গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে উন্নয়নকাজ চলায় ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক হয়নি। সেসব কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সব রাস্তা ও ফ্লাইওভার খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে এবারও ঈদযাত্রায় স্বস্তির আশা নেই। গ্রামে যাওয়ার পথে ভোগান্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে গাজীপুরের শিল্পকারখানার শ্রমিকরা। ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে, সেই আশঙ্কা তত বাড়ছে।

ঢাকার সঙ্গে উত্তর, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের সড়ক যোগাযোগ হয় গাজীপুরের মধ্য দিয়ে। ঈদে ৩৬টি জেলার মানুষকে বাড়ি যেতে হয় এই জেলার ওপর দিয়ে। ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে এরই মধ্যে প্রস্তুতি নিয়েছে পুলিশ। তবে তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ এনে দিচ্ছেন শিল্পকারখানার মালিক ও শ্রমিকরা।

ফেব্রুয়ারি-মার্চের বেতন ও ঈদ বোনাসের দাবিতে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ২৫ রোজা পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। ঈদের আগে এ দাবি কারখানা মালিকরা কতটা পূরণ করতে পারবেন, এর ওপর মহাসড়কের পরিস্থিতি নির্ভর করছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গতকাল সোমবার ভোগড়া বাইপাসে বেতন-বোনাসের দাবিতে একটি কারখানার শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসেন। তাৎক্ষণিকভাবে আশপাশের ১২টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শ্রীপুরে দুই মাসের বকেয়া বেতন, বোনাস ও কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করেন শ্রমিকরা।
গত এক সপ্তাহে অন্তত ১২টি কারখানার শ্রমিক ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বিক্ষোভ করেছেন। আর বকেয়া বেতনসহ নানা দাবি নিয়ে গত সাত মাসে (৫ আগস্টের পর) অন্তত ১০০ বার শ্রমিকরা এ দুই মহাসড়ক অবরোধ করেছেন।

মহানগরের ভোগড়া বাইপাস এলাকায় টিএনজেড গ্রুপের পাঁচটি ও কলম্বিয়ার দুটি কারখানা রয়েছে। প্রতি মাসে এসব কারখানার শ্রমিকরা মহাসড়কে নেমে আন্দোলন করার পর বেতন পরিশোধ করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।

কয়েকটি কারখানার শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে কোনো উপায়ে তারা ফেব্রুয়ারির পুরো বেতন, মার্চের অর্ধেক বেতন ও ঈদ বোনাস পুরোটা নিয়ে বাড়ি যাবেন। এর ব্যত্যয় হলে আন্দোলন হবে।
টিএনজেড গ্রুপের একটি কারখানার শ্রমিক জাহেদুল ইসলাম গতকাল বলেন, ‘আমার বেতন-বোনাসের টাকার ওপর কতগুলো মানুষ নির্ভর করে জানেন? স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা, বাসার মালিক, বাকিতে যে দোকানি মালপত্র দেন তিনি। এবার বলুন, বেতন ও বোনাস না দিলে রাস্তায় নামা ছাড়া আর কী করার থাকে?’ তিনি আরও বলেন, ‘আশা করছি, ঝামেলা ছাড়াই বেতন ও বোনাস পাব। এবার আমরাও যানজটমুক্ত সড়ক দিয়ে গ্রামে যাব।’

চান্দনা চৌরাস্তার অটোরিকশার চালক আবুল কাশেম জানান, সব রাস্তা ভালো। তবে এই মোড়ের অবস্থা ভয়ংকর। এ অংশ সংস্কার হয়নি। খানাখন্দে ভরা। এ জন্য চারটি রাস্তায় ভয়াবহ যানজট তৈরি হতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য বলেন, গাজীপুরে যানজটের অন্যতম কারণ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা। ঈদের আগে মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচল বন্ধ করতে হবে। তা ছাড়া তাকওয়া পরিবহনের অন্তত ৩০০ অবৈধ মিনিবাস চলাচল বন্ধ করলে ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক হতে পারে।

গাজীপুর শিল্প পুলিশ-২-এর সুপার (এসপি) এ কে এম জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চাই, মহাসড়ক যানজটমুক্ত থাকুক। ঈদে স্বস্তি নিয়ে যাতে মানুষ বাড়ি ফিরতে পারে, সে জন্য চেষ্টা করছি। কিন্তু যানজটের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিচ্ছি না। শ্রমিকরা যদি রাস্তায় নেমে পড়ে, তাহলে তা স্বস্তির হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঈদের আগে শ্রমিকদের তিনটি দাবি। ফেব্রুয়ারির পুরো ও মার্চের অর্ধেক বেতন এবং পুরো ঈদ বোনাস। গাজীপুরে ২ হাজার ১৭৬টি শিল্প প্রতিষ্ঠান। গত সাত মাসে অর্থনৈতিক সংকটে ৫০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। টিকে থাকাগুলোর মধ্যে যদি ১ শতাংশ কারখানায় ঝামেলা হয়, তবু তো ২১টিতে ঝামেলা হবে। সে ক্ষেত্রে পুরোপুরি বলা যাচ্ছে না যে ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক হবে।’

তিনি জানান, গতকাল পর্যন্ত ৭২ শতাংশ কারখানায় ফেব্রুয়ারির বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি রয়েছে ২৮ শতাংশ (প্রায় ৬০০) কারখানা। এর ওপর মার্চের অর্ধেক বেতন ও বোনাসের দাবি রয়েছে। মালিকরা যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শ্রমিকদের পাওনা বুঝিয়ে দেন, তাহলে ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক হতে পারে।
শিল্প পুলিশের আরেকজন কর্মকর্তা জানান, এরই মধ্যে বোনাস পুরোটা ও মার্চের অর্ধেক বেতন দিয়েছে ৩৫টি কারখানা। তাদের মতো যদি সব কারখানা শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দিয়ে দেয়, তাহলে আর কোনো ঝামেলা নেই। স্বস্তির ঈদ হতে পারে সবার জন্য।

সার্বিক বিষয়ে গাজীপুরের এসপি চৌধুরী মো.

যাবের সাদেক বলেন, ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক করার জন্য আমরা সব প্রস্তুতি নিয়েছি। কোনো কারখানার শ্রমিক সড়কে নেমে আন্দোলন যাতে না করে, সেটাও নজরদারি করছি। তিনি আরও বলেন, শ্রমিকদের বেতন দ্রুত পরিশোধ করার জন্য অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল কারখানা মালিককে বারবার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। কোনোভাবে যেন শ্রমিকরা ঈদের আগে রাস্তায় না নামে, সেটা বোঝানো হচ্ছে। ২৫ রমজানের মধ্যে তাদের বেতন ও বোনাস পরিশোধ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। জেলা পুলিশ, মহানগর পুলিশ ও শিল্প পুলিশ দফায় দফায় মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলছে।

তবে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর হিসাব বলছে, গতকাল পর্যন্ত গাজীপুরের ১২৪ কারখানায় ফেব্রুয়ারির বেতন পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। বাকি দুই হাজার কারখানায় ইতোমধ্যে মজুরি পরিশোধ করা হয়েছে। জানতে চাইলে বিজিএমইএ সহায়ক কমিটির সদস্য এবং সংগঠনের সাবেক সহসভাপতি শহীদ উল্লাহ আজিম সমকালকে বলেন, ‘বাকি কারখানাগুলোও যাতে দু-এক দিনের মধ্যে মজুরি পরিশোধ করতে পারে, এ ব্যাপারে সহায়তা করছে বিজিএমইএ।’ শ্রম আইন অনুযায়ী, সমাপ্ত মাসের মজুরি পরের মাসের প্রথম ১০ কার্যদিবসের মধ্যে পরিশোধ করার কথা। ১৭ তারিখেও কেন এত কারখানা মজুরি পরিশোধ করেনি– এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সব কারখানার সামর্থ্য সমান নয়। ছোট অনেক কারখানার পরিস্থিতি ভালো যাচ্ছে না। এ কারণে মজুরি পরিশোধে কিছুটা সময় লাগছে।’

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ঈদয ত র পর শ ধ ক ঈদয ত র র জন য গতক ল র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

ব্যালটে মামদানি, অদৃশ্য ‘প্রার্থী’ ট্রাম্প

নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচন আগামীকাল মঙ্গলবার। ‘বিশ্বের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত এই শহরে প্রথমবার এমন একজন মেয়র পদে নির্বাচিত হতে পারেন, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির চলতি ধারার একদম বিপরীতমুখী। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর রিপাবলিকান পার্টি এক ‘শ্বেতকায়, খ্রিষ্টান ও রক্ষণশীল’ আমেরিকার কথা বলছেন।

জোহরান মামদানি শ্বেতকায় নন, তিনি বাদামি রঙের দক্ষিণ এশীয়। তিনি খ্রিষ্টান নন, একজন মুসলিম। তিনি অবশ্যই রক্ষণশীল নন, তিনি খোলামেলাভাবে একজন প্রগতিশীল, যিনি নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলতে দ্বিধা করেন না।

‘মামদানি একজন ভয়ানক মানুষ’, সাবধান করে বলেছেন অ্যান্ড্রু কুমো, মঙ্গলবারের নির্বাচনে যিনি মামদানির প্রতিদ্বন্দ্বী। সারা জীবন ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য থাকলেও বাছাইপর্বে পরাজিত হয়ে তিনি এখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন।

ব্যালটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নাম না থাকলেও এই নির্বাচনে তিনি একজন অদৃশ্য প্রার্থী। কুমোর পক্ষ নিয়ে তিনিও এই নির্বাচনের একজন অংশগ্রহণকারী। বড় ব্যবধানে মামদানির বিজয় হলে অনেকেই তা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অনাস্থা হিসেবেই দেখবেন।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউইয়র্কের আদি বাসিন্দা। তিনি কোনোভাবেই চান না মামদানি এই শহরের মেয়র নির্বাচিত হোন। তাঁর বিবেচনায় মামদানি শুধু একজন পাক্কা কমিউনিস্টই নন, রীতিমতো উন্মাদ। এমন একজনকে নির্বাচিত করা হলে তিনি নিউইয়র্ক সিটির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল আটকে দেবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, মামদানি একজন অবৈধ অভিবাসী। তা প্রমাণিত হলে তাঁকে বহিষ্কার করা হবে। মেয়র নির্বাচিত হয়ে মামদানি যদি অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের চলতি অভিযানে বাধা দেন, তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে, এমন হুমকিও দিয়েছেন ট্রাম্প।

শহরের প্রতিটি প্রধান কেন্দ্র হেঁটে জনসংযোগ সেরেছেন মামদানি। ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের অধিকাংশই নবীন, শহরের প্রতিটি বাসায় কড়া নেড়েছেন। টিকটক ও ইউটিউবে তাঁর উপস্থিতি অভূতপূর্ব। মামদানির এই ‘মাঠপর্যায়ের খেলা’ ঠেকাতে কুমো বেছে নিয়েছেন একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে ভীতি।

ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়

শুধু নিউইয়র্কে নয়, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আরও অন্তত তিনটি রাজ্যে নির্বাচন হবে আগামীকাল, যার ফলাফল ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের ব্যাপারে একটি রেফারেন্ডাম বা জনরায় হবে ভাবা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে নিউ জার্সি ও ভার্জিনিয়ায় গভর্নর পদে নির্বাচন। এই দুই রাজ্যে প্রতিনিধি পরিষদ ও উচ্চ পরিষদেও ভোট গ্রহণ করা হবে। উভয় রাজ্যই ডেমোক্রেটিক রাজনীতির সমর্থক, বা ‘ব্লু স্টেট’। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই দুই রাজ্যেই ট্রাম্পের হার হয়, কিন্তু ২০১৬ সালের তুলনায় তিনি অনেক ভালো ফল করেন। দেখার বিষয়, দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে এই দুই রাজ্যে ট্রাম্পের জনসমর্থন এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে।

এ ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ায় গভর্নর গেভিন ন্যুসাম নির্বাচনী ম্যাপ পরিবর্তনের অনুমতি চেয়ে একটি গণভোটের আয়োজন করেছেন। আগামী বছরের নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে রিপাবলিকান পার্টি বড় রকমের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। তা ঠেকাতেই ট্রাম্পের নির্দেশে টেক্সাসের নির্বাচনী ম্যাপ ঢেলে সাজানো হয়েছে, যার ফলে রিপাবলিকান দল কংগ্রেসে আরও পাঁচটি আসন নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হবে ভাবা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ‘ব্লু স্টেট’ ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর ন্যুসামের নির্দেশে নির্বাচনী ম্যাপ বদলানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার ফলে সেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য কংগ্রেসে পাঁচটি আসনে বিজয়ের সম্ভাবনা তৈরি হবে।

এই তিনটি নির্বাচনের প্রতিটিতেই ভোটারদের মনে থাকবেন ট্রাম্প, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে আইনি বাধা উপেক্ষা করে বিভিন্ন ডেমোক্রেটিক শহরে অবৈধ অভিবাসনবিরোধী অভিযানের নামে সেনাসদস্যদের পাঠাচ্ছেন তিনি। যেসব ডেমোক্রেটিক নেতাকে শত্রু মনে করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছেন। কোনো যুক্তি বা কারণ ছাড়াই ২০২৪ সালের নির্বাচনে তাঁর পক্ষে ভোট দেয়নি এমন ডেমোক্রেটিক রাজ্যের কেন্দ্রীয় অনুদান বাতিল করছেন। কংগ্রেসের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই একাধিক সরকারি দপ্তর আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রচলিত আইনের তোয়াক্কা না করে মাদক পাচার বন্ধের নামে ভেনেজুয়েলার সমুদ্রসীমায় সামরিক হামলা চালাচ্ছেন। আমদানি শুল্কের নামে যে বাণিজ্যযুদ্ধ তিনি শুরু করেছেন, তার ফলে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের দাম বাড়া শুরু হয়েছে।

গ্যালপ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধনতন্ত্রের সমর্থক ছিল, তা এখন কমে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই যে পরিবর্তিত আমেরিকা, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা সে কথা জানেন না বা জানতে চান না। গাজা প্রশ্নে তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান দলটির প্রতি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের অবজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।

এসব কার্যকলাপের ফলে সারা দেশে ট্রাম্পের জনসমর্থন কমেছে। অধিকাংশ জনমত জরিপে তাঁর প্রতি সমর্থন ৪২ থেকে ৪৫ শতাংশের বেশি নয়। সাম্প্রতিক সময়ে মাত্র ১০ মাসের মাথায় অন্য আর কোনো প্রেসিডেন্টের জনসমর্থনে এমন ধস নামেনি।

এবারের নির্বাচনে ট্রাম্প কোনো রাজ্যেই ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি প্রচারে আসেননি। এমনকি রিপাবলিকান প্রার্থীদের পক্ষে সরব সমর্থনও জানাননি। এর একটা সম্ভাব্য কারণ, জয়ী হবেন এমন প্রার্থীর সমর্থন দিতেই ট্রাম্প ভালোবাসেন। আগামীকালের নির্বাচনে তেমন সম্ভাবনা কম।

এই নির্বাচন যে ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়, তার আরেক প্রমাণ নির্বাচনী প্রচারণায় সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অংশগ্রহণ। ডেমোক্রেটিক পার্টিতে জাতীয় নেতা বলতে তিনিই সবেধন নীলমণি। শনিবার নিউ জার্সির ডেমোক্রেটিক গভর্নর পদপ্রার্থী মাইকি শেরিলকে পাশে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। একই দিন ভার্জিনিয়ায় ডেমোক্রেটিক গভর্নর পদপ্রার্থী এবিগেইল স্প্যানবার্গারের পক্ষেও প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। উভয় রাজ্যেই ওবামা কঠোর ভাষায় ট্রাম্পের সমালোচনা করে বলেন, ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী নীতির কারণেই আমেরিকা আজ এক দুঃসময়ের মুখোমুখি।

জনমতে এগিয়ে মামদানি

ওবামা মামদানিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দেননি। তবে তিনি যে মামদানির পাশে আছেন, সে কথাও গোপন রাখেননি। মামদানির ক্যাম্পেইন থেকে জানানো হয়েছে, সম্প্রতি ওবামা নিজেই ফোন করে জানিয়েছেন, তাঁর (মামদানির) বিজয়ের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তিনি বলেছেন, মামদানির নির্বাচনী প্রচার ‘ইম্প্রেসিভ’ বা নজরে পড়ার মতো।

কুমো ক্যাম্প থেকে অহোরাত্রি তাঁকে ‘কমিউনিস্ট’ ও ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ হিসেবে প্রচার সত্ত্বেও মামদানি যেসব জনমত জরিপে এগিয়ে, তার একটি বড় কারণ মাঠপর্যায়ে তাঁর এই ‘ইম্প্রেসিভ’ প্রচারণা। শহরের প্রতিটি প্রধান কেন্দ্র হেঁটে জনসংযোগ সেরেছেন মামদানি। ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের অধিকাংশই নবীন, শহরের প্রতিটি বাসায় কড়া নেড়েছেন। টিকটক ও ইউটিউবে তাঁর উপস্থিতি অভূতপূর্ব। মামদানির এই ‘মাঠপর্যায়ের খেলা’ ঠেকাতে কুমো বেছে নিয়েছেন একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে ভীতি। এতে তিনি ফল পাচ্ছেন, গত দুই সপ্তাহে মামদানির সঙ্গে তাঁর ব্যবধান ১০ শতাংশের মতো কমে এসেছে। নিউইয়র্কের চলতি মেয়র নির্বাচন থেকে এরিক অ্যাডামস সরে দাঁড়ানোয় কুমোর লাভ হয়েছে সন্দেহ নেই, তবে এখনো মামদানির সঙ্গে যে ১৬-১৭ পয়েন্টের ব্যবধান রয়েছে, তা অতিক্রম করা কার্যত অসম্ভব, এই মত অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের।

ভূমিধস পরিবর্তন

একটা বিষয় স্পষ্ট। মেয়র নির্বাচনে মামদানি জয়ী হলে তা মার্কিন রাজনীতিতে প্রজন্মগত ও নীতিগত পরিবর্তনের সূচনা করবে। ভূমিধস পরিবর্তন আসবে ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিতে। মধ্যপন্থী ও ডানঘেঁষা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে এই দল অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে কম জনপ্রিয়। এই দলে যাঁরা নেতৃত্বে, তাঁদের অধিকাংশই বয়োবৃদ্ধ, করপোরেট আমেরিকার কাছে এদের হাত-পা বাঁধা। ইসরায়েল প্রশ্নে তাদের সমর্থন এখনো আগের মতো নতজানু।

পিউ রিসার্চের তথ্য অনুসারে, ইসরায়েল প্রশ্নে এখন নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে এমন আমেরিকানের সংখ্যা ৫৩ শতাংশ, যা তিন বছর আগের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। একইভাবে ধনতন্ত্রের প্রতিও আমেরিকানদের সমর্থন নিম্নগামী। গ্যালপ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধনতন্ত্রের সমর্থক ছিল, তা এখন কমে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই যে পরিবর্তিত আমেরিকা, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা সে কথা জানেন না বা জানতে চান না। গাজা প্রশ্নে তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান দলটির প্রতি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের অবজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।

অন্যদিকে ট্রাম্পের নেতৃত্বে রিপাবলিকান পার্টি খোলামেলাভাবে অভিবাসনবিরোধী, দক্ষিণপন্থী, খ্রিষ্টবাদী ও রক্ষণশীল। চলতি সপ্তাহের নতুন উদ্বাস্তু নীতিতে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন শ্বেতকায় ও ইউরোপীয় আশ্রয়প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেবে। এই অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতকায় নাগরিকবৃন্দ, ট্রাম্প প্রশাসনের চোখে যারা সে দেশের সরকারের বৈষম্যের শিকার।

এই প্রতিক্রিয়াশীল রিপাবলিকান পার্টির বিপরীতে একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল ডেমোক্রেটিক আন্দোলন গড়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ও কংগ্রেস সদস্য ওকাসিও-কর্তেজ ইতিমধ্যে এই আন্দোলনের প্রধান মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন। সবাই মানেন, মামদানির মতো তরুণ ও বুদ্ধিমান নেতৃত্ব এই আন্দোলনকে আরও বেগবান করবে।

এই সম্ভাবনার কথা খুব স্পষ্ট করে বলেছেন বার্নি স্যান্ডার্স। তাঁর কথায়, এই দেশ করপোরেট আমেরিকার নির্দেশে চলবে, না তার রাজনীতির কেন্দ্রে থাকবে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ—এ মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ‘যদি আমরা দ্বিতীয় পথটি বেছে নিতে চাই, করপোরেট আমেরিকার বদলে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিই, তাহলে আমাদের মামদানির পাশে দাঁড়াতে হবে।’

কোন পথ বেছে নেবে নিউইয়র্ক, মঙ্গলবারেই তা নিশ্চিত হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ