রাজধানীর পান্থকুঞ্জ উদ্যান জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত এবং সেখানে গাছরক্ষা আন্দোলনকারীদের অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন গণ আদালত। একই সঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে পান্থকুঞ্জে জনসাধারণের অবাধ প্রবেশ ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে গণস্বার্থ বিষয়ে এটি ছিল প্রথম গণ আদালত।

আজ শুক্রবার বিকেলে পান্থকুঞ্জের উত্তর প্রান্তে অনুষ্ঠিত গণ আদালত এই রায় ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ গাছরক্ষা আন্দোলন ‘পান্থকুঞ্জ মোকদ্দমা: জনগণ বনাম অন্তর্বর্তী সরকার’ শীর্ষক এই গণশুনানির আয়োজন করে।

পান্থকুঞ্জের গাছ কেটে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের (দ্রুতগতির উড়ালসড়ক) র‌্যাম্প নির্মাণ বন্ধের দাবিতে গাছরক্ষা আন্দোলনের কর্মীরা গত ১৪ ডিসেম্বর থেকে এখানে অবস্থান করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে গণ আদালত পরিচালনা করে এই গণশুনানির আয়োজন করা হয়।

আদালতের এজলাসের মতোই লাল সালু কাপড়ে আচ্ছাদিত বিচারকদের মঞ্চ, সাক্ষীদের কাঠগড়া, বিচারমঞ্চের উভয় পাশে বাদী ও বিবাদীপক্ষের আসন এবং সামনে দর্শকদের আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বাদীপক্ষ উপস্থিত থাকলেও বিবাদীপক্ষে কেউ ছিলেন না। তাঁদের আসনগুলো খালিই ছিল। বিবাদীরা হলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিব, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, সড়ক পরিবহন সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সেতু বিভাগের নির্বাহী পরিচালক (সচিব), পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্প পরিচালক।

বিচার কার্যক্রমের শুরুতে বাদীপক্ষের প্রসিকিউটরের ভূমিকা পালনকারী গাছরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আমিরুল রাজিব আদালতকে জানান, বিবাদীপক্ষকে রেজিস্ট্রি ডাক, ই-মেইলে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গণশুনানিতে হাজির থাকার জন্য জানানো হলেও তাঁরা জনগণের পক্ষের এই আবেদনে সাড়া দেননি; উপেক্ষা করেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় জনগণের প্রতি তাঁদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই।

আমিরুল রাজিব জানান, গাছরক্ষা আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দল বা কোনো বেসরকারি সংস্থা নয়। প্রাণ পরিবেশ প্রকৃতি ও অধিকার আদায় নিয়ে যারা কাজ করে, তাদের একটি সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম। গত ১৬৮ দিন থেকে তাঁরা পান্থকুঞ্জে অবৈধভাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‌্যাম্প নির্মাণ বন্ধের দাবিতে আন্দোলন করছেন। এখানে প্রায় দুই হাজার গাছ কাটা হয়েছে। বহু পাখি, পতঙ্গের আবাস ধ্বংস হয়েছে। আশপাশের এলাকা মানুষের এই মিলনস্থল, প্রাতর্ভ্রমণের জায়গাটি বিনষ্ট করা হচ্ছে।

গাছরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক বলেন, সুস্পষ্টভাবে সংবিধান, আইন ও আদালতের নির্দেশ অমান্য করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সুবিধার জন্য বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলের এই জনবিরোধী প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই দুর্নীতিদুষ্ট জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প বাতিলের জন্য প্রায় ৬ মাসে ৪০টির বেশি সংবাদ সম্মেলন, সেমিনার, সাংস্কৃতিক সমাবেশ, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। সেখানে দেশের অগ্রগণ্য শিক্ষাবিদ, প্রাণ পরিবেশ প্রকৃতিবিশেষজ্ঞ, অধিকারকর্মী, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ অংশ নিয়েছেন। কিন্তু এই সরকার কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করছে না। এ কারণে এই গণশুনানির আয়োজন করা হয়েছে।

সহকারী প্রসিকিউটরের ভূমিকায় গাছরক্ষা আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক নাঈম উল হাসান আদালতের সামনে ছয়টি অভিযোগ তুলে ধরেন। এগুলো হলো অর্থনৈতিক অনিয়ম ও দুর্নীতি; সংবিধান, আইন ও আদালতের আদেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন; পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া প্রকল্পের কাজ করা; বৈষম্যমূলক চুক্তির মাধ্যমে জনগণের ওপরে জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প চাপিয়ে দেওয়া; প্রকল্প কাজের সময় দেশের নাগরিকের মৃত্যুর পরে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দায়মুক্তি দেওয়া; প্রকল্পের অজুহাতে হাতিরঝিল ভরাট এবং পান্থকুঞ্জের দুই হাজারের বেশি গাছ কাটা ও পাখি–পতঙ্গের বাসস্থান ধ্বংস করা।

এই অভিযোগ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য–উপাত্ত এবং নানা অসুবিধার কথা তুলে ধরে কাঠগড়ায় এসে শপথ নিয়ে সাক্ষ্য দেন নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহম্মদ খান, লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ, তেঁতুলতলা মাঠরক্ষা আন্দোলনের সংগঠক ও পরিবেশকর্মী সৈয়দা রত্না, পান্থকুঞ্জ প্রভাতি সংঘের সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন, শিল্পী সৈয়দ মোহাম্মদ জাকির।

এজলাসে পাঁচ সদস্যের বিচারকমণ্ডলীর প্রধান ছিলেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য গীতি আরা নাসরিন। অন্য সদস্যরা হলেন সর্বজনকথা সম্পাদক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান, প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা মঞ্চের আহ্বায়ক জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এবং জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সামসি আরা জামান।

বিচারকমণ্ডলীর প্রধান গীতি আরা নাসরিন জানতে চান বিবাদীপক্ষের কেউ উপস্থিত আছেন কি না এবং তাঁদের কোনো বক্তব্য আছে কি না। তাঁকে জানানো হয়, বিভিন্ন মাধ্যমে গণশুনানিতে হাজির থাকার জন্য অনুরোধ করা হলেও বিবাদীদের কেউ উপস্থিত হননি। এরপর বিচারকেরা রায়ের একেকটি অংশ ঘোষণা করেন।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, আদালত মনে করে, ভবিষ্যতে এ ধরনের জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প গ্রহণ থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। গোপনীয়তার অজুহাতে প্রকল্পের চুক্তি ও অন্যান্য জনগুরুত্বপূর্ণ তথ্য জনসমক্ষে না প্রকাশ করার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। এই গোপনীয়তার ফলে মেগা প্রকল্পেই দুর্নীতি হয়েছে। এই আদালত ভবিষ্যতের সব প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য তথ্যের অবাধ সরবরাহ নিশ্চিতের আদেশ প্রদান করছে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্পে যেসব দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা আজকের শুনানিতে প্রমাণিত হয়েছে, সে বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করছে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পরিবেশ ছাড়পত্রের শর্ত ভঙ্গ করে পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিল জলাধারে নির্মাণকাজ চালানো হয়েছে। এ জন্য পুনরায় ছাড়পত্র প্রদান কিংবা নবায়নের ক্ষেত্রে জনগণের ক্ষতিপূরণ আদায়সহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হলো। তা ছাড়া পান্থকুঞ্জ উদ্যানের দুই হাজার গাছ কেটে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটানোর কারণে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জনসমক্ষে প্রকাশ করার জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হলো।

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, আজকের আদালত বিবাদীপক্ষের এহেন আইন অমান্য করার প্রবণতার কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং তীব্র তিরস্কার করছে।

সামসি আরা জামান প্রকল্প চলাকালে দেশের নাগরিকের মৃত্যু সম্পর্কে বলেন, বিদ্যমান ফৌজদারি আইনেই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব ছিল। আদালত সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে অবহেলাজনিত হত্যার কারণে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনে যেহেতু শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, সেহেতু উক্ত আইনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আইজিপি (পুলিশ মহাপরিদর্শক) ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ প্রদান করছে।

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে প্রধান বিচারক গীতি আরা নাসরিন বলেন, বাদীপক্ষ ১২টি সংযুক্তির মাধ্যমে তাদের অভিযোগের প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছে। বৈষম্যমূলক চুক্তি এবং জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প দেশের জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে আদালত সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার্থে বৈষম্যমূলক চুক্তি করে এই জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বৈষম্যমূলক ও জনস্বার্থবিরোধী এই প্রকল্প ও চুক্তির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদালত নির্দেশ প্রদান করছেন।

রায়ে প্রধান বিচারক পান্থকুঞ্জ সবার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত ও গাছরক্ষা আন্দোলনের অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রকল্পের কাজ স্থগিত ঘোষণা করে রায় দেন।

গণশুনানিতে পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন মুরশিদ, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন হক। তবে তাঁরা কোনো মন্তব্য করেনি। অন্যদের মধ্যে শিক্ষাবিদ, প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ ও অধিকারকর্মী শিল্পী-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীসহ সর্বস্তরের জনসাধারণ উপস্থিত ছিলেন।

গাছরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আমিরুল রাজিব ও গবেষক পাভেল পার্থ প্রথম আলোকে বলেন, এই রায়কে তাঁরা স্বাগত জানান। রায় তাঁরা বিবাদীপক্ষের সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছে দেবেন। তাঁরা আশা করছেন, গাছরক্ষা আন্দোলন যেমন গণ আদালতের রায়কে সম্মান জানিয়ে মেনে নিয়েছে, তেমনি বিবাদীপক্ষও রায়ের সুপারিশ ও নির্দেশনা মেনে নেবেন।

আরও পড়ুনসরকারকে জনগণের মুখোমুখি করতে গণশুনানির সিদ্ধান্ত২১ মে ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অবস থ ন কর প রকল প র গণশ ন ন র সমন বয়ক র র জন য ব যবস থ উপস থ ত উপদ ষ ট জনগণ র প রক ত ব চ রক সরক র গ রহণ

এছাড়াও পড়ুন:

কর ব্যবস্থার অতীত-বর্তমান

‘আপনি কি সরকারকে কর দেন’– এমন প্রশ্নে অনেক মানুষই হয়তো বলবেন, ‘না’। প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার এ দেশে ৪০ লাখ মানুষও আয়কর রিটার্ন জমা দেন না। যারা রিটার্ন জমা দেন না, স্বভাবতই তারা মনে করেন, তারা সরকারকে কর দেন না। আদতে বিদ্যমান ব্যবস্থায় এমন কেউ নেই যে কর দেন না।
প্রাচীনকাল থেকে যখন রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রবর্তন হয়, তখন থেকে কর ব্যবস্থার শুরু। সে কর ছিল প্রত্যক্ষ কর। তবে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কর ব্যবস্থা বিস্তৃত হয়েছে। প্রত্যক্ষ করের বাইরে, পরোক্ষ করও আদায় করছে সরকার। অত্যাবশ্যক কিছু পণ্য ছাড়া উৎপাদন, সরবরাহ বা আমদানির বিভিন্ন পর্যায়ে সরকার কর বা শুল্ক আরোপ করে। ফলে আপনি যে পণ্যই কিনুন না কেন, পরোক্ষভাবে সরকারকে কর দিচ্ছেন। আধুনিক কর ব্যবস্থায় শিশু থেকে বৃদ্ধ, হতদরিদ্র ভিক্ষুক থেকে ধনী– কেউই আদতে করজালের বাইরে নেই।

প্রাচীন যুগে কর
মানব সভ্যতার ইতিহাসে কর ধারণা বেশ পুরোনো। এখন থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে প্রাচীন মিসরের ফারাও সম্রাটরা জনগণের কাছ থেকে কর আদায় করতেন। তখন কৃষকের ঘরে ঘরে গিয়ে কর আদায় করতেন সম্রাটের নিযুক্ত কর্মকর্তারা। কখনও গম, কখনও পশু, কখনওবা এক দিনের শ্রম– এ সবই ছিল করের উপাদান।
প্রাচীন মিসরের বাইরে মেসোপটেমিয়া (বর্তমানে ইরাক), ভারতীয় উপমহাদেশ– সবখানেই কর আদায়ের রীতি চালু ছিল কৃষি ও সামরিক খরচ মেটাতে। সে সময়ে কর আদায়ের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল– রাজপরিবার ও সামরিক বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ, ধর্মীয় বা রাজকীয় স্থাপনার নির্মাণ এবং যুদ্ধের জন্য রসদ সংগ্রহ। করের অর্থ জনগণের স্বার্থে ব্যবহারে সামন্ত শাসকদের কোনো দায় ছিল না।
ভারতের মৌর্য যুগে কৌটিল্য কর আদায়কে রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্রীয় স্তম্ভ হিসেবে দেখেছেন। বাংলার ইতিহাসেও পাল, সেন ও পরে মুসলিম শাসকরা কৃষিপণ্যের ওপর কর আদায় করতেন। মোগল আমলে আকবরের দহসালা ব্যবস্থা বাংলায় কার্যকর ছিল, যা ছিল একটি ভূমি জরিপ ও কর নির্ধারণ পদ্ধতি। ব্রিটিশ আমলে করের চরিত্র রূপ নেয় শোষণমূলক কাঠামোয়। ১৭৯৩ সালের স্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারদের হাতে কর আদায়ের ক্ষমতা দেওয়া হয়, যার ফলে কৃষকদের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়। এই সময় রাজস্ব আদায়ের অর্থ ঔপনিবেশিক সরকারের খরচ এবং মুনাফার জোগান দিত।
সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে কর ব্যবস্থার বদল হয়েছে। সময়ের প্রবাহে কর ব্যবস্থার রূপ ও উদ্দেশ্য বদলেছে। এখন প্রচলিত মুদ্রায় কর দিতে হয়। বলা চলে, করব্যবস্থাই মানব সভ্যতাকে এগিয়ে দিয়েছে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পথে এবং আজকের উন্নত সভ্যতা গড়ার পথে মূল নিয়ামকের ভূমিকা রেখেছে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের অর্থ জনগণের স্বার্থে ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা আছে সব দেশে। 

বর্তমানে কর উন্নয়ন ও পুনর্বণ্টনের নিয়ামক
করের এখন অর্থ জীবনমান উন্নয়ন, নিরাপত্তাসহ জনগণের জন্য ব্যবহার হয়। একদিকে জনপ্রশাসন চালানোর সঙ্গে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আয় পুনর্বণ্টন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সরকারের বিশাল অঙ্কের কর চাহিদা রয়েছে। বর্তমান কর আদায়ের উদ্দেশ্য অবকাঠামো উন্নয়ন (যেমন– সড়ক, বিদ্যুৎ, হাসপাতাল), শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ভর্তুকি ও সামাজিক সুরক্ষা এবং আয়বৈষম্য কমাতে ধনীদের ওপর অধিক কর।

করের নানা ধরন
বাংলাদেশে কর দুই প্রকার– প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আয় বা সম্পদের ওপর সরাসরি যে কর আরোপ করা আছে, সেটি প্রত্যক্ষ কর। পণ্য বা সেবা কেনার সময় সরকার যে কর আদায় করে তা পরোক্ষ কর। কোনো ব্যক্তির আয় নির্দিষ্ট আয়সীমা অতিক্রম করলে তাকে কর দিতে হয়। এটিকে ব্যক্তি আয়কর বলা হয়। বর্তমানে করমুক্ত সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা। এটি অবশ্য স্বাভাবিক পুরুষ করদাতার ক্ষেত্রে। নারী, প্রতিবন্ধী, বয়স্ক এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা কিছুটা বেশি। ব্যক্তি করহার ৫ থেকে ২৫ শতাংশ। স্বাভাবিক ব্যক্তি ভিন্ন কোনো প্রতিষ্ঠান যখন আয়ের ওপর কর দেয়, তা করপোরেট কর হিসেবে পরিচিত। প্রাতিষ্ঠানিক করহার কোম্পানিভেদে ১০ থেকে ৪৫ শতাংশ। কর ফাঁকিসহ নানা কারণে মুনাফা না হলেও সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর লেনদেনের ওপর ন্যূনতম কর আরোপ করেছে। এটিকে বলা হয় টার্নওভ্যার ট্যাক্স। 

এর বাইরে আরেক ধরনের প্রত্যক্ষ কর রয়েছে। এটি হলো উৎসে কর। যেমন– ব্যাংকে আমানত বা সরকারি বন্ড বা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থেকে সুদ বা মুনাফা পেলে তার ওপর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কেটে রাখার বিধান করেছে। এর বাইরে কোনো ব্যবসা বা সেবা সরবরাহ করার পর মূল্য নেওয়ার জন্যও সরকারের আদেশে মূল্য পরিশোধকারী প্রতিষ্ঠান উৎসে কর কেটে নেয়। উচ্চ ধনীদের আয়েও সরকার কর আরোপ করেছে। ৪ কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে সরকার তার ওপর কর আরোপ করছে। 
সরকার যখন জনগণের কাছ থেকে সরাসরি কর না নিয়ে পরোক্ষ ব্যবস্থায় কর নেয়, তখন সেটিকে পরোক্ষ করা বলা হয়। এই করব্যবস্থা পণ্য বা সেবা গ্রহণের সঙ্গে সম্পর্কিত। আপনি যখন প্রক্রিয়াজাত বা প্যাকেটজাত বা আমদানি পর্যায়ের কোনো পণ্য কেনেন, তার ওপর নিজের অজান্তেই কর দিচ্ছেন। আবার গ্যাস বা বিদ্যুৎ বিল দিচ্ছেন, তখনও পরোক্ষ করে আরোপ করে। এটিকে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বলে। পণ্য ও সেবার ওপর আরোপিত যে কর ভোক্তা পরোক্ষভাবে বহন করেন সেগুলোর একটি ভ্যাট। এছাড়া আমদানি শুল্ক আকারে বিদেশি পণ্যের ওপর করারোপ হয়। এর বাইরে বিলাসবহুল ও ক্ষতিকর পণ্যের ওপর সরকার বিশেষ কর আরোপ করে থাকে। এটি হলো সম্পূরক শুল্ক। একজন সাধারণ নাগরিকের আয়কর না লাগলেও, পণ্য কিনলে বা মোবাইলে রিচার্জ করলেও তিনি কর দিচ্ছেন, এটিই পরোক্ষ করের বাস্তবতা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভোজ্যতেলের অণুপুষ্টি রক্ষায় অস্বচ্ছ প্যাকেজিং
  • ক্ষমতার লোভে বেহুঁশ বিএনপি, হুঁশে ফিরতে বললেন এনসিপি নেতা
  • বিএনপির শক্তি হচ্ছে জনগণ : জোসেফ
  • ৫ আগস্টের পর জন্ম হওয়া দলগুলোই শুধু নির্বাচন চায় না: আমীর খসরু
  • বিএনপিকে যমুনায় ডেকেছেন প্রধান উপদেষ্টা
  • শহিদ জিয়ার শাহাদাত বার্ষিকীতে দ্বিতীয় দিনের মত সিদ্ধিরগঞ্জে দোয়া ও খাবার বিতরণ  
  • বিএনপির সঙ্গে এনসিপির আসন ভাগাভাগির আলোচনা নিয়ে যা বললেন হাসনাত আব্দুল্লাহ
  • আসন ভাগাভাগির সমঝোতার দাবি ভিত্তিহীন: হাসনাত 
  • জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ‘ঘোষণা’ পান্থকুঞ্জ পার্ক
  • কর ব্যবস্থার অতীত-বর্তমান