প্রকৌশলী এবং ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের কোটা কেন বাতিল নয়
Published: 19th, April 2025 GMT
গত ১৬ মার্চ এক ভিয়েতনামি ডেলিগেশনের সঙ্গে মিটিং ছিল সকাল সাড়ে দশটায়। ভিয়েতনামিরা সাধারণত সময় মেনে চলেন। কিন্তু সাড়ে দশটায় ফোন এল। ফোনের ওপার থেকে বলা হলো, ‘সুবাইল, আমি খুব দুঃখিত, ঠিক সময়ে রওনা দিয়েও আমি এক জায়গায় আটকে আছি।’
খোঁজ নিয়ে জানলাম, আন্দোলনের দেশে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীর শিক্ষার্থীরা রাস্তা আটকে রেখেছেন। এ কারণে অনেক মানুষ আটকা পড়েছেন। আমার মতো এ রকম ভুক্তভোগী আরও অনেকেই হয়েছেন নিশ্চয়ই।
আসুন, ঘুরে আসি আরও আগের সময়ে। মার্চের ১১ তারিখে আদালত এক যুগান্তকারী রায় দিয়েছিলেন। সে রায়ে বলা হয়েছে, এমবিবিএস এবং বিডিএস ছাড়া কেউ নামের আগে ‘ডাক্তার’ লিখতে পারবেন না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এ দেশে প্রকৌশলী বা ইঞ্জিনিয়াররা অনেক উদার। বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের অনেকে নামের আগে পিছে কিছু না লিখলেও ডিপ্লোমাধারী প্রকৌশলীরা তাঁদের নামের আগে ইঞ্জিনিয়ার লিখে রাখবেনই। এ জন্যই অনেককেই হয়তো বলতে শুনবেন, ‘আমার অফিসেও তো একজন ইঞ্জিনিয়ার আছেন, অফিসের ফ্যান-বাতি ঠিক করেন।’
বিএমডিসি এ ব্যাপারে নিজেদের মান সংরক্ষণের ব্যাপারে যতটা উদ্গ্রীব, সেখানে ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স ইন বাংলাদেশ (আইইবি) ততটাই উদাসীন। আইইবিতে নির্দিষ্ট কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিষয় থেকে পাস করে তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকলেই কেউ মেম্বার হতে পারেন। আমরা তাঁদের তখন আসলে প্রকৌশলী বলতে পারি। তাঁরা বিদেশে গেলে এ–সংক্রান্ত সনদ ইস্যুও করতে পারেন। কিন্তু তাঁদের সনদের কোথাও কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় মনে হয়, এই দেশে প্রকৌশলীদের সংখ্যা এখন সবচেয়ে বেশি।
যেখানে এ দেশের চিকিৎসকেরা তাঁদের মান নিয়ে উদ্গ্রীব, সেখানে আমরা যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে টাকা থাকলেই বিএসসি প্রকৌশলী বানিয়ে দিচ্ছি। এরপর দোষ দিচ্ছি মান বা কোয়ালিটির। এই প্রকৌশলীরা চাকরির বাজারে বেতন কমিয়ে দিচ্ছেন।
সত্যিকারের দক্ষ প্রকৌশলীর সংখ্যা কম হওয়ায় দেশের মেগা প্রজেক্টে তাই আমাদের সুযোগ না দিয়ে বিদেশিদের নিয়ে আসা হয়। এই মেগা প্রজেক্টে যেসব স্থানীয় প্রকৌশলী/ডিপ্লোমাধারী (অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ে) কাজ করেন, তাঁদের বেশির ভাগই শুধু বিদেশ থেকে আনা প্রকৌশলীদের ফরমাশ রক্ষার কাজ করে যান।
যেহেতু এই প্রকল্পগুলোতে খুব কমই উন্মুক্ত নিয়োগ হয়, ফলে স্থানীয় প্রকৌশলীদের বেশির ভাগই সুপারিশে (মূলত দলীয় সুপারিশে) আসেন। ফলাফল হিসেবে এসব প্রকল্পে নিম্নমানের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা বা সাধারণ ডিপ্লোমাধারীরা আসেন। তাঁদের যথোপযুক্ত দক্ষতা যাচাই হয়নি এবং দেশ ভবিষ্যতে যদি আবারও মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও; তখন আবারও আমাদের বাইরের প্রকৌশলীদের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু বিদেশ থেকে যাঁরা উচ্চ বেতনে কাজ করে গেছেন, সুযোগ পেলে তাঁদের জায়গায় এ দেশের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কেউ কাজ করতে পারতেন।
খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলাম, এখন দেশে বিসিএস এবং ডিপ্লোমা—উভয় শ্রেণির প্রকৌশলীরা আন্দোলন করছেন। যেহেতু বিসিএসি ডিগ্রিধারী প্রকৌশলীরা সংখ্যায় কম, যেহেতু তাঁরা রাস্তা আটকিয়ে দাবিদাওয়া আদায় করার মতো অবস্থায় নেই, সেহেতু তাঁদের আন্দোলনকে কেউ খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের কিছু দাবি আসলেই ন্যায়সংগত। যেমন ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টরদের জন্য যে ৩০ শতাংশ প্রমোশন কোটা আছে, তা বাতিল করা উচিত। এরপর ডিপ্লোমাতে যেকোনো বয়সে ভর্তির সুযোগও এখন বাতিল করার সময় হয়েছে।
আমাদের তরুণ, প্রাণসঞ্চারী মানুষ দরকার এখন। ওদের শিক্ষাক্রম ইংরেজি এবং মানসম্পন্ন করার দাবি খুবই যৌক্তিক। এ জন্য কারিগরি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করা যেতে পারে। তবে তাঁদের বাকি দাবিগুলোকে খুব একটা যৌক্তিক মনে হয়নি।
ডিপ্লোমাধারীদের ৩ নম্বর দাবি যা আছে, তার বিপক্ষে বিসিএস প্রকৌশলী সমাজ। দশম গ্রেড পুরোপুরি ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য সংরক্ষিত এবং নবম গ্রেড প্রমোশনে ৩৩ শতাংশ কোটা তাদের জন্য সংরক্ষিত। এটি পুরোপুরি নতুন বাংলাদেশের চেতনার বিপক্ষে যায়। এর মানে দাঁড়াচ্ছে নবম এবং দশম গ্রেডে যদি ২০০টি আসন থাকে; ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য ১৩৩টি আসন সংরক্ষিত থাকবে এবং বিএসসি প্রকৌশলীদের জন্য থাকবে মাত্র ৬৬টি।
ফলাফল হিসেবে সরকারি প্রকৌশলীদের নামে দুটি অভিযোগ আসবে—‘আপনারা তো কাজ করেন না’ এবং ‘ইঞ্জিনিয়ারমাত্রই দুর্নীতিগ্রস্ত’। তাই এই কোটা বাতিল করে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে এটি ছাড়া উপায় নেই। এখানে লক্ষণীয়, সরকারি চাকরিতে ১৩তম গ্রেড থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারীরা চাকরি করতে পারেন।
একজন ইচ্ছা করলে নিচের গ্রেডে যেতে পারেন, এটি তাঁর অধিকার। কিন্তু এখানে ডিপ্লোমাধারীদের জন্য দশম গ্রেড সংরক্ষণের মাধ্যমে এই সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। এ ছাড়া তাঁরা সরকারি চাকরিতে প্রমোশনে ৫০ শতাংশ দাবি করছেন এবং মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি রিট করে আটকে দিয়ে সরকারি কাজ স্থবির করে ফেলছেন।
এ ছাড়া ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা নিজেদের জন্য মন্ত্রণালয় চাচ্ছেন এবং নিজেদের সংক্রান্ত বোর্ডসহ সবকিছুতে নিজেদের কারিগরি শিক্ষিত মানুষ নিয়োগ চাইছেন; যা আসলে অযৌক্তিক।
দেশ এমনিতেই মন্ত্রণালয়ের ভারে নুইয়ে আছে। সেখানে নতুন মন্ত্রণালয় আরও খরচ বাড়াবে। সব জায়গাই যদি নিজেদের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ নিয়োগ দেন, তাহলে দেশ আসলে আরও পেছাবে। আর একজন কারিগরি শিক্ষার মানুষ হচ্ছে এইচএসসি সমমানের।
এ ছাড়া আরও চারটি প্রকৌশলী কলেজকে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানানো হচ্ছে। যখন আমাদের এগোনোর সময়, আরও মেধাবী জনশক্তি দরকার, সেই সময়ে এই দাবি দেশকে আরও পেছনে টানবে। আপনারা বরং এখানে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দাবি করতে পারেন। যদি আপনার মেধা থাকে, অবশ্যই রাষ্ট্রের সেই সুযোগ দেওয়া উচিত। কিন্তু কোনো কোটার মাধ্যমে নয়।
এ ঘটনা মনে করিয়ে দেয়, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের সেই আন্দোলনের কথা যখন তাঁরা বুয়েটে নিজেদের ভর্তির সুযোগ চেয়ে বুয়েটে হামলা করতে যান। সেই আন্দোলনে সরকার নতিস্বীকার করে, সরকার গাজীপুর বিআইটি তাঁদের জন্য দিয়ে দেয়। কিছুদিন আগে তাঁদের দাবির ফলে সরকার কয়েক বছর অভিজ্ঞতা থাকলে ডিপ্লোমাদের গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার জন্য বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার কমিটিও গঠন করেছে।
আমি গুগলে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের দাবি নিয়ে সার্চ দেওয়ার পর দেখলাম, তাঁরা প্রতিবছর কিছু না কিছু দাবি নিয়ে সরকারকে চাপ দিচ্ছেন। তাঁদের সংখ্যাধিক্যের জন্য কোনো রাজনৈতিক দল তাঁদের খুব ঘাঁটায়ও না।
এখনো যদি আমরা কোটা দিয়ে দেশ চালাই এবং রাস্তা বন্ধ করলেই সব দাবি মেনে নেওয়া হয়, তাহলে তা দেশের জন্য মোটেও ভালো নয়। অবশ্যই ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের শিক্ষাক্রম উন্নত করতে হবে, সেই সঙ্গে দেশ পরিচালনায় ভালো প্রকৌশলী পেতে হলে সব কোটা থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে।
সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক জ কর আম দ র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
অটোরিকশার ধাক্কায় পড়ে যান মোটরসাইকেলচালক, কাভার্ডভ্যানের চাকায় পিষ্ট
রংপুরে কাভার্ডভ্যানের চাকার পিষ্ট হয়ে ফরহাদ আলম নামে এক মোটরসাইকেল চালক নিহত হয়েছেন। রোববার দুপুরে রংপুর নগরীর মাহিগঞ্জ কলেজের সামনে এই দুর্ঘটনা হয়।
নিহত ফরহাদ আলম রংপুর নগরীর লালকুঠির মোড় এলাকার শাহ আলমের ছেলে।
নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেন মাহিগঞ্জ থানার ওসি আব্দুল কুদ্দুস।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মাহিগঞ্জ কলেজের সামনে প্রথমে অটোরিকশার ধাক্কায় মোটরসাইকেল চালক একটি কাভার্ডভ্যানের পিছনের চাকার সামনে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মোটরসাইকেল চালকের ওপর দিয়ে কাভার্ডভ্যানের পিছনের চাকা উঠে যায়। ঘটনাস্থলেই পিষ্ট হয়ে মারা যান ফরহাদ আলম।
মাহিগঞ্জ থানার ওসি আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ঘটনার পরপরই আকিজ কোম্পানির ওই কাভার্ডভ্যানটি জব্দ করা হয়েছে। তবে চালক পলাতক রয়েছে।
ওসি বলেন, মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।