এই সরকারের সময়ে করা ‘গায়েবি মামলা’ প্রত্যাহার করবে কে
Published: 8th, December 2025 GMT
২০১৮ সালে মারা গিয়েছিলেন নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট পৌরসভার বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন দিপু। মারা যাওয়ার পাঁচ বছর পর ২০২৩ সালে তাঁকেসহ বিএনপির নেতা-কর্মীদের আসামি করে সেই উপজেলার তৎকালীন স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আলমগীর হোসেন একটি মামলা করেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থেকেও বিদেশে থাকা প্রবাসীকেও এই মামলায় জড়ানো হয়েছিল। (প্রথম আলো, ১৭ জুন ২০২৩)
শুধু এমন একটি ঘটনা নয়, গত ১৬ বছরে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক ‘গায়েবি মামলায়’ বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নেতা-কর্মীরা জেলে থেকেছেন, অপরাধ না করেও শাস্তি ভোগ করেছেন। এমনকি কোনো ঘটনা ঘটেইনি এমন ক্ষেত্রেও সাজানো মামলায় অসংখ্য মানুষকে আসামি করে ঘরবাড়ি ছাড়া করা হয়েছিল।
ভিত্তিহীন মামলায় জেল-নির্যাতন ও হয়রানি থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে।
২৭ নভেম্বর প্রথম আলোর প্রথম পাতায় প্রকাশিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে সরকার বলছে, ৬ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও অন্যদের বিরুদ্ধে করা হয়রানিমূলক (যা অনেক ক্ষেত্রে গায়েবি মামলা হিসেবে পরিচিত) মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যাঁর মধ্যে ২০ হাজার মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে আরও যাঁরা এসব হয়রানির শিকার হয়েছেন, তাঁদের আগামী ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে দরখাস্ত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। বিনা অপরাধে কেবল রাজনৈতিক আক্রোশের জায়গা থেকে কেউ দিনের পর দিন জেলে থাকবে তা কেবল অমানবিকই নয়, নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার দেওয়ার যে অঙ্গীকার তার প্রায়োগিক দায়বদ্ধতা স্পষ্ট করে। ফলে এ ধরনের ‘গণবিজ্ঞপ্তি’ অবশ্যই বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা তৈরির পথ তৈরি করে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে সরকার এসব গায়েবি মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, সেই সরকারের আমল কি গায়েবি মামলার কলঙ্ক থেকে মুক্ত আছে? যে সরকার ৫ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত গায়েবি মামলার কথা জানাচ্ছে, সেই সরকার ৮ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশে কি কোনো রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা হয়নি? বলতেই হয়, এ গণবিজ্ঞপ্তিতে সরকারের ১৫ মাসের আমলনামা প্রতিফলিত হয়নি।
আরও পড়ুনজুলাই হত্যাকাণ্ডের মামলায় মৃতও আসামি! ১২ অক্টোবর ২০২৪এই সরকারের আইন উপদেষ্টা হওয়ার আগে আসিফ নজরুল নিজেই এক কলামে লিখেছিলেন, ঘটনাগুলো এমন সাজানো বা বানানো হয়ে থাকে বলে এগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে গায়েবি মামলা। ঘটনা যে সাজানো, তার আরেকটি প্রমাণ পাওয়া যায় এসব মামলায় মৃত, কারাবন্দী বা বিদেশে থাকা ব্যক্তিদের আসামি করার বহু নজির থেকে। গায়েবি মামলার ওপর বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনে, এমনকি এ-ও দেখা গেছে যে মামলায় আহত হিসেবে বর্ণিত ব্যক্তি বলেছেন, তিনি আসলে আহত হননি বা বাদী বলেছেন, তিনি আসলে কারও নির্দেশে মামলা করেছেন, জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর করা মানুষ বলেছেন, ধরিয়ে দেওয়া কাগজ না দেখেই তিনি তাতে স্বাক্ষর করেছেন। (গায়েবি মামলার গায়েবি ককটেল, প্রথম আলো, ১১ আগস্ট ২০২৩)
পাঠক চলুন এবার কিছু ঘটনার আলোকপাত করা যাক। গত বছরের ৩ জুন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার দুপ্তারা ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি বাবুল মিয়া মারা যান। কিন্তু ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন এই নেতা এবং তাঁকে হত্যা করা হয় উল্লেখ করে ২২ আগস্ট একটি মামলা করেন ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন। (প্রথম আলো, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৪)
গত বছরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ৫ আগস্ট মো.
শুধু গায়েবি মামলাই নয়, মিথ্যা মামলায়ও জড়ানো হয়েছে অনেক মানুষকে। যেমন, এই সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টার বিরুদ্ধেই রামপুরায় একটি হত্যাকাণ্ডের মামলা করা হয়। যেখানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৫৭ জনকে আসামি করা হয়, সেখানে ৪৯ নম্বর আসামি ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার পর বিষয়টি আলোচনায় আসে। এরপর তাঁকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় (প্রথম আলো, ২৫ নভেম্বর ২০২৫)। কিন্তু অন্য ৫৬ জনকে মামলার আসামিই রাখা হয়। তাঁরা সবাই কি ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?
আরও পড়ুনঢালাও হত্যা মামলায় সাংবাদিকেরা কেন আসামি৩১ আগস্ট ২০২৪একই ভাবে জুলাই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া। যদিও তিনি সেই সময় দেশেই ছিলেন না, কিন্তু মিথ্যা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তারের পর নানামুখী সমালোচনার পর থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। (১৮ মে, বিবিসি বাংলা)
জুলাই আন্দোলনে আহাদুল ইসলামকে হত্যার অভিযোগে গত বছরের অক্টোবরে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন এবং সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জহিরুল ইসলাম খান পান্নাসহ (জেড আই খান পান্না) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ ১৮০ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছিলেন নিহতের বাবা মো. বাকের। অথচ জুলাইয়ে ছাত্র–জনতার উপর গুলি চালানো বন্ধ করতে রিটকারী আইনজীবী ছিলেন জেড আই খান পান্না। ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মুখে মামলা থেকে তাঁর নামটি প্রত্যাহার করা হয়।
এই কয়েকটি কেবলই উদাহরণ দিলাম। প্রকৃতপক্ষে আমরা যদি গত ১৫ মাসে এই সরকারের আমলে হওয়া মামলাগুলো বিশ্লেষণ করতে যাই, তাহলে দেখা যাবে, এসব মামলার অনেকগুলোতে প্রতিহিংসা, রাজনৈতিক আধিপত্য, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব কিংবা দখলের নিমিত্তে হাজার হাজার মানুষকে আসামি করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের পাশাপাশি সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পত্রিকার সাংবাদিক-সম্পাদক, লেখক, খেলোয়াড় বা ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা দেওয়া হয়েছে, কাউকে কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। কেউ জামিন পেয়েছেন, কেউ এখনো কারাগারে আছেন।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না হলেও একই স্টাইলে একই এজাহারের ভাষায় দেশজুড়ে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক’ মামলার কোনো সুরাহা হয়নি। ওঁদের না হয়েছে জামিন, না হয়েছে মামলার তদন্ত। এসব গায়েবি মামলা নিয়ে আমাদের সুশীল সমাজের কোনো মাথাব্যথা নেই। সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোও এসব সাংবাদিকের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার নয়। ফলে সাংবাদিকতায় মানবাধিকার সুরক্ষায় যে প্রতিশ্রুতি থাকে, তা কার্যত দেখা মিলছে না।
অধ্যাপক আলী রীয়াজের ভাষায় বলতে হচ্ছে, এসব গায়েবি মামলায় যাঁরা অভিযুক্ত, তাঁদের অনেকেই জামিনের ব্যবস্থা করতেই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের মামলাগুলো তো বাতিল হচ্ছে না। সেগুলোর হাজিরা চলবে ভবিষ্যতে। কত দিন? (মামলাগুলো গায়েবি, মানুষগুলো নয়, প্রথম আলো, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) আলী রীয়াজ এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী।
দুঃখজনক হচ্ছে, এক সময় গায়েবি মামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা মানুষগুলোও এখন আর গায়েবি মামলার তালাশ করতে পারছেন না। রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় ভারী হওয়া কাঁধকেও মুক্ত করতে পারছে না সরকার। বরং পুরোনো চক্রেই নিজেরা আটকে পড়েছে। যা আমাদের জন্য বড়ই হতাশার, লজ্জার।
গায়েবি মামলা যদি প্রত্যাহারই করতে হয়, তাহলে সরকারের উচিত হবে তাদের নিজেদের আমলেও ভুতুড়ে মামলায় শত শত আসামিদের এই ভয়াবহ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দেওয়া। এর মধ্য দিয়ে নিজেদের সরলরৈখিক মানসিকতার প্রমাণ দেওয়াও সম্ভব হবে। নয়তো গায়েবি মামলার এই ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। এর দায় থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেদের মুক্ত করার কোনো সুযোগ পাবে না।
ড. নাদিম মাহমুদ লেখক ও গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]
*মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এই সরক র র ই সরক র র প রথম আল উপদ ষ ট র আস ম আগস ট আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
ঢাকার সাত কলেজ নিয়ে যে ব্যাখ্যা দিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়
রাজধানীর বড় সাতটি সরকারি কলেজ নিয়ে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোর পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলন চলার মধ্যেই এ নিয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বলছে, প্রস্তাবিত ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর খসড়া পরিমার্জন করে চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। এ কাজ সম্পন্ন করে ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে পরিমার্জিত খসড়ার ওপর আন্তমন্ত্রণালয় সভা করা সম্ভব হবে বলে আশা করছে মন্ত্রণালয়।
আজ সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই ব্যাখ্যা দিয়েছে। আসন্ন শীতকালীন ছুটি শেষে আগামী বছরের ১ জানুয়ারি ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু করা সম্ভব হবে বলে ব্যাখ্যায় আশার কথা জানানো হয়।
রাজধানীর বড় সাত কলেজ ঘিরে সৃষ্ট সংকট আরও জটিল হচ্ছে। এই কলেজগুলো নিয়ে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোর পক্ষে-বিপক্ষে এখন অন্তত পাঁচটি পক্ষ হয়ে গেছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ দ্রুত জারির দাবিতে আজ সোমবারও রাজধানীর শিক্ষা ভবনের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছেন সাত কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের একদল শিক্ষার্থী।
অন্যদিকে কলেজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার দাবিতে ধারাবাহিকভাবে বিক্ষোভ করে আসছেন ঢাকা কলেজসহ একাধিক কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা। গতকাল তাঁরা কলেজ ক্যাম্পাসসহ আশপাশের এলাকার সড়কে বিক্ষোভ করেছেন। পরে পাঁচটি কলেজের শিক্ষার্থীরা ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’র স্কুলিং মডেলভিত্তিক খসড়া অধ্যাদেশ উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলবে—দাবি করে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।
প্রস্তাবিত কাঠামোর বিরোধিতা করে আসছেন কলেজগুলোর শিক্ষকেরা। আর ইডেন মহিলা কলেজকে কেবল নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখাসহ পাঁচ দফা দাবি জানিয়ে আসছেন এই কলেজের ছাত্রীদের অনেকেই। এর মধ্যে গত শনিবার সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের একাংশ প্রস্তাবিত কাঠামোর (স্কুলিং) বিরোধিতায় নামেন। সব মিলিয়ে সাত কলেজ নিয়ে সৃষ্ট সংকট বেশ জটিল রূপ নিয়েছে।
এ রকম পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ব্যাখ্যায় বলা হয়, মানসম্মত শিক্ষা, সময়মতো পরীক্ষা অনুষ্ঠান ও ফল প্রকাশ এবং প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনাগত উৎকর্ষ নিশ্চিত করার বিষয়ে ঢাকা শহরের সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের যৌক্তিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যকে সামনে রেখে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ প্রস্তাবিত ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ প্রতিষ্ঠার কাজ করে যাচ্ছে। এর খসড়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) আগে পাঠিয়েছে, তা পরিমার্জন করে চূড়ান্ত করার কাজ চলমান রয়েছে।
এতে আরও বলা হয় অংশীজন ও সর্বসাধারণের মতামত গ্রহণের জন্য খসড়া অধ্যাদেশটি গত ২৪ সেপ্টেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। খসড়া বিষয়ে বিভিন্ন মহল হতে পাঁচ হাজারেরও বেশি মতামত পাওয়া গেছে। পাশাপাশি, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উদ্যোগে তিনটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। একই সঙ্গে, নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের মতামত সংগ্রহের কাজও সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রাপ্ত প্রতিটি মতামত আইনগত ও বাস্তবতার নিরিখে পর্যালোচনা করে খসড়া পরিমার্জন করা হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, পরিমার্জনের কাজ সম্পন্ন করে ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে পরিমার্জিত খসড়ার ওপর আন্তমন্ত্রণালয় সভা করা সম্ভব হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে খসড়া চূড়ান্ত করার কাজ চলমান রাখার পাশাপাশি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন, সাত কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষক ও ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গেও সময়ে সময়ে প্রয়োজনীয় আলোচনা করা হচ্ছে। বিশেষ করে, অধ্যাদেশ চূড়ান্ত করাসহ সামগ্রিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার মধ্যবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা যেন কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয়, সে লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন ও ক্লাস পরিচালনার বিষয়ে গত ১১ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি, অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন এবং সাত কলেজের অধ্যক্ষদের অংশগ্রহণে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
ব্যাখ্যায় আরও জানানো হয় ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন ইউনিটে ১০ হাজার ১৯৪ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। তবে নির্ধারিত সময়ে ৯ হাজার ৩৮৮ জন শিক্ষার্থী ভর্তির নিশ্চয়ন সম্পন্ন করেন। এই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন ও পাঠদানের জন্য একটি পরিচালন ম্যানুয়েলও অনুমোদন করা হয়েছে।
২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তিপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন, তাদের ক্লাস শুরুর বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বিবেচনায় নিয়ে ৪ ডিসেম্বর অধ্যক্ষ এবং ৭ ডিসেম্বর শিক্ষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে সভা করা হয়েছে। ভর্তি বিজ্ঞপ্তির আলোকে বিদ্যমান একাডেমিক কাঠামোতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরুর জন্য নিজ নিজ কলেজের শিক্ষকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আসন্ন শীতকালীন ছুটি শেষে ১ জানুয়ারি এই শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু করা সম্ভব হবে বলে শিক্ষক প্রতিনিধিরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়, উচ্চশিক্ষার গুরুত্ব, সংশ্লিষ্ট অংশীজনের ব্যাপকতা, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের পদ সংরক্ষণ, কলেজগুলোর স্বাতন্ত্র্য রক্ষা, নারীশিক্ষার সুযোগ সংকোচন না করা, নারীদের জন্য নির্ধারিত কলেজগুলোর মূল বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রাখা, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে কলেজগুলোর মালিকানা সংরক্ষণ, কলেজগুলোর বিদ্যমান উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত না করা, সর্বোপরি প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির সঙ্গে সাত কলেজের সম্পৃক্ততার ধরন বিষয়ে উপযোগী কাঠামো নির্ধারণসহ সব সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে অধ্যাদেশের খসড়া পরিমার্জন করা হচ্ছে। সময়সাপেক্ষ এ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সব মহলের ধৈর্যশীল আচরণ ও বিবেচনা একান্ত কাম্য। সবার সহযোগিতায় সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য ও সমন্বিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ বিশ্বাস করে।
ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে দেশের উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ও সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং অভিভাবকসহ সব অংশীজনের ন্যায্য স্বার্থ রক্ষা এবং দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়নে ইতিবাচক একাডেমিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা এ বিভাগের প্রধান লক্ষ্য। ব্যক্তিগত ধারণা, অসম্পূর্ণ তথ্য বা গুজবের ভিত্তিতে বিভ্রান্তি বা পারস্পরিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি না করে সরকারি কর্মচারী হিসেবে শিক্ষকেরা পেশাদারি বজায় রাখবেন এবং শিক্ষার্থীরা নিজের অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল আচরণ করবেন বলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ প্রত্যাশা করে। শিক্ষার্থীদের মূল্যবান শিক্ষাজীবন এবং সামগ্রিক শিক্ষা কার্যক্রম যাতে কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়, সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকার জন্য বিশেষভাবে আহ্বান জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।