‘শ্যামলতার মৃত্যুশিথান’ গল্পের বই। লিখেছেন ইমতিয়ার শামীম। গল্পগুলোর কেন্দ্রে জীবন-বাস্তবতা, সামাজিক অবক্ষয়, লোভের আবর্ত এবং নীরবে হার মেনে নেওয়ার মতো বিষয়। গভীর পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি রয়েছে মাটি-সংশ্লিষ্টতা। আর রয়েছে নিজস্ব ভঙ্গিমা, যা একজন কথাসাহিত্যিকের সবচেয়ে বড় গুণ।
এই বইয়ের গল্পগুলোতে ফুটে উঠেছে লেখকের অসাধারণ জীবনবোধ। এসব গল্প কখনও সময়ের বয়ান হয়ে উঠেছে। সামাজিক নানা অসংগতি, অন্তরালের জীবন, বৈপরীত্য, রাজনীতি, অর্থনীতির নানা দিক ফুঠে উঠেছে।
বইটিতে সব মিলিয়ে গল্প রয়েছে সাতটি, যেগুলো ভিন্ন ভিন্ন উপজীব্যে বর্ণিত। ‘নির্মাণের প্রাকপর্ব’তে সাদামাটাভাবে জীবনের চিত্র ও অসংগতি উঠে এসেছে। বাবা ও ছেলের সম্পর্ক, জমি-জিরাত, আর্থিক বিষয় নিয়ে পারিবারিক চিত্র এটি। এখানে গল্পের কোনো মিলনাত্মক বা বিয়োগান্ত পরিণতি না থাকলেও ছোট ছোট ঘটনায় জীবন আঁকার চেষ্টা রয়েছে। এক শ্রেণির মানুষ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করে খ্যাতিমান হওয়ার চেষ্টায় থাকেন, এমন একটি বিষয়ও এ গল্পে পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় গল্পটির শিরোনাম ‘যেমত আকাশমাটি, রক্তপ্রলাপ’। এটি জেনারেল এইচএম এরশাদের শাসনামলের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত। পড়লে সে সময়ের বাস্তবতা সম্পর্কে লেখকের বর্ণনা পাওয়া যায়। দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল নিয়ে কথাবার্তা রয়েছে এতে। সুবিধাবাদী রাজনীতিক, বামপন্থি যুবকের দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠেছে গল্পের সূক্ষ্ম গাঁথুনিতে। ঘটনার বর্ণনা মিরাজ নামের চরিত্র দিয়ে শুরু এবং তাকে ঘিরে আবর্তিত হলেও সেখানে বামপন্থি যুবক রুহুলের উপাখ্যান পাঠকের কাছে দীর্ঘশ্বাস হয়ে ধরা দেয়। এহসানউল্লাহর শয়তানি ও মিরাজের বোনের এসিডে ঝলসে যাওয়া জীবন পাঠকের মনে কষ্ট সঞ্চার করে।
‘ঘাসওঠা মাঠে এক সবুজ বালক’ শিরোনামে গল্পে সোলায়মান নামে কিশোরের বৃত্তান্ত রয়েছে। সে ও তার পরিবারের কথা তুলে ধরার মাধ্যমে নতুন মাত্রায় চিত্রিত হয়েছে গ্রামের জীবন। সেখানে সমাজের নানা অসংগতি, ধর্মকে কেন্দ্র করে কুসংস্কার ও সংকীর্ণতা চিত্রিত হয়েছে, বিশেষ করে সোলায়মানের বাবা কোবাদ আলীর জীবনাচরণে। গ্রামের নারীর বঞ্চনাও সূক্ষ্ম তারে বেজে উঠেছে নিপুণ সুরে।
‘ভাতঘ্রাণ নাকে নিয়ে’ গল্পটি ঈমান আলী নামে একটি চরিত্র ঘিরে আবর্তিত। দিনমজুর ঈমানের জীবনের নানা বাস্তবতার ভেতর দিয়ে অতিদরিদ্র বা ছিন্নমূল শ্রেণির মানুষের জীবন-বাস্তবতা, প্রেম-কাম ও সংকট ফুটে উঠেছে। ঈমান এখানে প্রোটাগনিস্ট বা প্রধান চরিত্র হলেও ‘মিজার মা’ ভিন্ন এক আবহের সৃষ্টি করে। সব মিলিয়ে গল্পটিতে ভিন্ন এক সমাজের দৃশ্য রয়েছে।
গল্পের বর্ণনায় প্রকৃতির চিত্র আঁকার চেষ্টা সাবলীল। চিত্রকল্প সজীব হয়ে চোখের সামনে ধরা দেয়। উপাখ্যান পড়লে মনে হয়, আমাদের প্রতিবেশীদের মধ্যেই এসব ঘটছে। সূক্ষ্ম প্রকাশভঙ্গিতে কখনও অনেক গোপন ও গূঢ় সত্যও সহজ-স্বাভাবিক হয়ে উঠে এসেছে। সমাজকে আয়না দেখানোর চেষ্টা এগুলোতে বেশ স্পষ্ট। পুলিশ, জিআরপিসহ নিরাপত্তা বাহিনীর আচরণের নানা দিকেও রয়েছে আলোকপাত। লেখক মাটিসংলগ্ন ভাষার ব্যবহার করে গল্পের উপাখ্যান তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সেখানে ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতি উঠে এসেছে। কখনও পাওয়া গেছে ইতিহাসের খণ্ডচিত্র। কার্যত ‘শ্যামলতার মৃত্যুশিথান’ শেষ পর্যন্ত সমাজচিত্র হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেছে।
বইটিতে আরও রয়েছে ‘দ্রষ্টব্য গয়ালক্ষুধা’, ‘চাঁদকুয়াশার ভোর’ ও ‘নির্ভরতার দুঃখ’ শিরোনামের গল্প। এগুলোর চিত্রকল্প ও জুতসই উপমা বর্ণনাকে প্রাণবন্ত ও জোরালো করেছে।
শ্যামলতার মৃত্যুশিথান, ইমতিয়ার শামীম, প্রসিদ্ধ পাবলিশার্স, প্রচ্ছদ নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, পৃষ্ঠা ১১২, মূল্য ৩০০ টাকা।
তুহিন তৌহিদ, জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, দৈনিক সমকাল
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বইম ল ব স তবত র জন ত র জ বন
এছাড়াও পড়ুন:
প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টে সোনালী মিতুয়ার বাজিমাত
বাংলাদেশের মেকআপ আর্ট জগতে নীরবে নতুনত্ব যোগ করে যাচ্ছেন সোনালী মিতুয়া। তার শৈল্পিক ইলিউশন এবং বডি পেইন্টিংগুলো আন্তর্জাতিক মানের, যা দেখে চোখ ফেরানো দায়। বর্তমানে ফিনল্যান্ডে মেকআপের ওপর উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন এই শিল্পী, যার ক্যানভাসে শৈশবের প্রথম গন্ধ ছিল তেল রং আর থিনারের তীব্রতা। মেকআপ ব্যবহার করে তিনি যে ক্যানভাস তৈরি করেন-তা এক কথায় অনন্য, অসাধারণ।
সোনালী মিতুয়া কখনও তার মুখে ফুটে ওঠে ফাটল ধরা পৃথিবী, যেখান থেকে গজিয়ে ওঠে সবুজ লতা। কখনও দেখা যায় তার মুখটাই এক অর্ধেক যন্ত্র, অর্ধেক প্রকৃতি, যেন মানুষ আর মেশিনের মাঝের এক অদ্ভুত, কাব্যময় দ্বন্দ্ব।আর কখনও সেই মুখটাই অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, শুধু দেখা যায় এক ভয়ঙ্কর কালো গহ্বর — যেন মানুষের শূন্য আত্মা। এগুলো কোনো সিনেমার দৃশ্য না।এগুলো এক তরুণী মেকআপ আর্টিস্টের সৃষ্ট জীবন্ত শিল্পকর্ম।
আরো পড়ুন:
একা বাস করতে পারে যে পাখি
কেউ কটূক্তি করলে কী করবেন?
সোনালী মিতুয়ার মেকআপে একটা গল্প, একটা দর্শন, একটা গভীর বার্তা লুকিয়ে থাকে। যেখানে অধিকাংশ মানুষ মেকআপকে শুধু প্রসাধনের জগতে দেখে, সে সেখানে মেকআপকে তুলেছে এক উচ্চমাত্রার শিল্প হিসেবে। তার হাতে রঙ মানে—চামড়ার ওপরে নয়, বরং আত্মার ভাষা প্রকাশের এক মাধ্যম।
তার কাজে দেখা যায় প্রস্থেটিক মেকআপের প্রভাব— যেখানে মুখ বদলে যায়, গড়ে ওঠে নতুন রূপ, নতুন চরিত্র। এমন কৌশল একদিন তাকে সিনেমার পর্দায় প্রস্থেটিক আর্টিস্ট হিসেবে বড় জায়গায় নিয়ে যাবে—
এ কথা বলার জন্য বিশেষজ্ঞও হতে হয় না।
এই মেয়েটির সবচেয়ে বড় শক্তি তার কল্পনাশক্তি। সে মুখের ভেতরেই ফুটিয়ে তোলে গল্প—একদিকে প্রকৃতি, ফুল, প্রজাপতি; অন্যদিকে প্রযুক্তি, ধ্বংস আর শূন্যতা। দেখলে মনে হয়, এই দুইয়ের টানাপোড়েনেই গড়ে উঠেছে তার শিল্পজগৎ।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য এই মেয়েটি এক অনুপ্রেরণা। সে প্রমাণ করছে—শিল্পের ভাষা যদি শক্ত হয়, তাহলে দেশের সীমা পেরিয়ে বিশ্বেও পৌঁছানো যায়। যেখানে মেকআপকে এখনো অনেকেই কেবল সাজের কাজ মনে করেন, এই মেয়েটি সেখানে দেখিয়েছে — মেকআপও হতে পারে দর্শন, প্রতিবাদ আর সৃষ্টির ক্যানভাস।
তিনি জানেন, প্রস্থেটিক আর্টে (বিশেষত কৃত্রিম অঙ্গ, ক্ষত বা ফ্যান্টাসি চরিত্র তৈরি) করা যায় দক্ষতার সাথে। বর্তমানে বাংলাদেশের সিনেমায় যেখানে প্রস্থেটিকের ব্যবহার খুবই সীমিত, সেখানে সোনালী মিতুয়ার মতো একজন আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিল্পী আছেন, তার হাতেই তৈরি হতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসের চরিত্রদের নিখুঁত রূপ, অথবা আমাদের ফ্যান্টাসি সিনেমার ভিনগ্রহের প্রাণী।
সোনালী মিতুয়ার কাজগুলো দেখলেই বোঝা যায়, তিনি মেকআপকে স্রেফ সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যম হিসেবে দেখেন না, বরং এটিকে একটি শক্তিশালী গল্প বলার হাতিয়ার মনে করেন।
একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন মানুষ প্রকৃতির মাঝে ফাটল ধরা পাথরের মতো এক রূপ ধারণ করেছেন। সবুজ, হলুদ ও লালের মিশ্রণে চোখের অংশটি গভীর এবং রহস্যময়, আর ফাটলের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসা লতা-পাতা জীবনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি তার পরিবেশ-সচেতনতা এবং ফ্যান্টাসি আর্টের দক্ষতা প্রমাণ করে।
সাদাকালো স্কেচের মতো দেখতে এই মেকআপটি অত্যন্ত কঠিন এবং চোখে পড়ার মতো। মুখের প্রতিটি অংশে পেন্সিল বা চারকোল দিয়ে আঁকা হ্যাচিংয়ের মতো স্ট্রোকগুলো ত্রিমাত্রিক চেহারাটিকে দ্বিমাত্রিক কমিক-বুক বা নয়ার চলচ্চিত্রের চরিত্র হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছে।
চোখ ও মুখের চারপাশে মাকড়সার জাল এবং ফুলা, রক্তবর্ণ চোখের পাপড়ি ভীতি ও কষ্টের এক শক্তিশালী অনুভূতি জাগায়। এটি বিশেষ করে হ্যালোইন বা হরর থিমের জন্য পারফেক্ট।
গভীর অন্ধকারে তোলা এই ছবিটি ‘অন্ধকার গহ্বর’ বা ‘কৃষ্ঞগহ্বর’ থিমের একটি চমকপ্রদ ইলিউশন মেকআপ। নিখুঁত কনট্যুরিং এবং রঙের ব্যবহারে মুখের এক অংশে যেন সত্যিই একটি ফাঁকা, গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা/লিপি