মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫৩ বছর পর এসে ফের যাচাই-বাছাই হচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা। এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিতর্কমুক্ত, গ্রহণযোগ্য তালিকা প্রণয়নই এর লক্ষ্য। এ জন্য মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও স্বীকৃতি দেওয়ার বয়সসীমা পর্যালোচনাসহ সংশ্লিষ্ট আইন ও নির্দেশিকা সংশোধন করা হবে। ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি চাকরি পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীর ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার (পিতামহ/পিতা/মাতা ইত্যাদি) গেজেট যাচাই-বাছাই শুরু হয়েছে। তৈরি হয়েছে ‘অমুক্তিযোদ্ধা শনাক্তকরণ অভিযোগ ফরম’। এতে সারাদেশে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেছেন, অমুক্তিযোদ্ধারা স্বেচ্ছায় এখান থেকে চলে গেলে তারা সাধারণ ক্ষমাও পেতে পারেন। আর যদি না যান তো প্রতারণার দায়ে তাদের অভিযুক্ত করা হবে। অভিযোগ আছে, মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও অনেকে তালিকাভুক্ত ও গেজেটভুক্ত হয়ে সুবিধা গ্রহণ করছেন। এটি ছোটখাটো অপরাধ নয়, অনেক বড় অপরাধ। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাওয়া উচিত। 
মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। মুক্তিযুদ্ধে নানা ধরনের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন, বিভিন্নভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। রাজনৈতিক কারণে সব সরকারই মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনেছে। এটি এখন আবার হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হয়তো হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধ এবং যারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, শুধু তারাই ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’র স্বীকৃতি পাবেন। এর বাইরে যারা দেশ-বিদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন, বিশ্বজনমত তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন, তারা হবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন সংশোধন করে নতুন যে অধ্যাদেশ হতে যাচ্ছে, তাতে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় এ পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এর আগে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছিল ২০২২ সালে। সর্বশেষ সংজ্ঞায় মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা যুদ্ধ করেছিলেন এবং যারা বিশেষ অবদান রেখেছিলেন, তাদের সবাইকে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনার বিষয় নিয়ে সরকার খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক এবং বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কথা বলেছে। প্রায় সবাই বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন আর যারা বিভিন্ন উপায়ে অবদান রেখেছেন, তারা একই কাতারে থাকতে পারেন না। যে কারণে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হচ্ছে।
খসড়া অধ্যাদেশে নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা দেশের ভেতরে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন; পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় সহযোগী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, এ রূপ সব বেসামরিক নাগরিক (ওই সময়ে যাদের বয়স সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়সের মধ্যে ছিল) বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবেন। এর পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী, মুক্তিবাহিনী, বিএলএফ ও অন্যান্য স্বীকৃত বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স ও আনসার সদস্যরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন। খসড়া অধ্যাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী নামে নতুন একটি ধারা যুক্ত করা হচ্ছে। সহযোগীদের সম্পর্কে বলা আছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা দেশের ভেতরে বা প্রবাসে অবস্থান করে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করতে সংগঠকের ভূমিকা পালন, বিশ্বজনমত গঠন, কূটনৈতিক সমর্থন অর্জন এবং মনস্তাত্ত্বিক শক্তি অর্জনে বাংলাদেশের যেসব নাগরিক প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছিলেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীর মর্যাদা পাবেন।

স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১১ বার বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড বদলানো হয়েছে। এর মধ্যে শুধু সংজ্ঞা বদলানো হয়েছে পাঁচবার। অধ্যাদেশ জারি হলে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড বদলাবে ১২ বার। অন্যদিকে এখন পর্যন্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে সাতবার। বীর মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা, ভাতা প্রদানসহ অন্যান্য তথ্য ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) নামে একটি সফটওয়্যারে হালনাগাদ করে থাকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এমআইএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৯৭ হাজার ৮০০। এর মধ্যে মাসিক ভাতা পান ১ লাখ ৯৬ হাজার ৪৫৪ জন। নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী করা হলে স্বাভাবিকভাবেই বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কমে যাবে। 

স্বাধীনতার পর কখনও কোনো বিধি মেনে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরি করা হয়নি। এ ব্যাপারে জাতীয় সংসদে পাস করা কোনো আইনও নেই। ফলে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন সব দলই মুক্তিযোদ্ধা তৈরিতে প্রভাব বিস্তার করেছে। এই ধারাবাহিকতা এখনও অব্যাহত। নিয়ম লঙ্ঘন করে আবেদনকারী মুক্তিযোদ্ধার নাম গেজেটভুক্ত করা হয়েছে। অথচ তারা কে কোন তালিকা থেকে এসেছেন, তার কোনো হিসাব নেই। এর আগে যাচাই-বাছাইয়ের সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক এবং গেজেট করার সময়ে মন্ত্রণালয় ও জামুকার সরকারি কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেছেন। যদি অনিয়ম-দুর্নীতি বা ভুলত্রুটি কিছু হয়েই থাকে, তো সরকারি কর্মকর্তারা কেন দায়ী হবেন না– এ প্রশ্নের জবাব আজ জরুরি হয়ে পড়েছে।

একাত্তরে সমগ্র পূর্ব বাংলা ছিল শত্রুবেষ্টিত, অবরুদ্ধ। মানুষের জীবন ছিল কচুপাতার ওপর এক ফোঁটা পানির মতো। এমন অবস্থায় বাঙালি কোনো কিছু প্রাপ্তির আশায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি। তারা মনেপ্রাণে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে চেয়েছিল। স্বাধীনতা লাভের পর এ দেশের নির্যাতিত জনগণ আশায় বুক বেঁধেছিল, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল তারা ভোগ করতে পারবে। শোষণ-বঞ্চনা চিরবিদায় নেবে। সাম্যপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে। সর্বহারা থেকে শুরু করে সব শ্রেণির মানুষ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারবে এবং মানুষের সব ধরনের মুক্তি সুনিশ্চিত হবে। কিন্তু অচিরেই জনগণের স্বপ্নভঙ্গ হয়। তারা বুঝতে পারে, মানচিত্রগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে শাসক আর শোষকের হাত বদল হয়েছে মাত্র। প্রকৃত স্বাধীনতা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। যত দিন যাচ্ছে, বৈষম্য আর বঞ্চনার মাত্রা তত প্রকট হচ্ছে। 
ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বুর্জোয়া নেতৃত্বই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে রেখেছে। ফলে একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের সম্পদ লুণ্ঠিত হচ্ছে, অন্যদিকে দরিদ্র ও ভূমিহীন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সব মৌলিক অধিকার থেকে জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে।

রেজাউল করিম খান: সাংবাদিক
rezaul.

bd1956@gmail.com    

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ম ক ত য দ ধ র সহয গ স ব ধ নত র কর মকর ত কর ছ ল ন কর ছ ন ক ত কর ত র পর মন ত র র সময় সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

নোয়াম চমস্কির দৃষ্টিতে ইসরায়েলি হামলা

নোয়াম চমস্কিকে শুধু ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে চেনা যথেষ্ট নয়। তিনি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বিশ্বমানবতার বিবেক হয়ে উঠেছেন বহু আগেই। গত শতকের ষাটের দশক থেকে সক্রিয় ও স্পষ্টভাষী এই রাজনৈতিক সমালোচক বরাবরই প্রশ্ন তুলেছেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার, সাম্রাজ্যবাদ, যুদ্ধ ও সংবাদমাধ্যমের পক্ষপাত নিয়ে। চমস্কি মনে করেন, ‘ফর দ্য পাওয়ারফুল, ক্রাইমস আর দোজ দ্যাট আদারস কমিট’। ন্যায়ের সংজ্ঞা যদি পক্ষবিশেষ নির্ধারণ করে, তাহলে তা আর ন্যায় থাকে না, বরং হয়ে দাঁড়ায় রাজনীতির বাহন।

চমস্কির মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এক প্রকার বিকৃত নৈতিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে। শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর জন্য এক সেট নীতি, আর দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর জন্য আরেক। এই দ্বিচারিতা প্রবলভাবে প্রতিফলিত ইরান-ইসরায়েল সংকটে। একদিকে ইসরায়েল নিজেকে মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র পারমাণবিক শক্তি হিসেবে গোপনে রাখে এবং পশ্চিমা বিশ্ব তার অস্ত্রভান্ডার নিয়ে নীরব। অপরদিকে ইরান শান্তিপূর্ণভাবে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের চেষ্টা করলেও তাকে ‘বিশ্বশান্তির হুমকি’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। চমস্কি বলেন, আমরা যখন ‘সন্ত্রাস’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করি, তখন সতর্ক হওয়া দরকার যে কারা এটা সংজ্ঞায়িত করছে।

ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শত্রুতা হঠাৎ তৈরি হয়নি। চমস্কি স্মরণ করিয়ে দেন, ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যৌথ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটিয়ে পশ্চিমা মদদপুষ্ট শাহকে পুনরায় ক্ষমতায় বসিয়েছিল। এই হস্তক্ষেপ ইরানিদের মনে গভীর রাজনৈতিক ক্ষোভ সৃষ্টি করে। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লব কেবল শাসক পরিবর্তন নয়; বরং ছিল ভূরাজনৈতিক স্বাধীনতার নামান্তর। চমস্কির মতে, বিপ্লব-পরবর্তী ইরান স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে গিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের শত্রুতে পরিণত হয়।
এই শত্রুতার সবচেয়ে বড় কাঁটা হয়ে ওঠে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি। ২০১৫ সালের ‘জয়েন্ট কমপ্রিহেন্সিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন’ চুক্তি চমস্কির দৃষ্টিতে ছিল কূটনৈতিক সমঝোতার ইতিবাচক নজির। ইরান এই চুক্তির আওতায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সীমিত করে, পরিদর্শকদের ঢুকতে দেয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ মেনে নেয়। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন একতরফা চুক্তিটি বাতিল এবং ইরানকে নতুন নিষেধাজ্ঞা দেয়। এই ঘটনাকে চমস্কি বলেন ‘কৃত্রিম সংকট তৈরির ধ্রুপদি উদাহরণ’। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্রই প্রথমে চুক্তি ভঙ্গ করে সৃষ্ট সংকটের দায় চাপায় ইরানের ওপর। আন্তর্জাতিক মিডিয়া সেই বয়ানকেই নিরীক্ষাহীনভাবে গ্রহণ করে।

চমস্কি আরও দেখান, কেবল নিষেধাজ্ঞা আরোপই নয়; ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র একাধিকবার ইরানে সাইবার আক্রমণ চালিয়েছে; ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের হত্যা করেছে। এমনকি সামরিক হামলার হুমকিও দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। অথচ পশ্চিমা প্রচারে ঘটনাগুলো আত্মরক্ষার পদক্ষেপ বলে বৈধতা পায়। চমস্কির ভাষায়, মার্কিন নীতির মৌল ভিত্তিই হলো– নিজেরা করলে বৈধ, অন্য কেউ করলে অপরাধ।
ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার আন্তর্জাতিকভাবে ওপেন সিক্রেট হলেও যুক্তরাষ্ট্র কখনও সেটি স্বীকার করে না। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে কোনো রাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি-এনপিটি স্বাক্ষর না করলে তাকে সামরিক সহায়তা দেওয়া বেআইনি। ইসরায়েল এনপিটি স্বাক্ষর করেনি। তাই পারমাণবিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা বন্ধ করতে হয়। আইনি ফাঁক এড়াতে চমস্কির ভাষায়– ‘দ্য পলিসি ইজ: ডোন্ট আস্ক, ডোন্ট টেল’।

চমস্কির মতে, মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তির জন্য অন্যতম কার্যকর ও ন্যায্য উপায় হতে পারে গোটা অঞ্চলকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত ঘোষণা। ইরান একাধিকবার এই প্রস্তাব দিয়েছে; আরব রাষ্ট্রগুলোরও দীর্ঘদিনের দাবি; জি৭৭ গোষ্ঠীর দেশগুলোও এ প্রস্তাবকে সমর্থন করে। কিন্তু এ উদ্যোগ বারবার ব্যর্থ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরোধিতায়। চমস্কির প্রশ্ন, যদি বিশ্বশান্তিই উদ্দেশ্য হয়, তবে কেন দুই রাষ্ট্রই পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে বাধা দিচ্ছে?
‘ন্যায্য যুদ্ধতত্ত্ব’ সম্পর্কে চমস্কির মত– এটি এক ধরনের মতামতভিত্তিক কাঠামো, যা বাস্তবে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর যুদ্ধকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। তিনি মনে করেন, আফগানিস্তান বা ইরাক যুদ্ধকে পশ্চিমা বয়ানে ‘ন্যায্য’ বলা হলেও আসলে আগ্রাসনেরই পরিপাটি কেস স্টাডি।

ইসরায়েল যদি ইরানে হামলা চালায়; পশ্চিমা বয়ানে সেটা ‘প্রি-এম্পটিভ’ বা কল্পিত বিপদের আশঙ্কা থেকে আঘাত। অথচ জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আত্মরক্ষা কেবল তখনই বৈধ, যখন আগ্রাসন বাস্তবে সংঘটিত হয়। চমস্কির মতে, প্রি-এম্পটিভ আঘাত প্রতিরক্ষা নয়; আগ্রাসন।
ইরান বর্তমানে কঠোর নিষেধাজ্ঞা, অর্থনৈতিক অবরোধ, সাইবার আক্রমণ ও সামরিক হুমকির মুখে। চমস্কি প্রশ্ন করেন– ‘তাহলে কি ইরানেরও অধিকার আছে পাল্টা প্রতিরোধমূলক হামলা চালানোর?’ তাৎক্ষণিক সেটি অগ্রহণযোগ্য আখ্যা পায়। এই অসামঞ্জস্যই চমস্কির মতে আধুনিক নীতিবোধের বিপর্যয়। তাঁর মতে, যদি ইসরায়েলের উদ্বেগ বৈধ হয়, তবে ইরানের উদ্বেগও সমানভাবে ন্যায্য।
চূড়ান্তভাবে চমস্কি যুদ্ধ নয়; শান্তি ও সংলাপের পথকেই অগ্রাধিকার দেওয়ার পক্ষপাতী। তিনি বলেন, হয় আমাদের পারমাণবিক অস্ত্র সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করতে হবে, না হয় আমরাই বিলুপ্তির মুখোমুখি হবো। তাঁর অবস্থান, সব রাষ্ট্রকেই আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে হবে– বন্ধু হোক বা শত্রু। এই অবস্থান নিছক নীতিকথা নয়; বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্বের প্রতি জরুরি আবেদন।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত রাজনৈতিক হলেও গভীর নৈতিক সংকটও বটে। এই সংকটে কেবল পারমাণবিক অস্ত্র নয়, সত্য ও ন্যায়ের প্রশ্ন জড়িত। চমস্কি বিশ্বাস করেন, সত্যিকারের শান্তি তখনই সম্ভব, যখন আমরা দ্বিচারিতা পরিহার করে প্রত্যেক মানুষের অধিকার, মর্যাদা ও জীবনের গুরুত্ব সমানভাবে বিবেচনা করব; হোক সে ইরানি কিংবা ইসরায়েলি।

সাঈফ ইবনে রফিক: কবি ও সাংবাদিক
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ