ইসরায়েলের ‘গোপন পারমাণবিক স্থাপনায়’ হামলার হুঁশিয়ারি ইরানের
Published: 10th, June 2025 GMT
ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, যদি ইরান ভবিষ্যতে ইসরায়েলি আক্রমণের শিকার হয়, তাহলে দেশের সশস্ত্র বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে ইসরায়েলের ‘গোপন পারমাণবিক স্থাপনায়’ হামলা চালাবে।
সম্প্রতি ইসরায়েলের স্পর্শকাতর পারমাণবিক তথ্য পাওয়ার দাবি করে ইরান। এরপরপরই সোমবার (৯ জুন) দেশটির সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল (এসএনএসসি) এক বিবৃতিতে ইসরায়েলকে সতর্ক করে এমন হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
মঙ্গলবার (১০ জুন) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে চীনের বার্তা সংস্থা সিনহুয়া।
আরো পড়ুন:
গাজা অভিমুখী ‘ম্যাডলিন’ আরোহীদের অপহরণ ইসরায়েলি বাহিনীর
ইসরায়েলি হামলায় আরো ১০৮ ফিলিস্তিনি নিহত
ইরানের গোয়েন্দামন্ত্রী ইসমাইল খাতিব রবিবার (৮ জুন) দাবি করেন, ইরান গোয়েন্দা অভিযানের মাধ্যমে ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ, স্পর্শকাতর কয়েক হাজার নথি হাতে পেয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে পারমাণবিক অবকাঠামোর তথ্য ও পরিকল্পনার নথি।
ইসরায়েল দীর্ঘদিন থেকেই ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলার হুমকি দিয়ে আসছিল। আর এবার ইরান দাবি করলো, তারা ইসরায়েলের পারমাণবিক অবকাঠামোর নথি হাতে পেয়েছে।
সোমবার (৯ জুন) ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল (এসএনএসসি) জানায়, কয়েক মাসের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের ফলে ইরানের সশস্ত্র বাহিনী সম্ভাব্য প্রতিশোধমূলক হামলার জন্য ইসরায়েলি উচ্চ-মূল্যবান লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। ইসরায়েল যদি ইরানের স্বার্থের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেয়, তাহলে প্রতিশোধমূলক হামলায় ‘গোপন সামরিক স্থাপনা’ লক্ষ্যবস্তু করবে ইরান।
ইরানি গোয়েন্দারা ইসরায়েলের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে গোপন নথির বিশাল ভাণ্ডার নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হয়েছে বলে দাবি করেছে। ইরানি কর্তৃপক্ষের মতে, এই অভিযানটি এক রাতের মধ্যে সম্পন্ন হয়নি। বরং, বহুদিন আগেই নথিগুলো সংগ্রহ করা হলেও সেগুলো নিরাপদে তেহরানে পৌঁছাতে এবং কোনো তথ্য যেন ফাঁস না হয়, সেজন্য এক দীর্ঘ সময় ধরে ছিল সম্পূর্ণ নীরবতা ও সংবাদ ব্ল্যাকআউট।
ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মতে, “এটি শত্রু পক্ষের বিভ্রান্তিকর তথ্য মোকাবিলা এবং ইরানের প্রতিরোধ ক্ষমতা জোরদার করার লক্ষ্যে একটি বৃহত্তর কৌশলগত উদ্যোগের অংশ।”
কাউন্সিল বলছে, ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামোতে হামলার জবাবে তেহরানকে ‘গোপন পারমাণবিক স্থাপনায়’ দ্রুত হামলার সুবিধা দেবে।
ইসরায়েল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী বলে বিশ্বাস করা হয়। যদিও ইসরায়েল কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে এটি নিশ্চিত বা অস্বীকার করেনি, বরং কৌশলগত অস্পষ্টতার দীর্ঘস্থায়ী নীতি বজায় রেখেছে।
ঢাকা/ফিরোজ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইসর য় ল ইসর য় ল র ক উন স ল লক ষ য ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
ইমরানের পতন ও আসিম মুনিরের উত্থানে ভারতের জন্য যে বিপদ ডেকে আনছে
পাকিস্তান অদ্ভুত থমথমে অবস্থার মধ্যে আছে। ঝড় থেমে যাওয়ার পর যেমন এক ধরনের নীরবতা থাকে, কিন্তু তার মধ্যে আবার নতুন অস্থিরতার গন্ধ থাকে, পাকিস্তানে এখন সে রকম একটি পরিস্থিতি।
পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ইমরান খান এখন আদিয়ালা জেলে বন্দী। ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির পুরো ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে। শাহবাজ শরিফ নামমাত্র প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।
এ অবস্থায় একটি ব্যর্থ গণতন্ত্রের জাহাজ সামনে এগোতে চেষ্টা করছে। ভারতের জন্য (যে দেশ মাত্র কিছুদিন আগে পেহেলগামে এক মারাত্মক সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে এবং পরে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালিয়েছে) পাকিস্তানের এই অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা দূরের ঘটনা নয়। কারণ এটি দক্ষিণ এশিয়ার নড়বড়ে নিরাপত্তা ভারসাম্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে।
ইমরান খানের পতন পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নাটকীয় ঘটনা। দুর্নীতির মামলায় ইমরানের সাজা এবং তাঁর দলকে ভেঙে দেওয়ার নানা উদ্যোগ—এ সবকিছু দেশটিতে একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
তবু অদ্ভুতভাবে ইমরান এখনো পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতীক। জেলে থাকায় তাঁর জনপ্রিয়তা কমেনি; বরং তিনি এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভের প্রতীক হয়ে উঠেছেন, যেটিকে বহু মানুষ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত বলে মনে করে।
যা বোঝা যাচ্ছে, তাতে আপাতত ইমরানের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা নেই। কারণ নির্বাচনী প্রতীক হারিয়ে ইমরানের দল পিটিআই দুর্বল হয়ে পড়েছে। দলীয় কর্মীরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। সভা-সমাবেশ বন্ধ। দলটির নেতা-কর্মীদের হয় চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, নয়তো সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠদের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
ইমরানের দল পিটিআই যতই দমন-পীড়নের শিকার হোক, শহুরে তরুণ ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী; বিশেষ করে পাঞ্জাব এবং খাইবার পাখতুনখাওয়ার তরুণেরা এখনো পিটিআইকেই ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী’ শক্তি মনে করেন।
ইমরানের দলকে দমন করে রাখার পেছনে রয়েছেন পাকিস্তানের প্রথম ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ আসিম মুনির। দেশটির বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থপতি তিনিই। ইমরানের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান কঠোর। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কঠিন। পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতি—সবকিছু একাই নিয়ন্ত্রণ করেন।
পাকিস্তানে বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক আগে থেকেই সেনাবাহিনীর দিকে ঝুঁকে ছিল। মুনির সেটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকাপোক্ত করেছেন। শাহবাজ শরিফ এমন এক ম্যান্ডেটে সরকার চালাচ্ছেন যা জনগণের উচ্ছ্বাস থেকে নয়; বরং সেনাবাহিনীর কৌশলগত প্রয়োজন থেকে এসেছে। তিনি নির্বাচিত নেতার মুখোশ পরে বাস্তবে সেনাপ্রধানের নির্দেশনায় হাঁটছেন।
মুনির-শাহবাজের এই সমঝোতা কার্যকর হলেও ভেতরে-ভেতরে তা ভীষণ ভঙ্গুর। কারণ পাকিস্তানের অর্থনীতি ঋণে জর্জরিত, আইএমএফের কঠোর শর্তে নিঃশেষ, আর প্রবৃদ্ধি খুবই কম।
বাইরের দিকেও পাকিস্তানের সমস্যা বাড়ছে। আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক দ্রুত খারাপ হয়েছে। পাকিস্তানের অভিযোগ, তেহরিক-এ-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-কে তালেবান আশ্রয় দিচ্ছে। টিটিপির হামলাও বেড়েছে। জবাবে পাকিস্তান বিমান হামলা চালিয়েছে, সীমান্ত বন্ধ করেছে এবং লাখো অনথিভুক্ত আফগানকে ফেরত পাঠিয়েছে।
এদিকে ভারত কাবুলের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়িয়েছে। এটিও পাকিস্তানের জন্য এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছে।
চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপেক) এখনো পাকিস্তান-চীন সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু। তবে চীন এখন অনেক বেশি সতর্ক এবং শর্তসাপেক্ষ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র আবার পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে মূলত সন্ত্রাসবাদবিরোধী সহযোগিতা এবং কৌশলগত কারণ থেকে। ওয়াশিংটনে শাহবাজ ও মুনিরের যৌথ উপস্থিতি থেকে বোঝা যাচ্ছে, এই সম্পর্ক সহযোগিতামূলক হলেও পুরোপুরি লেনদেননির্ভর। এই পুরো ছবিতে সৌদি আরবও একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে কাজ করছে। বহু বছর ধরে সৌদি আরব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ত্রাতা হিসেবে কাজ করেছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর, অবকাঠামো, মসজিদ, মাদ্রাসা—বহু জায়গায় সৌদির অবদান আছে। এখনো তারা পাকিস্তানকে বিলম্বিত তেল মূল্য পরিশোধ সুবিধা দেয় আর রাজনৈতিক দিক থেকেও পাকিস্তানকে রক্ষা করে।
মুনির ও শাহবাজের জন্য সৌদির সমর্থন অত্যন্ত জরুরি। এটা না থাকলে আইএমএফের সঙ্গে শর্ত আরও কঠিন হতো। পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিপজ্জনকভাবে কমে যেত। কিন্তু একই সময়ে সৌদি আরবের ভারতের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা প্রমাণ করে, পাকিস্তান আর আগের মতো সহজে সৌদির বন্ধুত্বের ওপর ভরসা করতে পারে না।
এই বিস্তৃত কূটনৈতিক পরিস্থিতি সরাসরি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলছে। ভারতের কাছে পেহেলগাম হামলাটি ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ সীমা অতিক্রমের ঘটনা। এরপর পাকিস্তানভিত্তিক গোষ্ঠীর ওপর ভারতীয় হামলা, পাকিস্তানের পাল্টা আঘাত এবং তারপর যুদ্ধবিরতি—সব মিলিয়ে এক কঠিন ‘নতুন স্বাভাবিক’ তৈরি হয়েছে। এখন এই অঞ্চলে সীমিত সামরিক সংঘর্ষ, ড্রোন যুদ্ধ, ক্ষেপণাস্ত্রভিত্তিক প্রতিরোধ—সবকিছুই পারমাণবিক হুমকির ছায়ার সঙ্গে পাশাপাশি চলছে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ককে স্থিতিশীল রাখতে বহু বছর ধরে যে দুইটি বড় কূটনৈতিক চুক্তি কাজ করত তার একটি হলো সিন্ধু পানিচুক্তি, আরেকটি হলো শিমলা চুক্তি। তবে দুটো চুক্তিই এখন কার্যত অচল বা স্থগিত অবস্থায় রয়েছে। ফলে আগের মতো কোনো নিয়ম বা কাঠামো নেই যা দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়লে তা নিয়ন্ত্রণে রাখবে।
এখন অঞ্চলটি এমন এক কৌশলগত মুহূর্তে দাঁড়িয়ে, যা গত দুই দশকে দেখা যায়নি। পাকিস্তানের ভেতরের অস্থিরতা এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছে, যেখানে পররাষ্ট্রনীতি পরিকল্পিত নয়; বরং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া-নির্ভর হয়ে পড়েছে। ভারতের জন্য এর মানে হলো, পাকিস্তান এখন শুধু একটি দুর্বল দেশ নয়, বরং এটি একটি অনিশ্চয়তার দেশ।
আর দক্ষিণ এশিয়ায় সরাসরি শত্রুতা যতটা বিপজ্জনক, অনিশ্চয়তা অনেক সময় তার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর। ভারতের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হলো পাকিস্তানের নানা কথা, প্রচারণা বা হুমকির ভিড় থেকে কোনটি আসল বার্তা—তা ঠিকভাবে বোঝা।
ইসলামাবাদে যেসব রাজনৈতিক নাটক চলে, তার আড়ালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভেতরে যে গভীর পরিবর্তন হচ্ছে, সেটাও আলাদা করে চিনতে হবে। ভারত যদি পাকিস্তানের বিশৃঙ্খলাকে নিজের জন্য সুবিধা মনে করে, সেটা ভুল হবে।
কারণ এমন একটি অনিরাপদ, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং রাজনৈতিকভাবে চাপে থাকা প্রতিবেশী দেশ যেকোনো সময় হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসতে পারে যা তার বেসামরিক সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। সেই সিদ্ধান্তের ফল ভারতকে বড় ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে।
ভারতের কাজ পাকিস্তানকে ঠিক করা নয়, বরং নিশ্চিত করা যে, পাকিস্তানের অস্থিরতা যেন ভারতের সীমান্তে সমস্যা না তৈরি করে এবং ভারতের বড় কৌশলগত উদ্দেশ্যগুলোকে যেন ব্যাহত না করে।
দিল্লিকে এখন নিশ্চিত করতে হবে, ভারত এখন ইন্দো-প্যাসিফিক, উপসাগরীয় অঞ্চল এবং আফগানিস্তানে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, পাকিস্তানের ভেতরের অস্থিরতা যেন সেই বড় কাজগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে।
দিল্লিকে মাথায় রাখতে হবে, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক ভবিষ্যতে কোনো বড় চুক্তি বা নাটকীয় কূটনৈতিক সাফল্যে বদলে যাবে না। তাই দুই দেশের মধ্যে যে ঝুঁকি আছে, ভারত কত শান্তভাবে এবং বুদ্ধি দিয়ে তা সামলাতে পারে—তা দিয়েই ভারতকে সম্পর্কের প্রকৃতি ঠিক হবে।
নাজিব জং জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ