আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উচ্চারিত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূলনীতি ‘জনগণকে একটি নিয়মতান্ত্রিক ও ন্যায়ানুগ সরকার প্রদান’ করা। এই নিয়মতান্ত্রিক ও ন্যায়ানুগ শাসন হিসেবে গণতন্ত্রকেই গ্রহণ করেছিলাম আমরা। মোটের ওপর চলনসই একটি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাও করা গিয়েছিল, কিন্তু সেটা স্থায়ী ও নিরবচ্ছিন্ন করা যায়নি।

 প্রায়ই হোঁচট খেয়েছে, নানা রকমের অগণতান্ত্রিক শাসন এসে জুড়ে বসেছে, জনগণকে বারবারই রাজপথে নেমে এসে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে হয়েছে। এসব প্রক্রিয়ায় প্রায়ই বিচার বিভাগকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক—দুই রকম ভূমিকাই পালন করতে দেখা গেছে। এর মধ্যে ২০০৬-২৪ পর্যন্ত অবিমিশ্র তিক্ত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, এমনটাই অভিমত ওয়াকিবহাল মহলের। 

এমন মিশ্র অভিজ্ঞতার আলোকে দেশে একটি কার্যক্ষম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও তা অব্যাহত রাখার জন্য বিচার বিভাগের পৃথক্‌করণ ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য, এমন একটি নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো, নাগরিক সমাজ ও সরকার—সবাইকেই একমত হতে দেখা গেছে। এ জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা জরুরি, এ বিষয়েও অন্তত প্রকাশ্যে কারও দ্বিমত আছে বলেও মনে হয় না। 

একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করলেই পৃথক্‌করণ বা স্বাধীনতা সম্পন্ন হয়ে যাবে, তেমনটা নয়। আরও বেশ কিছু অত্যাবশ্যক অনুষঙ্গও যুক্ত আছে এর সঙ্গে।

পাকিস্তান আমলে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের দ্বারা ব্যাপকভাবে হেনস্তা হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে রাজনীতিবিদেরা বিচার বিভাগ পৃথক করার সদিচ্ছা পোষণ করেছিলেন। 

বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্রীকরণকে সম্পূর্ণ করার জন্য সংবিধান সংশোধন করতে আইনসভা, অর্থাৎ সংসদকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি কখনো। 

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণে বিচার বিভাগের সংস্কারকে সরকারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি হিসেবে অভিহিত করা, প্রধান বিচারপতি ড.

সৈয়দ রেফাত আহমেদ ঘোষিত রোডম্যাপ, সংবিধান ও বিচার বিভাগীয় সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশনগুলোর প্রতিবেদন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ থেকে সুস্পষ্টভাবেই এই মতৈক্যের প্রমাণ মিলবে। তারপরও আমাদের এমন একটি শতাব্দীপ্রাচীন রাজনৈতিক অঙ্গীকার ঠেকে আছে কেন বা কোথায়?

এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে। পুরো দেশ-জাতিকে ঠেকিয়ে রাখা ১১৬ অনুচ্ছেদে কী আছে? এখানে যা আছে, তার সারসংক্ষেপ হলো, অধস্তন আদালতের বিচারক ও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির হাতে থাকবে এবং তিনি সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করেই সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। শুরুতেই অবশ্য এমন বিধান ছিল না। দুই দফা বিবর্তনের ভেতর দিয়ে গিয়েই বর্তমান রূপে উপনীত হয় ১১৬ অনুচ্ছেদ।

১১৬ অনুচ্ছেদের বিবর্তন

১৯৭২ সালের সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, ‘বিচার-কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান, ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকিবে।’

চতুর্থ সংশোধনীর পর ১১৬ অনুচ্ছেদ দাঁড়ায়, ‘বিচার-কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান, ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকিবে।’ 

পঞ্চম ও ও পঞ্চদশ সংশোধনীর পর বর্তমানে ১১৬ অনুচ্ছেদ যা আছে তা হলো, ‘বিচার-কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান, ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।’

বর্তমান সংবিধান অনুসারে, প্রধান বিচারপতি ও প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতি আর কোনো কিছুই স্বাধীনভাবে করতে পারেন না। তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর বাধ্যতামূলক পরামর্শ অনুসারেই অন্য সব নির্বাহী দায়িত্ব পালন করতে হয়। ফলে বিচারকদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীই চালকের আসনে ছিলেন ও আছেন। 

সরকারের কাজগুলো কে, কীভাবে করবে, এ–সংক্রান্ত ‘রুলস অব বিজনেস’ এবং ‘অ্যালোকেশন অব বিজনেস’ অনুসারে সরকারের আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই প্রধানমন্ত্রী এই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন। মাঝখানে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে এই ক্ষমতা প্রয়োগের বিধান থাকলেও এবং মাসদার হোসেন মামলার রায়ে এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের সেই পরামর্শই প্রাধান্য পাবে বলে সাব্যস্ত হওয়ার পরও বিগত সরকারের আমলে উল্টোটাই হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করতেন।

বিচারক ও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের সরকারের হাতে ‘সোপর্দ’ করার এই কাজ সম্পন্ন হয়েছিল ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। তার আগে এই ক্ষমতা ছিল সুপ্রিম কোর্টের হাতে। এটা সত্যি যে পাকিস্তান আমলে সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের দ্বারা ব্যাপকভাবে হেনস্তা হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে এ দেশের রাজনীতিবিদেরা বিচার বিভাগ পৃথক করার সদিচ্ছা পোষণ করতেন। 

তারই প্রতিফলনে নির্মিত হয়েছিল পৃথক্‌করণের ১৯৭২–এর সাংবিধানিক কাঠামো। সেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই ১১৬ অনুচ্ছেদ দিয়েই। তাতে সাংবিধানিকভাবে নিয়ন্ত্রণের পুরো ও একচ্ছত্র কর্তৃত্ব কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের হাতে ছিল। 

আরও পড়ুনবিচার বিভাগ প্রকৃত পৃথক্‌করণের এখনই সময়০৮ নভেম্বর ২০২৪বিচার বিভাগে দ্বৈত শাসন

সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের হাতে থাকলেও, ফৌজদারি কার্যবিধিতে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বিচারিক কর্মকর্তাকে নয়; বরং নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদেরই নিয়োগ দেওয়ার বিধান বহাল রাখা হয়। এভাবে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়ে বিচার বিভাগে পরোক্ষভাবে আংশিক দ্বৈত শাসনব্যবস্থাই চালু রাখা হয়।

কিন্তু এই জোড়াতালির বন্দোবস্তও বেশি দিন সহ্য করেননি রাজনীতিবিদেরা। সব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এক বিন্দুতে ঘনীভূত করতে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ১১৬ অনুচ্ছেদে ‘সুপ্রিম কোর্ট’–এর জায়গায় ‘রাষ্ট্রপতি’ লিখে দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটদের তো বটেই, তার সঙ্গে সঙ্গে বিচারকদের নিয়ন্ত্রণও নিজের হাতে তুলে নেয় সরকার।

একটিমাত্র শব্দ বদলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বলা যায়, যবনিকাপাত ঘটে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বা পৃথক্‌করণ নিশ্চিত করার যাবতীয় রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রথম অধ্যায়ের। এভাবে পৃথক্‌করণের বদলে একীভূতকরণই হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় নীতি।

এই সংশোধনী দিয়ে কার্যত সংবিধান ‘পুনর্লিখন’ করে তার মাধ্যমে কায়েম করা একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা বেশি দিন টেকেনি। পরবর্তী আমলে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আরেক দফায় সংবিধানের পুনর্লিখন করা হয়। এই সরকারের আমলে অবশ্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার্থে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে নিয়ে দেশের শীর্ষ তিন বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ন্যস্ত করা হয়।

১১৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমেই রাষ্ট্রপতি বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ করবেন, এমন রক্ষাকবচও জুড়ে দেওয়ার কাজটি করে কিছুটা ‘ক্ষতিপূরণ’ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সংবিধানে আরও যোগ করা হয়, অধস্তন আদালতের বিচারক ও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক কাজে স্বাধীন থাকার নিশ্চয়তা দেওয়া সংবলিত ১১৬ক অনুচ্ছেদ। পঞ্চম সংশোধনীর আওতায় চতুর্থ সংশোধনীর বেশির ভাগ বাতিল হয়ে গেলেও ১১৬ অনুচ্ছেদের ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দটি কিন্তু ঠিকই টিকে যায়।

১৯৮২ সালে ঘটা এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশ প্রবেশ করে আরেক জমানায়। আশ্চর্যরকমভাবে তৎকালীন সামরিক শাসক রাষ্ট্রের বিচারিক সেবা জনগণের দোরগোড়ায় নেওয়ার নীতি নিয়েছিলেন। আঞ্চলিক পর্যায়ে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপন ও উপজেলাগুলোতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বিচার বিভাগ পৃথকীক্‌রণের উদ্যোগ নিয়ে প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনের খসড়াও প্রস্তুত করে ফেলা হয়েছিল।

কিন্তু সেগুলো আর বাস্তবায়ন করা হয়নি। তাই আগের ধারাই বহাল থাকে। পরে আদালতের রায়ে উচ্চ আদালত এবং তারও পরে নির্বাহী আদেশে অধস্তন আদালতের বিকেন্দ্রীকরণের উভয় প্রকল্পই বাতিল হয়ে যায়।

১৯৯০ সালে আরেকটি গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার কালে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তৃতীয় দফায় ঘটে সংবিধান ‘পুনর্লিখন’। রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতির বদলে দেশ প্রবেশ করে সংসদীয় পদ্ধতিতে। কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগেনি। ২০০৭–এর আগে পালাক্রমে রাজনৈতিক সরকার এল-গেল, কিন্তু বিচার বিভাগ একত্রীকরণের নীতির আর বদল হয়নি। 

এর মধ্যে মাসদার হোসেন মামলায় বিচার বিভাগের পৃথক্‌করণের সাংবিধানিক পর্যালোচনা করতে গিয়েও আদালত ‘আবিষ্কার’ করেন যে ১১৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে একটি অনতিক্রম্য দ্বৈত শাসনব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। তাই আদালত সংবিধানের অন্য বিধানাবলির চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই দ্বৈতশাসনের মধ্যেই যতটুকু পৃথক্‌করণের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, সেটুকু বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেন। 

পূর্ণাঙ্গ পৃথক্‌করণ নিশ্চিতের জন্য সংবিধান সংশোধনের জন্য আবশ্যকতা স্বীকার করা হয়েছে আদালতের ১২ দফা নির্দেশনাতেই। নির্দেশনার ১১তম দফায় বলা হয়েছে, ‘অধস্তন বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার জন্য আর কোনো সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নেই মর্মে হাইকোর্ট বিভাগের ঘোষণাটি রদ ও রহিত করা হলো। জাতীয় সংসদ চাইলে এ স্বাতন্ত্রীকরণকে আরও অর্থবহ, সুস্পষ্ট, কার্যকর ও সম্পূর্ণ করতে সংবিধান সংশোধন করতে পারেন।’ 

বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্রীকরণকে সম্পূর্ণ করার জন্য সংবিধান সংশোধন করতে আইনসভা, অর্থাৎ সংসদকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি কখনো। ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে যখন চতুর্থ দফায় সংবিধান পুনর্লিখন করতে দেখা যায়, তখনো জাতীয় সংসদ এই প্রশ্নে পঞ্চম সংশোধনীকেই বহাল রাখেন। পরিহাস হলো, আদালতের রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করার অজুহাত দেখিয়েই পঞ্চদশ সংশোধনী করা হয়েছিল।

রাজনৈতিকভাবে মীমাংসা

বিদ্যমান ১১৬ অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা অসাংবিধানিক মর্মে ঘোষণা চেয়ে দায়ের করা মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। পরবর্তী সময়ে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের মামলায় ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে কোনো আদেশ হয়নি। এ রকম অবস্থায় ১১৬ অনুচ্ছেদ ও বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাতন্ত্রীকরণের প্রশ্নে আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকতে হবে। বিচার বিভাগের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠাও দৃশ্যত এখানেই থমকে আছে। 

অবশ্য শুধু একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করলেই পৃথক্‌করণ বা স্বাধীনতা সম্পন্ন হয়ে যাবে, তেমনটা নয়। আরও বেশ কিছু অত্যাবশ্যক অনুষঙ্গও যুক্ত আছে এর সঙ্গে। যেমন আদালতে রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা কত দূর পর্যন্ত হতে পারে; উচ্চ আদালতে নিয়োগ–সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণ; অবসরের পর বিচারকদের লাভজনক সরকারি পদে নিয়োগের প্রশ্ন; স্বতন্ত্র অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা; বিচারকদের নিয়োগ, পদায়ন-কর্মকাল-পদোন্নতি-বদলি-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত নীতিমালা স্থির করা; আর্থিক স্বাধীনতা; জবাবদিহি নিশ্চিত করাসহ আরও অনেক বিষয় এর সঙ্গে জড়িত। তবে এই সবকিছুর কেন্দ্রে রয়েছে সচিবালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি।

মাসদার হোসেন মামলায় দেওয়া আদালতের নির্দেশনা অনুসারে আইনসভা বা সংসদের ক্ষমতাবলে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ভিত্তিতে ১১৬ অনুচ্ছেদের সংশোধনের দরজা সব সময়ই খোলা থাকছে। বর্তমানে ‘জাতীয় ঐকমত্য’ প্রতিষ্ঠার যে প্রক্রিয়া চলমান আছে, সেখানেও ১১৬ অনুচ্ছেদসহ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় অন্য সংস্কারগুলো সম্পর্কেও রাজনৈতিক ফয়সালা হতে পারে। রাজনৈতিক প্রশ্নের ফয়সালা রাজনৈতিকভাবে হওয়াই সর্বোত্তম, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।

মিল্লাত হোসেন সংবিধান ও আইন বিষয়ে গবেষক ও লেখক

[email protected]

*মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব চ র ব ভ গ র স ব ধ নত ব চ রকদ র ন য় র ষ ট রপত র ন শ চ ত কর গণতন ত র র জন য স র জন ত ক সরক র র র কর ম হয় ছ ল অন স র করণ র ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

বিদ্যুৎ খাতে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি হয়েছে: পর্যালোচনা কমিটি

বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির নামে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া বাবদ অর্থ নিয়েছে, যেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের চেয়ে দুর্নীতিই মুখ্য ছিল বলে অভিমত দিয়েছে সরকার গঠিত চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। তারা বলেছে, চুক্তিতে ব‍্যবসায়ীদের কোনো ঝুঁকি নেই, সব ঝুঁকি সরকারের। এটি সরকারের অদক্ষতাজনিত ব‍্যর্থতা নয়, দুর্নীতি জড়িত। তাই চুক্তি বাতিল করা সম্ভব।

বিদ্যুৎ খাতের চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির তিন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তাঁরা বলেছেন, গত সরকারের দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ, খরচ বেড়েছে ১১ গুণ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনটি করাই হয়েছে দুর্নীতির জন্য। এখানে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি হয়েছে। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলো ভাড়া আদায়ের নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে কাজ করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জ্বালানি আমদানি করেছে নিজেরা। এতেও দুর্নীতি হয়েছে।

তবে এখন এসব চুক্তি বাতিল করতে হলে অনুসন্ধান করে দুর্নীতির প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন পর্যালোচনা কমিটির সদস্যরা। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের প্রতিবেদন নিয়ে সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করতে পারে। গত সরকারের সময় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একের পর এক একতরফা চুক্তি করা হয়েছে। চুক্তিতে সব সুবিধা দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে, রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করা হয়নি। একটি চুক্তি যেন আরেকটির প্রতিলিপি। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ সংস্থাগুলো এতে জড়িত ছিল। গ্যাস পাওয়া যাবে না, চুক্তি করা হোক—এমন সুপারিশও দেখা গেছে মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে।

পর্যালোচনা কমিটির তিনজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, শুধু চুক্তি নয়, চুক্তির আগের পুরো প্রক্রিয়া যাচাই করে দেখা হয়েছে। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপের নমুনা পাওয়া গেছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সাবেক দুই বিদ্যুৎসচিব, যাঁরা পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব হয়েছিলেন; তাঁদের সংশ্লিষ্টতা আছে সংঘবদ্ধ দুর্নীতিতে। এই দুজন হলেন আবুল কালাম আজাদ ও আহমদ কায়কাউস।

# চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন
# দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ, খরচ বেড়েছে ১১ গুণ
# ব্যবসায়ী, আমলা, সরকারের শীর্ষ পর্যায় মিলে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি
# চুক্তি বাতিল সম্ভব, দুদকের তদন্ত করতে হবে
# আদানির চুক্তিতে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে

দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনটি বাতিল করা হয় গত বছরের নভেম্বরে। এর আগেই এ আইনের অধীনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে গত সরকারের করা চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আছেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সহ-উপাচার্য আবদুল হাসিব চৌধুরী, কেপিএমজি বাংলাদেশের সাবেক প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আলী আশফাক, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ফ্যাকাল্টি অব ল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের অর্থনীতির অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক।

জানুয়ারিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন

আজ রোববার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে তারা। এ ছাড়া ভারতের আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে করা চুক্তির অনিয়ম নিয়েও একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তারা। প্রতিবেদন জমার পর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে একটি সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন কমিটির সদস্যরা।

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, কারণ ছাড়া চুক্তি বাতিল করলে তার ক্ষতিপূরণের বিষয়টি চুক্তিতেই বলা আছে। তবে প্রতিটি চুক্তিতেই স্বীকারোক্তি থাকে যে এই চুক্তিতে কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়নি। এটা যদি লঙ্ঘিত হয়, তাহলে চুক্তি বাতিল করা যায়। কিন্তু মুখের কথা তো আদালত মানতে চাইবেন না, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে হবে আদালতে। কমিটির সহায়তায় চুক্তির অনিয়ম খুঁজে দেখা হচ্ছে। কারণ, খুঁজে পাওয়া গেলে চুক্তি বাতিলে দ্বিধা করা হবে না।

কমিটির আহ্বায়ক মঈনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, চুক্তি কতটা বাতিল করা যাবে, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। বিদ্যুৎ খাতের চুক্তিগুলো পুরোপুরি কারিগরি, তাই সময় লেগেছে পর্যালোচনায়। এতে ব্যাপক দুর্নীতি পাওয়া গেছে। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কমিটির সদস্য জাহিদ হোসেন বলেন, চুক্তি–সম্পর্কিত নথি দেখা হয়েছে। পিডিবি থেকে পরিশোধ করা বিলের তথ্য নেওয়া হয়েছে। এগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে, কী কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে। ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ ছিল, মন্ত্রণালয় সব সময় প্রধানমন্ত্রীর হাতে ছিল। বিদ্যুৎ খাতে যে পরিমাণ বিল পরিশোধ করা হয়েছে এবং এর বিপরীতে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে, এর হিসাব আইনস্টাইনও মেলাতে পারবেন না।

চুক্তি বাতিল করলে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য শাহদীন মালিক বলেন, যাঁরা ক্ষতিপূরণ দাবি করবেন, তাঁরা তাঁদের ক্ষতির হিসাব দেবেন। তাই ক্ষতিপূরণের বিষয়টা তো এ কমিটি বলতে পারবে না।

দুর্নীতির কারণে বেড়েছে বিদ্যুতের দাম

সংবাদ সম্মেলনে কমিটির সদস্য মোশতাক হোসেন খান বলেন, ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতির কারণে বিদ্যুতের দাম ২৫ শতাংশ বেশি হয়ে গেছে। ভর্তুকি না থাকলে ৪০ শতাংশ বেড়ে যেত। এ দামে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকতে পারবে না। এটা কমাতে হবে। যারা টাকা নিয়ে চলে গেছে, তাদের বোঝাতে হবে, তারা পার পাবে না। তাড়াতাড়ি করলে ভুল হতে পারে, তাই সময় লেগেছে। তবে রাষ্ট্রের সঙ্গে কোম্পানির চুক্তিগুলো সার্বভৌম চুক্তি। চাইলেই এটা বাতিল করা যায় না। বড় জরিমানা দিতে হতে পারে।

আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে মোশতাক হোসেন বলেন, আদানির চুক্তির অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে আদালতে রিট হয়েছে। আদালত প্রতিবেদন চেয়েছেন। মাসখানেকের মধ্যে শক্ত প্রমাণ সামনে আসবে। এসব প্রমাণ নিয়ে দেশে-বিদেশে আইনি প্রক্রিয়া নেওয়া যাবে।

পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশে মূলত ভবিষ্যতে সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যাতে এ ধরনের চুক্তি না করা হয়। চুক্তির আগে স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে যাচাই করে দেখার কথা বলা হয়েছে। পর্যালোচনা কমিটির পরামর্শে গত ২১ জানুয়ারি করা হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ (বিদ্যুতের দাম) পর্যালোচনা কমিটি। এ কমিটির কাজ চলমান।

চুক্তি অনুসারে প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে নেয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম নির্ধারণে একটি সূত্র দেওয়া আছে চুক্তিতে। এ সূত্র অনুসারে দাম নির্ধারিত হয়। একেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে একেক দাম। সমঝোতার মাধ্যমে কাউকে কাউকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। দরপত্র ছাড়া বিশেষ বিধান আইনে এভাবে চুক্তি করার সুযোগ নিয়েছে গত আওয়ামী লীগ সরকার।

বিশেষ বিধান আইনটি করা হয় ২০১০ সালে। এরপর দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। এই আইনের অধীনে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এর কারণে এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত। এ আইনের অধীনে দরপত্র ছাড়া একটার পর একটা চুক্তি করেছিল গত সরকার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ