হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘আপনারা প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে জামায়াতে ইসলামীর ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নেবেন। জামায়াতের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিলে আপনাদের স্বাগত জানানো হবে।’

বুধবার রাজধানীর ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার উদ্যোগে ভিন্নধর্মাবলম্বীদের নিয়ে প্রীতি সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথাগুলো বলেন শফিকুর রহমান। ভিন্নধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা আপনাদের ভালোবাসা চাই। অতীতে যাঁরা নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশ ছেড়েছেন, তাঁদেরকেও আমরা ফিরিয়ে আনতে চাই।’

ধর্ম ও পেশার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পরিচয়কে বৈষম্য উল্লেখ করে জামায়াতের আমির বলেন, ‘এই সামাজিক পার্থক্যকে আমরা ঘৃণা করি। জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় গেলে ভিন্নধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে নেবে। আমরা ওই সংস্কৃতির বিকাশ চাই, যেখানে কোনো মন্দির, চার্চ ও মঠ পাহারা দিতে হবে না।’

যেকোনো ‘মবের’ বিরুদ্ধে জামায়াতের অবস্থান উল্লেখ করে দলটির আমির বলেন, ‘সম্প্রতি দেশে কিছু ভাঙচুরের ঘটনার বিরোধিতা করায় অনেকে আমার বিরুদ্ধে খেপে যান। কিন্তু আমি কোনো মবের পক্ষে নই। কেউ অপরাধী হলে তার জন্য আইন ও আদালত আছে। সেখানে তার বিচার হবে।’

প্রীতি সমাবেশে বিভিন্ন ধর্মের সদস্যরা নিজেদের দাবি তুলে ধরেন। জামায়াতের পক্ষ থেকে উত্থাপিত দাবি যাচাই–বাছাই করে বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন শফিকুর রহমান।

জামায়াতে ইসলামীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ শর্মা বলেন, ‘আমাদের প্রাণের আট দফা দাবি জামায়াতে ইসলামী তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সংযোজন করবে, সেই প্রত্যাশা রাখছি। আমরা ৫৩ বছর ধরে বঞ্চিত। যত বঞ্চনা কিংবা নির্যাতন হয়েছে, আমরা কোনো ঘটনার বিচার পাইনি। আপনারা সেই বিচার নিশ্চিত করুন।’

হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমরা হিন্দুদের ওপর সংঘটিত সকল নির্যাতন ভুলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা হয়নি। বাংলাদেশে হিন্দুরা ধর্মের দিক দিয়ে হলেও সংখ্যায় কম। ফলে আমরা শঙ্কায় থাকি।’

সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কাছে সেই ১৯৫৪ সাল থেকে জিম্মি হয়েছিলাম। এবার আমরা সেই জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছি। তাই সংসদে আমরা নিজেরা নিজেদের কথা বলতে চাই।’

জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির মো.

নূরুল ইসলাম বুলবুলের সভাপতিত্বে সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি আবদুল মান্নান। প্রীতি সমাবেশ সঞ্চালনা করেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য শফিকুল ইসলাম মাসুদ।

সমাবেশে অংশ নেন একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর, সিদ্ধেশ্বরী সর্বজনীন পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সভাপতি নিবাস চন্দ্র মাঝি, বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সহসভাপতি বদন্ত স্বরুপানন্দ ভিক্ষু, ইমানুয়েল ব্যাপ্টিস্ট চার্চের পাস্তর তপন রায়, হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব সভাপতি দিনবন্ধু রায়, শুভাশীষ বিশ্বাস, লিটন কোমল বড়ুয়াসহ প্রমুখ।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম বলম ব দ র ইসল ম র র আম র

এছাড়াও পড়ুন:

অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে

সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’

বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।

এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।

এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’

আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ