আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে দেশের লাখো মানুষের স্বজনের কাছে ফেরার যাত্রা স্বস্তিদায়ক ও নিরাপদ করতে সরকার নিয়েছে একাধিক সমন্বিত উদ্যোগ। যানজট, অতিরিক্ত ভাড়া, ফিটনেসবিহীন যান চলাচল, অবৈধ পশুর হাট দীর্ঘদিনের এসব সমস্যা মোকাবিলায় এবার পরিকল্পনা যেমন বিস্তৃত, তেমনি নজরদারিও হচ্ছে জোরদার।

ছয় দিন বন্ধ থাকবে পণ্যবাহী যান

ঈদের চাপ সামাল দিতে ৪, ৫, ৬ জুন এবং ১২, ১৩, ১৪ জুন এই ছয় দিন প্রধান মহাসড়কে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও লরি চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে গরুবাহী ও জরুরি পণ্য পরিবহনের যানবাহন এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে।

রেলপথ ও সড়ক পরিবহনবিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘‘জনগণ যেন নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরতে পারে, সেই লক্ষ্যেই এসব ব্যবস্থা। বিআরটিএ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মোবাইল কোর্ট মাঠে থাকবে কার্যকর তদারকিতে।’’ 

১৫৫টি যানজটপ্রবণ পয়েন্টে বাড়তি নজরদারি

বিভিন্ন মহাসড়কে যানজট এড়াতে চিহ্নিত করা হয়েছে ১৫৫টি যানজটপ্রবণ এলাকা। এর মধ্যে
ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ৪৮টি, ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কে ৫২টি, ঢাকা-পাটুরিয়া-আরিচা রুটে ৮টি, ঢাকা-ময়মনসিংহে ৬টি, ঢাকা-সিলেটে ৪১টি। 

প্রধান স্পটগুলোর মধ্যে রয়েছে : কাঁচপুর, চন্দ্রা মোড়, বাইপাইল, হাটিকুমরুল, যমুনা সেতু, শায়েস্তাগঞ্জ ও পায়রা সেতু।

হাইওয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘‘যানজটপ্রবণ এলাকাগুলোতে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন থাকবে। ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টে প্রযুক্তি ব্যবহার ও সমন্বিত টিম মাঠে কাজ করবে। গরুবাহী ট্রাক যেন নির্দিষ্ট জায়গায় পার্ক হয়, সেটিও নিশ্চিত করা হবে।’’ 

বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি (ট্রাফিক) মো.

দেলোয়ার হোসেন মিঞা বলেন,   ‘‘যানজটপ্রবণ পয়েন্টগুলোতে অতিরিক্ত ট্রাফিক পুলিশ, ওয়ার্ডেন ও স্বেচ্ছাসেবক মোতায়েন থাকবে। কোরবানির পশুবাহী ট্রাক যাতে নির্দিষ্ট স্থানে পার্ক করে এবং মূল সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে, তা নিশ্চিত করা হবে। একই সঙ্গে মুভমেন্ট কন্ট্রোল, সিগন্যাল সমন্বয় ও দ্রুত সমস্যা সমাধানে মনিটরিং টিম কাজ করবে।’’ 

মোবাইল কোর্ট ও ভাড়া নিয়ন্ত্রণে কঠোরতা

ঢাকার গাবতলী, মহাখালী, সায়েদাবাদ ও ফুলবাড়িয়া টার্মিনালসহ দেশের প্রধান বাসস্ট্যান্ডগুলোতে মোবাইল কোর্ট মোতায়েন থাকবে। অতিরিক্ত ভাড়া, চাঁদাবাজি ও রুট পারমিট ছাড়া চলাচল করা যানবাহনের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

টিটিপাড়া আন্ডারপাস খুলছে ঈদের আগেই

রাজধানীর যানজট নিরসনে একটি বড় অগ্রগতি হচ্ছে টিটিপাড়া আন্ডারপাসের উদ্বোধন। ঈদের আগেই এটি খুলে দেওয়া হবে। গত ৩০মে’র পর শহরের সব খোঁড়াখুঁড়ির কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

কোরবানির হাটে শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ

মহাসড়কের পাশ ঘেঁষে গড়ে ওঠা অস্থায়ী পশুর হাট যানজটের অন্যতম উৎস। এবারের ঈদে মহাসড়ক লাগোয়া ২১৭টি অস্থায়ী পশুর হাট বসবে, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রামে ৩০টি।

প্রশাসনের নির্দেশনায় বলা হয়েছে হাট প্রবেশপথ যেন মূল সড়কের বিপরীতে থাকে এবং গরুবাহী ট্রাকগুলো যেন বাম পাশে নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়ায়। স্থানীয় পুলিশ ও সিটি করপোরেশন টিমকে এসব নিয়ম বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা নিতে বলা হয়েছে।

টোল আদায়ে ইটিসি 

পদ্মা, যমুনা, কর্ণফুলী, মেঘনা ও গোমতীসহ দেশের প্রধান সেতুগুলোতে ইলেকট্রনিক টোল কালেকশন (ইটিসি) বুথ চালু থাকবে ২৪ ঘণ্টা। এতে টোল আদায়ে সময় সাশ্রয় হবে এবং সেতুর মুখে যানজট কমবে বলে আশা করছে সড়ক বিভাগ।

মহাসড়কে তিন চাকার যানকে নিষিদ্ধ

ঈদযাত্রায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মহাসড়কে ইজিবাইক, নসিমন, করিমনসহ তিন চাকার যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা অস্থায়ী দোকান ও হাট দ্রুত সরিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে বলা হয়েছে।

সড়ক সংস্কার ও গতি নিয়ন্ত্রণ

গত ৩০ মে জাতীয় ও সিটি সড়কের সংস্কারকাজ শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে ‘মোটরযান গতিসীমা নির্দেশিকা ২০২৪’, যা দুর্ঘটনা হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলকার বাসিন্দা আজাদুর রহমান বলেন, ‘‘গত কয়েক বছরে ঈদের সময় রাস্তায় আটকে থেকে নাকাল হয়েছি। তবে এবার প্রস্তুতির পরিধি দেখে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি।’’ 

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু পরিকল্পনা নয়, এর কার্যকর বাস্তবায়ন ও সময়োপযোগী সমন্বয়ই এবারের ঈদযাত্রাকে সত্যিকার অর্থে স্বস্তিদায়ক করতে পারে।

ঢাকা/টিপু

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর সমন ব য নজট

এছাড়াও পড়ুন:

এই অদম্য মেয়েদের আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না

অবহেলিত মেয়েরা কঠিন একটি কাজ সম্পন্ন করেছেন। অনেকের কাছে এখনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। অসাধ্য এক অর্জনকে বাস্তবের জমিনে নামিয়ে এনেছেন আমাদের বাঘিনীরা। সাফ পর্যায় জয় করে নারীদের ফুটবলকে এশীয় পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। বিশ্বকাপও খেলে ফিরতে পারেন এই অদম্য বাঘিনীরা।

এখন বলাই যায়, নারী ফুটবলের বিশ্ব পর্যায়ে কড়া নাড়ছেন আমাদের মেয়েরা। ফুটবলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁরা। শুধু ফুটবলই নয়, আমাদের নারী জাগরণের নতুন দিশা হতে পারে মেয়েদের এই সাফল্য। এই মেয়েরা সারা দেশের মেয়েদের জন্য উদাহরণ। নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়নের নতুন দিনের আলোকবর্তিকা আমাদের নারী ফুটবল দল।

ফুটবলে মেয়েদের এই সাফল্যের পেছনে আছে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। সফলতা খুব সহজে আসেনি। নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে কঠিন এক সংগ্রামের ফসল মেয়েদের আজকের এই অর্জন। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত পল্লি থেকে কোহাটি কিষ্ক, কলসিন্দুরের মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার, তহুরা খাতুন, সানজিদা আক্তার বা রাঙামাটির দুর্গম গ্রাম মগছড়ি থেকে ঋতুপর্ণা চাকমাদের আজকের এই পর্যায়ে আসার ইতিহাসটা আমরা কমবেশি সবাই জানি।

এই পথচলায় সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল। ছিল আর্থিক টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা। জীবনের এমন কোনো সংকট নেই, যা তাঁদের সামনে আসেনি। কিন্তু হিমালয়সম সেই বাধাকে সাহসিকতার সঙ্গে পেছনে ঠেলে আজকে তাঁরা এশীয় পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করেছেন।

তাঁদের অর্জনের তুলনায় রাষ্ট্র দিতে পেরেছে খুবই কম। বলতে গেলে, তাঁরা পেটেভাতে দেশের জন্য খেলে দিচ্ছেন। যেন খেলার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চলছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আদলে। যৎসামান্য যে বেতন দেওয়া হয়, সেটাও অনিয়মিত। যেকোনো সাফল্যের পর যখন মেয়েদের কাছে শুনতে চাওয়া হয়, ‘আপনারা কী চান?’ উত্তরে মেয়েরা জানান, ‘নিয়মিত বেতনটা চাই। আর বেতনটা বাড়ালে আরও ভালো হয়।’ ২০২৫ সালে এসে এটা মেনে নেওয়া কঠিন।

দেশে মেয়েদের নিয়মিত লিগ হয় না। অন্য কোনো টুর্নামেন্টও হয় না নিয়মিত। নিয়মিত খেলার জন্য আমাদের মেয়েদের ভুটান লিগে খেলতে যেতে হয়। কেবল আবাসিক ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ ও কিছু প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলেই মেয়েদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক খেলায় নামতে হয়। সেই সব খেলায় তাঁরা নিয়মিত লিগ খেলা দলগুলোকে বলে-কয়ে হারাচ্ছে।

আমাদের খেলাধুলাকে রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। শুধু নারী ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে তৃণমূল থেকে। তবেই নতুন নতুন প্রতিভাবান খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে। ঢাকাকেন্দ্রিক খেলার কুফল কী হতে পারে, তার বড় উদাহরণ আমাদের ছেলেদের ফুটবল। সারা দেশে নিয়মিত প্রতিযোগিতামূলক লিগ না হওয়ার কারণে নতুন নতুন ফুটবলার বেরিয়ে আসছেন না।

কী পরিমাণ প্রতিভার অধিকারী হলে ন্যূনতম সুবিধা না পেয়েও এ পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করা যায়, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। ভারত ও নেপালে নিয়মিত মেয়েদের খেলা হয়, লিগ হয়। আর আমরা তাদের এখন নিয়মিতই হারাই। এখন সাফের বাইরের দলগুলোকেও আমরা হারাতে শুরু করেছি।

এই মেয়েদের প্রচেষ্টা ও সাহস নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড রকম ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে তাঁরা খেলতে নামেন। ভয়হীন ফুটবল খেলেন। সব থেকে বড় কথা, খেলার যেকোনো ধরনের ট্যাকটিকসের সঙ্গেই তাঁরা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন। আগে আমাদের মেয়েরা কিছুটা রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতেন। রক্ষণ সামলে প্রতি-আক্রমণে যেতেন। এবার এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে মেয়েরা পুরো খেলার ধরন বদলে ফেলেছেন।

আমাদের মেয়েরা এবার হাই প্রেসিং ফুটবল খেলেছেন। এই দল আগের থেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন ফুটবল খেলে। বল পায়ে রাখতে পারে। তাদের বল ডিস্ট্রিবিউশন আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। পাসিংও ভালো। পজিশন সেন্স চমৎকার। বিশেষ করে বল হারালে দ্রুত নিজেরা অবস্থান নিতে পারে।

এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে হাই লাইন ডিফেন্স করে গেছে দুর্দান্তভাবে। আর বাহরাইনের সঙ্গে শামসুন্নাহার জুনিয়র যেভাবে গতি সঞ্চার করে ডিফেন্স থেকে বেরিয়ে ওয়ান টু ওয়ানে গোলরক্ষককে পরাজিত করলেন ঠান্ডা মাথায়, তা আমাদের পুরুষ দলের স্ট্রাইকার বা উইঙ্গাররাও করতে পারেন না। নিয়মিত খেলার মধ্যে না থাকা একটি দলের কাছে এর বেশি আশা করা উচিত নয়। কিন্তু তাঁরা আমাদের সেই আশাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁরা পরিস্থিতি বুঝে মাঠে খেলাটা তৈরি করতে পারেন।

মেয়েদের এই লড়াইকে ধরে রাখতে হবে। তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সিরাত জাহান স্বপ্না বা আঁখি খাতুনের মতো খেলোয়াড়দের আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে ফুটবল থেকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক লিগ নিয়মিত আয়োজন করতে হবে। এর পাশাপাশি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে লিগের আয়োজন করতে হবে।

‘সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই মেয়েরা আমাদের ফুটবল নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ