জোয়ান অফ আর্ক বিপ্লবী ও গোপন প্রেমিকা
Published: 30th, May 2025 GMT
গগনবিদারী চিৎকারে ভারী হয়ে আসে চারপাশ। সিন নদীর তীরে উত্তর ফ্রান্সের এক লোকালয়ে উঁচু পিলারে বেঁধে আগুনে পোড়ানো হচ্ছে তাঁকে। অভিযোগ, তিনি ডাইনি। শুধু একবার পুড়িয়েই ক্ষান্ত হয়নি। পরপর তিনবার পোড়ানো হয়। অবশেষে ছাই হয়ে গেল তাঁর পুরো শরীর। সেই ছাই ফেলে দেওয়া হলো ফ্রান্সের সিন নদীতে। তিনি আর কেউ নন, ফ্রান্সের বীর নারী জোয়ান অফ আর্ক।
এই নারী স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর জন্মগ্রামের এক নদীতীরে বসে। ফ্রান্সের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর নারী জোয়ান অফ আর্ককে ১৪৩১ সালে এদিনে (৩০ মে) মাত্র ১৯ বছর বয়সে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়। ইংল্যান্ডের মানুষেরা উল্লাস করেছিল। আর ফরাসিদের হৃদয়ে হাহাকার। আর তাঁর সেই গোপন প্রেমিক তখন কী করছিল?
তাঁকে পুড়িয়ে মারার কারণ, তিনি ‘ডাইনি’। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক। প্রায় ৭০টির মতো। তিনি অল্প বয়সে মদ্যপান করতেন। পুরুষদের মতো পোশাক পরতেন। চুল বয় কাট ছিল। চলাফেরা পুরুষালি। জাদুবিদ্যা জানতেন। ঘোড়া চুরি করেছেন। সবচেয়ে বড় অপরাধ ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
১৪৩০ সালের মে মাসে জোয়ান ইংরেজদের মিত্রবাহিনীর হাতে আটক হন। তাঁরা ইংরেজদের হাতে জোয়ানকে তুলে দিলে শুরু হয় তাঁর বিচার। পিয়েরে কশন নামের এক বিশপ—আদালতের বিচারকাজ শুরু করেন।
১৪৩১ সালের মে মাসের মধ্যে অভিযোগ মাত্র ১২টিতে নামিয়ে আনা হয়েছিল। দুটো অভিযোগ জোরালো ছিল। পুরুষদের পোশাক পরা এবং ঈশ্বর সরাসরি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বলে দাবি করা। তাঁকে প্রশ্ন করা হয় তিনি আদৌ ঈশ্বরের দয়ায় আস্থা রাখেন কি না। সাহসী জোয়ান এর সরাসরি কোনো জবাব দেননি। বলেন, ঈশ্বর এত শক্তিশালী যে তিনি চাইলে যেকোনো বিচারই করতে পারেন। এই বিচারকের দরকার পড়ে না। এরপরই তাঁকে পুড়িয়ে মারা হয়। আর্ককে পুড়িয়ে মারার ১৫ দিনের মধ্যেই ইংল্যান্ডকে পাততাড়ি গুটিয়ে ফ্রান্স ছেড়ে দিতে হয়।
জোয়ান তাঁর বাবা জেকের সঙ্গে কৃষি খামারে কাজ করতেন একটু বড় হওয়ার পরই। মা ইসাবেলা তাঁকে সুতো বুনন এবং সেলাইর কাজ করাতেন। একেবারেই নিস্তরঙ্গ জীবন। এর ওপর ফ্রান্স তখন ইংল্যান্ডের দখলে। ইউরোপের দুই প্রধান শক্তির মধ্যে রেষারেষি চলছিলই। ফলে ফ্রান্সের সাধারণ প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষ চরম আর্থিক অনটনে পড়ে। সেই সময়ে দঁরেমি গ্রামের মিউজ নদীর তীরে একদিন বসেছিলেন। সেই নদীর পাড় ঘেঁষে এক সৈনিককে প্রথম দেখেন সাদা ঘোড়া তীব্র বেগে ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
এরপরই তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র আঠারোর অল্প ওপরে।
জোয়ানকে হত্যার ঠিক ১৫ বছর পর পোপ তৃতীয় ক্যালিক্সটাসের নেতৃত্বে গঠিত এক আদালতে জোয়ানকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। আর ১০৫ বছর পর ১৯২০ সালের ১৬ মে ফ্রান্সের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর নারী জোয়ান অফ আর্ককে রোমে পোপ পঞ্চদশ বেনেডিক্ট ক্যানোনাইজ সেন্ট উপাধি দেওয়া হয়।
একজন যোদ্ধাকে কেন এত বছর পর ‘সন্ত’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল এ প্রশ্ন রয়েছে অনেকের মনে। দার্শনিক মন্টেস্কু ছিলেন আলোকিত যুগের একজন ফরাসি লেখক এবং দার্শনিক। তার ‘পারসিয়ান লেটার’ বইতে উজবেক ও রিকা নামক দুজন পারস্য দেশীয় (বর্তমান ইরান) ভ্রমণকারীর ছদ্মনামে পারস্য সমাজের দোষ ত্রুটি তুলে ধরতে গিয়ে জোয়ান অফ আর্ক সম্পর্কে রিকা জানতে চাইছেন, আর্ককে এত অপবাদ দেওয়া হয়েছিল কেন?
জবাবে উজবেক বলছেন, এই অপবাদ তৈরিকৃত ছিল। ইংল্যান্ড ছড়িয়েছিল।
রিকা বলেন, নারীকে ‘ডাইনি’ বলে পুড়িয়ে দেওয়া কেমন বিচার?
উজবেক বলে, স্বার্থের রাজনীতি। একদিন নিশ্চয়ই তাঁর অবদানের জন্য তাঁকে ‘চরম ভালো’ কোনো খেতাবও দেওয়া হতে পারে।
পারসিয়ান লেটার কত আগের লেখা। অথচ উজবেকের সেই সংলাপই সত্য হলো। একসময় পশ্চিমা দুনিয়া জোয়ান অফ আর্কের জনপ্রিয়তাকে এড়িয়ে যেতে পারল না।
মৃত্যুর ১০৫ বছর পর ১৯২০ সালের ১৬ মে তাঁকে ‘সন্ত’ উপাধি দেওয়া হয়। আলথুসার এক ইন্টারভিউতে এই ‘সন্ত’ উপাধি দেওয়ার কারণ হিসেবে বলেন, খ্রিষ্টান ধর্মের মহত্ত্ব প্রচারের জন্যই তাঁকে ‘সন্ত’ উপাধি দিয়ে পাপমোচন করা হয়েছিল।
অন্যদিকে শুধু আধুনিক যুগে নয়, এখনো অনেক গবেষক জোয়ান অফ আর্ককে মৃগীরোগ থেকে শুরু করে সিজোফ্রেনিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিলেন বলে দাবি করছেন।
বলা হয়, ১২ বা ১৩ বছর বয়সে, জোয়ান অফ আর্ক স্পষ্টতই অদৃশ্য কণ্ঠস্বর শুনতে পেতেন এবং কাউকে দেখছেন (কিন্তু বাস্তবে আদৌ কেউ নেই) অনুভব করতে শুরু করেছিলেন, যা তিনি ঈশ্বরের কাছ থেকে আসা বার্তা হিসাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁর বিচারের সময়, তিনি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে ফেরেশতা এবং সাধুরা প্রথমে তাঁকে কেবল গির্জায় যেতে এবং ধার্মিকভাবে জীবন যাপন করতে বলেছিলেন; পরে তাঁরা তাঁকে আক্রমণকারী ইংরেজদের হাত থেকে ফ্রান্সকে মুক্ত করতে এবং ফরাসি সিংহাসনের মুকুটবিহীন উত্তরাধিকারী সপ্তম চার্লসকে দেশের ন্যায়সংগত রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে নির্দেশ দিতে শুরু করেছিলেন।
মূলত হ্যালুসিনেশন বা বিভ্রমের কারণে এমন হতো বলে মত দেন অনেকে। তিনি ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত; কারণ, অল্প বয়সে পাস্তুরিত দুধ পান করা এবং গবাদিপশু পালন করতেন, এসবও বলা হয়।
ফরাসি সেনাবাহিনীর কমান্ডার থাকাকালে জোয়ান অফ আর্ক সক্রিয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি—এমন অভিযোগও করা হয়। তিনি কোনো প্রতিপক্ষকে হত্যা করেননি। পরিবর্তে, তিনি তাঁর সৈন্যদের সঙ্গে একধরনের অনুপ্রেরণামূলক মাসকট হিসেবে থাকতেন।
কিন্তু উইলিয়াম স্মিথের দাবি, তিনি এত রোগে আক্রান্ত হলে যুদ্ধ করলেন কীভাবে? কারণ, জোয়ান সামনের সারির থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও কমপক্ষে দুবার আহত হয়েছিলেন। তাঁর বিখ্যাত অরলিয়ান অভিযানের সময় কাঁধে একটি তির এবং প্যারিসকে মুক্ত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টার সময় একটি ক্রসবো বোল্ট ঊরুতে লেগেছিল। জোয়ান দুজন ব্রিটিশ কমান্ডারকে গুলি করে হত্যাও করেছিলেন। স্মিথ মনে করেন, জোয়ানের বীরত্বগাথাকে ম্লান করার জন্য এসব প্রোপাগান্ডা। তবে যুদ্ধের কৌশলগত কারণে মনে করা হয়—জোয়ান অনেক সময়ই বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করতেন।১৯০৯ সালে পোলিশ বংশোদ্ভূত প্যারিসের অন্যতম জনপ্রিয় হেয়ারড্রেসার মন্সিউর অ্যান্টোইন জোয়ান অফ আর্কের হেয়ার স্টাইলের অনুসারী ফ্যাশনেবল ক্লায়েন্টদের চুল ছোট করে ‘বব কাট’ দিতে শুরু করেন। এই লুকটি সত্যিই ১৯২০-এর দশকে ধরা পড়ে, যা নীরব চলচ্চিত্র তারকাদের দ্বারা জনপ্রিয় হয়েছিল। এমনকি প্রিন্সেস ডায়ানাও প্রভাবিত ছিলেন বলে দাবি করেন মন্সিউর অ্যান্টোইন।
অ্যামি আর.
১৮৯৬ সালে মার্ক টোয়েন তাঁর শৈশবের নায়কের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি ‘পারসোনাল রিকলেকশনস অফ জোয়ান অফ আর্ক’ নামে উপন্যাস প্রকাশ করেন। সম্ভবত তাঁর জীবনের জীবন্ত এবং শ্বাসরুদ্ধকর প্রেমের মুখ বাঁচাতে। টোয়েন বইটি তাঁর স্ত্রী অলিভিয়া ল্যাংডনকে উৎসর্গ করেছিলেন। উপন্যাসের এক জায়গায় রয়েছে, অরলিন্স হামলার সময় জোয়ান অফ আর্কের ঊরুতে গুলি লাগলে তিনি মাটিতে হেলে পরার আগে অস্ফুট স্বরে শুধু বলেছিলেন, ‘আমার এক গোপন প্রেমিক ছিল’।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর ছ ল ন স ব ধ নত উপন য স বছর পর হয় ছ ল ম র এক র সময় করত ন
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সমস্যা কী, সমাধান কোথায়: শুনুন তামিমের মুখে
এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় সমস্যা কী? কোন বিষয়টি সবার আগে সমাধান করা উচিত?
দুটি প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই অনেক কথাই বলবেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত কারও বিষয়টি ভালো জানার কথা। যেমন তামিম ইকবাল। প্রথম আলোর প্রধান ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্র তামিমের সামনে দুটি প্রশ্ন রেখেছিলেন। তামিমের উত্তর, ‘আমার কাছে মনে হয় যে আমাদের ফ্যাসিলিটিজ (অনুশীলনের পর্যাপ্ত সুযোগ–সুবিধা) নাই।’
প্রথম আলোর কার্যালয়ে উৎপল শুভ্রকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে আড্ডার মেজাজে তামিম বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন। নিজের ক্যারিয়ার, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য—এসব নিয়েও বেশ খোলামেলা কথা বলেন সাবেক এই ওপেনার।
আলাপচারিতার একপর্যায়েই বাংলাদেশ ক্রিকেটে এ মুহূর্তের সমস্যার প্রসঙ্গ উঠেছিল। অনুশীলনের পর্যাপ্ত সুযোগ–সুবিধার অভাবকে সামনে টেনে এনে তামিম বলেছেন, ‘একটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দলের যে ফ্যাসিলিটিজ দরকার হয় কিংবা বাংলাদেশের মতো দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার একটি (ক্রিকেট), যে ফ্যাসিলিটিজ থাকা উচিত, তার আশপাশেও নেই। পৃথিবীর তৃতীয়, চতুর্থ ধনী বোর্ডের যে ফ্যাসিলিটিজ থাকা উচিত, আমরা এর আশপাশেও নেই।’
তামিম বিষয়টি ভালোভাবে ব্যাখ্যা করলেন, ‘ক্রিকেট দলের প্রতি ভক্তদের যে প্রত্যাশা, সেটা পূরণের জন্য যে ফ্যাসিলিটিজ দরকার, আমরা তার আশপাশেও নেই। আপনি মাঝারি মানের ক্রিকেটার হতে পারেন কিংবা মাঝারি মানের ব্যাটসম্যান হতে পারেন, সঠিক অনুশীলনের মাধ্যমে কিন্তু আপনি মাঝারি মান থেকে দুই ধাপ ওপরে উঠতে পারবেন।’
মুশফিকুর রহিম