স্বপ্নের উড়াল যাত্রা, অস্ট্রেলিয়ার পথে রিশাদ
Published: 8th, December 2025 GMT
বিপিএলকে না করে বিগ ব্যাশে রিশাদ হোসেন।
পাঠক ঠিকই পড়ছেন। আসন্ন বিপিএলে দেখা যাবে না রিশাদ হোসেনকে। তাকে দেখা যাবে অস্ট্রেলিয়ায় বিগ ব্যাশ টুর্নামেন্টে। নিজের স্বপ্ন পূরণে যাত্রা শুরু করেছেন রিশাদ। রবিবার রাতে এক ফ্লাইটে যাচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ায়।
টানা দ্বিতীয় মৌসুমে বিগ ব্যাশে দল পেয়েছেন রিশাদ। অস্ট্রেলিয়ার ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন হোবার্ট হারিকেনস আবার বাংলাদেশের লেগ স্পিনারকে নিয়েছে। গত আসরেও রিশাদকে ড্রাফট থেকে দলে নিয়েছিল হোবার্ট। তবে, জাতীয় দলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর ও পরে বিপিএলের জন্য সেবার খেলতে যাওয়া হয়নি তরুণ লেগ স্পিনারের।
আগামী ১৪ ডিসেম্বর শুরু হবে বিগ ব্যাশের নতুন আসর। ফাইনাল হবে আগামী বছরের ২৫ জানুয়ারি। বিপিএল শুরু হচ্ছে ২৬ ডিসেম্বর থেকে। এবার বিপিএলে খেলার চেয়ে বিগ ব্যাশকে বেছে নিয়েছেন তিনি। বিসিবি থেকেও মিলেছে সাড়া। আসরের সব ম্যাচ খেলার অনুমতি পেয়ে গেছেন রিশাদ।
কেন এই সিদ্ধান্ত? গত ৬ অক্টোবর হোবার্ট হারিকেনসের সংবাদ সম্মেলনে যোগ দিয়ে রিশাদ দিয়েছিলেন উত্তর, ‘‘একজন লেগ-স্পিনার হিসেবে, যদি আমি এই বিদেশি লিগে খেলতে পারি, তাহলে এটা আমার জন্য এবং আমার বোলিংয়ের জন্য ভালো হবে। আমি আমার দক্ষতা উন্নত করার সুযোগ পাব।’’
এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে আরো কিছু ভাবনা কাজ করেছে তার, ‘‘আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করছিলাম, আমার খেলার উন্নতির জন্য আমি কী করতে পারি। তারপর আমি ভাবলাম, যদি আমি এই লিগগুলিতে খেলতে পারি, তাহলে এটি আমার জন্য উপকারী হবে। যদি আপনি দেখেন, ম্যাচগুলো বিভিন্ন ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হবে- আমার খেলার স্বপ্নের মাঠ।’’
রিশাদকে দলে নেয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছেন রিকি পন্টিং। শেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩ ওভারের স্পেলে ২৩ রানে ২ উইকেট পেয়েছিলেন রিশাদ। বিশ্বকাপের ম্যাচেই রিশাদে মন মজেছিলেন হোবার্টের হেড অব স্ট্র্যাটেজি রিকি পন্টিং।
কিংবদন্তি পন্টিংয়ের সঙ্গে কাজ করার অপেক্ষায় রিশাদ, ‘‘ছোটবেলায় পন্টিং আমার প্রিয় খেলোয়াড়দের একজন ছিলেন। আমি তার খেলা দেখতাম। আমি সত্যিই তার সঙ্গে কাজ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। খেলোয়াড়দের চেয়েও বেশি, আমি রিকি পন্টিংয়ের সঙ্গে কাজ করার এবং তার কোচিংয়ে খেলার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।’’
সাকিব আল হাসানের পর প্রথম বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে বিগ ব্যাশে খেলার অপেক্ষায় রিশাদ। ২০১৪ সালে অ্যাডিলেইড স্ট্রাইকার্সের হয়ে দুটি ও ২০১৫ সালে মেলবোর্ন রেনেগেডসের হয়ে চারটি ম্যাচ খেলেন সাকিব। প্রথমবার তিনি সুযোগ পান ইয়োহান বোথার বদলি হিসেবে আর পরের বার খেলেন আন্দ্রে রাসেলের বদলি হয়ে। ড্রাফট থেকে সরাসরি সুযোগ পাওয়া রিশাদই প্রথম।
নিজের লক্ষ্যে জানাতে গিয়ে রিশাদ যোগ করেন, ‘‘একজন লেগ স্পিনার হিসেবে আমার কাজ হলো পাওয়ার প্লের পর উইকেট নেওয়া। আশা করি হোবার্টেও এটা অব্যাহত থাকবে। আমি আমার শক্তিতে বিশ্বাস করি এবং দিনের পর দিন আমি উন্নতি করার চেষ্টা করছি, এমনকি যদি তা মাত্র এক বা দুই শতাংশও হয়; ভবিষ্যতের কথা খুব বেশি না ভেবে।’’
ঢাকা/ইয়াসিন
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র জন য ক জ কর ব প এল
এছাড়াও পড়ুন:
জাবরা গ্রাম থেকে কম্পিউটার অধ্যাপনায় ড. কায়কোবাদ
ডাচ্–বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত অলিম্পিয়াডের কথা আমরা এখন গৌরবের সঙ্গে বলি। গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ সোনার পদক পেয়েছে, অন্য পদক পেয়েছে অনেক, কিন্তু সেরা পুরস্কার হলো, সারা দেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণিত বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। পৃথিবীর সেরা সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থীকে স্বাগত জানানো হয়েছে শুধু এ কারণে যে তারা গণিত অলিম্পিয়াডে ভালো করেছে।
গণিত অলিম্পিয়াডের আইডিয়া প্রথম যাঁর মাথায় আসে, আপনারা কি তাঁর নাম জানেন? অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ। ২১ বছর আগে মোহাম্মদ কায়কোবাদ স্যার ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন প্রথম আলোর অফিসে। দেখা করেছিলেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে। তাঁরা গণিত নিয়ে আন্দোলন করতে চান। ‘গণিতের ইশকুল’ নামে একটা গণিতের পাতা বের করা শুরু করে প্রথম আলো। সেই একটা মোমবাতি থেকে এখন চলেছে আলোর মিছিল।
ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ তখন বুয়েটের কম্পিউটার কৌশল বিভাগের প্রধান। তখন থেকেই তাঁকে আমরা জেনে এসেছি একজন নিরহংকার, সাদাসিধে একজন ভালো মানুষ হিসেবে। আমরা একটা ভাঙাচোরা মাইক্রোবাস নিয়ে খুলনা কিংবা রংপুরে গণিত অলিম্পিয়াডের অনুষ্ঠান শেষ করে রাত দুইটায় বাড়ি ফিরেছি। কত গল্প, কত কথা। আর দেখেছি, এই শিক্ষকেরা কত কষ্ট স্বীকার করেছেন। কায়কোবাদ স্যার ক্রিকেটের বিরোধী। আমি বাংলাদেশের ক্রিকেটের পাগলপারা ভক্ত। তিনি বলতেন, একটা সময় তিনি সারা দিন রেডিওতে কান পেতে রেখে ক্রিকেট শুনতেন। কিন্তু এখন তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহী নন। তিনি মনে করেন, আমরা ভালো করব বুদ্ধির খেলায়। যেমন দাবায়। নিয়াজ মোরশেদের পর আরও অনেক গ্র্যান্ডমাস্টার আমরা তৈরি করতে পারতাম।
‘ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলো’ শিরোনামের সাক্ষাৎকার সিরিজে আমরা দেশের অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার নিই। ২০ নভেম্বর ২০২৫ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা ছাদে ড. কায়কোবাদের ভিডিও সাক্ষাৎকার নিই। তাঁর শৈশব থেকে শুরু করে আজকের জীবনের নানা দিক তাতে আলোচনা করি।
মানিকগঞ্জের তরা সেতু পেরিয়ে উজানের দিকে একটু এগোলেই জাবরা গ্রাম। ১৯৫৪ সালের ১ মে সেখানেই জন্ম ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদের। কালিগঙ্গা নদীর ঢেউ, বর্ষার জল, পীর পরিবারের বড় উঠান—এসব মিলেই তাঁর শৈশব। তাঁর দাদা মুন্সি এখলাসউদ্দিন আহমেদ ছিলেন পীর, ওরস হতো বাড়িতে। বাবা আনিসউদ্দিন কবিতা লিখতেন, গান করাতেন, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের ঢেউ এসে সবকিছু বদলে দিল। মোহাম্মদ কায়কোবাদের ইন্টার পরীক্ষা পেছাল, ফল প্রকাশিত হলো ১৯৭৩ সালে। ভর্তি পরীক্ষা দিলেন বুয়েটে, মেডিকেলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে—সবখানেই ভালো ফল। কিন্তু বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ এল, যা তখনকার দিনে বড় প্রাপ্তি। স্কলারশিপে রওনা হলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। পড়লেন শিপ বিল্ডিং বিভাগে। কিন্তু ড্রয়িং তাঁর পছন্দের বিষয় নয়। শেষ পর্যন্ত বিভাগ বদল করে চলে এলেন অটোমেটেড ম্যানেজমেন্ট অব মেরিটাইম ট্রান্সপোর্টে। শুরু হলো কম্পিউটারের সঙ্গে জীবনব্যাপী সম্পর্ক। সে সময় ডেটাবেজ শেখানো হতো যখন এ সম্পর্কে বই-ই ছিল না। খুলে গেল নতুন জ্ঞানের দিগন্ত।
১৯৭৯ সালে দেশে ফিরে যোগ দিলেন বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনে। কিন্তু বাস্তবে শেখা কাজ প্রয়োগের সুযোগ নেই, যন্ত্র চলে গতানুগতিক ব্যবস্থায়। অবশেষে পড়তে গেলেন ব্যাংককের এআইটিতে।
এরপর অস্ট্রেলিয়ার ফ্লিন্ডার্স ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি ১৯৮৬ সালে। বিষয় কম্পিউটেশনাল কমপ্লেক্সিটির থিওরি। অ্যালগরিদম আবিষ্কারের আগেই অনুমান করা—প্রবলেমের যুক্তি কতটা কঠিন হবে।
দেশে ফিরে যোগ দেন অ্যাটোমিক এনার্জি রিসার্চ এস্টাবলিশমেন্টে। পরে বুয়েটে অতিথি শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেন ১৯৮৭ থেকে। ছাত্রদের মেধা দেখে বিস্মিত। যে ভালো ছাত্রকে দেখার জন্য শৈশবে ১০–১২ কিলোমিটার হেঁটে যেতেন, এখানে ডানে-বাঁয়ে তাকালেই স্ট্যান্ড করা ছাত্র। ১৯৯১ সালে যোগ দিলেন পূর্ণকালীন শিক্ষক হিসেবে। তিন দশক ধরে তৈরি করেছেন অগণিত প্রকৌশলী। ব্যস্ত ছিলেন প্রতিযোগিতা, অলিম্পিয়াড, গবেষণা নিয়ে। আফসোস করেন, বাংলাদেশের বিজ্ঞানমনস্ক মেধাবীরা জাতীয় নেতৃত্বে এখনো যথেষ্ট দৃশ্যমান নয়। মেধা আছে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মেধাবীদের অবদান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
২০২০ সালে অবসর বুয়েট থেকে, এখন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর। আজও তাঁর প্রত্যাশা, বাংলাদেশে জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বাড়ুক, মেধা সক্রিয় হোক উদ্ভাবনে, নেতৃত্বে। কারণ, তাঁর বিশ্বাস, শিক্ষা শুধু মুখে বলা স্লোগান নয়, শিক্ষা সত্যিই জাতির মেরুদণ্ড, যদি আমরা তা কাজে লাগাতে পারি।