শুধু বর্তমান সময়ে নয়, অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে তিন বছর ধরেই। তাতে দিন দিন ভালো ব্যবসায়ীরাও ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছেন। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চান ব্যবসায়ীরা। তাঁরা চান ঋণ পরিশোধে ন্যূনতম ৬ মাসের বিরতি (মোরাটোরিয়াম পিরিয়ড)। তাঁদের দাবি হচ্ছে, সহজ শর্তে ঋণ পুনর্গঠনের জন্য যেন বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দেয় সরকার।
সচিবালয়ে আজ বৃহস্পতিবার অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রাক্-বাজেট আলোচনায় বিভিন্ন চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা এ দাবি তুলে ধরেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো.
প্রায় দুই ঘণ্টার আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশ চেম্বার অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী ও বাংলাদেশ নিট পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
সভায় ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে করজাল সম্প্রসারণ, করব্যবস্থা ডিজিটাল করা, করপোরেট কর আদায় ব্যবস্থা অনলাইন করা এবং ভ্যাটের একক হার নির্ধারণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছেতাসকিন আহমেদ, সভাপতি, ঢাকা চেম্বারএ ছাড়া আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকিন আহমেদ, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সভাপতি সেলিম আর এফ হোসেন প্রমুখ।
সভায় ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে করজাল সম্প্রসারণ, করব্যবস্থা ডিজিটাল করা, করপোরেট কর আদায় ব্যবস্থা অনলাইন করা এবং ভ্যাটের একক হার নির্ধারণের পরামর্শ দেওয়া হয় বলে প্রথম আলোকে জানান ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকিন আহমেদ। সভা শেষে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকঋণ পরিশোধে ব্যবসায়ীদের ন্যূনতম ৬ মাসের বিরতি দরকার—এ কথা আমরা আমাদের পক্ষ থেকে অর্থ উপদেষ্টাকে জানিয়েছি।’
সভা শেষে মোহাম্মদ হাতেম উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আশা করছি, করব্যবস্থায় এবার একটা পরিবর্তন আসবে। এনবিআর চেয়ারম্যান এ পরিবর্তনের আশ্বাস দিয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘লাভের ওপর কর নেওয়া উচিত; কিন্তু বর্তমানে নেওয়া হচ্ছে টার্নওভারের ওপর। এনবিআর ১ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) নিচ্ছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ১ কোটি টাকা এআইটি কেটে রাখা হচ্ছে। কিন্তু বছর শেষে দেখা যাচ্ছে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রদেয় কর ২০ লাখ টাকা। তাতে বাকি ৮০ লাখ টাকা ফেরত পাওয়ার কথা; কিন্তু সেই টাকা আর ফেরত দিচ্ছে না এনবিআর।’
আলোচনাকালে বিকেএমইএর পক্ষ থেকে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্কবিষয়ক ১১ দফা প্রস্তাবনা জমা দেওয়া হয় অর্থ উপদেষ্টার কাছে। এসব প্রস্তাবনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, পোশাক খাতের জন্য উৎসে কর আদায়কে চূড়ান্ত দায় হিসেবে গণ্য করে পাঁচ বছরের জন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে কর নির্ধারণ, রপ্তানি প্রণোদনায় কর অব্যাহতি, বিনিয়োগবান্ধব করনীতি প্রণয়ন, অগ্নি ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম আমদানিতে কর রেয়াত, এইচ এস কোড ভুলের কারণে ২০০ থেকে ৪০০ শতাংশ জরিমানার বিধান বাতিল করা, ৮ ডিজিটের বদলে ৬ ডিজিট এইচ এস কোড করা, জ্বালানি সাশ্রয়ী বাতির ওপর ভ্যাট হার আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশের বদলে ৫ শতাংশ নির্ধারণ ইত্যাদি। এ ছাড়া রপ্তানি প্রণোদনার অর্থ যাতে রপ্তানিকারকেরা সহজে পান সেই উদ্যোগ গ্রহণের জন্য অর্থ উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিকেএমইএ।
সভা শেষে বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যাপারে তাঁরা প্রস্তাব করেছেন। এ ছাড়া করব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক চর্চা যেন বজায় রাখা হয় সেই অনুরোধও করেন। বিসিআইয়ের পক্ষ থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই) পর্যায়ে ভ্যাট হার কমানোর প্রস্তাবও দেওয়া হয়।
এ ছাড়া বিসিআইয়ের পক্ষ থেকে করপোরেট করহার আড়াই শতাংশ কমানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ভারতে করমুক্ত আয়সীমা যেখানে ১২ লাখ রুপি, বাংলাদেশে তা পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। উচ্চ করহার নতুন বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে—এ কথাও তিনি অর্থ উপদেষ্টাকে বলেছেন বলে জানান।
আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী আরও বলেন, আয়কর বা এনবিআর–সম্পর্কিত বিষয়ের ওপর শুনতে চেয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। অন্য বিষয়গুলো তিনি শুনতে চাচ্ছিলেন না। তবে উপদেষ্টাকে খুবই ইতিবাচক মনে হয়েছে। তিনি চান দেশটা এগিয়ে যাক এবং কিছু কিছু জায়গায় এনবিআর যাতে কর আহরণ করতে পারে। এনবিআরের কর আদায় যাতে বাড়ে তার জন্য কঠিন ভূমিকা নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক–সংক্রান্ত বিষয় ও আর্থিক সহায়তার বিষয়গুলো লিখিত আকারে চেয়েছেন উপদেষ্টা।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসেছি। আমরা চাই ব্যবসা উপযোগী করনীতি। এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীরা কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবের মাধ্যমে সুপারিশ দিয়েছেন। করের ব্যাপারেও মতামত তুলে ধরেছেন। এটা ঠিক যে কিছু কিছু খাতে সুবিধা কম আছে। যে বিষয়ে ব্যবসায়ীরা দাবি জানিয়েছেন তা হলো করকাঠামোর প্রক্রিয়া যেন অনলাইনে করা হয়। এ ছাড়া পেমেন্ট নিয়ে জটিলতারও সমাধান চেয়েছেন তাঁরা।’
প্রাক্-বাজেট আলোচনায় ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিনিয়োগ ও মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) যেন বাড়ে, ব্যবসায়ীরা সেই প্রস্তাব দিয়েছেন। আমি তাঁদের বলেছি, আগামী বাজেট হবে ব্যবসাবান্ধব।’ শুল্কবিষয়ক জটিলতা নিরসন নিয়ে ব্যবসায়ীদের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, সমস্যা নিরসনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবস য় দ র করব যবস থ ব যবস য় র য় ব যবস ন আহম দ ব যবস থ দ র বল র জন য ব স আই র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
৩০ নভেম্বরের মধ্যে করদাতাদের ই-রিটার্ন জমা দিতে বলেছে এনবিআর
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ১০ লাখের বেশি করদাতা অনলাইনে তাঁদের ই-রিটার্ন জমা দিয়েছেন। গত আগস্টে সব করদাতার জন্য অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
ই-রিটার্ন সিস্টেম ব্যবহার করে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে সব ব্যক্তি করদাতাদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে এনবিআর। গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ অনুরোধ জানায় সংস্থাটি।
গত বছর নির্দিষ্ট এলাকার অধিক্ষেত্রের ব্যক্তি করদাতা, সারা দেশে ব্যাংকে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়। তাতে ১৭ লাখের বেশি করদাতা অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করেন।
দেশে বর্তমানে ১ কোটি ১২ লাখের মতো কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) আছেন। তাঁদের মধ্যে প্রতিবছর মাত্র ৪০ লাখ টিআইএনধারী রিটার্ন দাখিল করেন।
এনবিআর জানায়, এক বিশেষ আদেশের মাধ্যমে চলতি বছর ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের প্রবীণ করদাতা, শারীরিকভাবে অসমর্থ বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন করদাতা, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি করদাতা, মৃত করদাতার পক্ষে আইনগত প্রতিনিধি কর্তৃক রিটার্ন দাখিল এবং বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিক ছাড়া সব ব্যক্তিশ্রেণির করদাতার অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
চলতি ২০২৫-২৬ করবর্ষে যেসব করদাতা অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন, তাঁরাও চাইলে অনলাইনে ই-রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। অন্যদিকে ই-রিটার্ন সিস্টেমে নিবন্ধনসংক্রান্ত সমস্যার কারণে কোনো করদাতা অনলাইনে রিটার্ন জমা দিতে না পারলে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট উপকর কমিশনারের কাছে সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে আবেদন করলে অতিরিক্ত বা যুগ্ম কর কমিশনারের অনুমোদনক্রমে কাগুজে রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। এই সময়সীমা ৩১ অক্টোবর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা ১৫ দিন বাড়ানো হয়েছে।
এনবিআরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, করদাতার পক্ষে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধিও অনলাইনে ই-রিটার্ন জমা দিতে পারছেন। এ ছাড়া বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি করদাতাদের ক্ষেত্রে অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও তাঁদের পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, ই-মেইল ইত্যাদি তথ্য দিয়ে ই-মেইল করলে ই-রিটার্নের নিবন্ধন লিংক পাঠানো হয়। এর মাধ্যমে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি করদাতারা ই-রিটার্ন সিস্টেমে নিবন্ধন করে সহজেই অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারছেন। কোনো ধরনের কাগজপত্র বা দলিল আপলোড না করেই করদাতারা তাঁদের আয়, ব্যয়, সম্পদ ও দায়ের প্রকৃত তথ্য ই-রিটার্ন সিস্টেমে এন্ট্রি করে ঝামেলাহীনভাবে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারছেন। ই-রিটার্ন দাখিলের পর তাৎক্ষণিকভাবে জমা স্লিপ পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে আয়কর সনদও প্রিন্ট করে নিতে পারছেন করদাতারা।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ই-রিটার্ন জমা সহজ করার জন্য গত বছরের মতো এবারও করদাতাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ই-রিটার্নসংক্রান্ত যেকোনো সমস্যায় করদাতাদের সহায়তা দিতে একটি কল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। আবার ওয়েবসাইটে ই-রিটার্নসংক্রান্ত যেকোনো সমস্যা লিখিতভাবে জানালেও তার সমাধান পাচ্ছেন করদাতারা। কোনো করদাতা সশরীর নিজ নিজ কর অঞ্চলে গিয়েও ই-রিটার্ন জমা দেওয়াসংক্রান্ত সেবা নিতে পারছেন।