শুক্রবারের শুরুতেই ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ও অস্ত্রাগারে বড় ধরনের হামলা চালায় এবং ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে আঘাত হানে। এর প্রতিশোধ হিসেবে ইরান শুক্রবার গভীর রাতে তেল আবিব ও জেরুজালেমের দিকে ডজন ডজন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘এই হুমকি দূর না হওয়া পর্যন্ত হামলা যত দিন প্রয়োজন, তত দিন চলবে।’ এর প্রতিক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলের হামলার প্রতি জোরালো সমর্থন জানান। তিনি সম্প্রতি ইরানের সঙ্গে নতুন করে পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করতে চেয়েছিলেন। ট্রাম্প বলেন, ‘আমি মনে করি, এটি দারুণ হয়েছে। আমরা (ইরানিদের) সুযোগ দিয়েছিলাম, তারা সেটি নেয়নি। তারা বড় আঘাত পেয়েছে, খুব বড় আঘাত.

..এবং আরও আসছে।’

নেতানিয়াহুর এই হামলার পেছনের উদ্দেশ্য, কীভাবে তিনি ট্রাম্পকে কাজে লাগিয়ে নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন এবং এই হামলার ফলে অঞ্চলের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে?

আরও পড়ুনইরানে ইসরায়েলের হামলা: ট্রাম্প কি পাগল হয়ে গেছেন১৩ জুন ২০২৫

হামলাটি ঠিক এখনই কেন হলো? প্রথমত, প্রায় দুই বছর ধরে ইসরায়েল ইরানের ‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’–এর সঙ্গে যুদ্ধ করছে।

দ্বিতীয়ত, ইসরায়েল ২০ বছরের বেশি সময় ধরে ইরানের ওপর হামলার পরিকল্পনা করে আসছে। এই ২০ বছরের বেশির ভাগ জায়গায় নেতানিয়াহুই ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু সামরিক নেতারা অনেক আগে থেকেই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসের কথা ভাবছিলেন। ১৯৮১ সালে ইরাকে এবং ২০০৭ সালে সিরিয়ায় পারমাণবিক চুল্লি ধ্বংস করা হয়েছিল। দুই ক্ষেত্রেই ওই পারমাণবিক কর্মসূচিগুলো ইসরায়েলের জন্য অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। ইসরায়েলের মূল উদ্দেশ্য ছিল আগেভাগে হামলা করে সেই হুমকি দূর করা।

ইরানে হামলার চিন্তাভাবনা ২০১২ সালে নেতানিয়াহু এবং তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এহুদ বারাকের সময় তুঙ্গে পৌঁছেছিল। কিন্তু তখন ওবামা প্রশাসন তাঁদের থামিয়ে দেয়। পরে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি হয়। তখন কিছু ইসরায়েলি নিরাপত্তা ও গোয়েন্দাপ্রধান মনে করেছিলেন যে ইসরায়েলকে একাই হামলা করা উচিত নয়।

আরও পড়ুনযে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে হামলা চালাল ইসরায়েল৭ ঘণ্টা আগে

আমেরিকার সম্মতি আর আগে থেকে জানিয়ে রাখা জরুরি। ১৯৮১ সালে মেনাখেম বেগিন আমেরিকাকে না জানিয়ে ইরাকের চুল্লিতে হামলা চালান। ফলে দুই দেশের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনা তৈরি হয়। তবে এহুদ ওলমার্ট ২০০৭ সালে জর্জ বুশকে সিরিয়ার গোপন চুল্লি সম্পর্কে জানান। তখন বুশ প্রথমে নিজে হামলার কথা ভাবলেও শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলকে তা ধ্বংস করতে দেন। প্রায় এক দশক ইসরায়েল সেই হামলার দায় স্বীকার করেনি।

কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। এই হামলা ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে গত বছরের দুই দফা পাল্টাপাল্টি হামলার পর হয়েছে। গত এপ্রিল মাসে দামেস্কে এক ইরানি জেনারেল নিহত হলে ইরান ড্রোন দিয়ে পাল্টা হামলা চালায়। কিন্তু সেটি ব্যর্থ হয়। কারণ, ইসরায়েল মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের সমর্থন পেয়েছিল।

অক্টোবর মাসে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ইসরায়েল পাল্টা আঘাত করে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেঙে দেয়। এরপর লেবাননে হিজবুল্লাহ ভেঙে পড়ে। সিরিয়ায় আসাদের শাসনও দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার দিকে আঘাত হানার পথ সুগম হয়। কিন্তু তারা ট্রাম্পের সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় ছিল।

এখন একটা প্রশ্ন হলো, ইসরায়েল কি এখন গাজায় হামলা থামিয়ে দেবে? নাকি এই আক্রমণ শেষ করে গাজায় নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে? এটা সময়ই বলবে। নেতানিয়াহু এখনো গাজায় হামাস ধ্বংস ও ফিলিস্তিনিদের বিতাড়নের পরিকল্পনায় অটল। ট্রাম্প পরিকল্পনা মেনে সেই এলাকায় অবকাশযাপনকেন্দ্র ও বসতি গড়ার নীতিই এখনো ইসরায়েলের নীতি।

কিছু ইসরায়েলি মনে করছিলেন, ট্রাম্প হয়তো এই হামলার অনুমতি দেবেন না। কারণ, তিনি ইরানের সঙ্গে চুক্তি করতে চেয়েছিলেন। আসলে কি সময় আর ট্রাম্পের উপস্থিতিই তাহলে মূল পার্থক্য তৈরি করল?

অবশ্যই। অক্টোবরের হামলার পর ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ভেঙে যাওয়া, রাশিয়ার নতুন প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম না দেওয়া, হিজবুল্লাহর নেতৃত্বের ধ্বংস, আসাদের পতন—সব মিলিয়ে বড় হামলার সুযোগ তৈরি হয়। সম্প্রতি জানা গিয়েছিল যে ইসরায়েল সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। নেতানিয়াহু হামলার জন্য চাপও দিচ্ছিলেন। ট্রাম্প কয়েক দিন আগেও প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করেছিলেন। বাস্তবে নেতানিয়াহু তাঁকে আগেই জানিয়েছিলেন। আর এখন ট্রাম্প প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছেন।

ট্রাম্পের সমর্থনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো, তাঁর প্রথম মেয়াদের শেষ দিকে ইসরায়েলকে সেন্টকমের অংশ করা হয়। ফলে ইসরায়েল এখন মার্কিন আঞ্চলিক বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় করছে। এতে মার্কিন সেনা বা বিমান নয়, গোয়েন্দা তথ্যও ভাগাভাগি হচ্ছে।

সেই সঙ্গে নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে বোঝার ক্ষেত্রে বেশ দক্ষ বলেই মনে হয়। ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে চুক্তির কথা বললেও বা গাজার যুদ্ধবিরতির কথা বললেও তিনি আসলে ইসরায়েলকে কোনো রকম চাপ দিতে চান না। ফলে ইসরায়েল নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে।

গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড নিয়ে অনেক সমালোচনা হলেও আমেরিকা প্রায়ই ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েলকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু আঞ্চলিক বিষয়ে শেষ কথা সব সময় আমেরিকার। ট্রাম্প চুক্তি চেয়েছিলেন। ইরান চুক্তির শর্ত মেনে চললে হামলা হতো না। কিন্তু তারা সুযোগ নেয়নি। হিজবুল্লাহও যুদ্ধ থামাতে পারত। কিন্তু তারা তা চায়নি।

এখন একটা প্রশ্ন হলো, ইসরায়েল কি এখন গাজায় হামলা থামিয়ে দেবে? নাকি এই আক্রমণ শেষ করে গাজায় নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে? এটা সময়ই বলবে। নেতানিয়াহু এখনো গাজায় হামাস ধ্বংস ও ফিলিস্তিনিদের বিতাড়নের পরিকল্পনায় অটল। ট্রাম্প পরিকল্পনা মেনে সেই এলাকায় অবকাশযাপনকেন্দ্র ও বসতি গড়ার নীতিই এখনো ইসরায়েলের নীতি।

ইরান আক্রমণে ইসরায়েলে প্রায় সর্বসম্মত সমর্থন আছে। গাজার যুদ্ধ ও ইরান আক্রমণ নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তাই বাড়িয়েছে। তাঁর কৌশল হলো, কোনো অজনপ্রিয় কাজ করতে গেলে যুক্তি দেখান যে বড় কোনো শক্তির চাপে পড়ে এমনটা করতে হচ্ছে।

নেতানিয়াহুর এই হামলা নিয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের উদ্বেগ ছিল, মার্কিন সমন্বয় ও ব্যর্থতার ঝুঁকি নিয়ে। কিন্তু এখন সমন্বয় হয়েছে। তবে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু সন্দেহ রয়ে গেছে। তবু এটি বহু বছরের প্রস্তুতির ফল।

ইরানের পারমাণবিক হুমকি সত্যিই বেড়েছে। গত ডিসেম্বর ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বাড়িয়ে পারমাণবিক অস্ত্রের এক ধাপ কাছে চলে যায়। এই তথ্য দিয়েছে আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা। সব মিলিয়ে ইরানের এই ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ, ইসরায়েলের সামরিক প্রস্তুতি এবং ট্রাম্পের সমর্থন—এই তিনের সমন্বয়েই এই হামলা হয়েছে।

আলুফ বেন হারেৎজ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক

দ্য নিউ ইয়র্কার থেকে নেওয়া ইংরেজির সংক্ষেপিত অনুবাদ

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল আম র ক বছর র ইসর য

এছাড়াও পড়ুন:

টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলার চিন্তা এখনই করা বোকামি: শান্ত

অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দল যখন ঐতিহাসিক লর্ডসে ‘টেস্ট বিশ্বকাপ’ বা টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াইয়ে ব্যস্ত, তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল প্রস্তুতি নিচ্ছে শ্রীলঙ্কা সফরের। গলে ও কলম্বোতে দুই টেস্ট দিয়ে বাংলাদেশ ২০২৫-২৭ চক্রে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের যাত্রা শুরু করবে।

বাংলাদেশ কি কখনো টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলতে পারবে? এরকম বড় মঞ্চে নাজমুল হোসেন শান্ত, লিটন দাস কিংবা মুমিনুলররা কি যেতে পারবেন? টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের নতুন চক্রে পা দেওয়ার আগে সেই প্রশ্নটাই গেল বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর কোর্টে।

বৃহস্পতিবার মিরপুর শের-ই-বাংলায় সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অধিনায়ক এখনই অত বড় স্বপ্ন দেখছেন না বলেই জানালেন। নিজেদের সামর্থ্য এবং পারিপার্শ্বিক সব কিছু বিবেচনায় এনে অধিনায়ক মনে করছেন, ধীরে ধীরে এগোনোই ভালো।

আরো পড়ুন:

টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে একদিনেই ১৪ উইকেটের পতন

টিভিতে আজকের খেলা 

তার ভাষ্য, ‘‘এটা (টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল) তো অনেক বড় স্বপ্ন। এত দূরে যদি আমি এখনই চিন্তা করি তাহলে আসলে বোকামি হবে আমার কাছে মনে হয়।’’

শেষ চক্রে বাংলাদেশ ১২ ম্যাচে মাত্র ৪টিতে জিতেছে। পাকিস্তানের বিপক্ষে রাওয়ালপিন্ডিতে দুই ম্যাচের সিরিজ জিতেছিল। এছাড়া নিউ জিল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছিল। এর আগের চক্রে সমান ম্যাচে মাত্র এক জয় এবং তারও আগের চক্রে সাত ম্যাচে কোনো জয় ছিল না বাংলাদেশের।

অধিনায়ক এই বাস্তবতাকেই সামনে এনে ছোট ছোট কদমে এগিয়ে যেতে চান, ‘‘ছোট ছোটভাবে যদি আমরা এগোতে পারি তাহলে খুব ভালো। কারণ, আপনি যদি দেখেন আমরা যখন শুরু করেছিলাম, এর আগের সার্কেলে মাত্র একটা ম্যাচ জিতেছিলাম। গত সার্কেলে আমরা চারটি ম্যাচ জিতেছি। আমাদের একটু উন্নতি হয়েছে। টার্গেট থাকবে যে, এবার আরও দুইটা তিনটা ম্যাচ বেশি জিততে পারি। আমরা যদি এভাবে ছোট ছোট চিন্তা করে এগোতে পারি তাহলে কেন না? বাংলাদেশ দলও একদিন ফাইনাল খেলবে। কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ সামনের দুই বছরের মধ্যে গত বছরের থেকে কিভাবে ভালো রেজাল্ট করছি আমরা।’’

উন্নতির জন্য ঘরের মাঠে জেতার বিকল্প নেই। শেষ চক্রে যে চারটি জয় ছিল, বাংলাদেশের তিনটিই দেশের বাইরে। নিউ জিল্যান্ডকে দেশের মাটিতে হারিয়ে শুরু। এরপর পাকিস্তানের বিপক্ষে দুই টেস্ট জয় এবং সবশেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে জয়। অথচ ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকা ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে। ভারতের মাটিতে গিয়ে হয়েছে নাস্তানাবুদ। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের বাইরে বাংলাদেশ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও দেশের মাটিতে হেরেছে।

ঘরের মাঠে জয়ের বিকল্প নেই জানিয়ে শান্ত বলেছেন, ‘‘আমার মনে হয় আমাদেরকে ঘরের মাঠে জিততে হবে। আমরা শেষ সার্কেলের ঘরের মাঠে খুবই বাজে ক্রিকেট খেলেছি। যদি ঘরের মাঠে জিততে পারতাম, তাহলে আমরা হয়তো আরও দুই-তিনটি ম্যাচ বেশি জিততে পারতাম। চিন্তা তো ওখানেই যে ঘরের মাঠে আমরা কিভাবে টেস্ট জিততে পারি। যখন ম্যাচ হবে তখন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে খেলতে হবে। বাইরে ভালো হয়েছে—এই আত্মবিশ্বাসটা আমাদের কাজে দেবে। আমরা যদি এই বছর বাইরের মাটিতে রেজাল্ট করতে পারি তাহলে দেখা যাবে আমাদের এই বছরের টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের সার্কেলে আরও ভালো রেজাল্ট হবে।’’

ঢাকা/ইয়াসিন/আমিনুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এখনই কেন ইরানের এ অপূরণীয় ক্ষতি করল ইসরায়েল
  • ফাইনাল খেলার স্বপ্নকে ‘বোকামি’ মনে হয় নাজমুলের
  • টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলার চিন্তা এখনই করা বোকামি: শান্ত