হারিয়ে যাওয়ার পথে খাতুনগঞ্জের হালখাতা
Published: 12th, April 2025 GMT
হালখাতা। হিসাব হালনাগাদ করা থেকেই হালখাতা শব্দের উদ্ভব। বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন লালখাতায় হালনাগাদ করার প্রক্রিয়াটি ব্যবসায়ীদের কাছে হালখাতা হিসেবে পরিচিত। বিশেষভাবে তৈরি করা এই খাতাটি বৈশাখের প্রথম দিনে হালনাগাদ করা হয়। দিনটিতে ব্যবসায়ীরা দেনা-পাওনার হিসাব সমন্বয় করে খোলেন নতুন খাতা। দেনাদার-পাওনাদারদের মিষ্টিমুখ ও কোমল পানীয় দিয়ে করানো হতো আপ্যায়ন। আর এর মধ্য দিয়ে তাদের বিনীতভাবে মনে করিয়ে দেওয়া হতো পাওনা পরিশোধ করার কথাও। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একদিকে থরেথরে সাজিয়ে রাখা হতো নানান মুখরোচক খাবার; আর অন্যদিকে জমা হতে থাকত পাওনা টাকা। এভাবেই বাংলা সনের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা আনুষ্ঠানিকভাবে দোকানপাটের হিসাব হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া শুরু করতেন।
কয়েক বছর আগেও দেশের ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বৃহৎ পাইকারি মোকাম চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে ধুমধাম করে পালন করতেন হালখাতা উৎসব। এ উৎসব ঘিরে এক সপ্তাহ আগে থেকেই পুরো বাজারে সাজ সাজ রব পড়ে যেত। পহেলা বৈশাখের ১০ থেকে ১৫ দিন আগে থেকেই হালখাতা পালনের নানা প্রস্তুতিও শুরু করতেন। ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা করার কাজটি শুরু করতেন। অনেকে নতুন রঙে রাঙিয়ে তুলতেন নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানকে। কে কার চেয়ে নান্দনিকভাবে প্রতিষ্ঠানকে তুলে ধরবেন তা নিয়ে চলত এক ধরনের প্রতিযোগিতাও। তবে হালখাতার সেই জৌলুস এখন আর নেই। কালের বিবর্তন ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় শত বছরের ঐতিহ্যবাহী হালখাতা উৎসব হারিয়ে যাওয়ার পথে। ঐতিহ্যের লালখাতার জায়গা এখন করে নিয়েছে কম্পিউটার-ল্যাপটপ। বাপ-দাদার রীতি-প্রথা ধরে রাখতে বর্তমানে হাতে গোনা কিছু প্রতিষ্ঠান ছোট পরিসরে পালন করে হালখাতা। আগে ব্যবসায়ীরা কেবল মুখের কথায় বিশ্বাস করে একে অপরের সাথে লাখ টাকা বাকি দিতেন। যার বেশির ভাগই উসুল হতো হালখাতার দিনে। তবে সেই বিশ্বাস এখন আর নেই। এখন লেনদেন চলে গেছে চেকে; ব্যাংকের মাধ্যমে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় তাই পাল্টে গেছে আয়োজনের ধরনও।
খাতুনগঞ্জের প্রবীণ ব্যবসায়ী মিলন চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের সময়কার হালখাতা আর এখনকার হালখাতার মধ্যে অনেক পার্থক্য। হালখাতা উদযাপনকে কেন্দ্র করে এক থেকে দুই সপ্তাহ আগেই পুরো বাজারে সাজ সাজ রব পড়ে যেত। কে অন্যের চেয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানকে নতুন রং, ফুল ইত্যাদি দিয়ে সাজাবে তা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত। পাশাপাশি দোকানে বিখ্যাত মিষ্টি, জিলাপিসহ নানা মুখরোচক খাবার নিয়েও থাকত আগেভাগে প্রস্তুতি। হালখাতার দিন ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের জটলায় প্রতিটি দোকান পরিণত হতো মিলনমেলায়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একেবারে অন্যরকম এক দিন পার করত সবাই। তবে বর্তমানে এসবের কিছুই নেই।’ খাতুনগঞ্জের বর্তমান জেনারেশনের
বেশ’কজন ব্যবসায়ীর মধ্যে একজন আরিফ মোহাম্মদ ফোরকান। তিনি মেসার্স এম আই ট্রেডিংয়ের সত্ত্বাধিকারী। হালখাতা প্রসঙ্গে মোহাম্মদ ফোরকান বলেন, ‘হালখাতা নিয়ে বাবা-চাচাদের কাছ থেকে অনেক কিছুই শুনেছি। অনেক আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বর্ণাঢ্যভাবে বিশেষ এই উৎসব পালন করা হতো চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে। কয়েক বছর আগেও স্বচক্ষে দেখতাম হালখাতাকে ঘিরে ব্যবসায়ীদের নানা তোরজোড়। তবে বর্তমানে মাত্র ৫ শতাংশ ব্যবসায়ী হালখাতা পালন করেন। এ কারণে আমরা তরুণ ব্যবসায়ীরাও হতাশ। ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে আগামীর প্রজন্মকে জানাতে বাঙালির এমন আয়োজনগুলোকে রক্ষা করা প্রয়োজন।’
আরেক ব্যবসায়ী রাজীব চক্রবর্তী বলেন, ‘হালখাতার সাথে জড়িয়ে আছে দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য। এখানকার সকল ধর্মের ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত আনন্দের সাথে হালখাতা উৎসব উদযাপন করতো। এ নিয়ে পুরো বাজারে থাকতো নানা কৌতুহলও। বর্তমানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ী দৈনন্দিন লেনদেনের হিসাব সংরক্ষণ করেন কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপে। আগে মুখের কথায় যে লেনদেন হতো তা এখন চলে গেছে ব্যাংকে; চেকের মাধ্যমে। একারণে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী হালখাতার জৌলুস।’ ব্যবসায়ীরা বলেন, নতুন বছরটা ভালোভাবে যাবে এমন প্রত্যাশায় ব্যবসায়ীরা বছরের প্রথম দিন উৎসাহ-উদ্দীপনা ও নানা আচার রীতি মেনে হালখাতা খুলতেন। পুরনো খাতা বাদ দিয়ে নতুন খাতায় প্রথম দিন থেকেই যাবতীয় লেনদেন লিপিবদ্ধ করতেন।
হালখাতার জৌলুস কমে যাওয়ায় এখন আর আগের মতো বিক্রিও হয় না হালখাতা হিসেবে ব্যবহৃত লালখাতাও। এতে হতাশ বিক্রেতারা। চট্টগ্রাম নগরের আন্দরকিল্লা, বক্সিরবিট, টেরিবাজার, রেয়াজউদ্দিন বাজার, দেওয়ান বাজারসহ আরও কয়েকটি স্থানে একসময় অনেক প্রতিষ্ঠান বিশেষভাবে তৈরি করা লালখাতা বিক্রি করতেন। তবে এখন আগের মতো চাহিদা না থাকায় অনেকে পরিবর্তন করেছেন ব্যবসার ধরন। টেরিবাজারের ব্যবসায়ী আশীষ চৌধুরী বলেন, ‘আগে পহেলা বৈশাখের প্রায় দুই সপ্তাহ আগে থেকেই লালখাতার অর্ডার আসতো। শহরের পাশাপাশি উপজেলা থেকেও ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা লালখাতা কিনতে দোকানে ছুটে আসতেন। তবে পহেলা বৈশাখের আর মাত্র কয়েকদিন বাকি থাকলেও তেমন বেচাবিক্রি নেই। শহরের কয়েকটি স্থান থেকে কিছু হিন্দু ব্যবসায়ী কেবল লালখাতা কিনতে আসছেন। অথচ একসময় সকল ধর্মের ব্যবসায়ীরা এটি কিনতেন।’ ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক ও মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবরের শাসনামল থেকে নতুন বছরের শুরুতে হালখাতার প্রচলন শুরু হয়। তখন থেকেই পুরনো হিসাব বন্ধ করে নতুন হিসাব খোলার এই রীতি হালখাতা নামে পরিচিতি লাভ করে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বর ষ ব দ য় খ ত নগঞ জ র র প রথম দ ন ব যবস য় র র ব যবস য় ল নদ ন করত ন
এছাড়াও পড়ুন:
যে কারণে সালাহ-ফন ডাইকদের কাছে এই শিরোপা বিশেষ
একসময় ইংলিশ ফুটবলের রাজা তারাই ছিল। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত তো বলতে গেলে লিভারপুলেরই একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল ইংল্যান্ডের শীর্ষ লিগে। তখন অবশ্য নামটা প্রিমিয়ার লিগ ছিল না, ছিল প্রথম বিভাগ লিগ। ১৯৯২ সালে প্রিমিয়ার লিগ নাম হওয়ার পর থেকে যেন লিভারপুলের দুর্ভাগ্যের শুরু। প্রথম বিভাগ যুগে ১৮টি লিগ জেতা লিভারপুল প্রিমিয়ার লিগ যুগে এসে জিততেই ভুলে গেল!
প্রিমিয়ার লিগে শুরু হলো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের একচ্ছত্র রাজত্ব। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের অধীন ১৩বার লিগ জিতে ইউনাইটেডের মোট লিগ শিরোপা হয়ে গেল ২০টি। লিভারপুলকে পেরিয়ে তারা হয়ে গেল ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল ক্লাব।
ইউনাইটেডের সেই আধিপত্যও শেষ হলো ২০১৩ সালে ফার্গুসনের অবসরের পর। কিন্তু রাজত্ব ফিরে পেল না লিভারপুল। ইংলিশ ফুটবলের নতুন রাজা হয়ে ওঠল ম্যানচেস্টার সিটি। পেপ গার্দিওলার অধীন সর্বশেষ সাত মৌসুমে ছয়বার শিরোপা জিতে সিটি একের পর এক নতুন রেকর্ড গড়তে থাকল।
আরও পড়ুনলাল সমুদ্রে গোল উৎসবে চ্যাম্পিয়ন লিভারপুল১১ ঘণ্টা আগেমাঝে ২০১৯-২০ মৌসুমে ৩০ বছর পর লিভারপুল পেল ইংলিশ লিগের শিরোপার স্বাদ। তবে পৃথিবী তখন করোনা মহামারি চলছে। শিরোপা উৎসব হলো না লিভারপুলের মনের মতো।
এবার আর্নে স্লটের অধীন প্রথম মৌসুমেই আবার চ্যাম্পিয়ন লিভারপুল। সেটাও কী রাজকীয়ভাবে! চার ম্যাচ হাতে রেখে, নিজেদের মাঠ অ্যানফিল্ডে, ভরা গ্যালারির সামনে। লিভারপুলের এটি ২০তম লিগ শিরোপা, ইউনাইটেডের সঙ্গে যৌথভাবে তারাও এখন ইংল্যান্ডের সবচেয়ে সফল ক্লাব।
ইতিহাস গড়া এই ট্রফি জেতার পর কী বলছেন লিভারপুলের খেলোয়াড়েরাকোডি গাকপোর উদ্যাপন