বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালেন। তাঁর মাথায় কিপ্পা (ইহুদিদের ধর্মীয়ভাবে মাথায় পরার ছোট গোলাকার টুপি)।

কাঁধে তালিত (ইহুদিদের ধর্মীয় স্কার্ফ, যেটি ধর্মীয় দায়িত্ব ও ঈশ্বরের আদেশ পালনের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়)। প্রাচীন দেয়ালটাতে হাত রেখে তিনি খানিকক্ষণ চুপচাপ প্রার্থনা করলেন।

দেয়ালের একটি ফোকরে একখণ্ড কাগজ পুরে দিলেন। এরপর সেখান থেকে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন।

এটি গত বৃহস্পতিবার (১২ জুন) ভোরের ঘটনা। সূর্যাস্তের পর, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নেতানিয়াহু ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন, ‘কয়েক মুহূর্ত আগে ইসরায়েল অপারেশন রাইজিং লায়ন শুরু করেছে।’

পরদিন শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সেই চিরকুটটির (যেটি নেতানিয়াহু আগের দিন দেয়ালের ফোকরে গুঁজে এসেছিলেন) একটি ছবি প্রকাশ করল।

ছবিতে দেখা গেল, কাগজে নেতানিয়াহুর নিজের হাতে হিব্রু ভাষায় লেখা: ‘হেন আম কে-লাবি ইয়াকুম’। বাংলায় এর অর্থ ‘এই জাতি সিংহের মতো জেগে উঠবে।’

এর নিচে হিব্রুতে বেনিয়ামিনের নিজের স্বাক্ষর।

‘হেন আম কে-লাবি ইয়াকুম’ একটি বাক্যাংশ। এটি নেওয়া হয়েছে ওল্ড টেস্টামেন্টের বুক অব নাম্বার্স-এর ২৩: ২৪ আয়াত থেকে।

পুরো আয়াতটির অর্থ: ‘দেখো, এই জাতি সিংহের মতো জেগে উঠবে এবং এক তাগড়া সিংহের মতো নিজেকে তুলে ধরবে যে শিকার ধরে তার রক্ত আকণ্ঠ পান না করা পর্যন্ত বিশ্রামে গা এলিয়ে দেবে না।’

‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ই ইসরায়েলের একমাত্র সামরিক অভিযান নয়, যার নাম ইহুদি বাইবেল থেকে নেওয়া। ইসরায়েল প্রায়ই তার অভিযানগুলোর নামকরণ করে ইহুদি বাইবেল কিংবা ধর্মীয় অনুপ্রেরণা থেকে।

আরও পড়ুনলাল গরু এসে গেছে, আল-আকসা ভেঙে থার্ড টেম্পল গড়া হবে?১৮ নভেম্বর ২০২৩ধর্মীয় শব্দ, প্রতীক ও ভাষ্য কেন সামনে আনা হয়?

তেল আবিবের উপকণ্ঠের রামাত গান এলাকায় অবস্থিত ইসরায়েলের দ্বিতীয় বৃহত্তম একাডেমিক প্রতিষ্ঠান বার ইলান ইউনিভার্সিটির (যেখানে ইহুদি ঐতিহ্য ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে শিক্ষাদান করা হয়) গবেষক দালিয়া গাভরিয়েলি-নুরির ভাষ্যমতে, ইসরায়েল তার ৭৫ বছরের ইতিহাসে যতগুলো সামরিক অভিযান চালিয়েছে, তার অর্ধেকের নাম ইহুদি বাইবেল থেকে নেওয়া।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে বাশার আল–আসাদ সরকারের পতন ঘটানোর উদ্দেশে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) সিরিয়ায় ‘অপারেশন অ্যারো অব বাশান’ নামের একটি অভিযান চালিয়েছিল।

‘বাশান’ শব্দটি ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লেখ করা একটি অঞ্চলের নাম। এটি সিরিয়ার দক্ষিণ ও জর্ডান নদীর পূর্ব দিকের ভূমিকে বোঝায়। প্রাচীনকালে ইহুদিরা বাশান রাজাকে পরাজিত করে এই অঞ্চল দখল নিয়েছিল।

গাজায় ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করতে ইসরায়েল যেসব অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে এবং সেসব অভিযানে যেসব অস্ত্র ব্যবহার করছে, সেগুলোতে তারা বিভিন্ন বিবলিক্যাল নাম ও প্রতীক ব্যবহার করছে।

অনেক বিশ্লেষকের মতে, এর মধ্য দিয়ে তারা ফিলিস্তিনের ভূমির ওপর ‘ঈশ্বরপ্রদত্ত অধিকার’ দাবি করে এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের যুদ্ধগুলোকে ন্যায্য বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।

নেতানিয়াহুর বিবৃতিতে ‘আমালেক’-এর উল্লেখ কতটা ভয়ংকর এবং এর মধ্য দিয়ে তিনি গাজার ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করতে কতটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তা বুঝতে ইহুদিধর্মীয় ভাষ্যের দিকে নজর বোলাতে হবে।আমালেক কারা? নেতানিয়াহু কেন আমালেক নিশ্চিহ্ন করতে চান?

গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের অভিযান চালানোর নির্দেশ দিতে গিয়ে নেতানিয়াহু এ পর্যন্ত অন্তত তিনবার হিব্রু বাইবেলে উল্লেখ করা আমালেকের কাহিনি সেনাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন।

২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহু হিব্রু বাইবেলের তোরাহ অংশের ২৫: ১৭ আয়াত থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন।

এই আয়াতে বলা আছে: ‘স্মরণ করো, আমালেক তোমার সঙ্গে কী করেছিল।’ নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ‘আমরা মনে রাখি এবং যুদ্ধ করি।’ নেতানিয়াহুর এই কথার মধ্যে হিব্রু বাইবেলের আরেকটি আয়াতের সংযোগ আছে বলে অনেক বিশ্লেষক তখন বলেছিলেন।

সেই আয়াতটি হলো: ‘যাও, আমালেকদের ওপর আঘাত হানো এবং যা কিছু তাদের আছে সব সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দাও; তাদের কাউকে ছেড়ে দেবে না—পুরুষ, নারী, শিশু, স্তন্যপানকারী নবজাতক, গরু, ভেড়া, উট এবং গাধা—সবকিছু মেরে ফেলো।’ (১ শমূয়েল ১৫:৩)

নেতানিয়াহুর বিবৃতিতে ‘আমালেক’-এর উল্লেখ কতটা ভয়ংকর এবং এর মধ্য দিয়ে তিনি গাজার ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করতে কতটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তা বুঝতে ইহুদিধর্মীয় ভাষ্যের দিকে নজর বোলাতে হবে।

আমালেক ছিল একটি প্রাচীন জাতিগোষ্ঠী। ফেরাউনের কবল থেকে মুসা নবী (মোজেস) বনি ইসরাইল বা ইসরায়েলিদের মুক্ত করে মিসর থেকে তাঁদের পূর্বপুরুষের (ইয়াকুব নবী, যাঁর আরেক নাম ‘ইসরাইল’) ভূমির দিকে, অর্থাৎ কিনান বা আজকের ফিলিস্তিনের দিকে যখন রওনা হয়েছিলেন (যূথবদ্ধ নির্গমন বা এক্সুডাস), তখন আমালেক সম্প্রদায় তাদের ওপর মরুভূমিতে আক্রমণ করেছিল।

এই আক্রমণকে ইহুদি ধর্মে এক নির্মম ও কাপুরুষোচিত কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়।

আরও পড়ুনগাজার যুদ্ধ সেই হাসান তেহরানির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে২৬ অক্টোবর ২০২৩

ইহুদিধর্মীয় গ্রন্থের ভাষ্যমতে, পরবর্তী সময়ে ঈশ্বর আদেশ দেন, আমালেকের নাম পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। তোরাহ-এর ২৫: ১৭ আয়াতে বলা হয়েছে: ‘তুমি আকাশের নিচ থেকে আমালেকের চিহ্ন মুছে ফেলবে।’

ঐতিহাসিকভাবে ইহুদিদের কাছে আমালেক কেবল একটি জাতি নয়, বরং চরম শত্রুতা, ঈশ্বরবিরোধিতা ও নিপীড়নের প্রতীক হয়ে ওঠে।

ইসলামের ভাষ্যেও আমালেকের উল্লেখ পাওয়া যায়। পবিত্র কোরআনে আমালেক নামটির সরাসরি উল্লেখ নেই। তবে কিছু ইসলামি ঐতিহাসিক সূত্রে, আমালেকদের প্রাচীন মিসর বা আরব অঞ্চলের আদি অত্যাচারী গোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

ইবনে কাসির, তাফসির কুরতুবি, তাফসির আল-জালালাইন প্রভৃতি প্রাচীন তাফসিরে বলা হয়েছে, এই শত্রুবাহিনী ছিল জালিম ও অত্যাচারী এক জাতি, যারা ‘আদ’ জাতির ধ্বংসপ্রাপ্ত লোকদের উত্তরসূরি হতে পারে।

আমালেকরা ফিলিস্তিন, মিসর ও হেজাজ অঞ্চলে বসবাস করত বলে মুসলিম ঐতিহাসিকেরা ধারণা দেন। তাঁদের ‘জাব্বারিন’ বা অত্যাচারী হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে।

এই আমালেক ইহুদি ইতিহাসে একমাত্র জাতি, যাদের পুরোপুরি নির্মূলের আদেশ দেওয়া হয়। তাদের স্মৃতি ও নাম নিশ্চিহ্ন করার আদেশ আজও তোরাহ পাঠের সময় বা ধর্মীয় বক্তৃতায় স্মরণ করা হয়।

নেতানিয়াহুর চোখে আজকের আমালেক কারা?

আজকের দুনিয়ায় আমালেক জাতিগোষ্ঠী অবশিষ্ট নেই। তবে ইহুদিদের ধর্মীয় ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতিটি প্রজন্মে ‘আমালেক’ নতুন রূপ নিয়ে ফিরে আসতে পারে বলে বিবেচিত হয়।

মূলত রাজনৈতিক বা ধর্মীয় শত্রুকে ইহুদিরা প্রতীকীভাবে ‘আমালেক’ বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন। ইহুদিদের ধর্মীয় নেতা বা রাবাইরা এবং ইহুদিধর্মগ্রন্থ ‘তানাখ’-এর পণ্ডিতদের বেশির ভাগই মনে করেন, ইরানিরা, ফিলিস্তিনিরা তথা মূলত মুসলমানেরাই হলো আজকের দিনের ‘আমালেক’।

ফলে নেতানিয়াহু যখন গাজায় সেনা পাঠানোর সময় সেনাদের তোরাহ-এর ২৫: ১৭ আয়াত উল্লেখ করে ‘আমালেকদের’ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার কথা মনে করিয়ে দেন, তখন সেটিকে গাজার নারী-পুরুষ-বৃদ্ধসহ সব ফিলিস্তিনিকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করার নীতি হিসেবে দেখা হয়। নেতানিয়াহু বলতে চান, এই আদেশ তাঁর নয়, বরং এটি ঈশ্বরের আদেশ।

ইসরায়েলের শীর্ষস্থানীয় রাবাই বা ধর্মগুরুরাও এই ‘ফতোয়া’ দিয়েছেন যে, অ–ইহুদি শত্রুদের সবাই এ সময়কার ‘আমালেক’। সে কারণে তাদের নারী–শিশু–বৃদ্ধ সবাইকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াই ঈশ্বরের আদেশ।

সিংহ যেমন শিকার ধরে তার রক্ত পান করে পরিতৃপ্ত না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেয় না, তেমনি ইহুদিদেরও ‘আমালেকদের’ সমূলে বিনাশ না করা পর্যন্ত বিশ্রাম নেওয়ার অনুমতি নেই।

‘কিংস তোরাহ’ বইয়ের দুই লেখক রাবাই ইৎসহাক শাপিরা এবং রাবাই ইয়োসেফ এলিৎসুর.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন শ চ হ ন করত ন শ চ হ ন কর ইসর য় ল র আম ল ক র আজক র

এছাড়াও পড়ুন:

পটুয়াখালীতে সালিস বৈঠকে অংশ নিলে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বিএনপি

পটুয়াখালীতে স্থানীয় পর্যায়ে সালিস বৈঠকে অংশ নিলে দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। গতকাল বুধবার রাতে ওই বিজ্ঞপ্তির কপি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

সম্প্রতি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে বিএনপির কিছু নেতা-কর্মী সালিস বৈঠকে অংশ নিয়ে আর্থিক লেনদেনে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে। ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা এ বিষয়ে ফেসবুকে নানা মন্তব্য তুলে ধরে ক্ষোভ জানিয়েছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে জেলা বিএনপি এই বিজ্ঞপ্তি দেয়।

এ বিষয়ে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান টোটন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামনে জাতীয় নির্বাচন। সংকটময় মুহূর্ত আসছে, তাই দলীয় নেতা-কর্মীরা যাতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনায় না জড়ান, তাই তাঁদের সতর্ক করা হয়েছে।’

ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিএনপি জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামী সংগঠন। এই দলের প্রত্যেক কর্মী জনগণের আস্থার প্রতীক এবং আন্দোলন-সংগ্রামের অগ্রণী সৈনিক। তাই দলের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখা ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে জেলা বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনের জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের কোনো নেতা-কর্মী স্থানীয় পর্যায়ে কোনো প্রকার সালিস, দাঙ্গা-ফ্যাসাদ বা পক্ষপাতদুষ্ট এবং মধ্যস্থতাকারী কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবে না।

একই সঙ্গে ওই বিজ্ঞপ্তিতে দলীয় নেতা-কর্মীদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মসূচি এবং জনগণের পাশে থাকতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া নেতা-কর্মীদের সদা হাস্যোজ্জ্বল, ভদ্র ও অমায়িক আচরণমুখী হতে বলা হয়েছে। এ নির্দেশনা অমান্য করলে তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ