প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের প্রভাবে পণ্যের দাম বাড়বে। এতে কোম্পানির মুনাফা কমে যাবে। তার প্রভাবে অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শুধু তা–ই নয়, মন্দা বৃদ্ধির শঙ্কাও তৈরি হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সুপরিচিত কোম্পানির নির্বাহীরা এভাবেই নিজেদের কোম্পানি ও বৃহত্তর অর্থনীতিতে পাল্টা শুল্কের প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। প্রযুক্তি কোম্পানি ইন্টেল, জুতার ব্র্যান্ড স্কেচার্স, ভোগ্যপণ্য বিক্রেতা প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল (পিঅ্যান্ডজি) ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে তাদের মুনাফার পূর্বাভাস কমিয়ে দিয়েছে। তার প্রভাবে কোন কোন কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে।

বাণিজ্য–ঘাটতি কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে সেসব দেশের ওপর ২ এপ্রিল ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক বা রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ আরোপ করেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ৫৭ দেশের ওপর বিভিন্ন হারে বাড়তি পাল্টা শুল্ক বসানো হয়। ৯ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক কার্যকরের দিন অনেকটা ‘ইউটার্ন’ করে তা তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন প্রেসিডেন্ট। যদিও সব দেশের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর করা হয়।

উচ্চ হারে পাল্টা শুল্ক আরোপের মাধ্যমে মূল বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলোকে আলোচনার টেবিলে আনতে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করছেন। যদিও বাণিজ্য–ঘাটতি কমাতে এখন পর্যন্ত কোনো দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির পর্যায়ে যেতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। যদিও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে দেশটির বাণিজ্য চুক্তির আলোচনায় অগ্রগতির লক্ষণ দেখা গেছে।

বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে এক আলোচনায় ইন্টেলের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) ডেভিড জিনসনার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার বাইরে নমনীয় বাণিজ্যনীতি ও নিয়ন্ত্রণের ঝুঁকি অর্থনীতিতে শ্লথগতি এবং মন্দা বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক কোম্পানি ইন্টেল ইতিমধ্যে হতাশাজনক মুনাফা ও রাজস্ব পূর্বাভাস ঘোষণা করেছে। প্রতিষ্ঠানটির সিএফও ডেভিড জিনসনার বলেন, ‘আমরা অবশ্যই খরচ বৃদ্ধি দেখতে পাব।’ তাঁর এই মন্তব্যের পর ইন্টেলের শেয়ারের দাম ৫ শতাংশের বেশি কমেছে।

শুধু প্রযুক্তি কোম্পানি নয়, জুতার ব্র্যান্ড স্কেচার্সও বিনিয়োগকারীদের হতাশাজনক তথ্য দিয়েছে। তারা তাদের বার্ষিক মুনাফা ও রাজস্বের পূর্বাভাস প্রত্যাহার করেছে। এতে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম কমেছে।

স্কেচার্সের প্রধান পরিচালক কর্মকর্তা (সিইও) ডেভিড ওয়েনবার্গ বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তিসংগত ব্যবসায়িক সাফল্যের পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়।’ প্রতিদ্বন্দ্বী জুতার ব্র্যান্ড নাইকি, অ্যাডিডাস ও পুমার মতো স্কেচার্স এশিয়ার কারখানায়, বিশেষ করে চীনে তাদের পণ্য তৈরি করে।

প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের (পিঅ্যান্ডজি), এরিয়েল, হেড অ্যান্ড শোল্ডার্স ও জিলেটের মতো সুপরিচিত কোম্পানি জানিয়েছে, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আনা উপকরণের অতিরিক্ত খরচ মেটাতে তারা দাম পরিবর্তন বা বৃদ্ধির কথা ভাবছে। তারা আরও বলছে, এই বছর তাদের পণ্যের বিক্রি পূর্বাভাসের চেয়ে কম পরিমাণে বাড়বে।

পাল্টা শুল্কের প্রভাব কমানোর জন্য প্রতিটি সুযোগ খোঁজার কথা বললেও পিঅ্যান্ডজির আর্থিক প্রধান আন্দ্রে শুল্টেন বলেন, কিছু পণ্যের ভোক্তা বা খুচরা মূল্যনির্ধারণে সমন্বয় করা হবে; অর্থাৎ দাম বাড়বে।

এদিকে গতকাল ওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার বাণিজ্য কর্মকর্তাদের মধ্যে শুল্ক কমানোর আলোচনা ইতিবাচক হয়েছে। মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বলেন, উভয় পক্ষের বৈঠক ‘খুব সফল’ হয়েছে।

বৈঠকের পর সাংবাদিকদের স্কট বেসেন্ট বলেন, ‘আমরা হয়তো আমার ধারণার চেয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি। আগামী সপ্তাহের প্রথম দিকে আমরা প্রযুক্তিগত শর্তাবলি নিয়ে কথা বলব।’ অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার শিল্পমন্ত্রী আহন ডুক-গিউনও আশাবাদের জানিয়ে বলেন, তাঁরা ‘জুলাই প্যাকেজ’ ঘোষণা কাজ করছেন।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের ওপর ৯০ দিনের স্থগিতাদেশ আগামী ৪ জুলাই শেষ হবে। ট্রাম্প বলেছেন, শুল্ক ঘোষণার পর থেকে ৭০টির বেশি দেশ আলোচনা শুরু করার জন্য যোগাযোগ করেছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইন ট ল র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

এই অদম্য মেয়েদের আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না

অবহেলিত মেয়েরা কঠিন একটি কাজ সম্পন্ন করেছেন। অনেকের কাছে এখনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। অসাধ্য এক অর্জনকে বাস্তবের জমিনে নামিয়ে এনেছেন আমাদের বাঘিনীরা। সাফ পর্যায় জয় করে নারীদের ফুটবলকে এশীয় পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। বিশ্বকাপও খেলে ফিরতে পারেন এই অদম্য বাঘিনীরা।

এখন বলাই যায়, নারী ফুটবলের বিশ্ব পর্যায়ে কড়া নাড়ছেন আমাদের মেয়েরা। ফুটবলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁরা। শুধু ফুটবলই নয়, আমাদের নারী জাগরণের নতুন দিশা হতে পারে মেয়েদের এই সাফল্য। এই মেয়েরা সারা দেশের মেয়েদের জন্য উদাহরণ। নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়নের নতুন দিনের আলোকবর্তিকা আমাদের নারী ফুটবল দল।

ফুটবলে মেয়েদের এই সাফল্যের পেছনে আছে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। সফলতা খুব সহজে আসেনি। নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে কঠিন এক সংগ্রামের ফসল মেয়েদের আজকের এই অর্জন। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত পল্লি থেকে কোহাটি কিষ্ক, কলসিন্দুরের মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার, তহুরা খাতুন, সানজিদা আক্তার বা রাঙামাটির দুর্গম গ্রাম মগছড়ি থেকে ঋতুপর্ণা চাকমাদের আজকের এই পর্যায়ে আসার ইতিহাসটা আমরা কমবেশি সবাই জানি।

এই পথচলায় সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল। ছিল আর্থিক টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা। জীবনের এমন কোনো সংকট নেই, যা তাঁদের সামনে আসেনি। কিন্তু হিমালয়সম সেই বাধাকে সাহসিকতার সঙ্গে পেছনে ঠেলে আজকে তাঁরা এশীয় পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করেছেন।

তাঁদের অর্জনের তুলনায় রাষ্ট্র দিতে পেরেছে খুবই কম। বলতে গেলে, তাঁরা পেটেভাতে দেশের জন্য খেলে দিচ্ছেন। যেন খেলার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চলছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আদলে। যৎসামান্য যে বেতন দেওয়া হয়, সেটাও অনিয়মিত। যেকোনো সাফল্যের পর যখন মেয়েদের কাছে শুনতে চাওয়া হয়, ‘আপনারা কী চান?’ উত্তরে মেয়েরা জানান, ‘নিয়মিত বেতনটা চাই। আর বেতনটা বাড়ালে আরও ভালো হয়।’ ২০২৫ সালে এসে এটা মেনে নেওয়া কঠিন।

দেশে মেয়েদের নিয়মিত লিগ হয় না। অন্য কোনো টুর্নামেন্টও হয় না নিয়মিত। নিয়মিত খেলার জন্য আমাদের মেয়েদের ভুটান লিগে খেলতে যেতে হয়। কেবল আবাসিক ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ ও কিছু প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলেই মেয়েদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক খেলায় নামতে হয়। সেই সব খেলায় তাঁরা নিয়মিত লিগ খেলা দলগুলোকে বলে-কয়ে হারাচ্ছে।

আমাদের খেলাধুলাকে রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। শুধু নারী ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে তৃণমূল থেকে। তবেই নতুন নতুন প্রতিভাবান খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে। ঢাকাকেন্দ্রিক খেলার কুফল কী হতে পারে, তার বড় উদাহরণ আমাদের ছেলেদের ফুটবল। সারা দেশে নিয়মিত প্রতিযোগিতামূলক লিগ না হওয়ার কারণে নতুন নতুন ফুটবলার বেরিয়ে আসছেন না।

কী পরিমাণ প্রতিভার অধিকারী হলে ন্যূনতম সুবিধা না পেয়েও এ পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করা যায়, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। ভারত ও নেপালে নিয়মিত মেয়েদের খেলা হয়, লিগ হয়। আর আমরা তাদের এখন নিয়মিতই হারাই। এখন সাফের বাইরের দলগুলোকেও আমরা হারাতে শুরু করেছি।

এই মেয়েদের প্রচেষ্টা ও সাহস নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড রকম ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে তাঁরা খেলতে নামেন। ভয়হীন ফুটবল খেলেন। সব থেকে বড় কথা, খেলার যেকোনো ধরনের ট্যাকটিকসের সঙ্গেই তাঁরা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন। আগে আমাদের মেয়েরা কিছুটা রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতেন। রক্ষণ সামলে প্রতি-আক্রমণে যেতেন। এবার এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে মেয়েরা পুরো খেলার ধরন বদলে ফেলেছেন।

আমাদের মেয়েরা এবার হাই প্রেসিং ফুটবল খেলেছেন। এই দল আগের থেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন ফুটবল খেলে। বল পায়ে রাখতে পারে। তাদের বল ডিস্ট্রিবিউশন আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। পাসিংও ভালো। পজিশন সেন্স চমৎকার। বিশেষ করে বল হারালে দ্রুত নিজেরা অবস্থান নিতে পারে।

এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে হাই লাইন ডিফেন্স করে গেছে দুর্দান্তভাবে। আর বাহরাইনের সঙ্গে শামসুন্নাহার জুনিয়র যেভাবে গতি সঞ্চার করে ডিফেন্স থেকে বেরিয়ে ওয়ান টু ওয়ানে গোলরক্ষককে পরাজিত করলেন ঠান্ডা মাথায়, তা আমাদের পুরুষ দলের স্ট্রাইকার বা উইঙ্গাররাও করতে পারেন না। নিয়মিত খেলার মধ্যে না থাকা একটি দলের কাছে এর বেশি আশা করা উচিত নয়। কিন্তু তাঁরা আমাদের সেই আশাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁরা পরিস্থিতি বুঝে মাঠে খেলাটা তৈরি করতে পারেন।

মেয়েদের এই লড়াইকে ধরে রাখতে হবে। তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সিরাত জাহান স্বপ্না বা আঁখি খাতুনের মতো খেলোয়াড়দের আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে ফুটবল থেকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক লিগ নিয়মিত আয়োজন করতে হবে। এর পাশাপাশি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে লিগের আয়োজন করতে হবে।

‘সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই মেয়েরা আমাদের ফুটবল নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ