‘উপকূলে জরায়ু সংক্রমণ ব্যাপকহারে বেড়েছে’
Published: 19th, April 2025 GMT
নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে অবস্থিত আন্তর্জাতিক গবেষণা, শিক্ষা ও পরামর্শ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কেআইটি রয়্যাল ট্রপিক্যাল ইনস্টিটিউটে গবেষণা করছেন নাজনীন নাহার। নারীর স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে তাঁর গবেষণাকর্ম রয়েছে। তিনি কথা বলেছেন সমতার সঙ্গে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে কেমন প্রভাব পড়ছে?
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা অনেক বেশি ঝুঁকিতে রয়েছি। এর প্রভাব আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা, বেড়িবাঁধ ভেঙে বন্যা, মৌসুমি খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, এমনকি হিট ওয়েভ বা তাপপ্রবাহ উল্লেখযোগ্য। উত্তরাঞ্চলে খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি উল্লেখযোগ্য।
স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর এর প্রভাব কতটা গভীর?
স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে এবং এ তাপমাত্রা বাড়ার কারণে হিটস্ট্রোকের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া তাপমাত্রা বাড়ার কারণে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার মতো রোগব্যাধির প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে মানসিক স্বাস্থ্যেও অনেক বড় প্রভাব পড়েছে। নিয়মিত দুর্যোগ এবং দুর্যোগসংক্রান্ত সমস্যা মানুষকে মানসিকভাবে ব্যাপক আঘাত করে। কারও কারও এ ট্রমা কাটিয়ে উঠতে সারাজীবন লেগে যেতে পারে।
এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এটি ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যারা গর্ভবতী হচ্ছেন, লবণাক্ত পানি ব্যবহার এবং খাওয়ার কারণে তাদের গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ, ইউরিন ইনফেকশনের মতো বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যারা জীবন-জীবিকার জন্য অনেক বেশি সময় লবণাক্ত পানিতে সময় কাটাচ্ছেন। কাঁকড়া চাষ বা চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করার জন্য যারা নিয়মিত নোনাপানিতে যান, তাদের বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ এবং নারীর জরায়ু সংক্রমণ ব্যাপকহারে বেড়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি খাত। এর ফলে আমাদের অনেকেই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যারা আগে নিজেদের ফসল নিজেরাই উৎপন্ন করতেন, তারা এখন পেশা পরিবর্তন করার কারণে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছেন। জনসংখ্যার একটা বিশাল অংশ অপুষ্টিতে ভোগার আশঙ্কা বেড়েই চলেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় খাবার পানির স্বল্পতা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে দূষিত বা নোনাপানি পান করছেন। এর ফলে অনেক ধরনের পানিবাহিত রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যারা দায়ী, তাদের কেন আমরা এখনও দায়বদ্ধতার জায়গায় আনতে পারছি না?
অর্থনৈতিক ও ক্ষমতা কাঠামোর কারণে এটি সম্ভব হয়নি। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী দেশগুলো অর্থনৈতিক ও ক্ষমতার দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। মূলত মুনাফানির্ভর ব্যবস্থা জলবায়ুর সুবিচার অর্জনে একটি বড় বাধা। আন্তর্জাতিক দরকষাকষির ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর শক্তিশালী নেতৃত্বই পারে এ অবস্থার পরিবর্তন করতে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের অগ্রগতি কতটুকু?
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলাকে আমরা দু’ভাবে দেখতে পারি। প্রথমত, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব যেন আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে পারি এবং দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে ধীর করতে ব্যবস্থা নিতে পারি। জলবায়ু পরিবর্তনের দুর্যোগ যেন আমাদের কোনো ক্ষতি করতে না পারে তার জন্য আমরা জলবায়ুর অভিযোজন পদ্ধতিগুলো অনুশীলন করতে পারি। আমরা যত বেশি উদ্ভাবনী শক্তি অর্জন করতে পারব, আমাদের টিকে থাকা ততটা সহজ হবে। একইভাবে ভবিষ্যতে যেন জলবায়ুর প্রভাব বেশি ত্বরান্বিত না হয়, তার জন্য এখন থেকে আমাদের জলবায়ু প্রশমনের উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার হতে পারে ভালো একটি উদ্যোগ। একইসঙ্গে সব সমস্যার প্রকৃতিবান্ধব সমাধানকে প্রাধান্য দিতে হবে। এখন আমাদের জন্য বেশি জরুরি হলো– জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ী দেশগুলোকে দায়বদ্ধতার জায়গায় আনা, ক্ষতিপূরণে তাদের বাধ্য করা। এ সমস্যা মোকাবিলায় আমাদের বহুমুখী সমন্বিত কার্যকরী পরিকল্পনা দরকার।
lসমতা ডেস্ক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ক রমণ লবণ ক ত আম দ র র জন য অন ক ব জলব য় ন করত জলব য
এছাড়াও পড়ুন:
শালবনে ছেচরা কই ও পাটখই
বিভতিভূষণের আরণ্যক উপন্যাসে একজন যুগলপ্রসাদ ছিলেন, যিনি লবটুলিয়ার জঙ্গলে সরস্বতী কুন্ডের পাড়ে নানা জায়গা থেকে নানা প্রজাতির গাছপালা এনে লাগাতেন। সেসব গাছে ফুল ফুটলে আনন্দে তিনি আত্মহারা হয়ে যেতেন। আমারও একজন যুগলপ্রসাদ ছিলেন, নাম আজাহার। প্রায় আমারই সমবয়সী।
টাঙ্গাইলের সখীপুরে বিভিন্ন শালবনে ঘুরতে গেলে মাঝেমধ্যে তিনি আমার সাথি হতেন। শালবনে কত গাছ! তেমন কিছুই চিনি না। কিন্তু সেই শালবনের কোলে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা আজাহার ঠিকই সেসব গাছ চিনতেন, আর জিজ্ঞেস করলে টপাটপ নাম বলে দিতেন। কিন্তু গোলমাল বাধত সেসব নাম শুনে। কেননা সেসব নাম বলতেন, তাঁদের স্থানীয় ভাষায়। বইয়ে সেসব নাম খুঁজে পাওয়া যেত না।
একদিন শালবনের মধ্যে একটা ছোট গাছ দেখলাম, গাছের গুঁড়ির চারদিকে তীক্ষ্ণসরু ও সোজা প্রচুর কাঁটা বেরিয়েছে। পাতাগুলো দেখতে কিছুট পেয়ারাপাতার মতো। প্রচুর ডালপালায় গাছটার মাথা ঝাঁকড়া হয়ে আছে। ডালের আগায় শিষের মতো মঞ্জরিতে প্রচুর ঘিয়া ও সাদাটে রঙের খুদে ফুল ফুটেছে। চিনি না। তাই আজাহারকে জিজ্ঞেস করলাম, নাম কী? চট করেই বলে দিলেন, ছেচরা কই। মাছের নাম কই হয় জানি, কিন্তু কোনো গাছের নাম কই হতে পারে? অগত্যা ছবি তুলে ওই নামকেই মনে গেঁথে ফিরে এলাম ঢাকায়।
আজাহার বললেন, এখন ফুল দেখছেন। কদিন পরেই ওসব ফুল থেকে ছোট ছোট গুলির মতো প্রচুর ফল ধরবে। ছোটবেলায় আমরা সেসব কাঁচা ফল নিয়ে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ফটকা বানিয়ে তার চোঙে একটা একটা করে ফল দিয়ে বন্দুকের মতো গুলি গুলি খেলতাম। চোঙের ভেতরে একটা সরু কাঠি ঢুকিয়ে চাপ দিয়ে সেসব ফল গুলির মতো ফাটাতাম। ফটাস করে শব্দ হতো। এ সময় মাসখানেকের জন্য আমরা এ গাছের ফল, পরে জালি খেজুর নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতাম। শালবনে সে সময় এ গাছের অভাব ছিল না। এখন তো দেখতে হলে খুঁজে বের করতে হয়।
ফিরে এসে সে ছবি পাঠালাম জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের সাবেক বোটানিস্ট সামসুল হক ভাইয়ের কাছে। দুই দিন পরেই তিনি জানালেন, গাছটার স্থানীয় নাম ছেচরা কই, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Bridelia retusa, গোত্র ফাইলেনথেসি। বইপত্রে এ গাছের চারটি বাংলা নাম পেলাম—কাঁটাকই, কাঁটাকুশি, কামকই, আকদানা। বাংলাদেশ ছাড়াও এ গাছ আছে নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীন, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে। সাধারণত উঁচু ও শুষ্ক বনাঞ্চলে এ গাছ দেখা যায়। ছোট বৃক্ষজাতীয় গাছ, প্রায় ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়, দ্রুত বাড়ে। এ গাছের কাঁটা থাকায় বন্য প্রাণীরা এদের ধারে ঘেঁষে না, এমনকি এর বাকল দিয়েও বিষ তৈরি করা হয় বলে শুনেছি।
ফল গোলাকার, ছোট, কাঁচা ফল ময়লা সবুজ, পাকলে খোসায় লাল রং ধরে। ছেচরা কইগাছের কাঠ মাঝারি শক্ত থেকে শক্ত, কাঠের রং ময়লা লাল। রঙে ও গুণে কাঠ উৎকৃষ্ট। নির্মাণকাজ ও গরুর গাড়ির চাকা বানাতে ব্যবহার করা হয়। জ্বালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও শুষ্ক তৃণভূমিতে যদি কোনো গাছ থাকে, তবে সেসব ঘাসে আগুন দিলে এ গাছ পোড়ে না বলে কথিত রয়েছে। বীজ দ্বারা সহজে বংশবৃদ্ধি বা চারা হয়।
পূর্বাচল উপশহরের শালবনে দেখা পাটখই ফল