পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন জেলায় সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, যানজটে ভোগান্তি
Published: 16th, April 2025 GMT
ছয় দফা দাবিতে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আজ বুধবার দেশের বিভিন্ন জেলায় সড়ক ও মহাসড়ক অবরোধ করেছেন। এতে সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। যানজটে ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রী ও চালকেরা। এ ছাড়া রাজশাহীতে রেলপথ অবরোধ করায় ট্রেন চলাচল বন্ধ আছে।
রাজশাহী
রাজশাহীর তিনটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আজ দ্বিতীয় দিনের মতো সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেছেন। দুপুর ১২টার দিকে নগরের ভদ্রা মোড় এলাকায় তাঁরা অবস্থান নেন। এতে ওই মোড়ের তিন দিকের সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়। এদিকে শিক্ষার্থীদের এই কর্মসূচির কারণে রাজশাহী থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
এর আগে আজ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজশাহী পলিটেকনিক, মহিলা পলিটেকনিক ও সার্ভে ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জমায়েত হন। পরে তাঁরা নগরের রেলগেট এলাকায় আসেন। এরপর দুপুর ১২টার দিকে মিছিল নিয়ে তাঁরা নগরের ভদ্রা মোড় এলাকায় তিন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড় অবরোধ করেন। এ সময় তাঁরা পাশে থাকা রেলপথেও অবস্থান নেন।
গতকাল মঙ্গলবার রাজশাহী পলিটেকনিক, মহিলা পলিটেকনিক ও সার্ভে ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা একই দাবিতে নগরের রেলগেট এলাকায় অবস্থান নিয়ে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন। পরে সাড়ে তিন ঘণ্টা পর সড়ক ও রেলপথ ছেড়ে দেন তাঁরা।
রাজশাহী পলিটেকনিকের শিক্ষার্থী জুয়েল রানা বলেন, সারা দেশে আজ এই কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চলবে।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় দিনের মতো সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেছেন। সেখানে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আছেন। এখন পর্যন্ত কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি।
রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের ব্যবস্থাপক শহীদুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীদের অবরোধের কারণে তিনটি ট্রেন আটকে আছে। কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস ট্রেনটি স্টেশনে এসে বেলা আড়াইটায় আবার ছাড়বে, ধূমকেতু এক্সপ্রেস ঢাকা থেকে আসবে, টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস আসবে গোপালগঞ্জ থেকে। ট্রেনগুলোর বেলা দুইটার দিকে রাজশাহী স্টেশনে ঢোকার কথা। তবে অবরোধের কারণে রাজশাহীর বাইরে আবদুলপুর, সারদা, ঈশ্বরদীসহ বিভিন্ন স্টেশনে অবস্থান করছে।
সিলেটসিলেটে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা দুপুর ১২টার দিকে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের চণ্ডীপুল এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন। এতে ওই মহাসড়কের যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে।
এর আগে বেলা ১১টার দিকে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে মিছিল নিয়ে বের হন। পরে সিলেটের চণ্ডীপুল এলাকায় জড়ো হয়ে সড়ক অবরোধ করেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। পুলিশের কর্মকর্তারা সড়ক থেকে সরে যাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
ময়মনসিংহএকাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করে আজ বেলা সাড়ে ১১টায় মাসকান্দা এলাকায় ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দীঘারকান্দা বাইপাস এলাকায় গিয়ে দুপুর সোয়া ১২টা থেকে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ।
কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা ‘যাদের হাতে স্ক্রু ড্রাইভার, তাদের হাতে চক-ডাস্টার মানায় না’, ‘মামা থেকে মাস্টার, মামা বাড়ির আবদার’, ‘১১৩–এর হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘আসো মামা খেলা হবে’, ‘ক্রাফট মামা হঠাও, পলিটেকনিক শিক্ষা বাঁচাও’, ‘তুমি কে, আমি কে, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার’, ‘জ্বালোরে জ্বালো, আগুন জ্বালো’ প্রভৃতি স্লোগান দেন। ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, রুমডো ও মোমেনশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা দীঘারকান্দা বাইপাস এলাকায় একত্র হয়ে বিক্ষোভ করেন।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থী মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ এগিয়ে দেন ক্রাফট মামারা। কিন্তু তাঁরা শিক্ষক হতে চান, এটা মানা যায় না। তাঁরা ব্লক পোস্টে যোগদান করে শিক্ষক হলে আমরা যাঁরা কারিগরি শিক্ষা অর্জন করছি, তাঁরা কোথায় যাব? এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে, কারিগরি শিক্ষা ধ্বংস করার জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম খান বলেন, শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন। পুলিশের সতর্ক অবস্থান রয়েছে।
রাজশাহীতে রেললাইনে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করেছেন শিক্ষার্থীরা। আজ দুপুরে নগরের ভদ্রা মোড় এলাকায়.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সড়ক ও র লপথ অবস থ ন এল ক য় নগর র
এছাড়াও পড়ুন:
‘রক্ত দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা আর অন্য কিছুতেই নেই’
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর আনন্দিপুর গ্রামের মামুন মিয়া (২২) ছোটবেলা থেকে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত। প্রায় প্রতি মাসেই তাঁর একাধিক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের পক্ষে এক সময় রক্তের জোগাড় বেশ কষ্টসাধ্যই হয়ে ওঠে। মানুষ বিনা স্বার্থে রক্ত দিতে চাইতেন না। ২০১৬ সাল থেকে পরিবারটিকে রক্তের জন্য আর কাউকে অনুরোধ করতে হচ্ছে না। মামুনের পাশে দাঁড়িয়েছে জেলার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
সম্প্রতি মামুনের মা মাজেদা বেগম অতীতের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘পোলার রক্তের লাইগ্গা মাইনষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কেউ রক্ত দিতে চাইতো না। মানুষ টাকা ভিক্ষা চায়, আর আমি মানুষের কাছে আমার পোলার জন্য রক্ত ভিক্ষা করছি। শইল্যে রক্ত না ভরলে আমার পোলা মইরা যাইতো।’
দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ব্যক্তি, জরুরি বা সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার, ক্যানসার, থ্যালাসেমিয়া কিংবা কিডনি আক্রান্ত রোগীর জন্য প্রায়ই প্রয়োজন হয় রক্তের। আত্মীয়স্বজন বা চেনাজানা কারও কাছে প্রয়োজনমাফিক রক্ত না পেয়ে অনেকেই ছুটে যান স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠনের কাছে। খবর পেয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা দ্রুততার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রক্তদাতাকে খুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করেন। আর মানুষের জীবন বাঁচানোর মতো মহৎ এই কাজেই তাঁদের আনন্দ বলে জানান ময়মনসিংহের ‘ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটি’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কয়েকজন কর্মী।
শুধু রক্তদান নয়, সমাজ পরিবর্তনে নানা কাজও করে চলেছে তরুণদের নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট এটি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন পায়। তবে এর দু-এক বছর আগেই সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু হয় বলে জানান সংগঠনটির মূল পরিকল্পনাকারী মমিনুর রহমান। তাঁর বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাইজবাগ এলাকায়।
সম্প্রতি মমিনুর রহমান বলেন, ‘শুধু রক্তের অভাবে একটি মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে না, এই চিন্তা থেকে কাজ শুরু করি। ময়মনসিংহে রক্তদান নিয়ে কাজ করে—এমন কোনো সংগঠন ছিল না। তখন স্থানীয়ভাবে মানুষকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্যাম্পেইন করে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর ৩৯ জনকে নিয়ে প্রথম সভা করি। পরে সেখান থেকে রক্তদানের এই সংগঠন করার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। যেহেতু ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বসে ওই সভা হয়েছিল, তাই সংগঠনটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটি’। ‘আর্তের মুখে হাসি ফোটানোই হয় যদি মানবতা, তবে তার শ্রেষ্ঠ সেবক হলো প্রতিটি রক্তদাতা’, এই স্লোগান সামনে রেখে শুরু হয় এর যাত্রা।
সংগঠনটি থেকে জানানো হয়েছে, রক্তদাতা তরুণেরা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সংগঠনটির একটি কমিটি ও ফেসবুক পেজ আছে। এর মাধ্যমে কিংবা মুঠোফোনে খবর পেয়েই রক্ত দিতে ছুটে যান তরুণেরা। তরুণদের তৎপরতায় দিন দিন সংগঠনটির পরিসর বাড়ছে। বর্তমানে এই সংগঠনের প্রায় ৫০ হাজার সদস্য আছেন, যাঁরা নিজেরা রক্তদান করেন এবং রক্তদানে অন্য তরুণদের উৎসাহিত করেন। ২০ বারের বেশি রক্ত দিয়েছেন, এমন রক্তদাতা আছেন ৮০ জন, যার ৬০ জনই শিক্ষার্থী। শুধু ময়মনসিংহ শহরেই ইতিমধ্যে ৩৫ হাজার ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন সংগঠনটির তরুণেরা। এর মধ্যে প্রায় ২৩ হাজার ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস ২০১৮ সাল থেকে ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত আছেন। এ পর্যন্ত তিনি ২৬ বার রক্ত দিয়েছেন। অন্যদের উৎসাহী করতে তিনি বলেন, ‘মুমূর্ষু অবস্থায় মানুষ রক্তের কারণে মারা যাবে, এটি কখনো হতে পারে না। তাই অসুস্থ জটিল রোগীর খবর পেলেই রক্ত দিতে যাই। রক্ত দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা আর অন্য কিছুতেই নেই।’
সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি আবিদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক সুমন রাহাত। স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত আবিদুর রহমান বলেন, ‘যাঁদের রক্তের প্রয়োজন, তাঁরা আমাদের ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করেন। অথবা রক্তের প্রয়োজন ফেসবুকে কারও স্ট্যাটাস দেখলেই আমরা নিজে থেকে যোগাযোগ করে রক্তের ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। আমরা রক্তদানের মাধ্যমে অন্যের জীবন বাঁচিয়ে আনন্দিত হই। আমরা মানুষ বাঁচানোর এই আনন্দ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। গ্রামে, পাড়ায় মহল্লায় রক্তের জন্য মানুষ যেন না মরে, এটিই আমাদের লক্ষ্য।’