মানুষ সংগ্রাম চালিয়ে যায়। স্থান-অঞ্চল ছাপিয়ে তা কদাচিৎ সব মানুষের গণ–অভ্যুত্থান হয়ে ওঠে। তখন মানুষ নিজের জীবন পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখে। আশায় বুক বাঁধে। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান আশাবাদের ঢেউ জাতির মধ্যে জাগিয়ে দিয়েছে। কৃষকেরাও সেই আশায় বুক বেঁধেছেন। কিন্তু তাঁদের কথা বলবে কে? প্রান্ত থেকে তাঁদের দুর্দশার কথা কীভাবে পৌঁছাবে কেন্দ্রে? এই কথাগুলো দাবি করে তোলার জন্য গত ২৬ জানুয়ারি চিলমারীতে ছিল কৃষক মহাসমাবেশ। সেখানে অনেক কথা বলার ছিল সর্বার্থে প্রান্তে বাস করা এই মানুষগুলোর। সেসবের কিছু অগ্রগণ্য চাওয়া তুলে ধরা যাক।

হাট ও ঘাট থেকে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ

গত বছরের ঘটনা। ফিরছিলাম গরুর হাট হয়ে। সেখানে কয়েকজন গরু ক্রেতার কাছ থেকে খাজনার রসিদের ফটো ও ক্রেতার ভিডিও রেকর্ড নিই। দেখে ফেলেন ইজারাদারের লোক। জোর করে ভিডিও ও ফটো মুঠোফোন থেকে মুছে দেন। সেখান থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে ফিরতি একটি গরুবাহী ভটভটির লোকদের সঙ্গে কথা বলি। গরুর পাইকার উলিপুর ধামশ্রেণির ব্যাপারী আবুল কাশেম (৬৫) ও উলিপুর সদরের আমিনুল(৫০)। তাঁরা খাজনার রসিদ দেখান। রসিদে গরুর মূল্য লেখা ৫০ হাজার, কিন্তু খাজনার ঘর ফাঁকা। তাঁরা জানান, বিক্রেতার কাছ থেকে খাজনা নিয়েছেন ৩০০ টাকা এবং তাঁদের কাছ থেকে ৪০০ টাকা।

পরে রসিদের ছবি ফেসবুকে দিলে পোস্টে কড়াই বরিশাল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সাদাকাত হোসেন (৪৫) জানান, ‘উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর হাট জোড়গাছের এখন সুনামের পরিবর্তে দুর্নামে ভরপুর।’ হাসান আল নাহিদ লিখেছেন, ‘এরা সংখ্যায় বেশি, যা জুলুম করে তা-ই মানতে বাধ্য হয়।’

চিলমারী বন্দর থেকে রৌমারী। একটি ৪০ হাত নৌকা। একবারে যাত্রী পারাপার সম্ভব ১৫০ জনের। সোয়া ঘণ্টার পথ। একই শক্তির শ্যালো ইঞ্জিন একটি ভটভটি একই সময়ে চিলমারী বন্দর থেকে কুড়িগ্রাম শহরে যায় ১০ জন যাত্রী নিয়ে। ভাড়া জনপ্রতি ৫০ টাকা। তাহলে ১০ গুণ যাত্রী নিয়ে নৌকা চললে ভাড়া হওয়ার কথা ৫ টাকা। সেখানে ১০০ টাকা ভাড়া কেন? বাড়তি ৯৫ টাকা নৌযাত্রীরা কেন দেবেন?

পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি ছিল জমিদারি উচ্ছেদ। কৃষকেরা যে হাটে কৃষিপণ্য কেনাবেচা করেন, সেটা নিয়েও ব্যাপক আন্দোলন ছিল। জমিদারের হাটের খাজনার অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকেরা নিজেরা হাট বসিয়েছেন। নৌপথে খাজনার অত্যাচারে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার ঘটনা আছে। হাট ও ঘাট থেকে ইজারার নামে জমিদারি প্রথাটি রয়ে গেছে। ফলে সড়কপথের চেয়ে নৌপথে তেল-মবিল খরচ কম লাগলেও সড়কপথের চেয়ে নৌপথে ভাড়া দু–তিন গুণ গুনতে হয়।

কৃষকের সঙ্গে আলোচনা করে কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ

ব্রহ্মপুত্রের শাখাহাতী চরের মিলন মিয়া (৪০) তিনি নিয়ে এসেছেন ১০ মণ কাঁচা বাদাম। প্রতি মণ তিন হাজার টাকা দরে বিক্রির আশা থাকলেও তা দুই হাজারের ওপরে দাম বলছেন না ব্যবসায়ীরা। হতাশা নিয়ে তিনি বলেন, আবাদে যা খরচ হয়েছে, তা–ই উঠবে না। লাভ তো দূরের কথা। বাড়ির সবাই মাঠে খেটে ছয় বিঘা জমিতে বাদাম চাষে এবার খরচ হয়েছে ৮০ হাজার টাকার মতো। বাদাম হয়েছে ৩০ মণ। প্রতি মণ গড়ে দুই হাজার টাকায় বিক্রি করলে আবাদের খরচই ওঠে না। মাঝখানে বন্যায় কিছু খেয়ে গেছে। কামলা খরচ বাদ দিয়ে হিসাব করলেও লস। সব জায়গাতেই কৃষকদের বিপদ।

বাজারে নতুন আলু এখন ১৫ টাকা। অথচ বীজ আলু কৃষকেরা কিনেছেন ২ হাজার টাকা মণ। অর্থাৎ ৫০ টাকা কেজি। সঙ্গে বিষ, বীজ, কামলা খরচ তো আছেই। কৃষকের ঘরে আলু। কোল্ডস্টোরগুলো যেখানে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা গত বছর ভাড়া নিয়েছে ৩০০ টাকা। এ বছর ৪০০ টাকা নিচ্ছে। কৃষকের লাভ কে খায়?

শিল্পপণ্যের দাম নির্ধারণ করেন শিল্পপতিরা। এটা সারা দুনিয়াতেই হয়। সেই শিল্পোন্নত দেশগুলোতে কৃষিপণ্যের দামটি নির্ধারণ করেন সেখানকার কৃষকেরা। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষকেরা তা পারেন না। কৃষক যে ট্রাক্টর, বীজ কেনেন, তা কোম্পানির নির্ধারিত মূল্যে। আর কৃষক নিজের উৎপাদিত পাট, তুলা, বাদাম, ধানের দামটা নির্ধারণ করতে পারেন না। চাষিদের মতামতের ভিত্তিতে সরকারিভাবে কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ করার দাবি কি খুব অপ্রাসঙ্গিক?

রেশম ও এন্ডি পোকার লার্ভা খোলাবাজারে বিক্রির ব্যবস্থা

রেশম উৎপাদনব্যবস্থা একাধারে কৃষি ও কুটির শিল্প—দুটোই। আগে কৃষকেরা অন্যান্য আবাদের সঙ্গে তুঁতগাছের চাষ করতেন। পাতা খাইয়ে রেশম পোকা পালন করতেন নিজের ঘরে। এই পোকা পালনই হলো কুটির শিল্প।

কিন্তু এখন চাইলেই যে কেউ রেশম চাষ করতে পারবে না। যখন রেশম বোর্ড প্রকল্পের নামে বাজেট পাবে, তখন তারা নিবন্ধিত কৃষকদের চারা, লার্ভা ও উৎপাদনের পুরো খরচ দেবে। চারা লাগানোর জন্য দুবারে মোট ২৫ হাজার ও ঘর তোলার জন্য ১ লাখ টাকা দেবে। একজন নিবন্ধিত কৃষকও চাইলে এক বিঘার বেশি আবাদ করতে পারবেন না। একজন কৃষককে মাত্র ১ বিঘা জমির জন্য যতটুকু রেশম পোকার লার্ভা লাগবে, ততটুকুই দেওয়া হবে।

লার্ভা কেন খোলাবাজারে সবার জন্য বিক্রি হয় না। কর্তারা জানিয়েছেন, লার্ভাগুলো ফ্রিজে বিশেষ ব্যবস্থায় রাখা হয়। আগে যখন ফ্রিজ ছিল না, তখন আমাদের কৃষকেরা রেশম উৎপাদন কেমন করে করতেন? অর্থাৎ সরকারগুলো নিজেই রেশম উৎপাদনকে মুক্ত করে না দিয়ে আটকে রেখেছে।

শুধু ইলিশ নয়, সব মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুমে মাছ ধরা

চিলমারীর জেলে আবু বক্কর সিদ্দিক (৫৫) বলেন, ‘ইলিশের ডিম ছাড়ার মৌসুম, মাছ ধরা বন্ধ। লাভ কার? যারা ইলিশ সারা বছর ধরে তাদের। কিন্তু হামরা রুই-কাতলা, বাগাড়.

..হ যে মাছগুলো মারি, সেগুলা তো ডিম পাড়ে ফাল্গুন-চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসে। সেগুলা আবার ডিম ফোটায় নদীর তলার কোলায় গিয়ে। এই মাছগুলা রক্ষার কথা তো আপনারা কন না।’

মানে ফাল্গুন-চৈত্রে নদ-নদী শুকাতে থাকে। তখন চরের মাঝখানে নিচু জলাভূমি তৈরি হয়। এর তিন দিকে চর, আরেক দিক নদীর স্রোতের সঙ্গে যুক্ত। একে বলে কোলা। একেকটা কোলা একেকটা হালদা নদীর মতো মিঠাপানির মাছের আধার। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে যখন নদীর পানি কমতে শুরু করে, তখন পৈরালী (বৈরালী), কালবাউশসহ কয়েক জাতের মাছ কোলাগুলোতে ঢুকে ডিম পাড়ে। একেকটি কোলায় প্রায় ১০০ প্রজাতির মাছ থাকে। এক একর আয়তনের পুকুরে এক বা দুই প্রজাতির মাছ থাকে। একপর্যায়ে প্রভাবশালীরা কোলার ইজারা নিয়ে মুখ বন্ধ করেন। তারপর কেউ বিষ দিয়ে মাছ মারেন। কেউ কাঁথা জাল দিয়ে কোলা সেচে ফেলেন। এতে মাছ ও সব কীটপতঙ্গ ঝাড়ে-বংশে নিপাত হয়।

মাছের এই একক চাষ প্রকৃতিতে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে। জেলেরা এটা জানেন। তাঁদের জীবনদর্শনও এই যে তাঁরা প্রকৃতিকে খণ্ড খণ্ড করে দেখেন না। তাঁরা জানেন, মাছ যখন আহরণ থেকে চাষে পরিণত হয়, তখন জীবনও বদলে যায়।

চরের ভাঙন রোধে বিন্নার বেষ্টনী

চরগুলোতে কোটি টাকা খরচ করে ভবন নির্মাণ করা হয়। এনজিওরা বাড়ি–ভিটা উঁচু করে। চরের এজমালি জমি দখল করেন চেয়ারম্যানের লোকেরা। কিন্তু চরগুলোকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষার কথা কেউ বলে না।

বাংলাদেশে সচরাচর যেসব বিন্না ঘাস চোখে পড়ে, সেগুলোর শিকড় ছড়িয়ে যায়, সোজা গভীরে যায় না। ফলে এগুলো নদীভাঙন ঠেকাতে অক্ষম। অথচ শিলিগুড়িতে তিস্তার ভাঙন ও পাহাড়ধস ঠেকিয়ে রাখে। কারণ, শিলিগুড়ির বিন্না ঘাস সোজা ২০ ফুট পর্যন্ত গভীরে চলে যায়। ইরি ধান লাগানোর মতো করে চারা রোপণ করা গেলে এক বছরেই ঘন বেষ্টনী তৈরি হয়। পাহাড়ের পার্শ্বঢাল রক্ষায় এই বিন্না ঘাসের জুড়ি নেই। গবেষকেরা জানিয়েছেন, বিন্নার তিনটা শিকড় ১ সুতি লোহার সমান শক্ত। লোহা ক্ষয় হয়, এটা দিনকে দিন মজবুত হয়।

নগরীর টাইগারপাস ও লালখান বাজারের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত বাটালি হিলের মিঠাপাহাড়ের পাদদেশে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে এই ঘাস লাগানোও সফল বলে প্রমাণিত হয়।

এই পাহাড়ি বিন্না ঘাস পাহাড়ের ধস ঠেকাতে পারলে নদীভাঙন তো সহজ। এর বিস্তার করতে পারলে গরু-মহিষের এজমালি গোচারণভূমির কাজও হবে। এতে ভূমিহীনেরা গরু-মহিষ পালন করতে পারবেন। চরাঞ্চলের চতুর্দিকে ৪০–৫০ হাত প্রশস্ত বেষ্টনী প্রাকৃতিক বনের অভাবও পূরণ করবে। চরের নারীদের কুটির শিল্পের মাধ্যমে বাড়তি আয়ের রাস্তা তৈরি হবে। নদ–নদীর বাস্তুসংস্থানও ঠিক থাকবে। পাখপাখালির ঠাঁই হবে। বাহাত্তরের সংবিধান ৩ ধরনের মালিকানার স্বীকৃতি দিয়েছে। রাষ্ট্রীয়, সমবায় ও ব্যক্তি মালিকানা। কিন্তু এগুলোর বাইরে সামাজিক মালিকানা বলে একধরনের মালিকানা আছে। অবাঙালি জাতিগুলোতে এটা চালু আছে। তাদের এই সামাজিক মালিকানার সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকা উচিত।

আরও রয়ে গেল

এ তো গেল কিছু বড় ব্যাপার। এ ছাড়া গরিব মানুষের প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধের দিকে কে তাকাবে? চরাঞ্চলে ভুয়া ভূমিহীনদের হাত থেকে খাসজমি দখলমুক্ত করে প্রকৃত ভূমিহীনদের মধ্যে তা বিতরণ; আন্তনগর ট্রেনে কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য তিনটি সুলভ বগি সংযুক্ত করা দরকার। পচনশীল কৃষিপণ্য বহনকারী যানবাহনকে রাস্তায় ও ফেরীতে আগে যেতে দেওয়া; আখ ও বিট চিনির আবাদ বাড়িয়ে সব চিনিকল সংস্কার করে চালু করা চাই। কৃষকের গুড় উৎপাদনের স্বাধীনতাদানে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের আখমাড়াই আইন এখনো রয়ে গেছে। মহাজনি প্রথা থেকে লবণচাষিদের রক্ষা করতে মিলমালিকদের পক্ষে সরাসরি ক্রয়কেন্দ্র খোলা তো আশু করণীয়।

আইন-আদালত তো এই গরিবদের পক্ষে না। গোবিন্দগঞ্জে দেখেছি, পুলিশ সাঁওতাল কৃষকদের কুঁড়েঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। সেই মামলায় উল্টো কৃষকেরা কোর্টের বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দিনাজপুরের ফুলবাড়িরও একই ঘটনা। গত বছর করোনার সময় চিলমারীর একজন কৃষককে ১০ হাজার টাকা ঋণের কারণে ২৫ বছর পর মধুপুর এলাকা থেকে পুলিশ ধরে এনে জেলে ঢুকিয়েছে। হাজার হাজার কৃষক অনাদায়ি কৃষিঋণের দায়ে এলাকাছাড়া। সেই ঋণ আদায়ে মামলা ও গ্রেপ্তারের আইন বাতিল করে সব ধরনের ক্ষুদ্র কৃষিঋণ মওকুফ করা উচিত।

সহস্র জনতার প্রাণের বিনিময়ে সংগঠিত গণ–অভ্যুত্থানের পর এই দাবিগুলো কি খুব বেশি চাওয়া?

নাহিদ হাসান আহ্বায়ক, কৃষক মহাসমাবেশ বাস্তবায়ন গণকমিটি

[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: খ জন র র জন য উৎপ দ ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

‘এক টাকায়’ ৫০ বছর ধরে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন যিনি

একটি বাড়ির উঠানে প্লাস্টিকের বস্তার ওপর বসে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পাঠদান করাচ্ছিলেন আশি ছুঁই ছুঁই বয়সের একজন শিক্ষক। শরীরের নানা অঙ্গ-ভঙ্গির মাধ্যমে তিনি পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন শিশু শিক্ষার্থীদের। তিনি তার কাছে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাচ্ছিলেন ‘মামার বাড়ি’ কবিতা কে লিখেছেন? শিক্ষার্থীরা সমস্বরে উত্তর দেয়, কবি জসীম উদদীন।

উত্তরের জনপদ গাইবান্ধা সদর উপজেলার মদনেপাড়া গ্রামের মিনারা বেগমের বাড়ির উঠানের চিত্র এটি। শনিবার (২২ নভেম্বর) এই বাড়ির উঠানে কোমলমতি শিশুদের (নার্সারি থেকে পঞ্চম শ্রেণি) গোল করে বসিয়ে পড়াতে দেখা যায় লুৎফর রহমানকে। পড়ানো বাবদ জনপ্রতি দৈনিক এক টাকা সম্মানী নেন। এ জন্য এলাকার মানুষের কাছে তার পরিচিতি ‘এক টাকার মাস্টার’ হিসেবে।

আরো পড়ুন:

৭ ঘণ্টা পর রেল অবরোধ স্থগিত রাবি শিক্ষার্থীদের

হল খালির বিষয়ে ঢাবি প্রক্টরের জরুরি বার্তা

১৯৪৮ সালের ২৩ নভেম্বর জেলার ফুলছড়ি উপজেলার মধ্য উড়িয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন লুৎফর রহমান। গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে  গিদারী ইউনিয়নের বাগুড়িয়া গ্রাম। সেখানকার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের ধারে টিনের একটি ঘরে পরিবার নিয়ে বর্তমানে বসবাস করেছেন এই শিক্ষক।

স্ত্রী লতিফুল বেগমসহ দুই মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার লুৎফর রহমানের। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। বড় ছেলে লাভলু এসএসসির গণ্ডি পেরুতে পারেননি। এখন ইজিবাইক চালান। ছোট ছেলে মশিউর রহমান মাদরাসা থেকে লেখাপড়া শেষ করে ইসলামি ফাউন্ডেশনে চাকরি করছেন। যদিও এখনো তার বেতন হয়নি।

লুৎফর রহমানের শিক্ষকতা জীবনের শুরু ১৯৭৫ সাল। শিশুদের ঝরেপড়া রোধে বিনা পয়সায় পড়ানো শুরু করেন তিনি। পরে অভিভাবকদের অনুরোধে এক টাকা সন্মানি নিতে শুরু করেন। তখন থেকে আজ অবধি এক টাকাই সম্মানি নেন। 

বর্তমান শিক্ষার্থীদের অনেক অভিভাবক লুৎফর রহমানের কাছে পড়ালেখা করেছেন

লুৎফর রহমান ১৯৭২ সালে ফুলছড়ি উপজেলার গুণভরি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায় পড়ালেখা। নিজে অভাবের অন্ধকারে থাকলেও সিদ্ধান্ত নেন, যে সব শিশুরা প্রাথমিকের গণ্ডি পেরুতে পারে না, তাদের বিনামূল্যে পড়ালেখা শেখানোর। এভাবেই শুরু। প্রায় ৫০ বছর ধরে চলছে তার শিক্ষার আলো ছড়ানোর এই কার্যক্রম। 

স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি থেকে বের হন লুৎফর মাস্টার। এরপর পায়ে হেঁটে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র-ছাত্রী ডেকে আনেন। পরে নির্দিষ্ট একটি বাড়িতে পাঠদান করান। শুধু নিজ এলাকা বাগুড়িয়া কিংবা মদনেরপাড়া নয়, তিনি স্থানীয় পুলবন্দি, চন্দিয়া, ঢুলিপাড়া, কঞ্চিপাড়া এবং শহরের মধ্যপাড়া, পূর্বপাড়া, মিস্ত্রিপাড়াসহ কয়েকটি এলাকার শিক্ষার্থী পড়ান। এভাবে সারাদিন ৭০ থেকে ৮০ জন শিক্ষার্থী পড়িয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন তিনি।

রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেছেন লুতফর মাস্টার। সরকারি বাঁধে বসবাস প্রসঙ্গে তিনি জানান, একসময় ৫০–৬০ বিঘা জমি ছিল তার। পুকুরে মাছ, গোয়াল ভরা গরু সবই ছিল। ১৯৭৪ সালের বন্যা আর নদী ভাঙনে ভিটেমাটি সব হারিয়ে আশ্রয় নেন বাগুড়িয়া গ্রামের ওয়াপদা বাঁধে। খুব অভাব তখন।  এরপর থেকেই এখানে বসবাস। ঘরবাড়িও জরাজীর্ণ। সারা জীবনে একটি স্থায়ী বাড়ি করতে না পারার আক্ষেপ তার কণ্ঠে।

তিনি বলেন, “আমি ১৯৭২ সালে গুণভরি স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করি। ১৯৭৪ সালে বন্যার পর অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায় পড়ালেখা। পরের বছর ১৯৭৫ সালে সিদ্ধান্ত নেই- অসহায় ও ছিন্নমূল শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া বন্ধ করতে বিনামূল্যে পড়ালেখা শেখাব। তখন থেকেই শুরু। দেশের কল্যাণে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই আমার মূল লক্ষ্য।”

গর্ব করে লুৎফর রহমান বলেন, “আমার অনেক শিক্ষার্থী ডাক্তার, ব্যাংকার, শিক্ষক, পুলিশ ও সাব-রেজিষ্টার। কেউ কেউ বিদেশেও চাকরি করছে। তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আমি এতেই সন্তুষ্ট। টাকা আমার কাছে বিবেচ্য নয়। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়াই আমার লক্ষ্য।”

অভিভাবকদের ভাষ্য:
মিনারা বেগম বলেন, “২৫ বছর আগে বিয়ে হয়ে আমি এখানে এসেছি। আমার স্বামীও এক ট্যাকার মাস্টারের কাছে পড়েছেন। আমার ছেলে-মেয়েরাও তার কাছেই পড়েছে। এক ছেলে ডিপ্লোমা করছে, আরেক ছেলে কলেজে পড়ে। মেয়েটা ক্লাস থ্রিতে পড়ে। সেও তার কাছে পড়ছে। খুব মনোযোগ আর আদর দিয়ে বাচ্চাদের পড়ান লুৎফর রহমান। টাকার প্রতি তার লোভ নেই। এ ধরনের মানুষ এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না।”

অপর শিক্ষার্থীর অভিভাবক সাথি আক্তার বলেন, “খুব সৎ এবং নিবেদিত একজন ব্যক্তি এই স্যার। আমিও তার কাছে পড়েছি। শুনেছি, আমার বাবাও তার কাছে এক টাকা দিয়ে পড়েছে। স্যার আমাদের বলেন, সমাজের শিক্ষা বঞ্চিত যেসব শিশু আছে, তাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করাই তার লক্ষ্য। আজও তিনি সেটাই করছেন মাত্র এক টাকার বিনিময়ে। এই যুগে এমন দৃশ্য বিরল। তাকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া উচিৎ।”

মোস্তাফিজুর নামে এক অভিবাবক বলেন, “লুৎফর মাস্টারের লক্ষ্য প্রাথমিকে ঝরেপড়াসহ ভাঙনকবলিত এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাদান। অভিভাবকদের বুঝিয়ে শিশুদের নিয়ে কখনো রাস্তার ধারে, বাঁধে কিংবা গাছতলায় পড়াতে বসেন তিনি। এখন কয়েকটি বাড়িতে গ্রুপ করে পড়ান। বর্তমানে তার ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৫০ থেকে ৬০ জন। প্রতি ব্যাচে ১৫ থেকে ২৫ জন করে পাঠদান করে।”

শিক্ষার্থী আমির হামজা মদনের পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার ভাষ্য, “স্যার আমাদের অনেক আদর করেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ান। তার কাছে পড়তে আমাদের অনেক ভালো লাগে। স্যার খুব ভালো মানুষ।”

শুধু আমির হামজা নয়, তার মতো এক টাকায় পড়তে এসেছে মানসুরা তাবাসসুম, তামিম, লিজা আক্তার, আশা মনি, সুমাইয়ারা। তারা প্রত্যেকেই স্যারের কাছে পড়ে ভীষণ আনন্দিত।

লুৎফর রহমানের ছেলে মশিউর রহমান  বলেন, “জন্মের পড় থেকেই দেখছি, পায়ে হেঁটে আবার সাইকেলে চড়ে ঘুরে ঘুরে শিশুদের পড়ালেখা শেখাচ্ছেন বাবা। এটি তার নেশা। আমরা বাঁধা দেই না তাকে। বিনা স্বার্থে দেশের জন্য শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ার কাজ করছেন, যতদিন বেঁচে আছে করুক। আমরা এতেই সন্তুষ্ট।”

যাদের জীবন আলোকিত করেছেন লুৎফর রহমান:
এক টাকার এই মাস্টারের হাত ধরে এখন পর্যন্ত সহস্রাধিক শিক্ষার্থী জীবন আলোকিত হয়েছে। সমাজে তারা এখন প্রতিষ্ঠিত। সেসব শিক্ষার্থীর একজন আব্দুর রাজ্জাক। তিনি এখন সদর উপজেলার দারুল হুদা আলিম মাদারাসার অধ্যক্ষ। আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “লুৎফর স্যারের মতো নির্লোভ ও নিরহংকারী মানুষ আর হয় না। তিনি কখনোই শিক্ষার্থীকে জিম্মি করে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করেননি। তিনি অল্পতেই সন্তুষ্ট একজন মানুষ। আমরা তার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করি।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান রাফিউল ইসলাম। রাইজিংবিডি ডটকমকে তিনি  বলেন, “শুধু আমি নই, আমার ভাই-বোনরাও তার কাছে পড়েছেন। তার জন্যই প্রাথমিকে ভালো রেজাল্ট করতে পেরেছি। আসলে সমাজে এই ধরনের মানুষগুলো অবহেলিত হয়। আমরা যদি তার পাশে দাঁড়াতে পারতাম, কিছুটা হলেও ঋণমুক্ত হতে পারতাম।”

লুৎফর রহমানের আরেক শিক্ষার্থী আব্দুর রাজ্জাক। চাকরি করেন ঢাকার চাটার্ড লাইফ ইন্সুইরেন্স কোম্পানীতে ম্যানেজার অডিট হিসেবে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, “স্যারের হাত ধরেই আমার শিক্ষা জীবনের শুরু। তার অবদান কোনভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে প্রতিদিন এক টাকায় পড়তাম। এখন দিন বদলে গেছে। স্যার এখনো এক টাকায় পড়ান, যা অবিশ্বাস্য। তার ভবিষ্যত জীবনের একটু সুখের জন্য সরকারি
সহায়তা একান্ত প্রয়োজন।”

আরেক শিক্ষার্থী নুরুন্নবী সরকার। সহকারী উপ-পুলিশ পরিদর্শক হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে কর্মরত রয়েছেন। লুৎফর মাস্টার সম্পর্কে তিনি বলেন, '১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত স্যারের কাছে পড়েছি। তিনি ছেড়া স্যান্ডেলে পাটের দড়ি বেঁধে হেটে আমাদের বাড়ি এসে ৫/৬ জনকে পড়াতেন। উনি খুব যত্ন করে ইংলিশ পড়াতেন। ওনার কারণেই আজ আমি প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছি।”

গিদারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ ইদু বলেন, “লুৎফর মাস্টার একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। মাত্র এক টাকার বিনিময়ে এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তার মতো ভালো মানুষ আরো দরকার, তাহলে আমাদের সমাজ বদলে যাবে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাকে সাধ্য অনুযায়ী সুবিধা দেওয়া হয়। তাকে সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে সহায়তা করা প্রয়োজন।”

এক টাকার মাস্টারের বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদ আল হাসানবলেন, “ওই শিক্ষককে ইতোমধ্যে কিছু সহযোগিতা করা হয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী তাকে আরো সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।”

ঢাকা/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • শেখ হাসিনার দুটি লকারে ৮৩২ ভরি সোনার গয়না
  • বিয়ে বাড়ির খাবার খেয়ে একজনের মৃত্যুর অভিযোগ, হাসপাতালে ১৭
  • মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা : মানবিক গুণাবলির প্রশ্ন-১
  • মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের স্বতন্ত্র পরিদপ্তর যে কারণে জরুরি
  • চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে একজনের মৃত্যু
  • ইসরায়েলের হামলায় নিহত তাবতাবাই কে, কীভাবে হিজবুল্লাহতে যোগ দিলেন
  • বৈরুতে ইসরায়েলের হামলায় হিজবুল্লাহর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নিহত
  • বিসিএস পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে রাজশাহীতে আবার রেলপথ অবরোধ  
  • ‘মনে হয়েছে, আমি মারা গেলে তো মারা গেলাম, বাচ্চাগুলো তো বাঁচবে।’
  • ‘এক টাকায়’ ৫০ বছর ধরে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন যিনি