মানুষ সংগ্রাম চালিয়ে যায়। স্থান-অঞ্চল ছাপিয়ে তা কদাচিৎ সব মানুষের গণ–অভ্যুত্থান হয়ে ওঠে। তখন মানুষ নিজের জীবন পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখে। আশায় বুক বাঁধে। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান আশাবাদের ঢেউ জাতির মধ্যে জাগিয়ে দিয়েছে। কৃষকেরাও সেই আশায় বুক বেঁধেছেন। কিন্তু তাঁদের কথা বলবে কে? প্রান্ত থেকে তাঁদের দুর্দশার কথা কীভাবে পৌঁছাবে কেন্দ্রে? এই কথাগুলো দাবি করে তোলার জন্য গত ২৬ জানুয়ারি চিলমারীতে ছিল কৃষক মহাসমাবেশ। সেখানে অনেক কথা বলার ছিল সর্বার্থে প্রান্তে বাস করা এই মানুষগুলোর। সেসবের কিছু অগ্রগণ্য চাওয়া তুলে ধরা যাক।

হাট ও ঘাট থেকে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ

গত বছরের ঘটনা। ফিরছিলাম গরুর হাট হয়ে। সেখানে কয়েকজন গরু ক্রেতার কাছ থেকে খাজনার রসিদের ফটো ও ক্রেতার ভিডিও রেকর্ড নিই। দেখে ফেলেন ইজারাদারের লোক। জোর করে ভিডিও ও ফটো মুঠোফোন থেকে মুছে দেন। সেখান থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে ফিরতি একটি গরুবাহী ভটভটির লোকদের সঙ্গে কথা বলি। গরুর পাইকার উলিপুর ধামশ্রেণির ব্যাপারী আবুল কাশেম (৬৫) ও উলিপুর সদরের আমিনুল(৫০)। তাঁরা খাজনার রসিদ দেখান। রসিদে গরুর মূল্য লেখা ৫০ হাজার, কিন্তু খাজনার ঘর ফাঁকা। তাঁরা জানান, বিক্রেতার কাছ থেকে খাজনা নিয়েছেন ৩০০ টাকা এবং তাঁদের কাছ থেকে ৪০০ টাকা।

পরে রসিদের ছবি ফেসবুকে দিলে পোস্টে কড়াই বরিশাল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সাদাকাত হোসেন (৪৫) জানান, ‘উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর হাট জোড়গাছের এখন সুনামের পরিবর্তে দুর্নামে ভরপুর।’ হাসান আল নাহিদ লিখেছেন, ‘এরা সংখ্যায় বেশি, যা জুলুম করে তা-ই মানতে বাধ্য হয়।’

চিলমারী বন্দর থেকে রৌমারী। একটি ৪০ হাত নৌকা। একবারে যাত্রী পারাপার সম্ভব ১৫০ জনের। সোয়া ঘণ্টার পথ। একই শক্তির শ্যালো ইঞ্জিন একটি ভটভটি একই সময়ে চিলমারী বন্দর থেকে কুড়িগ্রাম শহরে যায় ১০ জন যাত্রী নিয়ে। ভাড়া জনপ্রতি ৫০ টাকা। তাহলে ১০ গুণ যাত্রী নিয়ে নৌকা চললে ভাড়া হওয়ার কথা ৫ টাকা। সেখানে ১০০ টাকা ভাড়া কেন? বাড়তি ৯৫ টাকা নৌযাত্রীরা কেন দেবেন?

পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি ছিল জমিদারি উচ্ছেদ। কৃষকেরা যে হাটে কৃষিপণ্য কেনাবেচা করেন, সেটা নিয়েও ব্যাপক আন্দোলন ছিল। জমিদারের হাটের খাজনার অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকেরা নিজেরা হাট বসিয়েছেন। নৌপথে খাজনার অত্যাচারে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার ঘটনা আছে। হাট ও ঘাট থেকে ইজারার নামে জমিদারি প্রথাটি রয়ে গেছে। ফলে সড়কপথের চেয়ে নৌপথে তেল-মবিল খরচ কম লাগলেও সড়কপথের চেয়ে নৌপথে ভাড়া দু–তিন গুণ গুনতে হয়।

কৃষকের সঙ্গে আলোচনা করে কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ

ব্রহ্মপুত্রের শাখাহাতী চরের মিলন মিয়া (৪০) তিনি নিয়ে এসেছেন ১০ মণ কাঁচা বাদাম। প্রতি মণ তিন হাজার টাকা দরে বিক্রির আশা থাকলেও তা দুই হাজারের ওপরে দাম বলছেন না ব্যবসায়ীরা। হতাশা নিয়ে তিনি বলেন, আবাদে যা খরচ হয়েছে, তা–ই উঠবে না। লাভ তো দূরের কথা। বাড়ির সবাই মাঠে খেটে ছয় বিঘা জমিতে বাদাম চাষে এবার খরচ হয়েছে ৮০ হাজার টাকার মতো। বাদাম হয়েছে ৩০ মণ। প্রতি মণ গড়ে দুই হাজার টাকায় বিক্রি করলে আবাদের খরচই ওঠে না। মাঝখানে বন্যায় কিছু খেয়ে গেছে। কামলা খরচ বাদ দিয়ে হিসাব করলেও লস। সব জায়গাতেই কৃষকদের বিপদ।

বাজারে নতুন আলু এখন ১৫ টাকা। অথচ বীজ আলু কৃষকেরা কিনেছেন ২ হাজার টাকা মণ। অর্থাৎ ৫০ টাকা কেজি। সঙ্গে বিষ, বীজ, কামলা খরচ তো আছেই। কৃষকের ঘরে আলু। কোল্ডস্টোরগুলো যেখানে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা গত বছর ভাড়া নিয়েছে ৩০০ টাকা। এ বছর ৪০০ টাকা নিচ্ছে। কৃষকের লাভ কে খায়?

শিল্পপণ্যের দাম নির্ধারণ করেন শিল্পপতিরা। এটা সারা দুনিয়াতেই হয়। সেই শিল্পোন্নত দেশগুলোতে কৃষিপণ্যের দামটি নির্ধারণ করেন সেখানকার কৃষকেরা। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষকেরা তা পারেন না। কৃষক যে ট্রাক্টর, বীজ কেনেন, তা কোম্পানির নির্ধারিত মূল্যে। আর কৃষক নিজের উৎপাদিত পাট, তুলা, বাদাম, ধানের দামটা নির্ধারণ করতে পারেন না। চাষিদের মতামতের ভিত্তিতে সরকারিভাবে কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ করার দাবি কি খুব অপ্রাসঙ্গিক?

রেশম ও এন্ডি পোকার লার্ভা খোলাবাজারে বিক্রির ব্যবস্থা

রেশম উৎপাদনব্যবস্থা একাধারে কৃষি ও কুটির শিল্প—দুটোই। আগে কৃষকেরা অন্যান্য আবাদের সঙ্গে তুঁতগাছের চাষ করতেন। পাতা খাইয়ে রেশম পোকা পালন করতেন নিজের ঘরে। এই পোকা পালনই হলো কুটির শিল্প।

কিন্তু এখন চাইলেই যে কেউ রেশম চাষ করতে পারবে না। যখন রেশম বোর্ড প্রকল্পের নামে বাজেট পাবে, তখন তারা নিবন্ধিত কৃষকদের চারা, লার্ভা ও উৎপাদনের পুরো খরচ দেবে। চারা লাগানোর জন্য দুবারে মোট ২৫ হাজার ও ঘর তোলার জন্য ১ লাখ টাকা দেবে। একজন নিবন্ধিত কৃষকও চাইলে এক বিঘার বেশি আবাদ করতে পারবেন না। একজন কৃষককে মাত্র ১ বিঘা জমির জন্য যতটুকু রেশম পোকার লার্ভা লাগবে, ততটুকুই দেওয়া হবে।

লার্ভা কেন খোলাবাজারে সবার জন্য বিক্রি হয় না। কর্তারা জানিয়েছেন, লার্ভাগুলো ফ্রিজে বিশেষ ব্যবস্থায় রাখা হয়। আগে যখন ফ্রিজ ছিল না, তখন আমাদের কৃষকেরা রেশম উৎপাদন কেমন করে করতেন? অর্থাৎ সরকারগুলো নিজেই রেশম উৎপাদনকে মুক্ত করে না দিয়ে আটকে রেখেছে।

শুধু ইলিশ নয়, সব মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুমে মাছ ধরা

চিলমারীর জেলে আবু বক্কর সিদ্দিক (৫৫) বলেন, ‘ইলিশের ডিম ছাড়ার মৌসুম, মাছ ধরা বন্ধ। লাভ কার? যারা ইলিশ সারা বছর ধরে তাদের। কিন্তু হামরা রুই-কাতলা, বাগাড়.

..হ যে মাছগুলো মারি, সেগুলা তো ডিম পাড়ে ফাল্গুন-চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসে। সেগুলা আবার ডিম ফোটায় নদীর তলার কোলায় গিয়ে। এই মাছগুলা রক্ষার কথা তো আপনারা কন না।’

মানে ফাল্গুন-চৈত্রে নদ-নদী শুকাতে থাকে। তখন চরের মাঝখানে নিচু জলাভূমি তৈরি হয়। এর তিন দিকে চর, আরেক দিক নদীর স্রোতের সঙ্গে যুক্ত। একে বলে কোলা। একেকটা কোলা একেকটা হালদা নদীর মতো মিঠাপানির মাছের আধার। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে যখন নদীর পানি কমতে শুরু করে, তখন পৈরালী (বৈরালী), কালবাউশসহ কয়েক জাতের মাছ কোলাগুলোতে ঢুকে ডিম পাড়ে। একেকটি কোলায় প্রায় ১০০ প্রজাতির মাছ থাকে। এক একর আয়তনের পুকুরে এক বা দুই প্রজাতির মাছ থাকে। একপর্যায়ে প্রভাবশালীরা কোলার ইজারা নিয়ে মুখ বন্ধ করেন। তারপর কেউ বিষ দিয়ে মাছ মারেন। কেউ কাঁথা জাল দিয়ে কোলা সেচে ফেলেন। এতে মাছ ও সব কীটপতঙ্গ ঝাড়ে-বংশে নিপাত হয়।

মাছের এই একক চাষ প্রকৃতিতে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে। জেলেরা এটা জানেন। তাঁদের জীবনদর্শনও এই যে তাঁরা প্রকৃতিকে খণ্ড খণ্ড করে দেখেন না। তাঁরা জানেন, মাছ যখন আহরণ থেকে চাষে পরিণত হয়, তখন জীবনও বদলে যায়।

চরের ভাঙন রোধে বিন্নার বেষ্টনী

চরগুলোতে কোটি টাকা খরচ করে ভবন নির্মাণ করা হয়। এনজিওরা বাড়ি–ভিটা উঁচু করে। চরের এজমালি জমি দখল করেন চেয়ারম্যানের লোকেরা। কিন্তু চরগুলোকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষার কথা কেউ বলে না।

বাংলাদেশে সচরাচর যেসব বিন্না ঘাস চোখে পড়ে, সেগুলোর শিকড় ছড়িয়ে যায়, সোজা গভীরে যায় না। ফলে এগুলো নদীভাঙন ঠেকাতে অক্ষম। অথচ শিলিগুড়িতে তিস্তার ভাঙন ও পাহাড়ধস ঠেকিয়ে রাখে। কারণ, শিলিগুড়ির বিন্না ঘাস সোজা ২০ ফুট পর্যন্ত গভীরে চলে যায়। ইরি ধান লাগানোর মতো করে চারা রোপণ করা গেলে এক বছরেই ঘন বেষ্টনী তৈরি হয়। পাহাড়ের পার্শ্বঢাল রক্ষায় এই বিন্না ঘাসের জুড়ি নেই। গবেষকেরা জানিয়েছেন, বিন্নার তিনটা শিকড় ১ সুতি লোহার সমান শক্ত। লোহা ক্ষয় হয়, এটা দিনকে দিন মজবুত হয়।

নগরীর টাইগারপাস ও লালখান বাজারের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত বাটালি হিলের মিঠাপাহাড়ের পাদদেশে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে এই ঘাস লাগানোও সফল বলে প্রমাণিত হয়।

এই পাহাড়ি বিন্না ঘাস পাহাড়ের ধস ঠেকাতে পারলে নদীভাঙন তো সহজ। এর বিস্তার করতে পারলে গরু-মহিষের এজমালি গোচারণভূমির কাজও হবে। এতে ভূমিহীনেরা গরু-মহিষ পালন করতে পারবেন। চরাঞ্চলের চতুর্দিকে ৪০–৫০ হাত প্রশস্ত বেষ্টনী প্রাকৃতিক বনের অভাবও পূরণ করবে। চরের নারীদের কুটির শিল্পের মাধ্যমে বাড়তি আয়ের রাস্তা তৈরি হবে। নদ–নদীর বাস্তুসংস্থানও ঠিক থাকবে। পাখপাখালির ঠাঁই হবে। বাহাত্তরের সংবিধান ৩ ধরনের মালিকানার স্বীকৃতি দিয়েছে। রাষ্ট্রীয়, সমবায় ও ব্যক্তি মালিকানা। কিন্তু এগুলোর বাইরে সামাজিক মালিকানা বলে একধরনের মালিকানা আছে। অবাঙালি জাতিগুলোতে এটা চালু আছে। তাদের এই সামাজিক মালিকানার সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকা উচিত।

আরও রয়ে গেল

এ তো গেল কিছু বড় ব্যাপার। এ ছাড়া গরিব মানুষের প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধের দিকে কে তাকাবে? চরাঞ্চলে ভুয়া ভূমিহীনদের হাত থেকে খাসজমি দখলমুক্ত করে প্রকৃত ভূমিহীনদের মধ্যে তা বিতরণ; আন্তনগর ট্রেনে কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য তিনটি সুলভ বগি সংযুক্ত করা দরকার। পচনশীল কৃষিপণ্য বহনকারী যানবাহনকে রাস্তায় ও ফেরীতে আগে যেতে দেওয়া; আখ ও বিট চিনির আবাদ বাড়িয়ে সব চিনিকল সংস্কার করে চালু করা চাই। কৃষকের গুড় উৎপাদনের স্বাধীনতাদানে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের আখমাড়াই আইন এখনো রয়ে গেছে। মহাজনি প্রথা থেকে লবণচাষিদের রক্ষা করতে মিলমালিকদের পক্ষে সরাসরি ক্রয়কেন্দ্র খোলা তো আশু করণীয়।

আইন-আদালত তো এই গরিবদের পক্ষে না। গোবিন্দগঞ্জে দেখেছি, পুলিশ সাঁওতাল কৃষকদের কুঁড়েঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। সেই মামলায় উল্টো কৃষকেরা কোর্টের বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দিনাজপুরের ফুলবাড়িরও একই ঘটনা। গত বছর করোনার সময় চিলমারীর একজন কৃষককে ১০ হাজার টাকা ঋণের কারণে ২৫ বছর পর মধুপুর এলাকা থেকে পুলিশ ধরে এনে জেলে ঢুকিয়েছে। হাজার হাজার কৃষক অনাদায়ি কৃষিঋণের দায়ে এলাকাছাড়া। সেই ঋণ আদায়ে মামলা ও গ্রেপ্তারের আইন বাতিল করে সব ধরনের ক্ষুদ্র কৃষিঋণ মওকুফ করা উচিত।

সহস্র জনতার প্রাণের বিনিময়ে সংগঠিত গণ–অভ্যুত্থানের পর এই দাবিগুলো কি খুব বেশি চাওয়া?

নাহিদ হাসান আহ্বায়ক, কৃষক মহাসমাবেশ বাস্তবায়ন গণকমিটি

[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: খ জন র র জন য উৎপ দ ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

ইবিতে ছাত্রীর পোশাক নিয়ে শিক্ষকের কটূক্তি, শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) ছাত্রীদের পোশাক ও নিহত শিক্ষার্থী সাজিদকে নিয়ে এক শিক্ষকের বিরূপ মন্তব্যের অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

অভিযুক্ত শিক্ষক হলেন আল কুরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. নাছির উদ্দীন মিঝি। তবে অসাবধানতাবশত কিছু শব্দচয়নে ভুল হয়েছে জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন তিনি।

আরো পড়ুন:

জাবিতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ

স্কুল পরিচালকের বিরুদ্ধে ৮ শিক্ষার্থীকে বেত্রাঘাতের অভিযোগ 

মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) রাত সাড়ে ১০টার দিকে আব্দুল্লাহ আল আসাদ নামের একজনের আইডি থেকে ‘ইবিয়ান পরিবার IUian Family’ নামের একটি ফেসবুক পেইজে পোস্ট দেওয়া হয়। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে ওই শিক্ষককে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানান।

অডিওতে শোনা যায়, সাজিদ হত্যার বিচার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে হওয়া আন্দোলন ৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেওয়া প্রসঙ্গে কোনো এক শিক্ষার্থীর ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এখানে সকল ছাত্র-ছাত্রীরা আমার সাথে মিটিং করছে। মিটিং করার পরে প্রক্টরকে বললাম আমার এখানে সব ছাত্র-ছাত্রীরা আছে, আপনি আসুন। সেখানে অনেক রাত হয়ে গেছে, আর রাত হওয়ার পরেই ছেলেরা প্রক্টরকে বলে গেছে, স্যার, আমরা তো অনেক কাজ করছি। রাতের খাওয়ার জন্য ৫ হাজার টাকা দিয়েছি। সে লিখছে সুইট নাকি ৫ হাজার টাকা দিয়ে আন্দোলন বিক্রি করেছে। তাহলে আমি নাসির উদ্দিন সেখানে আছি। আমি ভিকটিম হলাম না?”

তিনি বলেন, “কোথাকার কোন একটা মৃত পোলা, যাই হইছে, সে তো চলে গেছে। ল্যাংটা মাইয়া কতগুলো নিয়ে সেখানে দাঁড়ায়। এক মাইয়া নিয়ে গেছে ওখানে আরেক হাইওয়ান। ও হাইওয়ান নিয়ে গেছে ওখানে। ওটা তো ইনসান না, হাইওয়ান। মরে গেছি মরে। আল-কোরআনের টিচার। আমি গেছি। আমার সাথে গেছে জিন্সের প্যান্ট পরা, গেঞ্জি পরা মাইয়া। মরে গেছি আমি মরে।”

অডিওর শেষ দিকে এক শিক্ষার্থীকে তিনি বলেন, “তোমার যদি ইচ্ছা হয় যাও, লড়ো সেখানে। আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমার হক আন্দোলনের, আমার জায়গা হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার তোমার নেই। এখন থেকে ক্লাস চলবে, পরীক্ষা চলবে, আন্দোলন চলবে, সবকিছু চলবে। ব্যাস, যাও। ঠিক আছে। এটার আমি বিভাগীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।”

অডিওর পোস্টে সালমান খান নামে এক শিক্ষার্থী মন্তব্যে লেখেন, “একজন শিক্ষক তার ছাত্রকে তিরস্কার করলে সেটি  সুন্দর ও মার্জিত হবে। যে যত জ্ঞানী সে তত বিনয়ী। সবচেয়ে বড় কথা আল কুরআনের মতো বিভাগের একজন শিক্ষক, তার ওপর বিভাগীয় প্রধান। তার বাক্যচয়ন থেকে আমরা কিছু শিখব। কিন্তু দুঃখের বিষয় এখানে শুনে মনে হলো, কোনো অশিক্ষিত গ্রামের মাতব্বরের বক্তব্য শুনলাম।”

রাইসা বিনতে রাশিদা লেখেন, “লজ্জাজনক মন্তব্য, এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাইতে হবে। তবে এই ভিডিও ওই সময় পোস্ট করার সাহস কেন হয়নি? উচিত ছিল ওইসময় পোস্ট করা।”

নুসরাত ঐশী লেখেন, “একটু ভালো রেজাল্টের আশায় এরে যেসব অমানুষরা ডিফেন্ড করতে আসবে ওরা সাজিদের বিচার চায় কিনা সন্দেহ...।”

ফাবিয়ান আরিফ লেখেন, “মাই গড, এমন আচরণ হতে পারে একজন শিক্ষকের? এমন সাহস কোথা থেকে পায়? আসলে দোষ তাদের না, দোষ আমাদের ছাত্রদের। আমরা চুপ করে থাকার জন্য তারা সাহস পায়।”

মেহেদী হাসান ইমন লেখেন, “যারা আন্দোলন করবেন, অবশ্যই আল কুরআন ডিপার্টমেন্টের হতে হবে। না হয় প্রিয় স্যার আন্দোলন করতে দিবে না।”

শরীফ উদ্দিন আমানউল্লাহ লেখেন, “ওইদিন আমরা উপস্থিত ছিলাম। স্যার একজন শিক্ষার্থীকে ধমক দিয়েছে তা ঠিক। ঐ ছাত্রের বিরুদ্ধে ডিপ্টের সকল শিক্ষার্থী স্যারের কাছে অভিযোগ করছে যে ঐ শিক্ষার্থীর আচার ব্যবহারে ডিপ্টের সম্মান নষ্ট হচ্ছে। বারবার সে ডিপ্টের সিদ্ধান্তের বাহিরে কাজ করেছে। আল কোরআনের ছাত্র হয়েও সে যথাযথ আচরণ করেনি। এজন্যে তাকে ধমক দেওয়া হয়েছে। ঐদিনের ধমক যথাযথই ছিল। সকল ছাত্র উপস্থিত ছিল। সকল ছাত্রের চোখে সে অভিযুক্ত ছিল। সে হিসেবে সম্মানিত চেয়ারম্যান স্যার সঠিক কাজ করেছে।”

তিনি আরো লেখেন, “এখানে আপনারা বিষয়টার আগা মাথা না জেনে পানি ঘোলা করতে চাচ্ছেন। এটা কখনো ঠিক হবে না। যারা উপস্থিত ছিল তাদের সাথে কথা বলুন। মূল বিষয় জানুন। স্যার ঐদিন যা করেছে যা বলেছে, তা ১০০% ঠিক করেছে ঠিক বলেছে আল কোরআনের চেয়ারম্যান হিসেবে।”

সোহরাব উদ্দিন লেখেন, “ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-কুরআন বিভাগের একজন শিক্ষক কর্তৃক এক ছাত্রীকে অশ্লীল ভাষায় অপমান করা একদম অগ্রহণযোগ্য। একজন শিক্ষক হয়ে এমন আচরণ পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানকে কলুষিত করেছে।”

তিনি আরো বলেন, “এছাড়া, খুনের বিচার চাওয়া ছাত্রদের আন্দোলনকে ছোট করে বিভাগের সুনাম রক্ষার নামে এমন ভাষা ব্যবহার কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই।”

অডিওর বিষয়ে অধ্যাপক ড. নাছির উদ্দিন মিঝি বলেন, “সংশ্লিষ্ট সবার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে আমি আল-কুর আন বিভাগের সভাপতি হিসেবে শহীদ সাজিদ আব্দুল্লাহর জন্য বিভাগের ছাত্র শিক্ষকদের নিয়ে বিচার চেয়ে আন্দোলন করেছি। আমার অফিসে বসেই কেইস এন্ট্রি করেছি।”

তিনি বলেন, “প্রশাসনিকভাবে বিষয়টি এগিয়ে নিতে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ইবি থানার ওসিসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। কিন্তু এ সত্ত্বেও বিভাগের অন্যান্য শিক্ষকসহ আমার আরেক ছাত্রের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমার অসাবধানতাবশত কিছু শব্দচয়নে ভুল হয়েছে বলে আমি মনে করি। এজন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”

এদিকে, বুধবার (২৯ অক্টোবর) বেলা ১১টার দিকে নারী শিক্ষার্থীদের পোশাক নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদে ও সাজিদ হত্যার সুষ্ঠু বিচার চেয়ে  মানববন্ধন করেছেন ইবি শিক্ষার্থীরা। পরে তারা নারীর পোশাক নিয়ে কটুক্তিকারী শিক্ষকের বিচারসহ পাঁচ দফা দাবিতে উপাচার্য অধ্যাপক ড নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বরাবর স্মারকলিপি দেন তারা।

এতে শাখা ছাত্রদল, আগ্রাসনবিরোধী শিক্ষার্থী জোট, ছাত্র ইউনিয়ন, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থী অংশ নেয়।  

স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল কুরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী শহীদ সাজিদ আব্দুল্লাহ হত্যার পর ১০৪ দিন অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত হত্যার বিচার হয়নি, কোনো খুনিও গ্রেপ্তার হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়সারা মনোভাব এবং বিচার প্রক্রিয়ার অনিশ্চয়তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে গভীর ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম দিয়েছে।

এছাড়া আল কুরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক ড. নাসিরউদ্দিন মিঝির সাজিদ আব্দুল্লাহকে ‘কোথাকার কোন মৃত পোলা, যাই হোক সে তো চইলাই গেছে’ বলে হেয় করা এবং নারী শিক্ষার্থীদের পোশাক নিয়ে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য ও কটূক্তির মতো লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে। তার এমন কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নৈতিক অধঃপতন এবং বিচারবোধহীনতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এই ধরনের বক্তব্য শিক্ষকতার মহান পেশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিভিন্ন সময় সাজিদ হত্যার বিচার দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের হুমকি প্রদান, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং আন্দোলন দমনে বিভিন্ন পক্ষের অনৈতিক হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্মারকলিপিতে উল্লেখিত দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- সাজিদ আব্দুল্লাহ হত্যার পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করে খুনিদের অতিদ্রুত গ্রেফতার করতে হবে; নিহত সাজিদকে হেয় প্রতিপন্ন করা এবং নারী শিক্ষার্থীদের পোশাক নিয়ে কটূক্তিকারী আল কুরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. নাসিরউদ্দিন মিঝিকে ন্যাক্কারজনক ও যৌন হয়রানী মূলক বক্তব্য দেওয়ার অপরাধে তাকে বহিষ্কার করতে হবে; সাজিদ হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতি হুমকি-ধামকি প্রদানকারীদের চিহ্নিত করে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

বাকি দাবিগুলো হলো- আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ন্যায্য প্রতিবাদ ও আন্দোলনে বাঁধা প্রদানকারীদের উদ্দেশ্য ও প্রবৃত্তি যাচাইয়ের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে; বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশের অধিকার ও আন্দোলনের সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষিত রাখতে হবে, কোনমতেই কোন আন্দোলনকারীর একাডেমিক ফলাফলের উপর বিরূপ প্রভাব যেন না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বলেন, “কোনো শিক্ষক যদি এ ধরনের কোনো শব্দ ব্যবহার করে সেটা মানহানিকর ও অপমানজনক। তিনি সাংবাদিকের মাধ্যমে এ ধরনের বক্তব্যের জন্য প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অথরিটি হিসেবে তার পক্ষ হিসেবে সবার কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। আগামীতে কোনো শিক্ষক যেন এ ধরনের বক্তব্য না দেয় এ ব্যাপারে নিশ্চিত করছি।”

ওই শিক্ষকের বিচারের দাবির প্রেক্ষিতে উপাচার্য বলেন, “তোমরা শিক্ষার্থীরা অভিযোগপত্র দাও। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দেখো কি করে।”

ঢাকা/তানিম/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কর্মদিবসের শেষ দিনে প্রধান শিক্ষকের মৃত্যু
  • প্রশিক্ষকদের দায়িত্বে উদাসীনতাসহ যেসব অসংগতি উঠে এল প্রাথমিক তদন্তে
  • চবি ছাত্রদলের ৪২০ জনের কমিটিতে নারী মাত্র ১১
  • চলন্ত গাড়ির নিচে পড়েও অক্ষত অবস্থায় ফিরল ৩ বছরের শিশুটি
  • মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে নতুন অধ্যাদেশ অনুমোদন
  • যমুনা ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন
  • এই তিন কন্যার একজন ঢালিউডের জনপ্রিয় নায়িকা, স্বামীও নায়ক
  • নিকোলাই গোগোলের নগরে
  • বিস্মৃতির ছোবল
  • ইবিতে ছাত্রীর পোশাক নিয়ে শিক্ষকের কটূক্তি, শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ