দেশের ডিজিটাল ও সাইবার নিরাপত্তায় আইন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নিতে গত ডিসেম্বরে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪’ করে অন্তর্বর্তী সরকার। এই অধ্যাদেশও নিপীড়নমূলক হওয়ায় পর তা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে সংশোধিত সাইবার অধ্যাদেশটিও আন্তর্জাতিক মানের হয়নি। সাইবার অধ্যাদেশটি সংশোধনের সময় জাতিসংঘ কিছু সুপারিশ করেছিল। এর সব আমলে নেয়নি সরকার। সংশোধিত সাইবার অধ্যাদেশ ও জাতিসংঘের সুপারিশ বিশ্লেষণ করে এ তথ্য মিলেছে।

দেশে ডিজিটাল ও সাইবার নিরাপত্তায় আইন হয়েছিল একাধিক। নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে তথ্য ও প্রযুক্তি আইন (আইসিটি অ্যাক্ট), ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ও সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) প্রবর্তন করা হয়। এসব আইন জনগণকে সুরক্ষার বদলে হয়ে ওঠে নিপীড়নমূলক। এ ছাড়া আইনগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে না হওয়া, মতপ্রকাশে বাধা ও বৈষম্যমূলক হওয়ায় দেশ-বিদেশে ছিল তুমুল সমালোচনা। অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর ধারাগুলো সংশোধনের সুপারিশ করে জাতিসংঘ। সংশোধিত অধ্যাদেশেও সুপারিশের পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন হয়নি।
কূটনৈতিকরা বলছেন, সংশোধিত অধ্যাদেশে সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা বাদ পড়েছে। অবশ্য মানবাধিকারকর্মীরা সাইবার নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে তুলনা করে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪’-কে তুলনামূলকভাবে ভালো বলে মন্তব্য করেছেন। তবে তাদের মতে, অধ্যাদেশের কিছু ক্ষেত্রে দ্বৈততা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বের বিষয়ে শঙ্কা রয়ে গেছে।

কূটনৈতিক সূত্র বলছে, সংশোধিত অধ্যাদেশে এখনও অনেক ধারায় অস্পষ্ট সংজ্ঞার মাধ্যমে মতপ্রকাশকে ‘অপরাধ’ হিসেবে রাখা হয়েছে, যা অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে কঠোর শান্তির বিধান, যার ভয়ে ব্যবহারকারীরা মতপ্রকাশে অনুৎসাহিত হবেন। পাশাপাশি নির্বাহীদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত একটি শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক কাঠামো রাখা হয়েছে, সেখানে জবাবদিহির ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এসব ধারা অতীতের রাষ্ট্রীয় নীতি ও অনুশীলনের কথা মনে করিয়ে দেয়। যার অন্যতম সমালোচক ছিলেন এখনকার কোনো কোনো উপদেষ্টা। অন্তর্বর্তী সরকারকে জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিআর) ১৯ ধারা মেনে চলার বাংলাদেশের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা একাধিকবার স্মরণ করিয়েছে জাতিসংঘ।
জাতিসংঘ বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ছিল আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করবে। তবে সংশোধনে তা অনুপস্থিত, যা নিশ্চিত করতে সরকার আইনত বাধ্য। গত মার্চে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার, প্রচার ও সুরক্ষাবিষয়ক বিশেষ দূত আইরিন খান বাংলাদেশকে বলেছিলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অগ্রাহ্য করায় তিনি মর্মাহত। যদিও অধ্যাদেশে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ অনেক ধারা বাতিল করা হয়েছে। 
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ সংশোধনের সময় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনারের কার্যালয় কিছু ধারা নিয়ে উদ্বেগ ও সুপারিশ করেছিল। অধ্যাদেশে হ্যাকিংয়ের মতো সাইবার অপরাধ ও লিঙ্গভিত্তিক হয়রানিকে এক করে দেখা হয়েছিল। সংশোধনে অপরাধের ভিন্নতা আমলে নিয়ে শাস্তি ও জরিমানা ভিন্ন করেছে সরকার। এ ছাড়া মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সংশোধনের ২৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘হুইসেলব্লোয়ার’দের ‘বৃহত্তর জনস্বার্থে’ আইনের আওতায় আনা যাবে না। 

সংশোধনের ২৩ ধারা সাইবার সন্ত্রাসকে সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতোই রাখা হয়েছে। ধারাটি অস্পষ্ট। ফলে রাজনৈতিক, মানবাধিকারকর্মীসহ সাংবাদিকদের বৈধ মতপ্রকাশে বাধা সৃষ্টি করবে। জাতিসংঘ বলছে, এ ধারায় অপরাধের কঠোর শাস্তির পরিপ্রেক্ষিতে সংজ্ঞাটি কঠোর করা এবং আন্তর্জাতিক মান ও বিশ্বজুড়ে ভালো অনুশীলনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্বর্তী সরকারকে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার প্রচার ও সুরক্ষাবিষয়ক বিশেষ দূতের মাধ্যমে নির্ধারিত সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা আমলে নেওয়া উচিত।
সংশোধিত অধ্যাদেশে ২৫ ধারায় যৌন হয়রানি, প্রতিশোধমূলক পর্নো, ব্ল্যাকমেইলিং বা অশ্লীল বিষয়বস্তু প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে আমলে নেওয়ায় সাধুবাদ জানিয়েছে জাতিসংঘ, যা ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ বা ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে’ ছিল না। ২০২৪ সালের অধ্যাদেশে ‘যৌন হয়রানি ও প্রতিশোধমূলক পর্নো’র ব্যাখ্যা না থাকলেও সংশোধনীতে দেওয়া হয়েছে। এ ধারায় গোপনীয় তথ্য প্রকাশ বা ক্ষতি করার ভয় দেখায় বেআইনি সুবিধা নেওয়াকে ব্ল্যাকমেইলিং বলা হয়েছে। তবে ‘গোপনীয় তথ্য’ ও ‘ক্ষতি’র ব্যাখ্যা পরিষ্কার নয়। সংশোধনে অশ্লীল বিষয়বস্তুকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে দেখানো হয়েছে। সংশোধনের ধারা ২৬-এ সাইবার স্পেসে জাতিগত বিষয়ে সহিংসতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক তথ্য প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ‘ঘৃণা’ বা ‘বিদ্বেষমূলক’ বক্তব্যের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড আইসিসিপিআরের ধারা ২০(২)-এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

সংশোধনের ধারা ২৭-এ অপরাধ সংঘটনে ‘সহায়তা’ করলে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু ‘সহায়তা’ কী, তা সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। এতে করে এ ধারার ফাঁকে কর্তৃপক্ষ কাউকে অযৌক্তিক ফৌজদারি অপরাধে জড়াতে পারে। এ ধারার অস্পষ্ট ভাষা এবং মামলা-মোকদ্দমা হওয়ার শঙ্কায় ব্যবহারকারী অনলাইন বিতর্কে অংশগ্রহণ বা তথ্য প্রচারে নিরুৎসাহিত হতে পারেন। 
সাইবার অধ্যাদেশ, ২০২৪ সংশোধনের সময় জাতিসংঘের সুপারিশগুলো সরকার আমলে নিয়েছে কিনা– জানতে চাইলে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেয়নি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে সমকালকে জানান, জাতিসংঘ থেকে মার্চে যেসব সুপারিশ দিয়েছিল, তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
জাতিসংঘের সুপারিশ আমলে নেওয়া হয়েছে কিনা– জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব সমকালকে বলেন, সব সুপারিশ পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় বিষয় আমলে নেওয়া হয়েছে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আইন র স রক ষ অপর ধ আইন র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

১০০ কোটি টাকার পাচারের অভিযোগ, জাহাঙ্গীরের নামে মামলা

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দপ্তরের সাবেক পিয়ন জাহাঙ্গীর আলম ওরফে পানি জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে মামলা করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) নোয়াখালীর চাটখিল থানায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে এই মামলা করেছে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট।

আরো পড়ুন:

নাফিসা কামালসহ ৮ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের মামলা

সাজিদ হত্যার তদন্তে সিআইডিকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমোদন 

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান জানান, প্রাথমিক অনুসন্ধানে উল্লেখযোগ্য প্রমাণ পাওয়ায় নোয়াখালীর চাটখিল থানায় জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

তিনি আরো জানান, নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান জাহাঙ্গীর আলম জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তিনি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে স্বল্প সময়ের জন্য ‘ব্যক্তিগত সহকারী’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই দায়িত্বই তাকে আর্থিকভাবে লাভবান করেছে মর্মে প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

জসীম উদ্দিন খান জানান, ২০১০ সালে জাহাঙ্গীর ‘স্কাই রি অ্যারেঞ্জ লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করে বিকাশের ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবসা নেন। কিন্তু এর আড়ালে তিনি অসংখ্য সন্দেহজনক ব্যাংকিং কার্যক্রম করেন। কোম্পানির নামে একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক অঙ্কের টাকা জমা হয়, যার বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি ও ব্যবসার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

সিআইডির এই কর্মকর্তা জানান, প্রতিষ্ঠানটির অ্যাকাউন্টগুলোতে ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংকে মোট ৫৬৫ কোটিরও বেশি টাকা লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ নগদে জমা হয়েছে দেশের নানা স্থান থেকে। এসব অর্থের উৎস অজানা এবং হুন্ডি ও মানিলন্ডারিং কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিক প্রমাণ মেলে।

বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দীন জানান, জাহাঙ্গীর আলম তার স্ত্রী কামরুন নাহার ও ভাই মনির হোসেনের সহায়তায় দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ অর্থ লেনদেন করতেন। জাহাঙ্গীর আলম ও তার স্ত্রী ২০২৪ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এবং বর্তমানে ভার্জিনিয়ায় অবস্থান করছেন। বিদেশে তাদের বিনিয়োগ বা সম্পদ ক্রয়ের কোনো সরকারি অনুমোদন না পাওয়া গেলেও তারা যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রমাণ মেলে।

অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে, জাহাঙ্গীর আলম, তার স্ত্রী কামরুন নাহার, ভাই মনির হোসেন এবং প্রতিষ্ঠান স্কাই রি অ্যারেঞ্জ লিমিটেড যৌথভাবে ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ১০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। অপরাধের পূর্ণাঙ্গ তথ্য উদঘাটন, অপরাপর সদস্যদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করার স্বার্থে সিআইডির তদন্ত ও অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

ঢাকা/মাকসুদ/সাইফ 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • যশোরে জিআই পণ্য খেজুর গুড় তৈরির রস সংগ্রহে গাছ প্রস্তুতির উদ্বোধন
  • ১০০ কোটি টাকার পাচারের অভিযোগ, জাহাঙ্গীরের নামে মামলা