হবিগঞ্জ জেলার হাওর অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে প্রায়ই ঘটছে বজ্রপাতের ঘটনা। জেলার মূল অংশের মতো বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ ও নবীগঞ্জ উপজেলাতেও বজ্রপাত এখন মূর্তমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। অথচ প্রাকৃতিক এ বিপর্যয় মোকাবিলায় হবিগঞ্জে বসানো বজ্রনিরোধক যন্ত্রগুলো (লাইটিং অ্যারেস্টার মেশিন) কার্যকর কিনা তা জানে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দপ্তরের সূত্র মতে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০২১-২২ অর্থবছরে হবিগঞ্জে বজ্ররোধক যন্ত্র স্থাপনে ব্যয় করা হয় ২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ১৫ লাখ, নবীগঞ্জে ৩০, বানিয়াচংয়ে ৪৫, আজমিরীগঞ্জে ৩০, হবিগঞ্জ সদরে ১৫, লাখাইয়ে ২৫, শায়েস্তাগঞ্জে ১০, চুনারুঘাটে ১৫ ও মাধবপুরে ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই টাকায় স্থাপন করা হয় ৩৩টি লাইটিং অ্যারেস্টার মেশিন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া হিসেবে বেড়েছে বজ্রপাতের ঘটনা। গত দেড় দশকে বজ্রপাতজনিত দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে। প্রাকৃতিক এই সংকট মোকাবিলায় গুরুত্ব আরোপে ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দেয় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বেশি হাওর অঞ্চলে। বিশেষ করে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জসহ দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোয় প্রাকৃতিক এই দুর্যোগে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। বজ্রপাতে মৃতের মধ্যে ৭০ শতাংশই কৃষক। এপ্রিল ও মে মাস সাধারণত ধান কাটার মৌসুম। প্রায় বৃক্ষহীন খোলা প্রান্তরে কৃষক ধান কাটার কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতে মারা যাচ্ছেন। ফলে ধান কাটতে গিয়ে ভয়ে মাঠে নামতে চান না অনেক কৃষক।

বজ্রপাত থেকে সুরক্ষায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় কর্তৃক স্থাপিত বজ্রনিরোধ দণ্ড থাকা সত্ত্বেও মৃত্যু ও দুর্ঘটনার হার কেন কমছে না, এ ব্যাপারে তথ্য অনুসন্ধানে গিয়ে জানা যায়, জেলার নিরোধক দণ্ডগুলো সচল না অচল তাই-ই জানে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

গত কয়েক বছরে এসব যন্ত্র কোনো বজ্রপাত ঠেকাতে পেরেছে কিনা– এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো তথ্য জানা যায়নি। সাধারণ মানুষও জানে না তাদের নিরাপত্তায় স্থাপিত কোটি টাকার এসব দণ্ড কার্যকর কিনা। জানা যায়, গত ৫ বছরে জেলায় বজ্রাঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন ৭৯ জন। তাদের মধ্যে ৫৫ জনই কৃষক। এছাড়া আজমিরীগঞ্জ, নবীগঞ্জ ও বানিয়াচংয়ে বজ্রপাতে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও ৩ জন।

চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল আজমিরীগঞ্জ উপজেলার শিবপাশা ইউনিয়নের হাওরের দক্ষিণের ঝিলেরবন্দ এলাকায় যান একদল ধান কাটার শ্রমিক। এ সময় বজ্রপাতে দুই শ্রমিক নিহত হন। তারা হলেন জেলার মোহনবাগ গ্রামের মনিরুল ইসলাম ও পার্বতীপুর গ্রামের আব্দুল্লাহিল কাফি।

একই দিন নবীগঞ্জ উপজেলার দীঘলবাক ইউনিয়নের বনকাদিপুর গ্রামে বজ্রপাতে এক কৃষকের মৃত্যু হয়। হাওরে গরু চরাতে গিয়ে বজ্রাঘাতে প্রাণ হারান শাহ আলম নামের ওই কৃষক। ২৮ এপ্রিল বানিয়াচংয়ের আড়িয়ামুগুর গ্রামের কৃষক দুর্বাসা দাস ভাইবোন নিয়ে হাওরে ধান কাটতে যান। বজ্রপাতে সেখানেই মারা যান দুর্বাসা। গুরুতর আহত হন তাঁর ভাই ভূষণ দাস ও বোন সুধন্য দাস। একই উপজেলার বাগহাতা গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে বায়েজিদ মিয়া নামে এক শিশু বজ্রঘাতে আহত হন।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসনকেন্দ্র সূত্র জানায়, বজ্রপাত থেকে সুরক্ষায় বসানো ৩৩টি বজ্রনিরোধক যন্ত্র চারপাশের ১০৮ মিটার পরিসরের মাঝে বজ্রপাত নিরোধ ও তথ্য সংরক্ষণ করার কথা। তবে গত তিন বছরে কোনো বজ্রপাতই নিরোধ করতে পারেনি সরকারের এসব যন্ত্র। এতে করে বাস্তবে যন্ত্রগুলো সচল নাকি অচল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারোর। এছাড়া যেসব জায়গায় এ লাইটিং অ্যারেস্টার বসানো হয়েছে, তা নিয়ে শুরু থেকে নানা বিতর্ক ছিল বলে জনিয়েছেন স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা।

বানিয়াচং উপজেলার বিঙ্গল গ্রামের কৃষক আলী রেজান জানান, বজ্রনিরোধক দণ্ড কি সেটিই তাদের জানা নেই। হাওরের কৃষকদের রক্ষায় প্রশাসনের আরও তৎপর হওয়া উচিত। আড়িয়ামুগুর গ্রামের কৃষক জিতেন্দ্র লাল বলেন, ২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৩টি বজ্রনিরোধক দণ্ড জেলার বিভিন্ন স্থানে বসানো হয়েছে। সেগুলো কতটা উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করা হয়েছে তা কেউ জানে না। 

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আজাদের রহমান বলেন, বিষয়টি টেকনিক্যাল। এগুলো সচল আছে কিনা সেটি যাচাই করার মতো মেকানিজম দেশে নেই। পরিধি কতটুকু তাও জানেন না তিনি। তবে স্থাপিত লাইটিং অ্যারেস্টার যন্ত্রের এক থেকে দেড়শ মিটারের মধ্যে বজ্রপাতের তথ্য জানা গেছে বলে জানিয়েছেন এ কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে গিয়ে জেলা প্রশাসক ফরিদুর রহমান বলেন জানান, বজ্রনিরোধক দণ্ড বা লাইটিং অ্যারেস্টার নির্মাণে ৪ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। স্থায়ীভাবে এর সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে নতুন করে অ্যারেস্টার স্থাপন কেন, স্থাপিত দণ্ডগুলো কার্যকর কিনা, সেগুলো সচল না অচল– এ ব্যাপারে পরিষ্কার কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।

দেশের বজ্রপাত পরিস্থিতি এবং হতাহতের ঘটনা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরাম। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে, ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে বজ্রপাতে প্রাণ গেছে ৪ হাজার ১৫৮ জনের। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ২৯৭ জন বজ্রপাতে মারা গেছেন। এর মধ্যে ২০২১ সালে সর্বোচ্চ ৩৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ক র যকর ক ন উপজ ল র ব যবস থ র ঘটন

এছাড়াও পড়ুন:

শত কোটি টাকার নদী খনন কাজ বন্ধ

নদীর নাব্যতা ফেরাতে চেঙ্গী ও মাইনি নদীর খনন কাজ শুরু করেছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু কিছুদিন কাজ করার পর তা বন্ধ চলে যায় চুক্তি করা টিকাদারী প্রতিষ্ঠান। দ্রুত পুনরায় খনন কাজ শুরু করার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

জানা গেছে, খাগড়াছড়ি শহর ও তৎসংলগ্ন অবকাঠামো নদী ভাঙন থেকে সংরক্ষণ প্রকল্পের আওয়াতায় ২৫০ কোটি ব্যয়ে নদীর নাব্যতা ফেরাতে চেঙ্গী ও মাইনি নদীর ৫৮ কিলোমিটার খনন কাজ শুরু করেছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রকল্প অনুযায়ি, চেঙ্গী নদীর মহালছড়ি থেকে নানিয়ারচর বুড়িঘাট শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ স্মৃতি স্তম্ভ এবং মাইনি নদীর ইয়ারাংছড়ি থেকে লংগদু মুখ পর্যন্ত খনন করার কথা।

আরো পড়ুন:

ঢাকার ৪৪ খাস পুকুর-জলাশয় সংস্কার শুরু

মাদারীপুরে নদীর মাটি চুরি, ভাঙন আতঙ্ক

কিন্ত মাইনি নদীর খনন কাজ চললেও চেঙ্গী নদীর কাজ কিছুদিন করার পর বন্ধ করে চলে যায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। মহালছড়ি থেকে নানিয়ারচর অংশে কাজ নতুন করে শুরু হলেও রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়ারচর থেকে বুড়িঘাট শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ স্মৃতি স্তম্ভ পর্যন্ত অংশের খনন কাজ ৩-৪ মাস ধরে একেবারে বন্ধ।

এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ হওয়া নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী।

নানিয়ারচর পুরাতন বাজার এলাকার বাসিন্দা মো. খোরশেদ আলম, মো. আনসার আলী ও হাসাপতাল এলাকা বাসিন্দা মো. নুরুল হক জানান, নদীর খনন কাজ শেষ হলে তারা উপকৃত হতেন। বিশেষ করে কাপ্তাই হ্রদের পানি যখন কমে যায়, শুকনা মৌসুমে নদী পথে তাদের মালামাল আনা-নেওয়া করতে সুবিধা হত। আর সেই মাটিগুলো দিয়ে যদি নিচু রাস্তাগুলো উচু করা যেত তাহলে তারা উপকৃত হতেন। তাদের দাবি আবার যেন দ্রুত খনন কাজ শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

এনিয়ে কথা বলতে নানিয়ারচর অংশের টিকাদারী প্রতিষ্ঠান ওয়েল এডব্লিউআর (জেভি) এর ম্যানেজার মো. মাহবুবের ও মহালছড়ি অংশের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এআরকেএল-এসএমআইএল (জেবি) এর ম্যানেজার মো. সোয়েবের মোবাইল নাম্বারে কল দেওয়া হলে তারা রিসিভ করেননি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড, চট্টগ্রাম পরিচালনা ও রক্ষনাবেক্ষন বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ জানান, চেঙ্গী নদীর মহালছড়ি থেকে নানিয়ার এর কাজ মাঝখানে বন্ধ হয়েছিল, ড্রেজার নিয়ে গিয়েছিল কন্ট্রাকটর। তখন কাজ বাতিলের নোটিশ করেছিলেন। তবে মহালছড়ি অংশের ঠিকাদার আবার নতুন করে ড্রেজার নিয়ে এসেছে। এখন থেকে নিয়মিত কাজ চলবে বলে আশা করা হচ্ছে।

তিনি জানান, নানিয়াচরে ঠিকাদার নিজস্ব ব্যবস্থাপনার কারণে কাজ করতে পারেনি। ফলে উপরের নির্দেশে কাজ বাতিলের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগ করতে হবে। আর মাইনী নদীর খনন কাজ চলমান আছে, আগামী জুন মাসে শেষ হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ