আজ খতমে তারাবিহতে পবিত্র কোরআনের মোট দেড় পারা পড়া হবে—অষ্টম পারার শেষ অর্ধেক এবং নবম পারার পুরো অংশ। সুরা আরাফের ১২ থেকে সুরা আনফালের ৪০ আয়াত পর্যন্ত। আদম ও হাওয়া (আ.) দুনিয়ায় আসার ঘটনা, শয়তানের ধোঁকা, লজ্জা, বিভিন্ন জাতি ধ্বংসের কারণ, মুসা (আ.)-এর মোজেজা, অপচয়, নবীরা নিজ নিজ সম্প্রদায়কে কী বলেছিলেন, জবাবে সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় লোকজন কী বলেছিল, ফলে আল্লাহ কী করেছেন, আল্লাহর একত্ববাদের প্রমাণ, বনি ইসরাইলের ওপর আল্লাহর শাস্তি, শয়তানের ধোঁকা থেকে মানুষকে বাঁচার নির্দেশ, মুসা (আ.
শয়তান কেন বিতাড়িত
আজকের তারাবিহর দ্বিতীয় আয়াতেই পড়া হবে আল্লাহর সঙ্গে শয়তানের বাগ্বিতণ্ডার কথা। আল্লাহর সৃষ্টিতে ফেরেশতা ও জিন ছিল মানুষেরও আগে। জিন জাতির সদস্য ছিল ইবলিশ; ছিল আগুনের তৈরি। সে থাকত ফেরেশতাদের সঙ্গে। মন লাগিয়ে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করত। আল্লাহর সৃষ্টিতে তার ইবাদতের আলাপ হতো। তাকে শ্রদ্ধা করত। দুনিয়াতে আল্লাহ মানুষকে প্রতিনিধি বানাতে চাইলেন। আদম (আ.) সৃষ্টি করলেন। আল্লাহ ফেরেশতাদের আদেশ দিলেন, আদমকে সেজদা করতে। ফেরেশতারা সেজদা করল; কিন্তু বেঁকে বসল ইবলিশ। সে আল্লাহর আদেশ অমান্য করল। নিজেকে আগুনের তৈরি বলে অহংকার করল। আল্লাহ তার প্রতি নারাজ হলেন। বের করে দিলেন জান্নাত থেকে।
খাবারে মধ্যপন্থা অবলম্বনই শ্রেয়
সুরা আরাফের ৩১ আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে পরিমাণমতো খাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অপব্যয় নিষেধ করেছেন। এই আয়াতের অধীন মুসলিম পণ্ডিতরা আটটি মাসআলা উদ্ভাবন করেছেন। এক, প্রয়োজনমতো পানাহার করা ফরজ। দুই, শরিয়তে কোনো খাদ্যবস্তু অবৈধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সব বস্তুই হালাল। তিন, আল্লাহ তাআলা ও রাসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক নিষিদ্ধ বস্তুগুলো ব্যবহার করা অপব্যয় ও অবৈধ। চার, যেসব বস্তু আল্লাহ তাআলা হালাল করেছেন, সেগুলো হারাম মনে করাও অপব্যয় এবং মহাপাপ। পাঁচ, পেট ভরে খাওয়ার পরও আহার করা নাজায়েজ। ছয়, এতটুকু কম খাওয়াও অবৈধ, যার ফলে কর্ম সক্ষমতা হারিয়ে যায়। সাত, সব সময় পানাহারের চিন্তায় মগ্ন থাকাও অপব্যয়। আট, মনে কিছু চাইলেই তা অবশ্যই খাওয়া অপব্যয়। (তাফসিরে মারেফুল কোরআন, পৃষ্ঠা ৪৩৮)
আরও পড়ুনরমজানে ছয়টি অভ্যাস১৪ মার্চ ২০২৪আল্লাহ তাআলা কোথায় আছেন
সুরা আরাফের ৫৪ আয়াতে আল্লাহ তাআলা আরশে অধিষ্ঠিত হওয়ার কথা এসেছে। কোরআনে আরও একাধিক জায়গায় এ ব্যাপার এসেছে। আরশ বলা হয় রাজসিংহাসনকে। এখন আল্লাহর আরশ কীরূপ এবং কী? এর ওপর অধিষ্ঠিত হওয়ার অর্থই–বা কী? এ সম্পর্কে বিশুদ্ধ কথা হলো, মানবজ্ঞান আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলির স্বরূপ পূর্ণরূপে অনুধাবন করতে অক্ষম। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেইন এবং পরবর্তীকালের সালাফদের অভিমত এটাই। (৩০ মজলিসে কুরআনের সার নির্যাস, পৃষ্ঠা ৯৮-৯৯)
প্রাচীন ৬ জাতি ধ্বংসের কাহিনি
এ সুরার ৬৫ থেকে ৮৭ আয়াতে প্রাচীন ছয় সম্প্রদায়ের অবাধ্য ও গজবে ধ্বংস হওয়ার আলোচনা রয়েছে।
১. নুহ (আ.)-এর জাতি: মূর্তিপূজা না ছাড়ার কারণে ভয়ংকর বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস দিয়ে নুহ (আ.)-এর জাতিকে ধ্বংস করা হয়েছিল।
২. আদ জাতি: শক্তি ও ক্ষমতার বাহাদুরি এবং মূর্তিপূজা না ছাড়ার কারণে বিভিন্ন আজাব দিয়ে হুদ (আ.)-এর সম্প্রদায় আদ জাতিকে ধ্বংস করা হয়েছিল।
৩. সামুদ জাতি: আল্লাহর নিদর্শন বিশেষ একটি উট হত্যার কারণে ভূমিকম্প দিয়ে সালেহ (আ.)-এর সম্প্রদায় সামুদ জাতিকে ধ্বংস করা হয়েছিল।
৪. লুত (আ.)-এর জাতি: সমকামিতার অপরাধে ভূমি উল্টে পাথর বৃষ্টি দিয়ে লুত (আ.)-এর জাতিকে ধ্বংস করা হয়েছিল।
৫. মাদায়েনবাসী: তওহিদে অবিশ্বাস, মাপে কম দেওয়া, সম্পদ আত্মসাৎ, অর্থনৈতিক অসততা ও মানুষকে ধর্ম পালনে বাধা দেওয়ায় ভূমিকম্প দিয়ে শোয়াইব (আ.)-এর সম্প্রদায় মাদায়েন জাতিকে ধ্বংস করা হয়েছিল।
৬. ফেরাউন ও তার জাতি: নিজের ক্ষমতার প্রতি অন্ধ মোহ, মুসা ও হারুন (আ.)-কে হত্যার পরিকল্পনা করার কারণে ফেরাউন ও তার জাতিকে নীল নদে ডুবিয়ে ধ্বংস করা হয়েছিল।
আরও পড়ুনতারাবির নামাজে কোন দিন কোন সুরা পড়া হবে২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪পথভ্রষ্ট হওয়ার কারণ
সুরা আরাফের ১৭৫ ও ১৭৬ আয়াতে আল্লাহ জ্ঞানী বালয়াম ইবনে বাউরার ঘটনা তুলে ধরেছেন, যে স্বীয় জ্ঞান দুনিয়ার তুচ্ছ জিনিসের বিনিময়ে বিক্রি করার কারণে অপদস্থ ও ধ্বংস হয়েছিল। বালয়াম ছিল একজন বিজ্ঞ আলেম ও সাধক। বায়তুল মুকাদ্দাসের নিকটবর্তী কেনানের অধিবাসী ছিল। তখন মুসা (আ.)-এর সময়কাল। মুসা (আ.) জাব্বারিন (আধিপত্যবাদী) সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সৈন্যবাহিনী নিয়ে সিরিয়ায় আসেন। এদিকে বালয়াম ইবনে বাউরার গোত্রের লোকেরা তার কাছে এসে মুসার বিরুদ্ধে বদদোয়া কামনা করল। বালয়াম নবী মুসা (আ.)–এর কথা শুনে তাদের ধিক জানিয়ে বিদায় দিল। লোকেরা আবার এল। বালয়াম বলল, ‘আমি আল্লাহর কাছে অনুমতি চেয়েছিলাম, তিনি নিষেধ করেছেন।’ তখন লোকেরা তাকে উপহার দেয়। সে তা গ্রহণ করে। লোকেরা তাদের চাওয়া অব্যাহত রাখল। বালয়াম আল্লাহর কাছে আবার অনুমতি চাইল। এবার কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। লোকেরা বলল, আল্লাহ যেহেতু কিছুই জানালেন না, এবার তবে দোয়া করুন। বালয়াম দোয়া করতে গিয়ে আল্লাহর কুদরতে নিজ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেই দোয়া করল। নিজ সম্প্রদায়ের ওপর ধ্বংস নেমে এল। তার জিহ্বা বেরিয়ে এসে বুকের ওপর লটকে গেল।
আরও পড়ুনইসলাম যাদেরকে বিয়ে করতে নিষেধ করেছে১৩ মার্চ ২০২৪সুরা আনফালে যুদ্ধের বিধান
পবিত্র কোরআনের অষ্টম সুরা আনফাল মদিনায় অবতীর্ণ। এ সুরার আয়াতের সংখ্যা ৭৫। আনফাল ‘নফল’ শব্দের বহুবচন। অর্থ অতিরিক্ত। অবিশ্বাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে যে সম্পদ মুসলিমদের হস্তগত হয়, তাকে নফল বা গনিমত বলা হয়। এ সুরায় গনিমতের সম্পদ বণ্টন নিয়ে আলোচনা থাকায় এ সুরাকে আনফাল বলা হয়।
বিশ্বাসীদের ৫ বৈশিষ্ট্য
সুরা আনফালের ২ থেকে ৪ আয়াতে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ এসব গুণের অধিকারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। ক্ষমা করেন এবং সম্মানজনক রিজিক দেন। বৈশিষ্ট্যগুলো হলো: আল্লাহর ভয়, কোরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর ওপর ভরসা, নামাজের সংরক্ষণ ও আল্লাহর বান্দাদের ওপর অনুগ্রহ।
সুরা আনফালের ৫ থেকে ৪০ আয়াতে আল্লাহর পথে জিহাদ, গনিমতের সম্পদ বণ্টনের নীতি, নবীজির বিরুদ্ধে কাফেরদের ষড়যন্ত্র, বদর যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ, মুসলমানদের অভিভাবক আল্লাহ, কাফেরদের ঠিকানা জাহান্নাম ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা রয়েছে।
রায়হান রাশেদ : লেখক ও আলেম
আরও পড়ুননারীর মর্যাদা ও অধিকার এবং অলৌকিক তিন ঘটনা১২ মার্চ ২০২৪উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আল ল হ ত আল ধ ব স কর কর ছ ন হয় ছ ল ফ র শত এর জ ত আর ফ র হওয় র শয়ত ন ক রআন র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
মোহাম্মদপুরে ডেকে নিয়ে হত্যার দুই ঘটনাকে গণপিটুনি বলছে পুলিশ, স্থানীয়রা কী বলছে
একই দিনে, একই জায়গায় হত্যাকাণ্ডের দুটি ঘটনা। একটি ঘটেছে ভোরে, আরেকটি সকালে।
ঘটনাস্থল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে। তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫।
প্রথম ঘটনায় দুই যুবককে ঘুম থেকে উঠিয়ে রাস্তায় নিয়ে পেটানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান একজন।
দ্বিতীয় ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, দুই যুবককে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার পাশাপাশি পিটিয়ে হত্যার দুটি ঘটনারই একাধিক ভিডিও ফুটেজ প্রথম আলো পেয়েছে। যারা পিটিয়ে হত্যা করছে, ভিডিও ফুটেজে তাদের চেহারা স্পষ্ট।
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।
নিহত দুই যুবক হলেন মো. সুজন ওরফে বাবুল ও মো. হানিফ। আর আহত দুজন হলেন মো. শরীফ ও ফয়সাল। ঘটনার পর নিহত দুই যুবকের স্বজনেরা মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে পুলিশকে ভিডিও ফুটেজ দেখালেও মামলা নিতে চায়নি। পরে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পরামর্শ দেয়। এতে পরিবার রাজি হয়নি। পরে আদালতে মামলা করতে আবেদন করেছে দুই পরিবার।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন। নিহত ও আহত ব্যক্তিরা ঢাকা উদ্যান এলাকায় কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী চক্রের অন্যতম প্রধান জনি ওরফে ‘রক্তচোষা’ জনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, ওই চারজন সেদিন ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েননি। কয়েকজন মিলে তাঁদের ধরে এনে পিটিয়েছে। এতে দুজনের মৃত্যু হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে এলাকার আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি।
ঘটনার ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে ও সকালে গণপিটুনির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। দুটি হত্যাকাণ্ডই হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এই দুটি হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় ওয়ার্ড (১০০ নম্বর সাংগঠনিক ওয়ার্ড) বিএনপির সহছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আক্তার হোসেনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাঁকে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে।
গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিংয়ের ১২ নম্বর সড়কে আক্তার হোসেনের বাসায় যান এই প্রতিবেদক। বাসার দরজার বাইরে থাকা কলিং বেল একাধিকবার চাপার পরও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেননি। পরে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সর্বশেষ গতকাল রোববার রাত আটটার দিকেও তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তখনো ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন।আক্তার হোসেনের ব্যবহার করা আরেকটি মুঠোফোন নম্বর গত রাত ১১টার দিকে নবীনগর হাউজিংয়ের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা সূত্রে পাওয়া যায়। এই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা (হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বক্তব্য জানতে) পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র ও স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর নবীনগর হাউজিং ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি ঠেকাতে নবীনগর হাউজিং এলাকায় স্থানীয়ভাবে একটি ‘টহল টিম’ গঠন করা হয়। আক্তার এই টহল টিমের প্রধান। দুটি হত্যাকাণ্ডে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা এই টহল দলের সদস্য।
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যার সঙ্গে জড়িত আরও যাঁদের চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় লোকজন, তাঁরা হলেন নবীনগর পশ্চিম ইউনিট বিএনপির সভাপতি মো. হাসনাইন, সদস্য মো. মালেক, সদস্য মো. জহিরুল, নবীনগর হাউজিংয়ের নৈশপ্রহরী হাবিবুর রহমান, ওই এলাকার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন, নুরু, শাহীন, চা-দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ ও আল আমিন। তাঁরা ১০০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বিএনপির সাংগঠনিক এই ওয়ার্ডের মধ্যে নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, ঢাকা উদ্যান হাউজিং, একতা হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, শ্যামলি হাউজিং (দ্বিতীয় প্রকল্প) ও নবোদয় হাউজিং রয়েছে।
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।
ভিডিও ফুটেজে আক্তার, হাসনাইন, মালেকসহ কয়েকজনকে লাঠি-রড দিয়ে পেটাতে দেখা গেছে, তাঁরা আপনার অনুসারী বলে অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন, তাঁরা বিএনপির মিছিল-মিটিংয়ে যান। যে কেউ মিছিল–মিটিংয়ে যেতে পারেন।
ঘুম থেকে ডেকে তুলে হত্যা
১০ সেপ্টেম্বর ভোরের ঘটনায় নিহত যুবক সুজন ওরফে বাবুলের বাসা ঢাকা উদ্যান এলাকায়। এ ঘটনায় আহত শরীফের বাসা চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায়। এই দুজন ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নবীনগর হাউজিংয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে যান। রাতে সেখানে খামারের কর্মী মনির আলীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমান। ভোর চারটার পর সেখান থেকে মালেক, হাবিবুরসহ কয়েকজন তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। এ সময় খামারের ভেতরেই মনির আলীকে মারধর করা হয়।
গত ৫ অক্টোবর ওই খামারে গেলে একাধিক কর্মী প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। তাঁরা বলেন, ঘটনার পরদিন মনির ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যান।
খামারের ব্যবস্থাপক নেছারউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মনির পাঁচ বছর ধরে এখানে কাজ করতেন। সুজনের মৃত্যুর পর মনির চলে গেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, এখানে তিনি নিরাপদ নন। তবে বিস্তারিত কিছু বলেননি। মনিরের কোনো খোঁজ তিনি দিতে পারেননি।
সুজন ও শরীফকে যেখানে পেটানো হয়, তার কাছেই টিনের একটি ঘরে থাকেন এক নারী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন ভোরে চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হন। দেখেন, দুই যুবককে কয়েকজন পেটাচ্ছেন। তাঁদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেননি।
নিহত সুজনের বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, কীভাবে সুজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, সেটি সবাই দেখেছে। আক্তার হোসেনের লোকজন তাঁর ছেলেকে সাদিক অ্যাগ্রোর খামার থেকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার পুরো ভিডিও আছে। খবর পেয়ে তিনি সেদিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, তাঁর ছেলেকে রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। ছেলে তখন আর বেঁচে ছিলেন না।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘটনার ভিডিও পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। অথচ মামলা নিল না। সুজন অবিবাহিত ছিলেন বলেও জানান তিনি।
নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?রাস্তা থেকে তুলে এনে পিটিয়ে হত্যা
১০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে মো. ফয়সাল ও মো. হানিফ নামের আরও দুই যুবককে পেটানো হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ফয়সালকে পাঁচজন এবং হানিফকে তিনজন মিলে পেটাচ্ছে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পেটানোর সময় হানিফ হাতজোড় করে মাফ চাইছেন।
ফয়সালের স্ত্রী নুপুর আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে হানিফ ও ফয়সালকে পেটানো হয়, তার কাছেই তাঁদের বাসা। খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ফয়সালকে মারধর করা বন্ধ করা হয়। তবে হানিফকে তখনো পেটানো হচ্ছিল। একপর্যায়ে হানিফের মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, যারা সেদিন পিটিয়েছে, এলাকার সবাই তাদের চেনে।
নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?
গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিং এলাকায় গিয়ে কথা হয় হানিফের বড় ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁর নামও আক্তার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই ছিনতাইয়ে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু ধরে নিয়ে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। হানিফ বারবার হাতজোড় করে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। তাঁর কথা কেউ শোনেনি। এ ঘটনায় মামলা করতে থানায় গেলে থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বলেছেন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। সব আসামিকে ভিডিওতে দেখা গেছে, এমন তথ্য জানালে ওসি বলেছেন, অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা না করলে চলে যান। পরে তাঁরা আদালতে মামলার আবেদন করেন।
আক্তার হোসেন জানান, হানিফের দেড় মাস বয়সী মেয়ে আছে। মেয়েসহ হানিফের স্ত্রী এখন বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে থাকেন।
ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’হত্যার ঘটনাকে গণপিটুনি বলে প্রচার
গত ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনার দিনই মোহাম্মদপুর থানার ওসি কাজী রফিকুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে ওই দুজন নিহত হন।
ওসির সঙ্গে এ বিষয়ে ৫ অক্টোবর আবার কথা বলেছে প্রথম আলো। মোহাম্মদপুর থানায় নিজ কক্ষে বসে ওসি বলেন, নিহত ওই দুজন ছিলেন পেশাদার ছিনতাইকারী। তাঁদের মৃত্যুর পর এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে। ছিনতাই কমে গেছে। তাঁরা গণপিটুনিতেই নিহত হন।
গণপিটুনিতে নয়, পরিকল্পিতভাবে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে—প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য ও ভিডিও ফুটেজেও বিষয়টি উঠে এসেছে, ওসিকে এ তথ্য জানানো হলে তিনি বলেন, তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুজন ও হানিফের লাশ ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আক্তারুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, সেদিন তিনি ওই এলাকায় টহল টিমের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুঠোফোনে সংবাদ পেয়ে তিনিই দুই দফায় চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান, যাঁদের দুজন মারা গেছেন। তিনি দাবি করেন, সেদিন গণপিটুনির ঘটনাই ঘটেছিল।
ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’
কোনো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে অবশ্যই মামলা নিতে হবে বলে প্রথম আলোকে জানান মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তি বড় অপরাধী হলেও সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। আর হত্যাকাণ্ডকে গণপিটুনি হিসেবে পুলিশ প্রচার করে থাকলে কাজটি মোটেও ঠিক করেনি, এটি অপতৎপরতা।