বই ছাপা হলেও পড়ানো হয় না সাদরিভাষী শিক্ষার্থীদের, শিক্ষক নিয়োগের দাবি
Published: 21st, February 2025 GMT
প্রাক্–প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত নিয়মিতভাবে সাদরি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করে আসছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। পাঠানোও হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ সাদরিভাষী ক্ষুদ্র জাতিসত্তা–অধ্যুষিত অন্য জেলাগুলোতে। তবে এসব বই পড়তে পারছে না খোদ সাদরিভাষী শিশুরাও। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ওঁরাও, মুন্ডা, রাজোয়ারসহ কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ এ সাদরি ভাষায় কথা বলে।
২০১৭ সালে প্রাক্–প্রাথমিক ও ২০১৮ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সাদরি ভাষায় বই প্রকাশ করা হচ্ছে জানিয়ে এনসিটিবির গবেষণা কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এনসিটিবির দায়িত্ব পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন পর্যন্ত। মাতৃভাষায় শিক্ষা বাস্তবায়নের দায়িত্ব প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের। মাতৃভাষায় সাদরিভাষী শিশুদের পড়ানো হচ্ছে না, এটা আমাদের জানা নেই।’
এ বিষয়ে কথা হয় রাজশাহীর কল্যাণী মিনজি, নওগাঁর বঙ্গপাল সরদার ও সিরাজগঞ্জের যোগেন্দ্রনাথ সরকারের সঙ্গে। তাঁরা সাদরিভাষী শিশুদের পাঠ্যবই উন্নয়ন, অভিযোজন ও ভাষান্তরের সঙ্গে যুক্ত এবং ওঁরাও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তাঁদের মতে, বই প্রকাশের আগেই পরিকল্পনা করা উচিত যে এসব বই কীভাবে পড়ানো হবে। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকায় সাদরিভাষী শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। এটি সম্ভব না হলে সাদরিভাষী খণ্ডকালীন শিক্ষক অথবা নিয়োগ করা বাঙালি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। কেননা বইগুলো বাংলা হরফেই লেখা হয়েছে।
বঙ্গপাল সরদারের দাবি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর, নাচোল ও সদর উপজেলায় সাদরিভাষী ওঁরাও, মুন্ডা, মাহাতো, রাজোয়ারসহ অন্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রায় ১০০টি গ্রাম আছে। এসব গ্রামের শিশুরা মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মাতৃভাষার অনেক শব্দ, সংস্কৃতি কিংবা পালাপার্বণ তাদের কাছে অজানা। ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে। অথচ এ দেশে অন্য জাতিসত্তার মানুষদের ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষা হবে না, এটা ভাবা যায় না।
সংশ্লিষ্ট শিশুরা মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মাতৃভাষার অনেক শব্দ, সংস্কৃতি কিংবা পালাপার্বণ তাদের কাছে অজানা। ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে। অথচ এ দেশে অন্য জাতিসত্তার মানুষদের ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষা হবে না, এটা ভাবা যায় না। বঙ্গপাল সরদার, সাদরিভাষী শিশুদের পাঠ্যবই উন্নয়ন, অভিযোজন ও ভাষান্তর বিশেষজ্ঞগত বুধবার নাচোলের মুন্ডা ও ওঁরাও–অধ্যুষিত এলাকা ফুলকুঁড়ি গ্রামে ‘ফুলকুঁড়ি নবযুগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ এবং বরেন্দা গ্রামের ‘বরেন্দা লালজাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ গিয়ে দেখা যায়, এই দুই বিদ্যালয়ে সাদরি ভাষার কোনো বই আসেনি। কারণ জানতে চাইলে ফুলকুঁড়ি নবযুগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রুমি মোস্তারী বলেন, শিক্ষা কর্মকর্তা সাদরি ভাষার বইয়ের চাহিদা পাঠাতে নির্দেশ দেন। তবে এবার নির্দেশ পাননি। এ ছাড়া সাদরিভাষী শিশুরা ওই ভাষার বই পড়তে চায় না। তাই চাহিদা পাঠাননি, আর বইও আসেনি। অন্যদিকে বরেন্দা লালজাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিয়ামত উল্লাহ বলেন, ‘শিশুরা আগ্রহ দেখায় না। তাই বইয়ের চাহিদা পাঠাইনি।’
তবে ভিন্ন কথা জানায় এসব বিদ্যালয়ের কয়েকজন সাদরিভাষী শিক্ষার্থী। তারা বলে, মাতৃভাষায় পড়ানো হলে তারা পড়তে চায়। এ ভাষায় যে বই আছে, তা–ই তারা জানে না। নাচোল উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মৃণাল কান্তি সরকার বলেন, বিদ্যালয়গুলো থেকে শিক্ষকেরা এবার সাদরি ভাষার বইয়ের কোনো চাহিদা পাঠাননি। তাই এবার নাচোল উপজেলায় সাদরি ভাষার কোনো বই আসেনি।
অন্যদিকে গোমস্তাপুর উপজেলার দেওপুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিদ্ধিগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সুবইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বসনইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বেগপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব বিদ্যালয়ে সাদরি ভাষার বই এলেও প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় পাঠদান করা হয় না। দেওপুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজনি খাতুন আজ বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীর বেশির ভাগই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার। তবে আমাদের শিক্ষকের সংখ্যা কম। প্রশিক্ষণও নেই। তাই পড়ানো সম্ভব হবে কি না, বলা যাচ্ছে না।’
সাদরি ভাষায় বই ছাপানো এবং শিক্ষার্থীদের হাতে যাওয়া—মাতৃভাষায় শিক্ষার ক্ষেত্রে এটি এক ধাপ অগ্রগতি বলে মনে করি। ধাপে ধাপেই কাজ এগোয়। শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিষয়টি পরিকল্পনায় নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।মো.জেছের আলী, জেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা
ওঁরাওদের সামাজিক সংগঠন দিঘরী পরিষদ গোমস্তাপুর উপজেলা শাখার রাজা জহরলাল এককা প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষার দাবি সরকার ২০১৫ সালেই মেনে নেয়। কিন্তু আজও সেটা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। আসলে আমরা চরম অবহেলার শিকার।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো.জেছের আলী জানান, ‘সাদরি ভাষায় বই ছাপানো এবং শিক্ষার্থীদের হাতে যাওয়া—মাতৃভাষায় শিক্ষার ক্ষেত্রে এটি এক ধাপ অগ্রগতি বলে মনে করি। ধাপে ধাপেই কাজ এগোয়। শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিষয়টি পরিকল্পনায় নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ইনব বগঞ জ ভ ষ র বই স দর ভ ষ য় স দর এসব ব সরক র উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
বিহারের ভোটার তালিকা নিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট: ‘মৃত’ নন জীবিত এমন ১৫ জনকে হাজির করলে ব্যবস্থা
বিহারে খসড়া ভোটার তালিকায় ‘মৃত’ চিহ্নিত ১৫ জন জীবিতকে হাজির করাতে পারলে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ব্যবস্থা নেবেন। বিহারের ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে মামলাকারীদের আইনজীবীদের এ আশ্বাস দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট।
সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি সূর্য কান্ত ও জয়মাল্য বাগচী এ আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। গণহারে ভোটার বাদ দেওয়া দেওয়া হলে তাঁরা অবশ্যই পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
আবেদনকারীদের উদ্দেশে দুই বিচারপতি বলেছেন, প্রক্রিয়ায় অনিয়ম বা ত্রুটি পাওয়া গেলে অবশ্যই তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন।
মামলাকারীদের আবেদন মেনে সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য খসড়া ভোটার তালিকা পেশ করার ওপর স্থগিতাদেশ দেননি। তবে ইসিকে তাঁরা বলেছেন, তাদের কাজ গণহারে ভোটার বাদ দেওয়া নয়। তাদের দেখা উচিত যাতে গণহারে ভোটারদের তালিকাভুক্ত করা যায়।
এসআইআর–প্রক্রিয়া অনুযায়ী ভোটার তালিকা সংশোধনের পর খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হবে ১ আগস্ট। সে লক্ষ্যেই ইসি এগিয়ে চলেছে। ইসি সূত্রে খবর, নিবিড় সংশোধনপ্রক্রিয়ার পর প্রাথমিকভাবে দেখা যাচ্ছে ৬৫ লাখেরও বেশি নাম খসড়া তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছে। তাঁদের মধ্যে অন্তত ২২ জন ‘মৃত’, ৩৬ লাখ ‘নিখোঁজ’। এ ছাড়া বেশ কয়েক লাখ ভোটারের নাম বিভিন্ন এলাকার তালিকায় রয়েছে। অর্থাৎ একই ভোটার অন্তত দুই জায়গায় নথিভুক্ত। আগের তালিকা অনুযায়ী বিহারে মোট ভোটারের সংখ্যা ৭ কোটি ৮৯ লাখ। ইসির দাবি, এই তালিকায় বহু ভোটার ভুয়া। তাদের বাদ দিতেই এই নিবিড় সংশোধন।
যে প্রক্রিয়ায় এই খসড়া তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে, মামলাকারীদের আপত্তি তা নিয়েই। তাঁদের অভিযোগ, ইসি যেভাবে নাগরিকত্বের যাচাই করছে, সে জন্য যেসব নথি পেশ করতে বলা হচ্ছে, তা বহু ক্ষেত্রে সম্ভবপর নয়। তেমন করা তাদের কাজও নয়। সেই কাজ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। তাঁদের অভিযোগ, এভাবে বহু দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের ভোটাধিকার ইসি কেড়ে নিচ্ছে।
গত সোমবার ও মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার শুনানি হয়। মঙ্গলবারের শুনানিতে মামলাকারীদের আইনজীবী কপিল সিব্বাল ও প্রশান্ত ভূষণকে আশ্বস্ত করে বিচারপতিরা বলেন, কমিশনের ত্রুটি–বিচ্যুতি দেখলে তাঁরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন। ভোটার প্রমাণে আধার কার্ড ও ভোটার কার্ডকে নথি হিসেবে গ্রাহ্য করার সুপারিশ বিচারপতিরা জোরের সঙ্গে করেছেন। এই দুই নথি জাল করা সহজ বলে ইসির দাবি নস্যাৎ করে বিচারপতিরা বলেছেন, যে ১১টি নথির ওপর নির্ভর করে তারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সেগুলোর প্রতিটিই জাল করা সম্ভব। কপিল সিব্বাল ও প্রশান্ত ভূষণকে বিচারপতিরা বলেন, খসড়া ভোটার তালিকায় ‘মৃত’ অথচ আসলে জীবিত, এমন ১৫ জনকে আপনারা হাজির করুন। আমরা ব্যবস্থা নেব।
আগামী ১২ ও ১৩ আগস্ট এই মামলার পরবর্তী শুনানি। তার আগে ৮ আগস্টের মধ্যে মামলাকারীদের বক্তব্য লিখিতভাবে আদালতে পেশ করতে হবে।