এআইইউবি’র ২২তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত
Published: 23rd, February 2025 GMT
আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশের (এআইইউবি) ২২তম সমাবর্তন শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মো. সাহাবুদ্দিনের সম্মতিক্রমে অর্থ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এবং গ্র্যাজুয়েটদের মাঝে সনদ বিতরণ করেন।
বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড.
সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন এআইইউবির ট্রাস্টি বোর্ডের সম্মানিত চেয়ারম্যান ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নাদিয়া আনোয়ার, এআইইউবি’র ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম এবং প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহমান।
এআইইউবি’র ২২তম সমাবর্তনে বিভিন্ন অনুষদের মোট ২,৫৪৭ জন শিক্ষার্থীকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া, বিভিন্ন বিষয়ে কৃতিত্বপূর্ণ ও সর্বোত্তম ফলাফল অর্জনকারী মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে পদক ও সম্মাননা প্রদান করা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে চ্যান্সেলর স্বর্ণপদক ৩টি, সুম্মা কাম লাউড (স্বর্ণ) ৭৯টি, ডা. আনোয়ারুল আবেদীন লিডারশিপ পদক ২০টি, ম্যাগনা কাম লাউড (রৌপ্য) ১২৮টি, ভাইস চ্যান্সেলর পদক ২৩টি, কাম লাউড (ব্রোঞ্জ) ৩৯টি।
নবীন গ্র্যাজুয়েটদের অভিনন্দন জানিয়ে অর্থ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘শিক্ষা সমতা আনয়নের বড় হাতিয়ার। শিক্ষা না থাকলেও অর্থ অর্জন করা যায়, কিন্তু শিক্ষা থাকলে তা কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে না। শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা কেউ কেড়ে নিতে পারে না। গ্র্যাজুয়েটরা প্রথমে নিজেদের পরিবারের প্রতি নজর রাখবেন, দেশের প্রতি নজর রাখবেন এবং মানুষের প্রতি যত্নশীল হবেন। শিক্ষকদের মান ও আন্তরিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি এআইইউবি’কে ধন্যবাদ জানাই, কারণ তারা এটি অর্জন করতে পেরেছে।’’
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ এআইইউবি’র সমাবর্তনে অংশগ্রহণকারী গ্র্যাজুয়েটদের অভিনন্দন জানান।
তিনি ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘‘ভালো-মন্দ সবাই বিচার করতে পারে; তবে যারা শিক্ষায় আলোকিত, তারাই ভালোভাবে বিচার করতে পারে।’’
সমাবর্তন বক্তা অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান নতুন গ্র্যাজুয়েটদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘‘সমাজকে আমরা কীভাবে ন্যায়ের পথে, মুক্তির পথে, স্বাধীনতার পথে পরিচালিত করতে পারি, সেই শিক্ষা আমাদের নেওয়া উচিত। আমি জেনে খুব আনন্দিত হলাম যে, এআইইউবি ২২টি সমাবর্তন সফলভাবে সম্পন্ন করেছে।’’
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘সমাজে বিশ্ববিদ্যালয় কখনো প্রাইভেট হয় না; বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে দশের সম্পত্তি।’’
এআইইউবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নাদিয়া আনোয়ার সকল স্নাতকের প্রতি তার স্বাগত বক্তব্যে বলেন, ‘‘জীবনে তোমরা যেখানেই থাক, এআইইউবি তোমাদের জন্য উৎসাহ জোগাবে, তোমাদের সাফল্য উদযাপন করবে এবং যখন প্রয়োজন হবে, তখন পাশে থাকবে।’’
এআইইউবি’র ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম শিক্ষার্থীদের তার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘‘আমাদের গ্র্যাজুয়েটদের সাফল্যে আমরা গর্বিত। এই আনন্দ ও সাফল্যের মুহূর্তে, আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন তোমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করেন এবং চূড়ান্ত সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান।’’
এআইইউবি’র প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহমান সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আগত শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও আমন্ত্রিত অতিথিদের উদ্দেশে ধন্যবাদ জ্ঞাপন বক্তব্যে বলেন, ‘‘এআইইউবি’র পক্ষ থেকে আমরা সকল শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও অতিথিদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, যারা আজ তাদের উপস্থিতির মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানকে সম্মানিত করেছেন।’’
সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন এআইইউবির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ড. হাসানুল আবেদীন হাসান, ইশতিয়াক আবেদীন ও ট্রাস্টি বোর্ডের সকল সদস্যরা, সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যরা, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের কর্মকর্তারা, আমন্ত্রিত অতিথিরা, এআইইউবির ট্রেজারার, ডিন, রেজিস্ট্রার, শিক্ষক, কর্মকর্তা, ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক ও গণমাধ্যমকর্মীরা।
ঢাকা/রাজীব
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স ফল য সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
আমার জন্মঋতু
আমি বন্ধনহীন মৌসুমী বায়ু—, ভ্রমি দেশে দেশে দেশে
শেষে পৌঁছেছি এনে আমার প্রিয় বাংলাদেশে।
তোমার স্পর্শ পেয়ে পেয়ে আমাকে ঝরতে হবে জানি।
তোমার প্রতিটি নদী-নালা, পথ-ঘাট, পুকুর-প্রান্তর,
খাল-বিল, গুহা-গিরি আমাকে করতে হবে জানি।
শরৎ আসার পরে আমাকে মরতে হবে জানি।
(বর্ষার মতো প্রেমিক)
প্রতিটি বর্ষায় আমি কিছু না কিছু কবিতা লিখি। আমাদের পত্রিকাগুলো বর্ষার ওপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। ওই সব পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদকদের মধ্যে কেউ কেউ আমার কাছে বর্ষার ওপর রচিত নতুন কবিতা চান। আমি পারতপক্ষে তাদের নিরাশ করি না। বিষয়ভিত্তিক কবিতা রচনায় আমার মন আজকাল আগের মতো সাড়া দেয় না। তবে বর্ষার কথা ভিন্ন। বর্ষার আগমনে আমার কবিচিত্ত মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা ব্যাঙের মতোই মহানন্দে আত্মপ্রকাশ করে তার প্রিয় সঙ্গমসঙ্গিনীকে খুঁজে বেড়ায়। ফলে প্রতিটি বর্ষায়, তা কোনো পত্রিকা আমার কাছে বর্ষার ওপর কবিতা চান বা না চান, আমি লিখি।
না লিখে পারি না আমার কবিতার সতর্ক পাঠক যদি থেকে থাকেন, তো মানলেন যে, আমার কবিতায় যে ঋতুটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছে, বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে, তার নাম বর্ষা। আমার আরেক প্রিয় ঋতু হলো বসন্ত। বাংলার অন্য সকল কবির মতোই বসন্তেও আমি কম উন্মাদ হই না। তবে বর্ষার তুলনায় কম। এর কারণ, নিশ্চিত জানি আমার জন্মের মধ্যে নিহিত। বর্ষা আমার জন্মসূত্রে পাওয়া ঋতু। আষাঢ় মাসের সপ্তম দিনের এক বৃষ্টিঝরা সকালে আমার জন্য হয়েছিল। এ শুধুই আমার শোনা কথা নয়, আমার স্মৃতিকথাও। আমি কান পাতলেই আমার জন্মগ্রামের আকাশ কালো করে নামা সেই আষাঢ়ীবর্ষণের মার্গসংগীতধ্বনি এখনো স্পষ্ট শুনতে পাই।
বর্ষার ওপর রচিত আমার কবিতাসমূহের একটি পৃথক কাব্যসংকলন আমি প্রকাশ করেছি। বসন্তের ওপরও একটি কাব্যসংকলন আছে। তবে বর্ষার ওপর লেখা আমার কবিতার সংখ্যা যেমন বেশি, মান বিচারেও তারা অধিক গুণী। যে কবিতাটি ওপরে উদ্ধৃত করেছি, কোনো পত্রিকার সাহিত্য পাতার চাহিদা পূরণের জন্য নয়, বর্ষাসিক্ত কবিচিত্তের অন্তর্গত চাহিদা মেটাতেই সেটি সম্প্রতি রচিত হয়েছে। কবিতাটিতে বাংলাদেশকে কল্পনা করা হয়েছে গ্রীষ্মতপ্ত প্রেয়সীরূপে, কবি যেন বিরহী যক্ষ। মৌসুমি বায়ুরূপে বিশ্বভ্রমণ শেষে সে ফিরে এসেছে তার প্রেয়সীর দেহসীমায়। যক্ষপ্রিয়ার দেহের সকল তৃষিত অঞ্চলে সে ঢালবে তার সঙ্গে করে নিয়ে আসা মেঘজলধারা। আকাশ কাঁপিয়ে, শুকনো মাটি ভিজিয়ে নামবে বৃষ্টি। অবিচ্ছিন্ন লয়ে বাংলার তপ্তশুষ্ক মাটি আর মেঘভারেনত আকাশকে সে বেঁধে দেবে অন্তহীন অঝোর বর্ষণে।
এ হচ্ছে সেই বৃষ্টি, যা হয়েছিল নূহের প্লাবনের সময়; এ হচ্ছে সেই বৃষ্টি, মানবমনের ভেতরের সুপ্ত কাম ও বিরহবোধকে যে জাগ্রত করে, ববীন্দ্রনাথের মতো নমিতকামের কবিও তখন বিশ্বাস করেন—এমন দিনেই তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়, এ হচ্ছে সেই বৃষ্টি, পবিত্র বেদে যাকে কল্পনা করা হয়েছে মহান মৃত্যুর সঙ্গে। এ হচ্ছে সেই বৃষ্টি, কবি শহীদ কাদরী যাকে তুলনা করেছেন সন্ত্রাসের সঙ্গে।
আমার জীবনের প্রথম ষোল বছর প্রায় অবিচ্ছিন্নভাবে আমি আমার জন্মগ্রামে কাটিয়েছি। শহরে যারা জন্মগ্রহণ করেন তাদের জন্মকে সামান্যতম খাটো না করেও বলি, গ্রামে জন্মগ্রহণ করার জন্য আমি নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান বলে মনে করি। প্রকৃতির সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক, তাকে যে আমি খুব কাছের করে চিনেছি, আপন বলে জেনেছি, সেটা সম্ভব হয়েছে অবিচ্ছিন্নভাবে আমি আমার শৈশব-কৈশোর গ্রামের বন-জঙ্গলে কাটাতে পেরেছি বলেই। বাংলার ষড়ঋতুর রূপবৈচিত্র্যকে আমি খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করার যে সুযোগ পেয়েছি, তাকে আমি যে আমার কবিতায় সেভাবে ধরতে পারিনি, তার জন্য দায়ী আমার প্রয়োজনীয় কারাশক্তির অভাব। সে কারণে আমার আত্মগ্লানি আছে বটে, কিন্তু তার নিবিড় সান্নিধ্যলাভের স্মৃতি আমার চির গৌরবের ধন। প্রকৃতিকে আমি কখনো পেয়েছি প্রেয়সীরূপে, কখনো দেখেছি জননীরূপে। আমি বুঝেছি, তার সঙ্গে আমার অস্তিত্ব এক অন্তহীন লীলায় জড়ানো। ফলে বলা যায় একেবারে খোলা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে বর্ষার আগমন, অবতরণ ও তার প্রত্যাগমনকে দেহেমনে মিলিয়ে খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। গুনেছি আকাশে আকাশে মেয়ের গুরুগুরু ডাক। বুঝেছি, গ্রীষ্ম-অবসানে আসছে আমার। জন্মসহোদর, আমার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু বর্ষা। আসছে আষাঢ়। আমার বেসুরো কণ্ঠেও লতিয়ে উঠেছে গান— 'আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে।' আহ, কী চমৎকার।
বর্ষা আমাকে খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তার সঙ্গে করে। দু কূল প্লাবিত করা নদীর আনন্দে, মাঠে-ঘাটে, ঝালে-বিলে, পুকুরে প্রান্তরে আমি বর্ষাকে তার জলজগৎ বিস্তার করতে দেখেছি। সে আমার কানে কানে বলেছে, আমি কীভাবে আমার দেশপ্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গম করি দেখো। আমি দেখেছি। প্রাণ ভরে
দেখেছি বর্ষার রূপ।
আমি যখন এই বর্ষাবন্দনা লিখছি, তখন আষাঢ় গত হয়েছে। চলছে শ্রাবণ। শ্রাবণের পুরোটাই সামনে পড়ে আছে। বলা যায় এখন বর্ষার ভরা যৌবন। ঢাকায় বসে তার রূপ দেখছি টিভির পর্দা আর পত্রিকার পাতায়। তার প্রকৃত চেহারাটা দেখতে পাচ্ছিনে এখানে। এই নিয়ে কবিতাও লিখেছি। গ্রামে ছোট ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম, বর্ষা, কতটা জাঁকিয়ে বসেছে সেখানে। সে জানিয়েছে, যদি বর্ষা বিষয়ে নতুন করে কিছু লিখতেই চাও তো গ্রামে চলে এসো। বর্ষা দেখে যাও। আজ তিন দিন হলো দিন-রাত বৃষ্টি। নদী-নালা, মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর ডুবিয়ে সে মেলে ধরেছে তার চোখজুড়ানো রূপ। আমি চোখ বন্ধ করে, কল্পনায় তার রূপ দেখলাম। মনে পড়ল, কত অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লীজননী।
বাংলার কবির কাছে, কবির চোখে বর্ষার কি আলাদা কোনো রূপ আছে? এর উত্তর সহজ নয়। জীবনানন্দ বলেছেন—সকলেই পবি নয়, কেউ কেউ করি। তার এই স্মরণীয় উক্তিটি ছোট কবিদের ভিড় থেকে বড় কবিদের পৃথক করার প্রয়োজন মেটায়। কিন্তু প্রকৃতির রাজ্যে সব মানুষই যে কমবেশি করি, আমার এই উপলব্ধিকে বাতিল করে না। বাংলার লোককবিদের রচিত কাব্যে, গানে তারই পরিচয় দেখতে পাই। অন্য কবিদের জন্মকথা বলতে পারিনে, তবে আমার কবিজন্ম যে বর্ষামায়ের গর্ভে, সে কথা না বললে নিশ্চিত জানি, স্বর্ণে বসে চিত্রগুপ্ত অকৃতজ্ঞের তালিকায় আমার নামটিও লিপিবদ্ধ করবেন।