আমার মায়ের পক্ষে রাজনীতিতে আগ্রহী হওয়ার কথা ছিল না। তিনি হনও-নি, কিন্তু বিদ্যমান রাজনীতির ঝাপটা তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে বৈকি, বৃক্ষ যেমন সহ্য করে ঝড়কে। রাষ্ট্রের উত্থান-পতন দেখেছেন, টের পেয়েছেন, উদ্বাস্তু হয়েছেন বারবার, মুখোমুখি হয়েছেন দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির। আমরা ছেলেরা রাজনীতি নিয়ে কথা বলতাম, রাজা-উজির মারার খেলায় অংশ নিতাম। তর্ক-বিতর্ক চলত। আমার মা দেখতেন। যেন খেলা দেখছেন। ছেলেদের ব্যাডমিন্টন খেলা। অথবা ফুটবল। তিনি ঝালমুড়ি, ডালের বড়া, ডালপুরি, চা ইত্যাদি সরবরাহ করেছেন, আমাদের সতেজ রাখবার জন্য। ভেতরে ভেতরে হাসতেন হয়তো, এই ভেবে যে তাঁর ছেলেরা বড় হয়েও ঠিক বড়টি হলো না।
আরও একটি রাজনীতি আছে, যেটা পারিবারিক; যেখানে রাষ্ট্রীয় রাজনীতি প্রতিফলিত ও পুনরুৎপাদিত হয়। এবং মানুষ যে একটি রাজনৈতিক প্রাণী তার প্রমাণ পাওয়া যায়। অগণতান্ত্রিক সমাজে পরিবারগুলোও গণতান্ত্রিক নয়, হতে চাইলেও বাধা পায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে হতে চায়ই না। রাজনীতির মর্মবস্তুটি হচ্ছে ক্ষমতা; ক্ষমতা কোথায় থাকবে বা থাকবে না– তা নিয়ে পরিবারের ভেতর দ্বন্দ্ব থাকে।
আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়সে। শাশুড়ি তাঁর মায়ের বয়সী; কিন্তু মা নন। সম্পূর্ণ অপরিচিত মহিলা। শাশুড়ি নিজে বিধবা; এতকাল সবেধন নীলমণি পুত্রের ওপর তাঁর একছত্র অধিকার ছিল। এখন একজন প্রতিদ্বন্দ্বী এসেছে। তাই ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল অনিবার্য, ছিল স্বাভাবিক। ক্ষমতা যাদের কম তারাই তো ক্ষমতার বিষয়ে অধিক সচেতন। বিরোধ বাধেনি, কিন্তু যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো অজুহাতে মনোমালিন্য এবং সেখান থেকে সংঘাত শুরু হয়ে যেতে পারত। তেমনটা যে ঘটেনি তার কারণ কেবল যে আমার মা তা নয়, তাঁর শাশুড়ি, আমার দাদিও। এ বিষয়ে তারা উভয়েই সজাগ ছিলেন, ছাড় দিচ্ছিলেন পরস্পরকে। কেননা তারা জানতেন একবার ঝগড়া লাগলে নিরসন কঠিন হবে, জোড়া লাগলেও দাগ রয়ে যাবে চিরস্থায়ী, ক্ষতি হবে উভয়ের, তার চেয়েও বেশি ছিল যে বিবেচনা সেটা হলো, কষ্ট পাবেন সেই ব্যক্তিটি, যাঁকে নিয়ে ওই দ্বন্দ্ব। আমার বাবা রাজশাহীতে প্রথম যখন বাসা নেন, তখন সে-বাসাতে শাশুড়ি ও পুত্রবধূ একসঙ্গেই ছিলেন। আমার মা সমস্ত ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন তাঁর শাশুড়ির হাতে, নির্দ্বিধায়। আর সেটা করেই তিনি জিতে গিয়েছিলেন পারিবারিক রাজনীতিতে। শাশুড়ি দেখলেন ঠিক হচ্ছে না। বিবাহিত পুত্রের সংসারে তাঁর এমন সর্বময় কর্তৃত্বটা অস্বাভাবিক। পুত্রবধূর অব্যাহত আত্মত্যাগ হয়তো শেষ পর্যন্ত তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন কোনো ঘটনার ঘটনা না হোক ক্ষতের সৃষ্টি করবে, যার ক্ষতিপূরণ সম্ভব হবে না। তিনি সরে গেলেন। শহর তাঁর ভালো লাগছে না বলে গ্রামের বাড়িতে চলে এলেন।
মায়ের দিক থেকে ক্ষমতার একটা লড়াই আমার বাবার সঙ্গেও ছিল। ওখানেও তিনি ছাড় দিয়েছেন। ত্যাগ নয়, দান নয়, অনাসক্তি। কলহে যাননি, আত্মম্ভরিতা প্রকাশ করেননি, সরে গেছেন। সেখানেই হেরে গেছেন আমার বাবা, কর্তৃত্ব করেছেন ওপরে ওপরে, কিন্তু সংসার ছিল মায়ের হাতে। সন্তানদের ওপর তাঁর যত কর্তৃত্ব, প্রভাব যদিও তত নয়। নিজে যখন শাশুড়ি হয়েছেন তখন একদা তাঁর শাশুড়ি তাঁর ওপরে যে-রাজনীতি কার্যকর করেছিলেন, তিনিও সেই পথেই অটল থেকেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাননি। সরে এসেছেন। ঠাঁই নিয়েছেন আপন সংসারে।
বিশেষ করে এখন তো দেখতে পাই যে, আমি যতটা না আমার বাবার সন্তান, তার চেয়ে বেশি আমার মায়ের। বাবা-মায়ের প্রভাব সন্তানের ওপর তো থাকবেই, থাকেও; কারটা কত শক্তিশালী সেটা মাপবার কোনো নির্ভরযোগ্য যন্ত্র নেই। আমি জানি আমার বাবার প্রভাব আমার ওপর মোটেই কম নয়, কিন্তু মায়ের ছাপটা ততোধিক, আর যেহেতু তা গভীর তাই অনির্দিষ্ট। আমি বেড়ে উঠেছি আমার বাবার উৎসাহে এবং মায়ের আশ্রয়ে। আশ্রয় অধিক কার্যকর, উৎসাহের তুলনায়। উৎসাহ ও আশ্রয়ের ভেতর এই বিভাজন অবশ্য খাড়াখাড়ি করা যাবে না; তা ছাড়া বাবার মধ্যেও মায়ের স্নেহ ছিল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনিও ছিলেন মাতৃস্বভাবসম্পন্ন।
আমার মায়ের মতো আমিও উন্নতিবিরোধী। ছাড় দিই, সরে আসি, সন্তুষ্ট হয়ে যাই অল্পতেই। আমিও পছন্দ করি আত্মীয়তা। আমার মা তাঁর আত্মীয়তাপ্রীতি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে– আমার নানির কাছ থেকে।
অনাসক্তি আমার বাবার গুণগুলোর একটি ছিল না, তিনি বরঞ্চ অস্থির হতেন পান থেকে চুন খসতে দেখলে। খুঁটিনাটি লক্ষ্য করতেন, অত্যন্ত দক্ষ গোয়েন্দার মতো। ওদিকে আমার মা সর্বদাই শান্তপ্রবাহ। কী করে তিনি স্থির থাকতেন, আমি জানি না। তাঁর স্বামী চলে গেলেন, একটি পুত্র চলে গেল, সবচেয়ে ন্যাওটা ছিল যে ছেলে সে গিয়ে স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধেছে আমেরিকায়। তাঁর দুই ভাই এবং একমাত্র বোন আগেই চলে গেছেন, একের পর এক। সর্বকনিষ্ঠজনও গেলেন। তাঁর সমবয়স্কদের অধিকাংশই আজ নেই, কম বয়স্কদেরও কেউ কেউ বিদায় নিয়েছেন। তিনি দেখেছেন, সহ্য করছেন, কান্নাকাটি করেছেন, কিন্তু ভেঙে পড়েননি, আত্মসংবরণ করে রয়েছেন, স্থির সাক্ষীর মতো। উপেক্ষা করেন, অপেক্ষা করেন। যতটা সম্ভব অবিচলিত থাকতেন। এক সময়ে তিনিও বিদায় নিয়েছেন। আমি মায়ের মতো পারিনি, আমি বড় সহজে চঞ্চল, উদ্বেল, উদ্বিগ্ন ইত্যাদি হই, ভয় পেয়ে যাই; আবার উৎফুল্লও হই খুব সহজে। মনের দিক থেকে আমি আমার মায়ের মতো নই; মানসিকভাবে আমি নিতান্তই নিম্নমধ্যবিত্ত। ভালো হতো যদি অনাসক্তি আরও গভীর হতো, যেমনটা আমার মায়ের মধ্যে দেখেছি। আমার ভেতরে কিছুটা আমলাতান্ত্রিকতা যে নেই তা নয়, ওটি বাবার কাছ থেকে পাওয়া; চমৎকার হতো ও-জিনিস না থাকলে। আমার মায়ের মধ্যে যা ছিল না।
আমি পেছনে পড়ে থাকি আমার মায়ের, একটি বিশেষ জায়গায়, সেটা আতিথেয়তার। ওইখানে আমি ভয় পেয়ে যাই, আমার বাবাও পেতেন, আমার মা মোটেই পাননি। আতিথেয়তার ব্যাপারে তাঁকে আমরা অসীম সাহসী বলেই জেনেছি। মেহমান পেলে খুশি হতেন, চলে গেলে বিষণ্ন। সামান্য উপকরণ নিয়ে অসামান্য আপ্যায়নে তাঁর দক্ষতা আমার কখনও আয়ত্তগত হবার ছিল না, হয়ও-নি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আম র ম য় র আম র ব ব র দ বন দ ব র জন ত ক ষমত র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
যশোরে পরকীয়া প্রেমিকের হাতে নারী খুন
যশোরের মনিরামপুর উপজেলার কৃষ্ণবাটি গ্রামে তৃপ্তি রাণী (৪০) নামের এক নারীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) দুপুরে তৃপ্তি রানী মাঠে ঘাস কেটে বাড়িতে ফেরার পথে শংকর নামের এক স্থানীয় যুবক তৃপ্তি রানীকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আহত করে। উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়ার পথে সন্ধ্যায় তার মৃত্যু হয়।
আরো পড়ুন:
প্রথম স্ত্রীকে তালাক না দেওয়ায় দ্বিতীয় স্ত্রীর আত্মহত্যা
যে কারণে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে গলায় ফাঁস দিলেন স্বামী
তৃপ্তি রানী উপজেলার কৃষ্ণবাটি দক্ষিণ পাড়ার অবনিশ মল্লিকের স্ত্রী। অভিযুক্ত শংকর নিহতের প্রতিবেশী। হত্যাকাণ্ডের পরে সে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে।
তৃপ্তি রানী পরকীয়ার জের ধরে হত্যার শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দারা।
কৃষ্ণবাটি এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য সাধন দাস বলেছেন, তৃপ্তির স্বামী অবনিশ ভ্যানচালক। এই দম্পতির একটি সন্তান আছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে বাড়ির পাশের এক নারীর সঙ্গে মাঠ থেকে ঘাস কেটে বাড়ি ফিরছিলেন তৃপ্তি। পথে শংকর তাদের গতিরোধ করে। এ সময় কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে শংকর তৃপ্তিকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে হাতে থাকা ধারাল অস্ত্র দিয়ে তৃপ্তির ঘাড়ে ও মাথায় এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। তখন তৃপ্তির সঙ্গে থাকা নারী বাধা দিতে গেলে তাকেও হত্যার ভয় দেখায় শংকর।
সাধন দাস বলেন, খবর পেয়ে দ্রুত তৃপ্তি রাণীকে মনিরামপুর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসক তাকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে রেফার করেন। অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকের পরামর্শে স্বজনরা তৃপ্তিকে নিয়ে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। সন্ধ্যায় নড়াইলে পৌঁছালে পথেই তৃপ্তির মৃত্যু হয়।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে তৃপ্তির সঙ্গে শংকরের পরকীয়া নিয়ে এলাকায় গুঞ্জন ছিল। একপর্যায়ে শংকর তৃপ্তিকে ঘরে তুলতে চান। তখন তৃপ্তি শংকর কাছে তার ভিটাবাড়ি দাবি করেন। শংকর তাতে রাজি না হওয়ায় তাদের দুজনের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এর জের ধরে তৃপ্তিকে খুন করেছে শংকর।
মনিরামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাবলুর রহমান খান বলেছেন, পরকীয়া সম্পর্কের জের ধরে শংকর নামের এক ব্যক্তি বৃহস্পতিবার দুপুরে তৃপ্তি রানীকে কুপিয়ে আহত করে। ঢাকায় নেওয়ার পথে তৃপ্তি মারা যান। গৃহবধূর মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠানো হয়েছে। অভিযুক্ত শংকর পলাতক আছে।
ঢাকা/রিটন/রফিক