জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আন্তমন্ত্রণালয় সভা করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও কাজে লাগানো যেতে পারে।