গোলাপী-নীল-কমলা রঙের স্কুলব্যাগগুলো পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। চূর্ণ-বিচূর্ণ ইটের সঙ্গে মিশে গেছে ভাঙা চেয়ার, টেবিল। পাশেই স্পাইডারম্যান খেলনা আর অক্ষর সাজানোর বর্ণমালাগুলো। প্রায় ১৫টি শিশুর স্কুলব্যাগ ধ্বংসস্তূপের নিচে ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এরই মাঝে ছোট সন্তানদের খুঁজছেন, নাম ধরে ডাকছেন অসহায় বাবা-মায়েরা। কাঁদতে কাঁদতে রাত পর্যন্ত সন্তানদের নাম ধরে ডাকতে দেখা গেছে। তিন দিন পর সোমবার ঘটনাস্থলটি নীরব। স্থানীয় লোকদের মুখে শোকের ছাপ। 

মিয়ানমারের ভূমিকম্পে বিধস্ত একটি প্রাক প্রাথমিক স্কুলের চিত্র এটি। মান্দালয় থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে কিয়ুকসে শহরের একটি স্কুল। শুক্রবার ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর একটি। 

স্থানীয়রা বলছেন- পুরো শহরের লোকজন উদ্ধার কাজে সাহায্য করতে এসেছিল এই স্কুলে। শুক্রবার বেশ কয়েকটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় সেখান থেকে। তারা বলছেন, ওই দিন স্কুলে দুই থেকে সাত বছর বয়সী প্রায় ৭০ জন শিশু আনন্দের সঙ্গে পড়াশোনা করছিল। কিন্তু এখন ইট, সিমেন্ট ও লোহার রডের স্তূপ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেখানে ১২ জন শিশু ও একজন শিক্ষক মারা গেছেন। তবে স্থানীয়দের বিশ্বাস- সংখ্যাটি কমপক্ষে ৪০ জন হবে। সেখানকার বাসিন্দা ও অভিভাবকদের চোখেমুখে হতাশা।   

৭১ বছর বয়সী কিউয়ে নাইইন স্কুলটির ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন। পাঁচ বছর বয়সী নাতনি থেট হটার সানের শেষকৃত্যের প্রস্তুতি নিচ্ছে তার পরিবার। তিনি জানান, ভয়াবহ ভূমিকম্প শুরু হওয়ার সময় সানের মা দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। তিনি দৌড়ে স্কুলে যান, কিন্তু ভবনটি সম্পূর্ণরূপে ধসে পড়ে। প্রায় তিন ঘণ্টা পর ছোট্ট শিশুর মৃতদেহ পাওয়া যায়। ঘটনার ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘সৌভাগ্যবশত, আমরা আমাদের প্রিয়জনের মৃতদেহ অক্ষত অবস্থায় পেয়েছি, মানে এক টুকরো অবস্থায়।’

এমন অবস্থা মিয়ানমারের আরও অনেক জায়গায়। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- উদ্ধার ও চিকিৎসা তৎপরতা যথেষ্ট নয়। উদ্ধারকর্মীরা খালি হাতে ধ্বংসস্তুূপ ঘেঁটে দেখছেন। সাহায্যকারী সংস্থাগুলো মিয়ানমারে মানবিক সংকটের আরও অবনতির ব্যাপারে সতর্ক করছে। হাসপাতালগুলোর অনেক ক্ষতি হয়েছে। 

মান্দালয় থেকে বিবিসি বার্মিজের রিপোর্টার হতেত নাইং জাও-এর বক্তব্য তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত একটি এলাকা দেখেছি, সেটি হলো সরকারি কর্মচারীদের একটি আবাসিক এলাকা। পুরো নিচতলাটি ধসে পড়েছে, যার উপরে আরও তিনটি তলা এখনও দাঁড়িয়ে। ধ্বংসস্তূপে রক্তের দাগ। তীব্র দুর্গন্ধ থেকে বোঝা যাচ্ছিল, সেখানে অনেক লোক মারা গেছে, কিন্তু উদ্ধার কাজের কোনো চিহ্ন নেই। একদল পুলিশ আসবাবপত্র ও গৃহস্থালীর জিনিসপত্র ট্রাকে ভরছিল। মনে হচ্ছিল, তারা এখনও ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্র উদ্ধার করার চেষ্টা করছে। দায়িত্বে থাকা পুলিশ অফিসার আমাদের সাক্ষাৎকার দেননি, যদিও কিছুক্ষণের জন্য ভিডিও করার অনুমতি দিয়েছিল। আমরা স্থানীয় লোকদের শোকাহত ও নিশ্চুপ অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলাম। সামরিক সরকারের ভয়ে তারা মিডিয়ার সঙ্গে হয়তো কথা বলতে চাইছিল না।

হতেত নাইং জাও বলেন, আমাদের অনেক প্রশ্ন ছিল। ধ্বংসস্তূপের নিচে কতজন লোক থাকতে পারে? তাদের মধ্যে কেউ কি এখনও বেঁচে থাকতে পারে? কেন কোনো উদ্ধারকাজ করা হয়নি, এমনকি মৃতদেহও উদ্ধার করা হয়নি কেন?

মিয়ানমারের রাজধানীর একটি হাসপাতালের অবস্থা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা রাজধানীর সবচেয়ে বড় হাসপাতাল পরিদর্শন করেছি, যা এক হাজার শয্যার হাসপাতাল। ওই হাসপাতালের জরুরি কক্ষের ছাদ ভেঙে পড়েছে। প্রবেশপথে, ইংরেজিতে ‘জরুরি বিভাগ’ লেখা একটি সাইনবোর্ড মাটিতে পড়েছিল। বাইরে ছয়টি সামরিক চিকিৎসা ট্রাক এবং বেশ কয়েকটি তাঁবু, যেখানে হাসপাতাল থেকে সরিয়ে নেওয়া রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তীব্র গরম থেকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার জন্য তাঁবুগুলোতে পানি ছিটানো হয়। দেখে মনে হচ্ছিল, সেখানে প্রায় ২০০ জন আহত ব্যক্তি ছিলেন, যাদের কারও মাথা রক্তাক্ত, কারও হাত-পা ভাঙা।

হতেত নাইং জাও- এর বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আমরা একজন কর্মকর্তাকে জরুরি অবস্থার সময় কাজে না আসা কর্মীদের তিরস্কার করতে দেখলাম। আমি বুঝতে পারলাম লোকটি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড.

থেট খাইং উইন। একটি সাক্ষাৎকারের জন্য তার কাছে গিয়েছিলাম কিন্তু তিনি সাক্ষাৎকারের অনুরোধে তিনি সাড়া দেননি।

শহরে ঢোকার পথে, মহাসড়কের পাশে গাছের নিচে মানুষ দলবেঁধে বসেছিল প্রচণ্ড রোদ থেকে কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার জন্য। এখন বছরের সবচেয়ে উষ্ণতম সময়। তাপমাত্রা প্রায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কিন্তু আফটারশকের (ভূকম্প পরবর্তী কম্পন) কারণে তারা ভবনের ভেতরে থাকতে ভয় পাচ্ছিল।

প্রতিবেদক বলেন, আমরা রোববার ভোর ৪টায় ইয়াঙ্গুন থেকে ভূমিকম্প অঞ্চলে যাত্রা শুরু করেছিলাম যা মান্দালয় থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দক্ষিণে। রাস্তায় আলো ছিল না। তিন ঘণ্টারও বেশি সময় গাড়ি চালানোর পর আমরা কমলা রঙের পোশাক পরা প্রায় ২০ জন উদ্ধারকর্মীর একটি দলকে দেখতে পেলাম, যাদের জ্যাকেটের ওপর লোগো ছিল যাতে লেখা- তারা হংকং থেকে এসেছেন। আমরা উত্তর দিকে গাড়ি চালানোর সময় রাস্তায় ফাটল দেখতে শুরু করি।

সাধারণত এই রুটে বেশ কয়েকটি চেকপয়েন্ট থাকে, কিন্তু আমরা ১৮৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে একটি চেকপয়েন্ট দেখতে পাই। একজন পুলিশ অফিসার আমাদের জানান, সেতু ভেঙে যাওয়ার কারণে সামনের রাস্তা বন্ধ। তিনি আমাদের একটি বিকল্প পথ দেখিয়ে দিলেন। আমরা আশা করেছিলাম, রোববার রাতের মধ্যে মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ে পৌঁছাব। কিন্তু সেই গতি পরিবর্তন এবং গরমে আমাদের গাড়ির সমস্যা হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। একদিন পর, আমরা অবশেষে শহরে পৌঁছে যাই। শহরটি সম্পূর্ণ অন্ধকারে ডুবে আছে, রাস্তার বাতি জ্বলছে না। ঘরবাড়িতে বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থা নেই। সকাল হলে এখানে কী পাব তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ভ ম কম প ন হত ভ ম কম প র জন য আম দ র র একট সবচ য অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত

ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।

মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স। 

গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’

পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।

আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।

সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’ 

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’

তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে আত্মসমর্পণ ও অস্ত্রত্যাগের প্রস্তাব মাওবাদীদের
  • হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত