সে ছিল এক আতঙ্কের অতীত। প্রতিপক্ষ ফ্লাওয়ার ভাইয়েরা এসে দাপিয়ে বেড়াত বাংলাদেশে। অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল, হিথ স্ট্রিকের জিম্বাবুয়ে তখন বাংলাদেশের সামনে প্রবল পরাক্রমশালী এক দল। তবে সেইসব দিন গত হয়েছে দুই দশক আগে। রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে জিম্বাবুয়ে নেই আর সেই জিম্বাবুয়ে। এখন আফ্রিকার এই প্রতিপক্ষ বাংলাদেশের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। কথিত আছে, টি২০ কিংবা ওয়ানডেতে যখনই বিপদে পড়েছে দল, তখনই ডেকে আনা হয়েছে এই জিম্বাবুয়েকে!
এবার তারা বাংলাদেশে এসেছে আইসিসির সূচি মেনে বছর পাঁচেক পরে। এবারও তাদের চোখে স্বপ্ন বাংলাদেশকে হারিয়ে নতুন যুগ শুরু করবে। বাংলাদেশেরও লক্ষ্য জিম্বাবুয়েকে দিয়ে প্রাক- মৌসুমের প্রস্তুতিটা সেরে নেওয়া যাবে এবং দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের শূন্যতায় নতুন প্রজন্মের যাত্রাও শুরু হবে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুই টেস্টের এই সিরিজ দিয়ে; যার প্রথম ম্যাচটি শুরু হচ্ছে আজ সিলেট থেকে। সুরমা নদীর আবহাওয়া অবশ্য বলছে টেষ্টের পাঁচ দিনই খালের পাকের থাকবে আকাশ। তৃতীয় ও চতুর্থ দিন তো বজ্রপাতসহ বৃষ্টিও হতে পারে- তাই ম্যাচের রেজাল্ট আনতে ফেভারিটের মতোই দাপট দেখাতে হবে শান্তদের; যা তাদের আগের প্রজন্ম দেখিয়ে এসেছে সেই ২০০৫ সাল থেকে।
টেস্ট র্যাংকিংয়ের ৯ আর ১২ নম্বর দলের মধ্যেকার এই সিরিজ ঘিরে বাজার হয়তো চড়েনি, টেলিভিশনে ম্যাচ দেখানোর আগ্রহ দেখাইনি বেসরকারি কোনো চ্যানেল। তারপরও খেলা মাঠে গড়ালে নিশ্চয় চোখ রাখবেন লাল-সবুজের সমর্থকরা। গেল বছর পাকিস্তানে গিয়ে তাদের হোয়াইট ওয়াশ করার পর প্রত্যাশার যে পারদ চড়েছিল, পরে তা মিইয়ে গেছে অনেকটা।
ভারতে গিয়ে এবং ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হোয়াইট ওয়াশ হওয়ার পর উইন্ডিজ সফরে ১-১ সিরিজ ড্র। গেল ছয় মাসে লাল বলের এই ফরম্যাটে অনেক হতাশার গল্প লেখা আছে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে। সেই সঙ্গে সামনের জুনে শ্রীলঙ্কা সফর দিয়ে শুরু হবে পরবর্তী আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের চক্র। তার আগে সব হতাশা এ জিম্বাবুয়েকে দিয়ে মুছে দিতে চাইছেন অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত।
'প্রতিপক্ষ আয়ারল্যান্ড বা জিম্বাবুয়ে- এ ধরনের চিন্তা না করে ভালো ক্রিকেট খেলতে হবে। জিম্বাবুয়ের সঙ্গে যেভাবে খেলব, দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গেও যেন সে মানসিকতা নিয়ে খেলতে পারি— সেই চেষ্টা থাকবে।' গতকাল সিলেটে সংবাদ সম্মেলনে শান্ত চেষ্টা করছিলেন 'জিম্বাবুয়ে ছোট প্রতিপক্ষ' এ ধারণা থেকে নিজেদের দূরে রাখতে।
তবে পরিসংখ্যানগুলো যেন বারবার বলে যাচ্ছিল এই জিম্বাবুয়ে শেষবার বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজ জিতেছে ১৪ বছর আগে।
শেষ টেস্ট জিতেছিল তারা সাত বছর আগে এবং এখানে, এ সিলেটেই! তাই সিলেট নিয়ে বাড়তি এক ভালোলাগা রয়েছে জিম্বাবুয়ে দলেরও। ‘এখানে আমরা আগেও এসেছি। তবে এবার পিচ কিছুটা ভিন্ন লাগছে। আগেরবার স্লো অ্যান্ড লো স্পিন সহায়ক ছিল। এবার মনে হচ্ছে পিচে ঘাস বেশি।'
জিম্বাবুয়ে দলের যে দু'জন শেষবার বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট খেলেছিলেন তাদের একজন শন উইলিয়ামস নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন এভাবে। এ দলটির মাত্র চারজনের এশিয়াতে টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। গত আড়াই বছরে ছয়টি টেস্ট খেলেছে তারা। উইন্ডিজের বিপক্ষে দুটি বাদ দিলে বাকিগুলো সব আয়ারল্যান্ড আর আফগানিস্তানের সঙ্গে। ভারত, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো দলগুলোর সঙ্গে তারা টেস্ট খেলার সুযোগ পায়নি কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে।
সেদিক থেকে শান্তরা অবশ্য অনেকটা এগিয়ে। তারপরেও টেস্ট সংস্কৃতি তৈরি না হওয়ার আক্ষেপ রয়েছে বাংলাদেশ অধিনায়কের। ‘গত ২০-২২ বছরে টেস্টে খুব বেশি উন্নতি হয়নি আমাদের। এই জায়গাতে পরিবর্তনের দরকার আছে। সেটি করার চিন্তা করছি।' লিটন দাস বিশ্রামে, তাসকিন ইনজুরিতে, সেই সঙ্গে মুশফিকুর রহিমকে কিপিং থেকে বিশ্রাম দেওয়া হতে পারে। সব মিলিয়ে স্কোয়াডে একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপার রয়েছে।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
মিরাজে দুর্দান্ত জয় বাংলাদেশের
এমন পারফরম্যান্সই তো চাওয়ার থাকে ভালো দলের কাছে। মেহেদী হাসান মিরাজের অলরাউন্ড নৈপুণ্য, সাদমান ইসলামের সেঞ্চুরি, তাইজুল ইসলামের ৯ উইকেট শিকারে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ইনিংস ও ১০৬ রানের বিশাল জয় এনে দেয় বাংলাদেশকে। প্রথম টেস্ট হারের পর যে সমালোচনা হয়েছিল, তার জবাবটা বোধ হয় দ্বিতীয় টেস্ট তিন দিনে জিতে দিয়ে দিলেন নাজমুল হোসেন শান্তরা। ‘বাউন্স ব্যাক’ করে সিরিজ ড্র ১-১-এ।
চট্টগ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্টেডিয়ামে বীরোচিত পারফরম্যান্স ছিল টাইগারদের। এটি সম্ভব হয়েছে পছন্দের উইকেটে খেলা হওয়ায়। স্পিন ভুবনে উইকেট উৎসব করেছেন তাইজুল, মিরাজ গাঁটছড়া বেঁধে। সিরিজ নির্ধারণী টেস্টে দুটি সেঞ্চুরি দারুণ অর্জন অধারাবাহিক ব্যাটিং লাইনআপের। এই টেস্টে ওপেনিং জুটি ভালো করেছে। লম্বা সময় পর টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়া এনামুল হক বিজয় ভালোই সঙ্গ দেন সাদমানকে। লোয়ার মিডলঅর্ডারে মিরাজের লড়াই ছিল দেখার মতো।
টেলএন্ডারদের নিয়ে রীতিমতো বাজিমাত করেছেন তিনি। শেষ ৩ উইকেটে তৃতীয় দিন ১৫৩ রান যোগ করেন। বাংলাদেশকে পৌঁছে দেন ৪৪৪ রানে। ২১৭ রানের লিড থাকায় ইনিংস ব্যবধানে জয়ের স্বপ্ন দেখায়। মিরাজের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে সে স্বপ্ন পূরণ হয়। সাকিব আল হাসান ও সোহাগ গাজীর পর তৃতীয় বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট শিকার তাঁর।
গত বছর দেশের মাটিতে টেস্টে ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার পর দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে। ২০২৫ সালের শুরুটাও ভালো ছিল না। সিলেটে জিম্বাবুয়ের কাছে হেরেছে। সিরিজ বাঁচাতে চট্টগ্রামে জিততেই হতো। লক্ষ্যে পৌঁছাতে কন্ডিশনেও পরিবর্তন আনা হয়। চট্টগ্রামের উইকেটে খেলা হয় দ্বিতীয় টেস্ট। যেখানে শাসন ছিল স্পিনারদের। পছন্দের উইকেট পাওয়ায় তিন স্পিনার নিয়ে খেলে বাংলাদেশ। তিনজনই দারুণ বোলিং করেন প্রথম থেকে।
দীর্ঘ বিরতির পর টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়া অফস্পিনার নাঈম হাসান চ্যালেঞ্জ নিয়ে বোলিং করে গেছেন। বেশি উইকেট না পেলেও এক প্রান্তে ব্যাটারদের চাপে ফেলেছেন। যার সুফল তাইজুল ও মিরাজ পেয়েছেন অন্য প্রান্তে। প্রথম দিন শেষ সেশনে ব্রেক থ্রু দেন তিনি। বাঁহাতি স্পিনার পরে পিক করে ৬ উইকেট শিকার করেন। জিম্বাবুয়ে ৯ উইকেটে ২২৭ রানে প্রথম দিন শেষ করে। পরের দিন এক বল খেলে ওই রানেই অলআউট হয়। বাংলাদেশ ব্যাটিং শুরু করে বড় লক্ষ্য নিয়ে। সাদমান ইসলাম ও এনামুল হক বিজয় ১১৮ রানের ওপেনিং জুটি করায় প্রতিপক্ষকে ছাড়িয়ে যাওয়া সহজ হয়। সাদমানের সেঞ্চুরি ও মুমিনুল হক, মুশফিকুর রহিম কিছু রান করায় ৭ উইকেটে ২৯১ রানে দ্বিতীয় দিন শেষ করে বাংলাদেশ।
সেদিন সংবাদ সম্মেলনে সাদমান আশা প্রকাশ করেন, মিরাজ ও তাইজুল জুটি করবেন। অষ্টম উইকেটে ৬৪ রানের জুটি দু’জনের। বেশি ভালো করেছেন পেসার তানজিম হাসান সাকিব। মিরাজের সঙ্গে ১৫৬ বলে ৯৬ রানের জুটি। অভিষেক টেস্টে সাকিবের ব্যাটিং দারুণ লেগেছে অধিনায়ক শান্তর কাছে। ৮০ বলে ৪১ রান করেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, মাথায় বল লাগার পরও বিচলিত হননি তিনি। মিরাজ ছাড়া চট্টগ্রাম টেস্টের প্রাপ্তি হিসেবে ওপেনিং জুটির ভালো খেলা, সাদমানের সেঞ্চুরি, তাইজুলের ৫ উইকেট শিকার ও সাকিবের রান করাকে মনে করেন শান্ত।
শেষের তিন উইকেটে তৃতীয় দিন প্রায় দুই সেশন ব্যাট করে বাংলাদেশ। তাইজুল, সাকিব ও হাসানকে নিয়ে ১৫৩ রান যোগ করে। মিরাজ ১০৪ রান করে ওয়েলিংটন মাসাকাদজাকে উইকেট দেন। নার্ভাস নাইটির ঘরে প্রবেশ করে কিছুটা ঝুঁকির মুখে ছিলেন মিরাজ। ৯৮ রানে পৌঁছানোর পর সেঞ্চুরি ছুঁতে দুই রান নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফিল্ডারের কাছে বল চলে যাওয়ায় এক রানে থামতে হয়। তখন স্ট্রাইকে হাসান থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল সবাই। ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফের সবাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। কখন হাসান আউট হয়ে যায়, সে ভয় কাজ করছিল হয়তো। কিন্তু হাসান ছিলেন দৃঢ়চেতা। মাসাকাদজাকে ডিফেন্স করে স্বস্তি দেন।
মিরাজ স্ট্রাইকে এসে মেদেভেরের প্রথম দুই বলে ঝুঁকি নেননি। তৃতীয় বলে এক রান নিয়ে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরির স্বাদ নেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ ও দ্বিতীয় টেস্টের সেরা খেলোয়াড় মিরাজ। প্রথম ম্যাচের উভয় ইনিংসে ৫ উইকেট করে ছিল তাঁর। চট্টগ্রামে অতীতের সব পারফরম্যান্স ছাড়িয়ে গেছেন। সেঞ্চুরির সঙ্গে ৫ উইকেটপ্রাপ্তি, দুই হাজার রানের মাইলফলক পেয়েছেন। ২০২১ সালে এই চট্টগ্রামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। ২১৭ রানে পিছিয়ে থাকা জিম্বাবুয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে অলআউট হয় ১১১ রানে। ফ্লাডলাইটের আলো জ্বেলে নির্ধারিত সময়ের বেশি খেলান আম্পায়াররা। প্রায় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খেলা হয়। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটাররা তাতে আপত্তি করেননি। তাইজুল ৩, নাঈম ১ ও মিরাজ ৫ উইকেট নিলে ম্যাচ শেষ হয়।
সিলেটে প্রথম টেস্ট হারের পর চট্টগ্রামে প্রভাব বিস্তার করে খেলে ম্যাচ জেতার পরও খুশি নন অধিনায়ক শান্ত, ‘আমি টেস্ট সিরিজ ড্র করে খুশি না। কারণ, প্রথম টেস্টে আমরা একেবারেই ভালো খেলিনি। এই টেস্টে একপেশে খেলে জিতলেও সিরিজে আরও ভালো খেলা উচিত ছিল। সিরিজটি জিততে হতো।’ টাইগার দলপতি জানান, এই পারফরম্যান্স শ্রীলঙ্কা সফরে কাজে দেবে। দেশের মাটিতে স্পোর্টিং উইকেট বানিয়ে বিদেশে খেলার পরিবেশ তৈরি করছিল বিসিবি। ২০২৩ সালে নিউজিল্যান্ড সিরিজ থেকে স্পোর্টিং উইকেটে খেলা হচ্ছে। কিউইদের বিপক্ষে সিলেটে ঐতিহাসিক জয় পেলেও মিরপুর থেকে হারতে শুরু করে। দেশের মাটিতে টানা ছয় হারের পর জয়ের দেখা পেল বাংলাদেশ।