‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ মুভিতে রেলস্টেশনে এজেন্ট স্মিথের সঙ্গে নিওর মারামারির দৃশ্য মনে আছে? কিছু মুহূর্তে নিও ও স্মিথের হাত দুটো এত দ্রুত চলেছে যে মনে হয়েছে, দুজনেরই হয়তো কয়েক শ হাত! কাল রাতে চ্যাম্পিয়নস লিগে আলিসন বেকার ও ভয়চেক সেজনিরও বুঝি কয়েক শ হাত গজিয়েছিল! তাঁদের সমর্থকেরা বলতে পারেন, প্রশংসায় এত কৃপণতা কেন? শুধু-ই কী হাত, পা দুটো এমনকি শরীরটাই তো গোলপোস্টের সামনে চীনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
রোমান্টিক সমর্থকেরা সব সময়ই এক কাঠি সরেস। ম্যাচের মধ্যে কল্পচোখে তাঁরা হয়তো দেখেছেন, পোস্টে আসলে আলিসন কিংবা সেজনি নয়, দাঁড়িয়ে নিও-র দুটি রূপ। প্রতিপক্ষ দলের এজেন্ট স্মিথরা যত খুশি শট নিচ্ছেন, আর নিও১ ও নিও২ ম্যাট্রিক্স সিনেমার আঙ্গিকে স্রেফ হাত তুলে সব ঠেকিয়ে দিচ্ছেন! লোকে বলে, ফুটবল গোলের খেলা। বটে! লিসবন ও সেখান থেকে ১৪৫০ কিলোমিটার দূরের শহর প্যারিসে কাল রাতে যে রাতটি নেমে এসেছিল, সেটা তো আসলে গোলকিপারদের রাত। ফুটবল তাই কখনো কখনো গোল না হওয়ার খেলাও।
কেন? সেটুকু বুঝিয়ে দেবে পরিসংখ্যান। লিসবনে ঘরের মাঠে শেষ ষোলো প্রথম লেগে বার্সেলোনার কাছে ১-০ গোলে হেরেছে বেনফিকা। পর্তুগিজ ক্লাবটি ২৬টি শট নিয়েছে, ৮টি সেভ করেছেন বার্সা গোলকিপার সেজনি। ২০০৩-০৪ মৌসুমের পর চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচে বার্সার কোনো গোলকিপারের গোল হজম না করে সর্বোচ্চ সেভের রেকর্ডটি এখন এই পোলিশ গোলকিপারের। অথচ অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন গত অক্টোবরেই। অবসর ভেঙে মাঠে ফিরে ক্যারিয়ারের সেরা ম্যাচ খেলা প্রথম গোলকিপার সেজনি কি না, তা নিয়ে এখন গবেষণা হতে পারে! তবে সেজনির বিশ্বাস, সেরাটা এখনো আসেনি, ‘চিন্তা করবেন না, সেরাটা এখনো বাকি।’
আরও পড়ুনঅবিশ্বাস্য আলিসন, নেমেই গোল এলিয়টের, লিভারপুলের পিএসজি জয়১১ ঘণ্টা আগেসেজনি তাই বলে ন্যায্য পাওনা ছাড়তে নারাজ। ‘ভুল করে’ পেদ্রিকে ম্যাচসেরার পুরস্কার দিলে কী হবে, সেজনি কিন্তু ভাগের কলা ছাড়তে নারাজ। ম্যাচসেরার ট্রফির অন্তত আধখানা ভাগ তাঁর চাই, ‘পেদ্রি ট্রফিটা পেয়েছে। তবে আমার মনে হয়, অর্ধেকটা আমারও।’ দলের ৩৪ বছর বয়সী সিনিয়র নিজ গুণে কোনো কিছু দাবি করে বসলে তাঁর চেয়ে ১২ বছরের ছোট পেদ্রির আর কী করার আছে। সেজনির গুণমুগ্ধ পেদ্রি বরং বলেছেন, ‘সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার ম্যাচসেরার ট্রফিটি সেজনিকে দিয়ে দেব। ড্রেসিংরুমে আমাদের এ নিয়ে কথা হয়েছে। অন্য যে কারও চেয়ে এটা তার বেশি প্রাপ্য। সে সবকিছু ঠেকিয়েছে।’
বার্সা তাঁদের এক্স হ্যান্ডলে সেজনির একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছে, ‘আজকের (গত রাত) ক্লিন শিটের স্পনসর ভয়চেক সেজনি।’ কাতালান ক্লাবটির এক্স হ্যান্ডলের অ্যাডমিন সম্ভবত একটু ভুলোমনা। বার্সায় এসে ১৪ ম্যাচ খেলে সব কটিতেই অপরাজিত থাকা সেজনি এর মধ্যে ক্লিন শিট রেখেছেন ৮ ম্যাচ। অথচ অ্যাডমিন আগের ৭টি ক্লিন শিটে এ নিয়ে টুঁ শব্দটিও করেননি!
কিন্তু সমর্থকেরা তো চুপ করে নেই। পছন্দের খেলোয়াড়দের আগাপাশতলা তাঁদের জানা। সে জন্যই এক্সে দেখা যাচ্ছে এমন অনেক পোস্ট—‘রোমের দুই সাবেক দ্বাররক্ষীর রাত।’ বুঝলেন না? সেজনি ও আলিসন ইতালিয়ান ক্লাব এএস রোমায় সতীর্থ ছিলেন। ২০১৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত আর্সেনাল থেকে ধারে রোমের ক্লাবটিতে কাটিয়েছেন সেজনি। আলিসন ছিলেন ২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত। দুজনে মিলে কাল রাতে কী করেছেন, সেটা বুঝিয়ে দেবে আরও একটি পরিসংখ্যান। ২০১৬-১৭ মৌসুম থেকে এ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউটে মাত্র তিন ম্যাচে অন্তত ২৫টি শট নিয়েও গোল না পাওয়ার নজির দেখা গেছে, যেখানে দুটি ঘটনাই ঘটেছে কাল রাতে—বেনফিকার ২৬ শট ও পিএসজির ২৭ শট।
রোমায় সেজনির কারণে আলিসনকে বেঞ্চে বসতে হলেও কাল রাতে সাবেক সিনিয়র সিটিজেনকে পেছনে ফেলেছেন আলিসন। সেটা সেভ করার সংখ্যায়। ফরাসি ক্লাবটির ২৭ শটের মধ্যে ৯টি সেভ করেন লিভারপুলের এই ব্রাজিলিয়ান গোলকিপার।
আরও পড়ুন১০ জনের বার্সেলোনাকে জেতালেন রাফিনিয়া১১ ঘণ্টা আগেচ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচে লিভারপুলের কোনো গোলকিপারের এটাই সর্বোচ্চসংখ্যক সেভ। লিভারপুলের হয়ে আলিসনের ক্যারিয়ারেও এটি এক ম্যাচে সর্বোচ্চ সেভ এবং ক্লাব ফুটবলে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে তাঁর নিজের ক্যারিয়ারেও এক ম্যাচে সর্বোচ্চ সেভ। চ্যাম্পিয়নস লিগে এবারের মৌসুমে আর কোনো গোলকিপারই ক্লিন শিট রাখার পাশাপাশি এক ম্যাচে ৯টি সেভ করতে পারেননি। আলিসন সেই কাজটিই করেছেন এমন এক দলের বিপক্ষে, যারা কাল রাতের আগে সর্বশেষ ১০ ম্যাচে প্রতিপক্ষের জালে ৪০ গোল করেছে!
ম্যাচ শেষে টিএনটি স্পোর্টসের সঙ্গে আলাপচারিতায় লিভারপুল কোচ আর্নে স্লট তাই বলেই ফেলেন, ‘মনে হয় না, এই পর্যায়ে খেলা অন্য কোনো গোলকিপারের সঙ্গে এর আগে কাজ করেছি, যেটা স্বাভাবিক কারণ সে বিশ্বসেরা। কোচ হিসেবে অনেক ভালো খেলোয়াড় পেয়েছি। কিন্তু বিশ্বের সেরা গোলকিপার কখনো পাইনি এবং আমার মনে হয় সে আজ (কাল রাতে) এটাই দেখাল।’
আলিসন নিজে অবশ্য মনে করছেন, এটাই তাঁর জীবনের সেরা পারফরম্যান্স। মৌসুমের সেরা পারফরম্যান্স কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘হ্যাঁ, সম্ভবত আমার জীবনেরও।’
একই রাতে এক গোলকিপার অবিশ্বাস্য খেলেও বলেন তাঁর সেরাটা এখনো বাকি আছে। সেখান থেকে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে আরেক গোলকিপারের কাছ থেকে দেখা গেল জীবনের সেরা পারফরম্যান্স। এমন একটা রাত আর যা–ই হোক গোলের কিংবা স্ট্রাইকারদের নয়, গোলকিপারদের।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চ য ম প য়নস ল গ স ভ কর স জন র
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচনে জোট গঠনে সতর্ক থাকার পরামর্শ হেফাজত আমিরের
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোট গঠনের ক্ষেত্রে সঙ্গে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী।
মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেছেন, আগামী নির্বাচনে এমন কোনো দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার চিন্তা করা যাবে না, যাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস সম্পর্কে বুজুর্গানে দ্বীন ও পূর্বপুরুষেরা আগেই সতর্ক করেছেন।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘জাতীয় উলামা মাশায়েখ সম্মেলন ২০২৫’–এ লিখিত বক্তব্যে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী এ কথা বলেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের উদ্যোগে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন হেফাজত আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও অসুস্থ থাকায় তিনি কথা বলেননি। তাঁর লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা তোফাজ্জল হক আজিজ।
ইসলামের মূলধারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমন কোনো সিদ্ধান্ত না নিতে দলগুলোকে অনুরোধ জানিয়ে লিখিত বক্তব্যে হেফাজত আমির বলেন, সহিহ আকিদার সব ইসলামি দলকে এক হওয়ার জন্য আগেও তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মতো তেমন পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, একদিকে যেমন ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার ষড়যন্ত্র চলছে, অন্যদিকে তেমনি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে বহু রকম চক্রান্ত লক্ষ করা যাচ্ছে। গণ–অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশে এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, তা তিনি কল্পনাও করেননি।
অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে উদ্দেশ করে বাবুনগরী বলেন, ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অফিস স্থাপনের চুক্তি দেশের স্বাধীনতার অখণ্ডতার জন্য এবং ধর্মীয় কৃষ্টির জন্য এক অশনিসংকেত। এ চুক্তির তীব্র নিন্দা জানিয়ে তা বাতিল করার দাবিও জানান তিনি।
সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা খলিল আহমদ কুরাইশী। দেশের সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, সামনে কালো তুফান দেখা যাচ্ছে। কালো তুফানের সঙ্গে মোলাকাত নয়, মোকাবিলা করতে হবে। জনগণকে ওলামাদের নেতৃত্ব কবুল করতে হবে। তখনই তুফানকে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহসভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব বলেন, যারা ফ্যাসিবাদী আমলে পাখা দিয়ে নৌকাকে বাতাস করেছে, তাদের সঙ্গে কোনো ঐক্য হবে না। জুলাই আন্দোলন ছিল ভোটের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য। সামনে নির্বাচন। সেই নির্বাচন বানচালের পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। সেই পাঁয়তারা রুখে দিতে হবে।
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ইসলামের বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আলেমদের মতামত উপেক্ষা করলে হাসিনার মতো পরিণতি হবে।
সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক। এ সময় আরও বক্তব্য দেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আলেম এবং ওলামারা।
১৫ দফা প্রস্তাবনা
সম্মেলনে জমিয়তে উলামায়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ১৫ দফা প্রস্তাবনা পেশ করা হয়। প্রস্তাবনা পাঠ করেন সংগঠনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা বাহাউদ্দিন জাকারিয়া।
১৫ দফার মধ্যে আছে—ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় স্থাপনের চুক্তি বাতিল করা, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা, জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীতের শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত বাতিল করা, ঘোষিত সময়ে নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা; নির্বাচনে কালোটাকা ও পেশিশক্তির মহড়া বন্ধ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা; বিতর্কিত নারী কমিশনের সুপারিশ বাতিল ও শরিয়ার সীমারেখার আলোকে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।