বজ্রনিরোধক দণ্ড কার্যকর কিনা জানে না কর্তৃপক্ষ
Published: 8th, May 2025 GMT
হবিগঞ্জ জেলার হাওর অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে প্রায়ই ঘটছে বজ্রপাতের ঘটনা। জেলার মূল অংশের মতো বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ ও নবীগঞ্জ উপজেলাতেও বজ্রপাত এখন মূর্তমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। অথচ প্রাকৃতিক এ বিপর্যয় মোকাবিলায় হবিগঞ্জে বসানো বজ্রনিরোধক যন্ত্রগুলো (লাইটিং অ্যারেস্টার মেশিন) কার্যকর কিনা তা জানে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দপ্তরের সূত্র মতে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০২১-২২ অর্থবছরে হবিগঞ্জে বজ্ররোধক যন্ত্র স্থাপনে ব্যয় করা হয় ২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ১৫ লাখ, নবীগঞ্জে ৩০, বানিয়াচংয়ে ৪৫, আজমিরীগঞ্জে ৩০, হবিগঞ্জ সদরে ১৫, লাখাইয়ে ২৫, শায়েস্তাগঞ্জে ১০, চুনারুঘাটে ১৫ ও মাধবপুরে ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই টাকায় স্থাপন করা হয় ৩৩টি লাইটিং অ্যারেস্টার মেশিন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া হিসেবে বেড়েছে বজ্রপাতের ঘটনা। গত দেড় দশকে বজ্রপাতজনিত দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে। প্রাকৃতিক এই সংকট মোকাবিলায় গুরুত্ব আরোপে ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দেয় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বেশি হাওর অঞ্চলে। বিশেষ করে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জসহ দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোয় প্রাকৃতিক এই দুর্যোগে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। বজ্রপাতে মৃতের মধ্যে ৭০ শতাংশই কৃষক। এপ্রিল ও মে মাস সাধারণত ধান কাটার মৌসুম। প্রায় বৃক্ষহীন খোলা প্রান্তরে কৃষক ধান কাটার কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতে মারা যাচ্ছেন। ফলে ধান কাটতে গিয়ে ভয়ে মাঠে নামতে চান না অনেক কৃষক।
বজ্রপাত থেকে সুরক্ষায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় কর্তৃক স্থাপিত বজ্রনিরোধ দণ্ড থাকা সত্ত্বেও মৃত্যু ও দুর্ঘটনার হার কেন কমছে না, এ ব্যাপারে তথ্য অনুসন্ধানে গিয়ে জানা যায়, জেলার নিরোধক দণ্ডগুলো সচল না অচল তাই-ই জানে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
গত কয়েক বছরে এসব যন্ত্র কোনো বজ্রপাত ঠেকাতে পেরেছে কিনা– এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো তথ্য জানা যায়নি। সাধারণ মানুষও জানে না তাদের নিরাপত্তায় স্থাপিত কোটি টাকার এসব দণ্ড কার্যকর কিনা। জানা যায়, গত ৫ বছরে জেলায় বজ্রাঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন ৭৯ জন। তাদের মধ্যে ৫৫ জনই কৃষক। এছাড়া আজমিরীগঞ্জ, নবীগঞ্জ ও বানিয়াচংয়ে বজ্রপাতে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও ৩ জন।
চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল আজমিরীগঞ্জ উপজেলার শিবপাশা ইউনিয়নের হাওরের দক্ষিণের ঝিলেরবন্দ এলাকায় যান একদল ধান কাটার শ্রমিক। এ সময় বজ্রপাতে দুই শ্রমিক নিহত হন। তারা হলেন জেলার মোহনবাগ গ্রামের মনিরুল ইসলাম ও পার্বতীপুর গ্রামের আব্দুল্লাহিল কাফি।
একই দিন নবীগঞ্জ উপজেলার দীঘলবাক ইউনিয়নের বনকাদিপুর গ্রামে বজ্রপাতে এক কৃষকের মৃত্যু হয়। হাওরে গরু চরাতে গিয়ে বজ্রাঘাতে প্রাণ হারান শাহ আলম নামের ওই কৃষক। ২৮ এপ্রিল বানিয়াচংয়ের আড়িয়ামুগুর গ্রামের কৃষক দুর্বাসা দাস ভাইবোন নিয়ে হাওরে ধান কাটতে যান। বজ্রপাতে সেখানেই মারা যান দুর্বাসা। গুরুতর আহত হন তাঁর ভাই ভূষণ দাস ও বোন সুধন্য দাস। একই উপজেলার বাগহাতা গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে বায়েজিদ মিয়া নামে এক শিশু বজ্রঘাতে আহত হন।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসনকেন্দ্র সূত্র জানায়, বজ্রপাত থেকে সুরক্ষায় বসানো ৩৩টি বজ্রনিরোধক যন্ত্র চারপাশের ১০৮ মিটার পরিসরের মাঝে বজ্রপাত নিরোধ ও তথ্য সংরক্ষণ করার কথা। তবে গত তিন বছরে কোনো বজ্রপাতই নিরোধ করতে পারেনি সরকারের এসব যন্ত্র। এতে করে বাস্তবে যন্ত্রগুলো সচল নাকি অচল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারোর। এছাড়া যেসব জায়গায় এ লাইটিং অ্যারেস্টার বসানো হয়েছে, তা নিয়ে শুরু থেকে নানা বিতর্ক ছিল বলে জনিয়েছেন স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা।
বানিয়াচং উপজেলার বিঙ্গল গ্রামের কৃষক আলী রেজান জানান, বজ্রনিরোধক দণ্ড কি সেটিই তাদের জানা নেই। হাওরের কৃষকদের রক্ষায় প্রশাসনের আরও তৎপর হওয়া উচিত। আড়িয়ামুগুর গ্রামের কৃষক জিতেন্দ্র লাল বলেন, ২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৩টি বজ্রনিরোধক দণ্ড জেলার বিভিন্ন স্থানে বসানো হয়েছে। সেগুলো কতটা উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করা হয়েছে তা কেউ জানে না।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আজাদের রহমান বলেন, বিষয়টি টেকনিক্যাল। এগুলো সচল আছে কিনা সেটি যাচাই করার মতো মেকানিজম দেশে নেই। পরিধি কতটুকু তাও জানেন না তিনি। তবে স্থাপিত লাইটিং অ্যারেস্টার যন্ত্রের এক থেকে দেড়শ মিটারের মধ্যে বজ্রপাতের তথ্য জানা গেছে বলে জানিয়েছেন এ কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে গিয়ে জেলা প্রশাসক ফরিদুর রহমান বলেন জানান, বজ্রনিরোধক দণ্ড বা লাইটিং অ্যারেস্টার নির্মাণে ৪ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। স্থায়ীভাবে এর সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে নতুন করে অ্যারেস্টার স্থাপন কেন, স্থাপিত দণ্ডগুলো কার্যকর কিনা, সেগুলো সচল না অচল– এ ব্যাপারে পরিষ্কার কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।
দেশের বজ্রপাত পরিস্থিতি এবং হতাহতের ঘটনা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরাম। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে, ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে বজ্রপাতে প্রাণ গেছে ৪ হাজার ১৫৮ জনের। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ২৯৭ জন বজ্রপাতে মারা গেছেন। এর মধ্যে ২০২১ সালে সর্বোচ্চ ৩৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক র যকর ক ন উপজ ল র ব যবস থ র ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
সাদাপাথরে লুটপাট, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতির পদ স্থগিত
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রের পাথর লুটপাটের ঘটনায় উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনের পদ স্থগিত করা হয়েছে। দলীয় বিজ্ঞপ্তিতে সাদাপাথরে লুটপাটের বিষয়টি উল্লেখ করা না হলেও চাঁদাবাজি ও দখলবাজির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
গতকাল সোমবার রাতে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে ওই নেতার পদ স্থগিত করা হয়। পাশাপাশি উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি আবদুল মান্নানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, ‘চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ বিএনপির নীতি ও আদর্শ পরিপন্থী অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনের সব পদ স্থগিত করা হয়েছে। তাঁর স্থলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি হাজী আবদুল মান্নানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে।’
বিএনপি নেতা সাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে সরকারি প্রায় ১৫০ একর জমি দখলের অভিযোগ ছিল। এ নিয়ে গত ১৭ মার্চ প্রথম আলোর শেষ পাতায় ‘দখলসূত্রে সরকারি জমির মালিক বিএনপি নেতা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে ১৮ মার্চ সরকারি জমি উদ্ধারে অভিযানে নামে স্থানীয় প্রশাসন। এ সময় প্রায় ৭০ একর জমি থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হয়। এসব স্থানে থাকা ছোট-বড় ১০০টি পাথর ভাঙার (স্টোন ক্রাশার) যন্ত্র উচ্ছেদের পাশাপাশি প্রায় ৫০টি টিনশেড ঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
এ ছাড়া কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জে সরকারি জমি দখলের ঘটনায় গত ১৯ মার্চ সাহাব উদ্দিনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় জেলা বিএনপি। পাশাপাশি অভিযোগ তদন্তে জেলা বিএনপির সহসভাপতি আশিক উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
জেলা বিএনপির একটি সূত্র জানায়, গত ১০ এপ্রিল ভোলাগঞ্জে পাথর কোয়ারি পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদনে সরকারি জমি দখল ও লুটপাটের ঘটনায় বিএনপি নেতা সাহাব উদ্দিন ও তাঁর স্বজনেরা জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, উপজেলা সভাপতির নেতৃত্বে এমন অপরাধ সংঘটিত হবে, তা কখনো ভাবা যায় না। এতে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট ও নেতৃত্বের চরম অবমাননা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
ওই নেতার পদ স্থগিতের বিষয়টি নিশ্চিত করে বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য সুস্পষ্ট। চাঁদাবাজি, দখলবাজি, লুটপাটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ বিএনপিতে থাকতে পারবে না। সেই সঙ্গে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে কেউ যাতে অপকর্ম-লুটপাট করতে না পারে, সে জন্য প্রশাসনকে আগে থেকেই জানানো হয়েছে। প্রশাসন যাতে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়, সেটি আমরা জানিয়েছিলাম। স্থানীয়ভাবেও সাদাপাথর লুটপাটের বিষয়ে প্রশাসনকে জানানো হয়। কিন্তু প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।’