রাজধানীর পান্থকুঞ্জ উদ্যান জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত এবং সেখানে গাছরক্ষা আন্দোলনকারীদের অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন গণ আদালত। একই সঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে পান্থকুঞ্জে জনসাধারণের অবাধ প্রবেশ ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে গণস্বার্থ বিষয়ে এটি ছিল প্রথম গণ আদালত।

আজ শুক্রবার বিকেলে পান্থকুঞ্জের উত্তর প্রান্তে অনুষ্ঠিত গণ আদালত এই রায় ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ গাছরক্ষা আন্দোলন ‘পান্থকুঞ্জ মোকদ্দমা: জনগণ বনাম অন্তর্বর্তী সরকার’ শীর্ষক এই গণশুনানির আয়োজন করে।

পান্থকুঞ্জের গাছ কেটে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের (দ্রুতগতির উড়ালসড়ক) র‌্যাম্প নির্মাণ বন্ধের দাবিতে গাছরক্ষা আন্দোলনের কর্মীরা গত ১৪ ডিসেম্বর থেকে এখানে অবস্থান করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে গণ আদালত পরিচালনা করে এই গণশুনানির আয়োজন করা হয়।

আদালতের এজলাসের মতোই লাল সালু কাপড়ে আচ্ছাদিত বিচারকদের মঞ্চ, সাক্ষীদের কাঠগড়া, বিচারমঞ্চের উভয় পাশে বাদী ও বিবাদীপক্ষের আসন এবং সামনে দর্শকদের আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বাদীপক্ষ উপস্থিত থাকলেও বিবাদীপক্ষে কেউ ছিলেন না। তাঁদের আসনগুলো খালিই ছিল। বিবাদীরা হলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিব, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, সড়ক পরিবহন সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সেতু বিভাগের নির্বাহী পরিচালক (সচিব), পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্প পরিচালক।

বিচার কার্যক্রমের শুরুতে বাদীপক্ষের প্রসিকিউটরের ভূমিকা পালনকারী গাছরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আমিরুল রাজিব আদালতকে জানান, বিবাদীপক্ষকে রেজিস্ট্রি ডাক, ই-মেইলে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গণশুনানিতে হাজির থাকার জন্য জানানো হলেও তাঁরা জনগণের পক্ষের এই আবেদনে সাড়া দেননি; উপেক্ষা করেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় জনগণের প্রতি তাঁদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই।

আমিরুল রাজিব জানান, গাছরক্ষা আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দল বা কোনো বেসরকারি সংস্থা নয়। প্রাণ পরিবেশ প্রকৃতি ও অধিকার আদায় নিয়ে যারা কাজ করে, তাদের একটি সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম। গত ১৬৮ দিন থেকে তাঁরা পান্থকুঞ্জে অবৈধভাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‌্যাম্প নির্মাণ বন্ধের দাবিতে আন্দোলন করছেন। এখানে প্রায় দুই হাজার গাছ কাটা হয়েছে। বহু পাখি, পতঙ্গের আবাস ধ্বংস হয়েছে। আশপাশের এলাকা মানুষের এই মিলনস্থল, প্রাতর্ভ্রমণের জায়গাটি বিনষ্ট করা হচ্ছে।

গাছরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক বলেন, সুস্পষ্টভাবে সংবিধান, আইন ও আদালতের নির্দেশ অমান্য করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সুবিধার জন্য বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলের এই জনবিরোধী প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই দুর্নীতিদুষ্ট জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প বাতিলের জন্য প্রায় ৬ মাসে ৪০টির বেশি সংবাদ সম্মেলন, সেমিনার, সাংস্কৃতিক সমাবেশ, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। সেখানে দেশের অগ্রগণ্য শিক্ষাবিদ, প্রাণ পরিবেশ প্রকৃতিবিশেষজ্ঞ, অধিকারকর্মী, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ অংশ নিয়েছেন। কিন্তু এই সরকার কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করছে না। এ কারণে এই গণশুনানির আয়োজন করা হয়েছে।

সহকারী প্রসিকিউটরের ভূমিকায় গাছরক্ষা আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক নাঈম উল হাসান আদালতের সামনে ছয়টি অভিযোগ তুলে ধরেন। এগুলো হলো অর্থনৈতিক অনিয়ম ও দুর্নীতি; সংবিধান, আইন ও আদালতের আদেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন; পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া প্রকল্পের কাজ করা; বৈষম্যমূলক চুক্তির মাধ্যমে জনগণের ওপরে জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প চাপিয়ে দেওয়া; প্রকল্প কাজের সময় দেশের নাগরিকের মৃত্যুর পরে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দায়মুক্তি দেওয়া; প্রকল্পের অজুহাতে হাতিরঝিল ভরাট এবং পান্থকুঞ্জের দুই হাজারের বেশি গাছ কাটা ও পাখি–পতঙ্গের বাসস্থান ধ্বংস করা।

এই অভিযোগ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য–উপাত্ত এবং নানা অসুবিধার কথা তুলে ধরে কাঠগড়ায় এসে শপথ নিয়ে সাক্ষ্য দেন নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহম্মদ খান, লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ, তেঁতুলতলা মাঠরক্ষা আন্দোলনের সংগঠক ও পরিবেশকর্মী সৈয়দা রত্না, পান্থকুঞ্জ প্রভাতি সংঘের সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন, শিল্পী সৈয়দ মোহাম্মদ জাকির।

এজলাসে পাঁচ সদস্যের বিচারকমণ্ডলীর প্রধান ছিলেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য গীতি আরা নাসরিন। অন্য সদস্যরা হলেন সর্বজনকথা সম্পাদক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান, প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা মঞ্চের আহ্বায়ক জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এবং জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সামসি আরা জামান।

বিচারকমণ্ডলীর প্রধান গীতি আরা নাসরিন জানতে চান বিবাদীপক্ষের কেউ উপস্থিত আছেন কি না এবং তাঁদের কোনো বক্তব্য আছে কি না। তাঁকে জানানো হয়, বিভিন্ন মাধ্যমে গণশুনানিতে হাজির থাকার জন্য অনুরোধ করা হলেও বিবাদীদের কেউ উপস্থিত হননি। এরপর বিচারকেরা রায়ের একেকটি অংশ ঘোষণা করেন।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, আদালত মনে করে, ভবিষ্যতে এ ধরনের জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প গ্রহণ থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। গোপনীয়তার অজুহাতে প্রকল্পের চুক্তি ও অন্যান্য জনগুরুত্বপূর্ণ তথ্য জনসমক্ষে না প্রকাশ করার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। এই গোপনীয়তার ফলে মেগা প্রকল্পেই দুর্নীতি হয়েছে। এই আদালত ভবিষ্যতের সব প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য তথ্যের অবাধ সরবরাহ নিশ্চিতের আদেশ প্রদান করছে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্পে যেসব দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা আজকের শুনানিতে প্রমাণিত হয়েছে, সে বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করছে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পরিবেশ ছাড়পত্রের শর্ত ভঙ্গ করে পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিল জলাধারে নির্মাণকাজ চালানো হয়েছে। এ জন্য পুনরায় ছাড়পত্র প্রদান কিংবা নবায়নের ক্ষেত্রে জনগণের ক্ষতিপূরণ আদায়সহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হলো। তা ছাড়া পান্থকুঞ্জ উদ্যানের দুই হাজার গাছ কেটে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটানোর কারণে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জনসমক্ষে প্রকাশ করার জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হলো।

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, আজকের আদালত বিবাদীপক্ষের এহেন আইন অমান্য করার প্রবণতার কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং তীব্র তিরস্কার করছে।

সামসি আরা জামান প্রকল্প চলাকালে দেশের নাগরিকের মৃত্যু সম্পর্কে বলেন, বিদ্যমান ফৌজদারি আইনেই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব ছিল। আদালত সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে অবহেলাজনিত হত্যার কারণে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনে যেহেতু শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, সেহেতু উক্ত আইনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আইজিপি (পুলিশ মহাপরিদর্শক) ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ প্রদান করছে।

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে প্রধান বিচারক গীতি আরা নাসরিন বলেন, বাদীপক্ষ ১২টি সংযুক্তির মাধ্যমে তাদের অভিযোগের প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছে। বৈষম্যমূলক চুক্তি এবং জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প দেশের জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে আদালত সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার্থে বৈষম্যমূলক চুক্তি করে এই জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বৈষম্যমূলক ও জনস্বার্থবিরোধী এই প্রকল্প ও চুক্তির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদালত নির্দেশ প্রদান করছেন।

রায়ে প্রধান বিচারক পান্থকুঞ্জ সবার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত ও গাছরক্ষা আন্দোলনের অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রকল্পের কাজ স্থগিত ঘোষণা করে রায় দেন।

গণশুনানিতে পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন মুরশিদ, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন হক। তবে তাঁরা কোনো মন্তব্য করেনি। অন্যদের মধ্যে শিক্ষাবিদ, প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ ও অধিকারকর্মী শিল্পী-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীসহ সর্বস্তরের জনসাধারণ উপস্থিত ছিলেন।

গাছরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আমিরুল রাজিব ও গবেষক পাভেল পার্থ প্রথম আলোকে বলেন, এই রায়কে তাঁরা স্বাগত জানান। রায় তাঁরা বিবাদীপক্ষের সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছে দেবেন। তাঁরা আশা করছেন, গাছরক্ষা আন্দোলন যেমন গণ আদালতের রায়কে সম্মান জানিয়ে মেনে নিয়েছে, তেমনি বিবাদীপক্ষও রায়ের সুপারিশ ও নির্দেশনা মেনে নেবেন।

আরও পড়ুনসরকারকে জনগণের মুখোমুখি করতে গণশুনানির সিদ্ধান্ত২১ মে ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অবস থ ন কর প রকল প র গণশ ন ন র সমন বয়ক র র জন য ব যবস থ উপস থ ত উপদ ষ ট জনগণ র প রক ত ব চ রক সরক র গ রহণ

এছাড়াও পড়ুন:

‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’—এটা কোন ঘরানার গান

ইদানীং কিছু ভদ্রলোক ইনিয়ে-বিনিয়ে, এমনকি সুযোগ বুঝে সরাসরিও বলে ফেলছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ের চেয়ে শেখ হাসিনার শাসনেই দেশ ভালো চলছিল। দু–একজন এ-ও বলছেন, গত ৪০ বছরে এখনকার মতো খারাপ অবস্থা নাকি তাঁরা দেখেননি।

এই ‘মহামানবদের’ কথা মান্য করলে প্রশ্ন এসেই যায়, কী লাভ হলো গণ–অভ্যুত্থান করে, এত জীবন বিসর্জন দিয়ে, এত রক্ত ঝরিয়ে?

আওয়ামী লীগের শত্রুরা উত্তর দিক: সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে হাসিনা পতনের এক দফা দাবিতে রূপান্তরের কী প্রয়োজন ছিল? গণবিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেড় দশকে গড়ে ওঠা এক শক্তিশালী ব্যবস্থাকে ভেঙে খান খান করে ফেলার কী এমন প্রয়োজন ছিল?

হাসিনা-পরবর্তী এই ‘ভগ্ন হৃদয়ের’ যুগে ভারতীয় শিল্পী কবির সুমনের সে গানটি ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই...শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই’ শুনি আর ভাবি, ২০২৪-এর ‘ডামি’ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনাকে আজীবন ক্ষমতায় দেখতে চাওয়া অলিগার্কদের কী যে আকুতি ছিল!

মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে নেত্রীর পতন দেখে হয়তো সেদিন তাঁরা শুনেছেন কিংবা গেয়েছেন অন্য কোনো গান। হতে পারে আরেক ভারতীয় শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার গাওয়া সেই গান তাঁরা গেয়েছিলেন, ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে...আমার বলার কিছু ছিল না।’

আক্ষেপ কেন, কমরেড, জীবন নিয়ে পালিয়ে তো তিনি নিরাপদেই আছেন দিল্লিতে!

তবু ‘সে কি ভোলা যায়, তুমি আমারই ছিলে’ হে বাংলাদেশ সাম্রাজ্য! সত্যিই তো তাঁর এবং তাঁদের একচেটিয়া অধিকার ছিল যেভাবে খুশি যত বেশি ক্ষমতা, অর্থ, প্রতিপত্তি ভোগের।

একটি অভিজাত গোষ্ঠীকে (অলিগার্কি) হাসিনা-প্রদত্ত সেই লাভজনক স্থিতাবস্থা হারিয়ে কীভাবে চুপ করে বসে থাকবে এর ‘ভাগ্যবান’ সদস্যরা! নতুন রাজনৈতিক বিনিয়োগও কিছু দরকার হবে যদি ভবিষ্যৎ মুনাফার আশা করতে হয়।

টাকাওয়ালাদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, বিনা ভোটে বা জালিয়াতির মাধ্যমে সংসদ সদস্য পদ বা মন্ত্রিত্ব উপহার, তাঁর চামচাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পদোন্নতি এবং দলীয় অনুগতদের মিডিয়ার লাইসেন্স প্রদানসহ কত ধরনের দান-দক্ষিণার ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন ‘ষোলো কোটি মানুষকে খাওয়ানোর’ দাবিদার বর্তমানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগপ্রধান হাসিনার সরকার।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা সেতু থেকে গভীর সমুদ্রবন্দর, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টোল রোড, ডজন ডজন নতুন ব্যাংক থেকে শত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি—এ রকম বড় বড় ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণে তাঁর কোনো তুলনাই হয় না।

একটু–আধটু দুর্নীতি হলেও অন্তত মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন তো দেখাচ্ছিলেন তাঁর সভাসদরা। এই ধরুন, লাখো কোটি টাকার ব্যাংকঋণ জালিয়াতি, খেলাপি, দলীয় নেতা মাস্তানদের হাজার হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি ও সম্পদ লুণ্ঠন, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার ইত্যাদি বিষয় দেড় দশকের স্থিতিশীলতার তুলনায় এমনকি বাড়াবাড়ি!

যাদের ‘এতিম’ করে রেখে উনি চলে গেলেন, তাদের কারও কারও বক্রোক্তি এ রকম: এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পর বহুত শখ করে তো ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে; তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? নির্বাচন, সংস্কার, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, অর্থনীতি জোরদার—কোনটি পেরেছে?

জনগণকে কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন জনদরদি হাসিনা সরকার। ২০১৪ সালের ১৫৪ সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত, ২০১৮ সালে নৈশকালীন ভোট এবং ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচন করে হাসিনা তাঁর বাবা শেখ মুজিবের তৈরি একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থার নতুন মডেল দাঁড় করান পৃথিবীর সামনে।

যাঁরা এই আওয়ামী শাসনের ‘স্থিতিশীলতা’ নস্যাৎ করতে চেয়েছে তাদের ‘ঠ্যাং ভেঙে’ দিতে একটুও দ্বিধা করেনি হাসিনা সরকার। সরকারের ধারাবাহিকতা নষ্টের চেষ্টাকারীদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়া হয়েছে গুম, খুন, সহিংসতা, জঙ্গিনাটক, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, প্রতিবাদ দমন ও বাক্‌স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে। সে জন্য আপনারা তাঁকে ফ্যাসিবাদী বলার সাহসও পাননি তখন।

জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে হাজারো তরুণ ও সাধারণ মানুষ নিহত (শহীদ) হওয়ার দায় নিতে চাননি হাসিনা। উল্টো তাঁর দাবি, ৫ আগস্ট তাঁকে মারতেই লক্ষ জনতা গণভবন অভিমুখে যাত্রা করেছিল।

আরও পড়ুন‘আমি কী অপরাধ করেছি’— সবাই জানেন শিরোনামটা...৩০ জুলাই ২০২৫

আরও রক্তপাত এড়াতেই নাকি তাঁর নিজের লোকদের মায়া ছেড়ে ‘একলা চলো’ নীতি অবলম্বন করে ভারতে পাড়ি জমান শেখ হাসিনা।

তাই আজ তাঁর ফেরার অপার ইচ্ছা যেন স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি গানের মতোই, ‘তোমাদের পাশে এসে বিপদের সাথি হতে আজকের চেষ্টা আমার।’

যাদের ‘এতিম’ করে রেখে উনি চলে গেলেন, তাদের কারও কারও বক্রোক্তি এ রকম: এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পর বহুত শখ করে তো ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে; তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? নির্বাচন, সংস্কার, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, অর্থনীতি জোরদার—কোনটি পেরেছে?

যেন এত সব বিষয় নিয়ে জনমনে কোনো ক্ষোভই ছিল না হাসিনার আমলে। এটি সেই বিস্মৃত অতীত, যেটি নিয়ে কল্পিত সংগীত রচিত হয়: ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’।

আরও পড়ুনশেখ হাসিনা স্বৈরশাসকদের টিকে থাকার দুটি মূলমন্ত্রেই ব্যর্থ২২ আগস্ট ২০২৪

তার মানে, তাঁর শাসনকালই জাতির জন্য ছিল আদর্শ। এটা প্রমাণ করার এক অদৃশ্য প্রচেষ্টা রয়েছে আজ এখানে, আমাদের চারপাশে, আশপাশে।

সত্য, মিথ্যা মিশিয়ে এমন দাবি করেন কারা এবং কেন—সেটা আমাদের একটু বোঝা দরকার।

হাসিনার চামচা ও সুবিধাভোগী, তাঁর ঘরানার অসৎ বুদ্ধিজীবী, তাঁর হত্যাকাণ্ড ও দুর্নীতি নিয়ে নির্বিকার নেতা-কর্মী-সমর্থক, বর্তমান আমলে বিশেষ কিছু না পেয়ে প্রবলভাবে হতাশ কতিপয় সুশীল অথবা পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্বোধ ব্যক্তির পক্ষেই ফ্যাসিবাদী শাসনামলকে উত্তম বলা সম্ভব।

এতে হাসিনার লোকদের বড় লাভ হতে পারে দায় স্বীকার না করে বা ক্ষমা না চেয়েই তাঁদের হাত ও নামসমূহকে দুর্নীতি, হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের রক্তের দাগ থেকে মুক্ত করা।

এ প্রচেষ্টা ঘটে যাওয়া সত্যকে অস্বীকার, শহীদদের আত্মত্যাগ অগ্রাহ্য, আহত ব্যক্তিদের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং মজলুমদের অনুভূতির সঙ্গে মশকরা ছাড়া আর কিছুই না।

এগুলোই আবার জুলাই বিপ্লবের পক্ষের শক্তির বয়ান তৈরিতে ব্যর্থতা প্রমাণ করে।

আরও পড়ুনহাসিনা শাসনের উন্নয়নের বানোয়াট গল্প০৩ অক্টোবর ২০২৪

পরিবর্তনের পক্ষে জনগণের প্রবল আকাঙ্ক্ষার কোনো কমতি ছিল না এবং হত্যা-দুর্নীতিসহ ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের বিচার এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের লক্ষ্যে কমবেশি সংস্কারের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক চিন্তা, গণতান্ত্রিক ভাবনা, কিংবা আমলাতান্ত্রিক কর্মসূচিকে জনমত তৈরির জন্য সেভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। একটা একটা করে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার উত্তম বিকল্প জনগণের সামনে আনলে গণমানুষকে নতুন ধারণা ও আশাবাদ উপহার দেওয়া যেত।

কয়েকটি মডেল নির্বাচন দিয়ে, তরুণদের পরিবেশ রক্ষার মতো সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে, রাজনৈতিক দলসমূহকে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি প্রতিরোধে অংশীদার বানিয়ে এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ঠিকঠাক করে, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করে হাসিনার কুশাসনকে যথাযথভাবে চিত্রিত করা যেত।

ধারণা করি, জনগণের সঙ্গে যোগাযোগে ঘাটতি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগগুলো সম্পর্কে জনসম্পৃক্ততার অভাব হাসিনার উপকারভোগীদের নিজস্ব গান গাওয়ার পরিসর দিয়েছে।

ফ্যাসিবাদী শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট রাজনৈতিক দল এবং ২০২৪-এর আন্দোলনে পুরোভাগে থাকা ছাত্র ও অন্য শক্তিগুলো পরস্পরের মধ্যে লজ্জাজনক কুতর্কে জড়িয়ে পড়ায় গণ–অভ্যুত্থান ও পরিবর্তনের এজেন্ডা এবং উপযোগী বয়ান যথেষ্ট মার খেয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে জনগণও কিছুটা বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়েছে।

বাংলাদেশিদের বর্তমান হতাশা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়াটাই কাম্য ছিল পরাজিত শক্তির। হাসিনা বিহনে আওয়ামী উপকারভোগী বা অন্ধ সমর্থকেরা গোপালগঞ্জ বা অন্য কোনো অঞ্চলে নিরালায় বসে যেন গুনগুন করে গাইছে গগন হরকরার গান, ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে...।’ তারা বুঝতে পারছে না জাতির জীবনে শেখ হাসিনা এমন এক জুলুমশাহি শাসকের নাম ও ফ্যাসিবাদের প্রতিমূর্তি; যার শাসন পুরো দেশকে বানিয়ে ফেলেছিল ‘জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ’।

নিজেদের বাইরে জনগণের অন্য যেকোনো গোষ্ঠীকে ক্ষমতার ভাগ দিতে না চাওয়া সেই ফ্যাসিবাদী ধারায় ছেদ টেনেছে জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের সরকার গঠন, যেটিও আশা করি বাংলাদেশের শেষ সরকার নয়।

বিদায় নেওয়া ফ্যাসিবাদ রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে যেকোনো দেশেই অনেকটা পুরোনো দিনের গান। এই গান অবশ্যই স্মৃতিজাগানিয়া কিন্তু চলমান বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। ভবিষ্যতে আবারও ফ্যাসিবাদকে সহ্য করবে, এমন প্রজন্ম এ দেশে সেকেলে এবং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। তরুণেরা এবং অভিজ্ঞ বিবেকবানেরা এখন অজানা এক নতুন বাংলাদেশের অপেক্ষায়।

ফলে ‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’ গান বাদ দিয়ে হাসিনার মানসপুত্রদের এখন নিরালা নিঝুম ও যথাযথ ভাবগম্ভীর পরিবেশে বসে মুদ্রিতনেত্রে মন্দ্রসপ্তক কণ্ঠে ভক্তিভরে গাওয়া উচিত, ‘মা, আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা... ।’

খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদে আমাদের যে সম্মতি সেটি আইনের ঊর্ধ্বে: সালাহউদ্দিন
  • সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ ও মাদকমুক্ত বন্দর গড়তে চাই : সাখাওয়াত
  • বিএনপির ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রূপগঞ্জে লিফলেট বিতরণ 
  • জুলাই আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়াবেন না: টুকু
  • সবাই অপেক্ষা করছে একটা নির্বাচনের জন্য
  • ‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’—এটা কোন ঘরানার গান
  • সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে দেশে ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে: তারেক রহমান
  • সরকারের একটি অংশ অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে: তারেক রহমান
  • ট্রাম্পের প্রতি মার্কিন জনগণের সমর্থন ৪০ শতাংশে ঠেকেছে
  • জাতিসংঘে সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশ-পাকিস্তান বৈঠক, ফিলিস্তিন ইস্যুতে উদ্বেগ