দেশের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাত সংস্কারের লক্ষ্যে ছয় বছর মেয়াদি একটি পথনকশার (রোডম্যাপ) খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে।

খসড়াটি তৈরি করা হয়েছে সরকারের আইসিটি বিভাগের উদ্যোগে। খসড়ার শিরোনাম: ‘ন্যাশনাল ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন স্ট্র্যাটেজি’। খসড়ায় ২০২৫ থেকে ২০৩০ সাল মেয়াদ ধরে আইসিটি খাত সংস্কারের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

খসড়ায় ১০টি পদক্ষেপের উল্লেখ আছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সরকারি হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীন উপাত্ত সুরক্ষা বোর্ড গঠন, ৮০ লাখ দক্ষ জনবল তৈরি, ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় অর্জন, অসম চুক্তি সংশোধন, প্রকল্পগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন, আইসিটি খাত–সম্পর্কিত নীতি বাস্তবায়ন।

খসড়াটি সম্পাদনা করেছেন আইসিটি বিভাগের নীতি পরামর্শক (সমন্বয় ও সংস্কার) ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আজ রোববার খসড়াটি বিশেষজ্ঞ মতামতের জন্য পাঠানো হবে। অংশীজনদের সঙ্গে আগামী দুই মাস খসড়াটি নিয়ে আলোচনা হবে। পরে জনসাধারণের মতামতের জন্য তা উন্মুক্ত করা হবে। চলতি বছরের মাঝামাঝি কৌশলটি (স্ট্র্যাটেজি) চূড়ান্ত হতে পারে।

খসড়া পথনকশায় যেসব পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে আছে—আন্তপরিচালনাযোগ্য ডিজিটাল অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা। সাইবার নিরাপত্তা ও ডেটা গভর্ন্যান্স শক্তিশালীকরণ। কার্যকর সেবা প্রদানের জন্য আইসিটি বিভাগের সংস্কার। নাগরিক ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য ডিজিটাল পরিষেবা সম্প্রসারণ করা। একটি সমৃদ্ধ ডিজিটাল অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী ইকোসিস্টেম গড়া। অন্তত ৮০ লাখ দক্ষ আইসিটি জনবল গড়ে তোলা। ২০২৭ সালের মধ্যে ২০ হাজার ও ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ হাজার সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ গড়ে তোলা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পোশাক খাতের শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়ানো। সরকার, প্রশাসন ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হস্তক্ষেপমুক্ত ডেটা গভর্ন্যান্স নিশ্চিত করতে সুপ্রিম কোর্টের অধীন একটি স্বাধীন উপাত্ত ও এআই কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা। আইনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ ও সুশাসন নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেসকো) মডেল অনুসরণ করা।

খসড়া অনুযায়ী, প্রথম ধাপের (২০২৫-২০২৬) অগ্রাধিকারে আছে ২০২৬ সালের মধ্যে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন ডেটা আদান-প্রদানে বাংলাদেশ জাতীয় ডিজিটাল আর্কিটেকচার (বিএনডিএ) চালু করা। একটি জাতীয় ডেটা এক্সচেঞ্জ তৈরি করা। ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা আইন বাস্তবায়ন করা। জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা টাস্কফোর্স তৈরি করা। সরকারের ই-সেবাকে আরও ত্বরান্বিত করা। ডিজিটাল অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করা, যেখানে ইউনিভার্সাল পেমেন্ট গেটওয়ে চালু হবে।

দ্বিতীয় ধাপের (২০২৭-২০২৮) অগ্রাধিকারে আছে ডিজিটাল অবকাঠামোগত উন্নয়ন। অর্থাৎ পুরোপুরিভাবে ফাইভ-জি প্রযুক্তি ও ফাইবার অপটিক ব্রডব্যান্ড চালু। জাতীয় ক্লাউডনীতিসহ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক পরিচয় যাচাই। সাইবার নিরাপত্তা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক নীতি প্রণয়ন।

তৃতীয় ধাপের (২০২৯-২০৩০) অগ্রাধিকারে আছে পরিপূর্ণ ডিজিটাল অর্থনীতি ও স্মার্ট সরকার প্রতিষ্ঠা। যেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে আইসিটি খাতে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের হাব হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়টি।

খসড়া অনুযায়ী, সংস্কার প্রক্রিয়া ন্যাশনাল ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন টাস্কফোর্সের তত্ত্বাবধানে হবে, যা আইসিটি বিভাগ বাস্তবায়ন করবে। কারিগরি সহায়তা দেবে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি)। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোও এই প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধান করবে। পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকবে। এ ছাড়া উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো অর্থসহ বিভিন্ন সহযোগিতা দেবে।

সংস্কারের অংশ হিসেবে আইসিটি বিভাগের কিছু উদ্যোগের কথা আছে খসড়ায়। এর মধ্যে আছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) সহায়তায় তৈরি আইসিটি ‘মাস্টারপ্ল্যান’ (মহাপরিকল্পনা)-এর ওপর অংশীজন বৈঠক।

খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, অপটিক্যাল ফাইবার ও নেটওয়ার্ক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে। ২০১৭ সাল থেকে সামিট কমিউনিকেশনস ও ফাইবার অ্যাট হোম নামের দুটি প্রতিষ্ঠান বিসিসির ফাইবার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু এই নেটওয়ার্কের ডিজিটাল মানচিত্র প্রতিষ্ঠান দুটি দেয়নি। এ ছাড়া বিসিসির সঙ্গে প্রতিষ্ঠান দুটির ৯০: ১০ হারে অসম রাজস্ব ভাগাভাগির চুক্তি ছিল। এসব জায়গায় সংস্কার হবে।

ডেটা সেন্টার সম্প্রসারণ ও সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথা আছে খসড়ায়। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার কোম্পানি পুনর্গঠন করা হবে। বিগত সরকার ওরাকল নামের কোম্পানির সঙ্গে ১৮ মিলিয়ন ডলারের যে চুক্তি করেছিল, তা জাতীয় স্বার্থবিরোধী। এই চুক্তি সংশোধন করা হবে।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত সফটওয়্যার পার্কগুলোর ট্রেনিং সেন্টার চালু করতে ব্র্যাক ও আস–সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে চুক্তির কাজ চলছে বলে খসড়ায় উল্লেখ আছে।

খসড়ায় বলা হয়েছে, বিসিসি, আইসিটি অধিদপ্তর, এটুআই (এজেন্সি টু ইনোভেট) পুনর্গঠন ও আইসিটি বিভাগের প্রকল্পগুলো পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। আইসিটি খাতের দুর্নীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের জন্য একটি কমিটি কাজ করছে।

আইসিটি বিভাগের বেশ কিছু উদ্যোগের পুনরাবৃত্তি রয়েছে উল্লেখ করে খসড়ায় বলা হয়েছে, এগুলো নতুন করে বিবেচনায় আসবে। সে হিসেবে আইডিয়া প্রকল্প ও স্টার্টআপ বাংলাদেশ এক হয়ে যাবে। জাতীয় ডেটা সেন্টার ও বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার কোম্পানি এক হবে। এ ছাড়া আইসিটি বিভাগের অধীন সংস্থাগুলোর মধ্যে একই ধরনের ভিন্ন প্রকল্প থাকলে সেগুলো একত্র (মার্জ) করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক ত র ম ব দ ধ মত ত প রকল প র জন য খসড় য় খসড় ট আইস ট সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে গুরুত্ব আরোপ

কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কার্যত সামরিক সংঘাতে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। এ পরস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে ফোন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। বুধবার দুজনকে করা এ ফোন কলে তিনি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া উত্তেজনা কমানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এছাড়া দুই 

ফোনালাপের বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে দেওয়া পৃথক বিবৃতিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় মার্কো রুবিও বলেন, তিনি পেহেলগাম হামলায় নিহতদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছেন এবং যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। 

তবে তিনি আরও বলেন, ভারত যেন পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করার আগে সতর্ক থাকে, কারণ এখনও পর্যন্ত ভারত এই হামলায় পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার কোনও প্রমাণ প্রকাশ করেনি।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস এক বিবৃতিতে বলেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণহানির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনা কমাতে এবং শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে ভারতকে পাকিস্তানের সঙ্গে কাজ করার জন্য বলেছেন।

পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস বলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে ফোনালাপে রুবিও- ২২ এপ্রিল ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পর্যটন কেন্দ্র পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।

তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, রুবিও এই অযৌক্তিক হামলার তদন্তে পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন।

জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ বলেন, ভারতের উস্কানিমূলক আচরণ শুধু উত্তেজনাই বাড়াচ্ছে এবং পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টাকে বিভ্রান্ত করছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান, যেন তারা ভারতের ওপর দায়িত্বশীল আচরণ ও ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাপ প্রয়োগ করে।

এর আগে গত ২২ এপ্রিল মঙ্গলবার বিকেলে কাশ্মীরের পেহেলগাম জেলার বৈসরণ তৃণভূমিতে বন্দুকধারীদের হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত হন, যাদের প্রায় সবাই পর্যটক। হামলার দায় স্বীকার করে রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট নামে একটি সংগঠন। এটিকে পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়্যেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে মনে করা হয়।

এ ঘটনায় আরও বেশ কয়েকজনকে আহত হন। যাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, তারা সবাই পুরুষ। বস্তুত, ২২ এপ্রিলের হামলা ছিল ২০১৯ সালের পুলোয়ামা হামলার পর জম্মু ও কাশ্মীরে সবচেয়ে বড় প্রাণঘাতী হামলা। বর্তমানে এ ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।

পেহেলগামের ভয়াবহ ওই হামলার জেরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। দুই দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে ভারত। জবাবে সিমলা চুক্তি স্থগিত ও ভারতীয় বিমানের জন্য নিজেদের আকাশসীমা বন্ধের ঘোষণা দেয় পাকিস্তান।

তাছাড়া, হামলার পরে দুই দেশই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের ভিসা বাতিল করে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। সূত্র-এএফপি 

সম্পর্কিত নিবন্ধ