আমার দেখা আজিমপুর, গ্রিন রোড ও ধানমন্ডি
Published: 22nd, March 2025 GMT
আমার জন্ম ঢাকায়। আব্বা এম এ কাদের ছিলেন একজন চিকিৎসক। আব্বার চাকরির সুবাদে আমরা ষাটের দশকে আজিমপুর সরকারি কোয়ার্টারে থাকতাম। তখনকার আজিমপুর কোয়ার্টার ছিল সবুজ ঘাসে পরিপূর্ণ। আমাদের ভবনের প্রায় সবাই ছিলেন আব্বার সহকর্মী। বিকেল হলে শিশু–কিশোরেরা পরিপাটি হয়ে ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট, গোল্লাছুট, দড়িখেলায় মেতে উঠত। সন্ধ্যায় সবুজ ঘাসে গৃহিণীদের আড্ডা বসত।
মহররমের সময় তাজিয়া মিছিল বের হতো। সে সঙ্গে বড় রাস্তায় বসত মহররম মেলা। আব্বার সঙ্গে মেলায় গিয়ে হাঁড়ি–পাতিল, খেলনা, নানা ধরনের জিনিস কিনে আনতাম। বাসার সামনেই ছিল বেবি আইসক্রিমের ফ্যাক্টরি। ইচ্ছা হলেই কিনে আনা যেত।
আমরা পড়তাম আজিমপুর এলাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে, যেটা বর্তমানে অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ। আমাদের সময় স্কুলটি ছিল একতলা। মিসেস আনোয়ারা মনসুরসহ কয়েকজন বিদেশি শিক্ষক ছিলেন।
সে সময় ঢাকা শহরে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন ছিল। আমাদের নানুভাই চুয়াডাঙ্গা থেকে ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে নেমে ঘোড়ার গাড়ি করে আমাদের বাসায় আসতেন। সঙ্গে আনতেন শাকসবজি, ফল, ঝোলা গুড়, পাটালি গুড়সহ অনেক কিছু।
আজিমপুর থেকে আমরা চলে আসি ঢাকা মেডিকেলের কোয়ার্টারে। বুয়েটের বড় মাঠের উল্টো দিকে সুন্দর গেটওয়ালা ডুপ্লেক্স বাড়িতে আমরা থাকতাম। ঢাকা মেডিকেলের চার কোণে এ ধরনের চারটি গেট রয়েছে। একটি গেটের সামনের আমতলায় ভাষা আন্দোলনের সভা হয়েছিল। আমাদের এ বাসার পাশেই ছিল রেললাইন। রেললাইন পার হলেই বকশীবাজার। রেললাইনের পাশের রাস্তা দিয়ে বান্ধবী সুলতানা কামাল খুকির সঙ্গে বুয়েটের মাঠে খেলতে যাওয়া, বকুল ফুল কুড়ানো, বকুল ফল খাওয়া—সে এক মধুর স্মৃতি।
আব্বা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ায় আমাদের চলে আসতে হয় গ্রিন রোডসংলগ্ন ক্রিসেন্ট রোডের নিজস্ব আঙিনায়। এখানে আব্বা ছোট একটা বাংলোবাড়ি বানালেন। এক ছাদের নিচে শোবার ঘর, বসার ঘর, খাবার ঘর ও রান্নাঘর। দেয়ালের ওপর টিনের চারচালার ছাদ। সীমানার চারদিক বাঁশের বেড়ার দেয়াল। বাংলোর সামনের দিকে কাঁটাতারের বেড়া। নানা রঙের কসমস ফুলের ও বোগেনভিলিয়ার বাগান। দূরে বেশ কয়েকটি বাড়ি। আমরা গোয়ালার বাড়ি থেকে দুধ নিয়ে আসতাম। গ্রিন রোড থেকে ক্রিসেন্ট রোডে আসতে হলে ছোট একটা খাল পার হতে হতো। গাড়ি যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। আমাদের বাড়ির পেছনে ছিল বড়সড় ধানখেত। এখানে আমগাছের ডালে দোলনায় আমরা দোল খেতাম আর ধানখেতের শীতল বাতাস উপভোগ করতাম।
গ্রিন রোডে চলাচল করত পুরোনো আমলের বাস, যাকে অনেকে মুড়ির টিন বলতেন। তত দিনে আমি হাটখোলা রোডের কামরুন্নেছা স্কুলে ভর্তি হয়েছি। স্কুলে যেতাম ঘোড়ার গাড়ি কিংবা মুড়ির টিনের স্কুলবাসে। পরে আব্বার চাকরির কারণে ক্রিসেন্ট রোড থেকে চলে যেতে হয় ময়মনসিংহে। ওখান থেকে আমরা চলে আসি ধানমন্ডির রোড ৩১–এর নিজস্ব বাড়িতে। ধানমন্ডির পরিবেশ ছিল শান্ত ও স্নিগ্ধ। বেশির ভাগ বাড়ি ছিল একতলা বা দোতলা। ফুলে ও ফলে ভরা। আম্মা হাঁস–মুরগি পালতেন। হাঁসগুলোকে মালি নিয়ে যেতেন লেকে। সন্ধ্যা হলে নিজেরাই গেটের সামনে এসে ডাকাডাকি করত। জুঁই ও মাধবীলতায় ঘেরা এ বাড়িতেই আব্বা হাসপাতালের কাজ সেরে রোগী দেখতেন। ৩১ নম্বর রোডে ছিল জাপানসহ কয়েকটি দেশের দূতাবাস।
সে সময় মিরপুর রোড ছিল সরু। রিকশা ও গাড়ি পাশাপাশি কোনোরকমে চলত। ধানমন্ডিতে থেকেই দেখেছি, আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ সব ঘটনা। দেখেছি, মিরপুর রোড ধরে পাকিস্তানি সেনাদের নিরস্ত্রভাবে চলে যেতে। সবার ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ পেলেও আমাদের মন ছিল বিষণ্নতায় ভরা। কারণ, আব্বাকে ১৬ ডিসেম্বরের পর তিন মাস ধরে পাওয়া যায়নি। এরপর একদিন আব্বা ফিরে আসায় আমাদের স্বাধীনতা যেন পূর্ণতা পায়।
আমার শৈশব ও কৈশোরে দেখা আজিমপুর, গ্রিন রোড, ক্রিসেন্ট রোড ও ধানমন্ডির ¯স্নিগ্ধতা, শান্ত পরিবেশ, লেকের স্বচ্ছ পানি আজ আর নেই। আমাদের ধানমন্ডির দ্বিতল বাড়ি এখন অ্যাপার্টমেন্ট।
জিনাত মাহরুখ বানু, সাবেক প্রধান, জাতিতত্ত্ব ও অলংকরণ শিল্পকলা বিভাগ, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ধ নমন ড র আম দ র র স মন
এছাড়াও পড়ুন:
দোষ বিয়ারিং প্যাডের নয়, যারা লাগিয়েছে কিংবা বুঝে নিয়েছে, তাদের: ডিএমটিসিএল এমডি
মেট্রোরেল চালুর আগে নিরাপত্তার পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা (সেফটি অডিট) ছাড়াই যাত্রা শুরু হয়েছিল ঢাকার মেট্রোরেলের। এর মধ্যে বিয়ারিং প্যাড নিচে পড়ে একজন পথচারী মারা গেছেন। এবার নতুন করে নিরাপত্তার নিরীক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
বিয়ারিং প্যাড পড়ে পথচারীর মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর আজ সোমবার সকালে উত্তরার দিয়াবাড়িতে মেট্রোরেলের প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, ‘মেট্রোরেলের আগে সেফটি অডিট হয়নি। তাই সেফটি অডিট করতে চাইছি। যত দ্রুত করা যায়, সেটা আমরা করব। থার্ড পার্টিকে (তৃতীয় পক্ষ) দিয়ে এই অডিট করানো হবে। ইউরোপীয় কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়েই করানো হবে। আমাদের কাছে ফ্রান্সের দুটি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। সেফটি অডিট করার জন্য আমরা খুব শিগগির টেন্ডারের প্রক্রিয়ায় যাব।’
এক বছর আগে ঢাকার মেট্রোরেলের স্তম্ভের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার পর গত ২৬ অক্টোবর ফার্মগেটে আরেকটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এক পথচারীর মৃত্যু হয়। এরপর ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় শাহবাগ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ছিল।
বিয়ারিং প্যাড পড়ে যাওয়ার পর এগুলোর নিরাপত্তা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএমটিসিএলের এমডি বলেন, ‘বিয়ারিং প্যাড হঠাৎ করে পড়ে যায়নি। এটা হঠাৎ করে পড়ে যাওয়ার জিনিস নয়। যেহেতু এটা নিয়ে তদন্ত চলছে, ফলে এ বিষয়ে আমি জাজমেন্টাল হতে চাই না। তবে যেটা হতে পারে, সেটা বলতে পারি, ডিজাইন ফল্ট হতে পারে। যে জিনিসের ওপর বসানোর কথা বলা হয়েছিল, যা যা দেওয়ার কথা ছিল, সেটা বসানো হয়নি। যে ডিজাইনে হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়তো ঠিকাদার করেনি। যে পরামর্শককে বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তারা হয়তো ঠিক করে জিনিসটা বুঝে নেয়নি। এই চারটা কারণে হতে পারে অথবা এর মধ্যে কোনো একটা কারণেও হতে পারে।’
ফারুক আহমেদ আরও বলেন, ‘দোষ কিন্তু বিয়ারিংয়ের নয়। বিয়ারিং যে লাগিয়েছে, সেটি বাজেভাবে লাগানো হয়েছে কি না? যার আসলে বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব ছিল, সে বুঝে নিয়েছে কি না, সেগুলো এখন দেখতে হবে।’
আরও পড়ুনবৃষ্টির পানি ঢোকে, এসি বিকল হয়, মেট্রোরেল ব্যবস্থায় ৪৫ সমস্যা০২ নভেম্বর ২০২৫এসব কাজ বুঝে নেওয়ার জন্য হাজার কোটি টাকায় বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ করা আছে জানিয়ে ফারুক আহমেদ বলেন, ‘প্রথম ঠিকাদারের কাছ থেকে বুঝে নেবেন পরামর্শক। আমাদের বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পরামর্শকদের। তখন এই কাজগুলো কিছুটা তাড়াহুড়া হয়েছে। কেন হয়েছে, সেটার উত্তর তো আমি দিতে পারব না। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সেই অংশে অনেক ডিফেক্ট আছে। ফলে সেটা এখনো আমরা বুঝে নিইনি।’
ডিএমটিসিএলের এমডি বলেন, যেখানে বিয়ারিং প্যাড পড়ে গিয়েছিল, ওই অংশের ত্রুটি সারিয়ে দেওয়ার সময়সীমা (ডিফেক্ট লায়াবেলিটি) গত জুন পর্যন্ত ছিল। কিন্তু ডিএমটিসিএল তাদের এই সময়সীমা গ্রহণ করেনি। কারণ, এখনো অনেক বড় ত্রুটি রয়ে গেছে। যত সমস্যা আছে, এগুলো ঠিকাদারকে মেরামত করতে হবে। এ জন্য ‘ডিফেক্ট লায়াবেলিটি’ দুই বছর বাড়ানোর জন্য ঠিকাদারকে বলা হয়েছে।
দুর্ঘটনার পর মেট্রোরেলের সব কটি পিলার পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে জানিয়ে ফারুক আহমেদ বলেন, এর আগে পুরো পথের বিয়ারিং প্যাডের ছবি ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে তোলা হয়েছে। এরপর কর্মকর্তারা সরেজমিনে নিরীক্ষা করেছেন। যেসব স্থানে ত্রুটি শনাক্ত করা হয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে জানানো হয়েছে। ডিএমটিসিএলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো, যেখানে ত্রুটি বা সমস্যা পাওয়া যাবে, সেখানে বিয়ারিং প্যাড অবশ্যই পরিবর্তন করা হবে।
আরও পড়ুনমেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড কী, খুলে পড়ার কারণ কী হতে পারে২৬ অক্টোবর ২০২৫চার বছর আগে তাড়াহুড়া করে ঢাকার মেট্রোরেল চালু করা হয়েছিল দাবি করে ফারুক আহমেদ বলেন, প্রকল্পটি চালুর আগে ন্যূনতম ছয় থেকে নয় মাসের পরীক্ষামূলক চলাচল নিশ্চিত করার প্রয়োজন ছিল। তিন বছরে মেট্রোরেল চালু হবে বা পাঁচ বছরে মেট্রোরেল সম্পূর্ণ হবে—এ ধরনের ধারণা আসলে ভুল। কোনো মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য সব ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার পর ছয় থেকে সাত বছর লাগে। এর আগে প্রকল্প প্রণয়ন, সম্ভাব্যতা যাচাই ও অন্যান্য প্রস্তুতিতে চলে যায় তিন বছর।
২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় ছয়টি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের যে লক্ষ্যমাত্রা আগে নেওয়া হয়েছিল, তা কিসের ভিত্তিতে হয়েছে, তা তার বোধগম্য নয় বলে মন্তব্য করেন ডিএমটিসিএলের এমডি।
নতুন মেট্রোরেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প তাহলে মুখ থুবড়ে পড়ছে কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে ফারুক আহমেদ বলেন, ‘মেট্রোরেল প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েনি। মেট্রোরেল আমাদের লাগবে। আমাদের লক্ষ্য হলো, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন এই প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হয়। সরকারের উদ্দেশ্য হলো একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করা, যাতে একাধিক প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে পারে এবং কম খরচে উন্নত মানের মেট্রোরেল নির্মাণ সম্ভব হয়। মেট্রোরেল আমাদের করতেই হবে; তবে তা হবে স্মার্ট ফাইন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে।’
আরও পড়ুনবিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে ফার্মগেটে একজন নিহত, মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ২৬ অক্টোবর ২০২৫