তেহরানের রাস্তাগুলো যেন এক বিশৃঙ্খলার গল্প বলছে— রাস্তার ফুটপাথ ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া স্যুটকেস, একা মা এক হাতে ছোট ছেলেকে ধরে আছেন, অন্য হাতে একটি কম্বল ও বালিশ নিয়ে নামছেন সাবওয়ে স্টেশনের দিকে; আরেকটি রাত কাটাতে যাচ্ছেন মাটির নিচে।

ইসরায়েলের হামলার মুখে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই, সতর্কতা বার্তা বা সরকারিভাবে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা নেই; তরুণ ইরানিরা এখন একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছেন ইন্টারনেটে, ডিসকর্ড ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো চ্যাট অ্যাপে।

তেহরানের ২৪ বছর বয়সি আইটি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র মোমো বলছিলেন, “আমরা জানি না কোথায় যাব।”

আরো পড়ুন:

ঝিনাইদহে বিএনপি নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়িতে হামলা

ইসরায়েলি হামলার পর পুনরায় সম্প্রচার শুরু করল ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভি

 “আমরা কখনোই জানি না পাশের ভবনটা ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থার কোনো কার্যালয় কি না। আমার ওপরতলার প্রতিবেশী একজন সাধারণ মানুষ নাকি সরকারের কেউ; তাও জানি না। পাশের যে স্থাপনাটা আছে, সেটা হয়তো কোনো গোপন সামরিক প্রকল্পের অংশ,” বলছিলেন মোমো।

ইসরায়েলের এমন সব আবাসিক ভবনে হামলার প্রসঙ্গ টেনে এই ছাত্র কথা বলছিলেন। ইসরায়েলের কাছে যেসব ভবন সন্দেহভাজন সামরিক বা পারমাণবিক স্থাপনা, সেখানে তারা নির্বিচার হামলা চালাচ্ছে। তবে ইরানের সাধারণ মানুষ জানেই না, কোথায় কীভাবে সামরিক কাজ পরিচালনা করে তাদের সরকার। ফলে সবসময় এক অনিশ্চিয়তার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে নাগরিকদের।

তবু সবকিছুর পরেও মোমো তেহরানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন; শুধু তার দুই বছরের উদ্ধার করা পোষা বিড়ালের জন্য নয়, বরং আদর্শের কারণে। 

তিনি বলেন, “আমি যাবইবা কোথায়? আমার ঘর তো এখানেই। আমার জীবন এখানেই। আমরা কোনো দমনমূলক শাসনের সামনে কিংবা ইসরায়েলের আগ্রাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করব না।” 

“আমাদের অনেকেই থেকে যাচ্ছি। আমরা জানি না এই অবস্থা কতদিন চলবে, কিন্তু আমি বরং চাই আমার ঘরই আমার কবর হোক, তবু উদ্বাস্তু হয়ে বাঁচব না।”

আশ্রয় নেই, শুধু ইন্টারনেটই ভরসা
পারম্পরিক আশ্রয়স্থল যখন নাগালের বাইরে, আর যোগাযোগ নেটওয়ার্কগুলো কঠোর নজরদারি বা পুরোপুরি অবরোধের মুখে, তখন ইরানের জেন জি বা জেনারেশন জি, যারা ১৯৯৭ থেকে থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মেছেন; তারা নতুন এক আশ্রয় গড়ে তুলেছেন ডিজিটাল জগতে। 

বিভিন্ন অনলাইন ফোরাম যেন এখন ইরানি জেন জির জন্য জরুরি লাইফলাইন; কখনো আশ্রয়কেন্দ্র, কখনো মানসিক প্রশান্তির স্থান, আবার কখনো সংগঠনের মঞ্চ।

মোমো সাত বছর ধরে ডিসকর্ড ব্যবহার করছেন। তিনি বলছিলেন, “এটাই একমাত্র জায়গা যেখানে আমি নিঃশ্বাস নিতে পারি।”

আগে বন্ধুদের সঙ্গে গেম খেলার সময় শুধু ভয়েস চ্যাটের জন্য প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করতেন মোমো। কিন্তু এখন এটি হয়ে উঠেছে তার ডিজিটাল ‘ঘর’। 

তিনি বলেন, “আমরা প্রায়ই পরিবার থেকেও বেশি সময় কাটাই ডিসকর্ডে থাকা মানুষদের সঙ্গে। বোমাবর্ষণের মাঝেও আমরা একসঙ্গে সিনেমা দেখি, সিরিজ দেখি। এমনকি মাঝেমধ্যে অনলাইনেই ঘুমিয়ে পড়ি।”

ইরানের এই প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে নিষেধাজ্ঞা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সেন্সরশিপের ছায়ায়। তাদের অনেকেই ছিলেন ২০২২ সালের সরকারবিরোধী বিক্ষোভের অগ্রভাগে, যা শুরু হয়েছিল মাহসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। 

হিজাব ঠিকমতো না পরায় আমিনি গ্রেপ্তারের পর পুলিশ হেফাজতে মারা যান। ওই আন্দোলনটি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায় এই স্লোগানে: ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’।

তখন অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো ছিল বিক্ষোভের চালিকাশক্তি। আর এখন, যখন জীবনযুদ্ধ আরো কঠিন হয়ে উঠেছে, তখনো এই ডিজিটাল পরিসরই রয়ে গেছে তাদের একমাত্র আশ্রয় ও সংযোগের সেতু।

ইরানে ১ কোটি ৪০ লাখ তরুণ ডিসকর্ডে, যুদ্ধের মধ্যে চলছে সংযোগ ও সহমর্মিতা
ইরানের প্রভাবশালী দৈনিক সার্গ-এর তথ্য অনুসারে, দেশটির প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশই জেন জি গেমার এবং নিয়মিত ডিসকর্ড ব্যবহার করেন। যদিও সরকারি বিধিনিষেধ রয়েছে, এই তরুণেরা এখনো ভিপিএন এবং এনক্রিপ্টেড অ্যাপ ব্যবহার করে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকছেন।

ইরানের উত্তরাঞ্চলের ২৩ বছর বয়সী এক তরুণী সামিন বলছিলেন, “যখন হামলা শুরু হলো, তখন আমরা একটা গেম খেলছিলাম। তখন এক অদ্ভুত বাস্তবতা তৈরি হলো; বুঝতেই পারছিলাম না গোলাগুলির শব্দগুলো গেম থেকে আসছে নাকি বাস্তব জীবন থেকে।“

“আমরা যে গেমগুলো খেলি, যেমন কল অব ডিউটি, সেগুলো ভরা থাকে বিস্ফোরণ আর বন্দুকের গুলিতে। তাই এটা যেন একটা তিক্ত রসিকতা। আমি বুঝতেই পারছিলাম না আমি গেম খেলছি নাকি বাস্তবতায় যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। দুঃখজনকভাবে, সেদিনের শব্দগুলো গেম থেকে আসেনি; সেগুলো ছিল বাস্তব বোমা হামলার শব্দ।”

২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ইরানে ডিসকর্ড আনুষ্ঠানিকভাবে ব্লক করে দেওয়া হয়। অনেকেই মনে করেন, এটি ছিল একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ, কারণ সরকার বুঝতে পেরেছিল যে ডিসকর্ড প্ল্যাটফর্মটি বিক্ষোভ সংগঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। যদিও ইরানের বিচার বিভাগ এটিকে নিষিদ্ধ করার কারণ হিসেবে ‘অশ্লীল বিষয়বস্তুর’ কথা বলেছিল।

তবু এই প্রজন্ম থেমে যায়নি।

সামিনের ভাষায়, “অনেক সময় শুধু একটা কার্যকর ভিপিএন খুঁজে পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যায়। শুধু ডিসকর্ডে লগইন করার জন্য আমাদের চ্যানেলগুলোতে যোগ দিতেও অনেক সময়  লাগে।”

“কেউ যদি অনলাইনে না আসে, আমরা ফোন করি। আর কেউ যদি হঠাৎ কলের মাঝখানে চুপ হয়ে যায়, আমাদের বুক কেঁপে ওঠে— ভাবি, না জানি ওটা কোনো বোমার আঘাত ছিল কি না,” যোগ করেন সামিন। 

“আমরা আগের চেয়েও বেশি অনলাইনে থাকি, একে অপরের খোঁজ নেই অবিরত। আমরা সেখানে একসাথে উদযাপন করি জন্মদিন, শুনি ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া মিসাইলের শব্দ, ভাগ করে নিই প্রিয়জন হারানোর কষ্ট।”

“এই ডিজিটাল জগতে আমরা আমাদের ভয়, দুঃখ, লড়াই— সব কিছু শেয়ার করি।”

সামিন বলেন, “বেদনাদায়ক এক পরিবেশ এটা, কিন্তু এর মধ্যেও আমরা খুঁজে পাই আশা, সংহতি আর ভালোবাসা।”

গর্ভাবস্থা, আতঙ্ক ও অদম্যতা: যুদ্ধের মধ্যে ইরানি নারীদের সাহসী লড়াই 
তেহরানে গর্ভবতী নারীদের জন্য চালু হওয়া একটি প্রি-নেটাল যোগব্যায়াম হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ এখন পরিণত হয়েছে অপ্রত্যাশিত এক প্রতিরোধ ও সহমর্মিতার কেন্দ্রবিন্দুতে। রাজধানী থেকে পালাতে না পারা এই গর্ভবতী নারীরা সেখানে এখন শ্বাস-প্রশ্বাসের কৌশল, জরুরি পরামর্শ, ব্ল্যাকআউটের সময় ভয়েস মেসেজ— সবকিছু শেয়ার করছেন একে অপরের সঙ্গে।

আমেনেহ ও তার বন্ধু জোহরেহ উভয়েই পিএইচডি ডিগ্রিধারী এবং যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ডধারী। কয়েক মাস ধরে তারা তাদের মা-বাবার ভিসা অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু সন্তান জন্মদানের জন্য তারা দুজন দুই রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন: জোহরেহ ফিরে যান ইরানে, যাতে পরিবারের সহায়তা পান। আর আমেনেহ থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে, সান ফ্রান্সিসকোতে, নিরাপদে সন্তান জন্ম দেওয়ার আশায়; যদিও একা।

ইসরায়েলে ইরানে টানা বিমান হামলার মধ্যে এই দুই নারীর জীবন ছিন্নভিন্ন হলেও তাদের ডিজিটাল বন্ধন অটুট রয়েছে একটি এনক্রিপ্টেড চ্যাট গ্রুপে, যার নাম ইয়োগা ফর প্রেগন্যান্সি।

জোহরেহ এখন তেহরানে আট মাসের গর্ভবতী। তিনি বলেন, “আমরা একে অপরকে আতঙ্ক সামলাতে শ্বাস-প্রশ্বাসের টেকনিক শিখাই, একসাথে অনলাইনে যোগ ব্যায়াম করি। যখন চারপাশে একটু নীরবতা নামে, তখন সবাই মোমবাতি জ্বালাই, আর ভয়েস নোট পাঠাই।”

তিনি আরো বলেন, “এক রাতে একটা বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। আমার গর্ভে তখন সংকোচন হচ্ছিল। এক বান্ধবী ফোনে গাইড করছিল, কীভাবে শুধু শ্বাস আর হৃদস্পন্দনে মনোযোগ দিলে আতঙ্ক কমে। আরেকবার দীর্ঘক্ষণ বাচ্চার কোনো নড়াচড়া না পেয়ে আমি আতঙ্কিত হই। তখন কেউ বলল, গান চালাও, শরীরে হালকা ম্যাসাজ করো, আবার যোগ ব্যায়াম করো।”

যখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘তেহরান খালি করার’ হুমকি দেন, তখন শহরজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

জোহরেহ বলেন, “আমরা তেহরান ছাড়ার পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু তখনকার ট্রাফিক দেখে এবং আগেভাগেই লেবার শুরু হওয়ার আশঙ্কায় আমি থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই, যাতে অন্তত হাসপাতালে যেতে পারি।”

এই যুদ্ধ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে ইরানিদের প্রতিরোধ ও মানবতা এখন বেঁচে আছে ডিজিটাল জগতে— নীরবে, দৃঢ়তার সঙ্গ আর গভীর মানবিকভাবে।

যখন আকাশ থেকে কোনো আগাম বার্তা আসে না, আর সরকার কোনো আশ্রয় দেয় না; তখনো তারা একে অপরকে খুঁজে নিচ্ছেন একা অন্ধকারের মুখোমুখি না হওয়ার অঙ্গীকারে।

নোট: ১৮ জুন আলজাজিরায় প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। সংবেদনশীলতার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নাম পরিবর্তন করেছে আলজাজিরা।

ঢাকা/রাসেল

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইসর য় ল ব যবহ র কর বলছ ল ন আম দ র র জন য সরক র আতঙ ক ইসর য

এছাড়াও পড়ুন:

ভাসমান পথশিশুদের নিয়ে এলইইডিও-র অন্যরকম আয়োজন

কমলাপুর রেলস্টেশনের ভাঙাচোরা প্ল্যাটফর্মে বোতল কুড়িয়ে কিংবা হাত পেতে খাবার জুটত হাসান আলী মুসাফিরের। বয়স তখন পাঁচ কিংবা ছয়। রাতে স্টেশনের পাশে ঘুমিয়ে থাকলে মাঝে মাঝেই তাড়িয়ে দিত পুলিশ। 

এক রাতে স্টেশনের ইঞ্জিনের ছাদে উঠে পড়ে সে-তার ছোট্ট বন্ধুও সঙ্গে ছিল। বন্ধুকে টানতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায় সে। গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয় কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। চিকিৎসার সময় খোঁজ নেওয়া হয় তার পরিবারের, কিন্তু কোনো সন্ধান মেলে না।

একপর্যায়ে দায়িত্ব নেয় অলাভজনক সংগঠন লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এলইইডিও)। তখন থেকেই তাদের আশ্রয়ে বড় হয় হাসান। এখন নবম শ্রেণির ছাত্র সে। শিখেছে গ্রাফিক ডিজাইনসহ নানা হাতের কাজ। স্বপ্ন-একদিন পুলিশ হয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়াবে।

দুই দশকে ৩০-৩৫ হাজার শিশুর পুনর্বাসন
হাসানের মতো হাজারো শিশুর জীবনের বাঁক ঘুরেছে এলইইডিও-র হাত ধরে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় আড়াই দশকে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার সুবিধাবঞ্চিত ও পরিবারহারা শিশুকে উদ্ধার করে পুনর্বাসনের চেষ্টা করেছে তারা। কেউ কেউ ফিরে গেছে পরিবারের কাছে, আবার কেউ থেকে গেছে সংগঠনের আশ্রয়ে-গড়ে তুলেছে নিজের ভবিষ্যৎ।

গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) এমন ৩০০ শিশু-কিশোরকে নিয়ে আয়োজন করা হয় দিনব্যাপী আনন্দভ্রমণের। স্থান ছিল ঢাকার ধামরাইয়ের মোহাম্মদী গার্ডেন। সকাল থেকে চলেছে চকলেট দৌড়, পিলো পাসিং, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-সব মিলিয়ে উৎসবমুখর এক দিন।

পথ থেকে আশ্রয়ে
এলইইডিওর সংগঠকরা জানান, ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল পাচার, নিখোঁজ ও ভাসমান শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়ন। কর্মীরা প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়ান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। যেসব শিশুর পরিবারের সন্ধান মেলে না, তাদের উদ্ধার করে থানায় সাধারণ ডায়েরি করে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যদি পরিবারের হদিস না মেলে, প্রথমে নেওয়া হয় ‘শেল্টার হোমে’, পরে ‘পিস হোমে’।

ঢাকার কমলাপুর ও কদমতলীতে রয়েছে দুটি শেল্টার হোম, আর ওয়াশপুরে একটি পিস হোম। শেল্টার হোমে প্রায় ২৫ জন ও পিস হোমে প্রায় শতাধিক শিশুর থাকার ব্যবস্থা রযেছে। শেল্টার হোমে থাকা শিশুদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলতে থাকে, ব্যর্থ হলে পাঠানো হয় সরকারি ছোট মনি নিবাসেও। পিস হোমে থাকা শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়, শেখানো হয় বিভিন্ন কারিগরি কাজ।

এছাড়া ঢাকার কদমতলী, সদরঘাট, এয়ারপোর্ট, মিরপুর, কমলাপুর ও তেজগাঁওয়ে ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’ নামে ছয়টি মুক্ত বিদ্যালয় পরিচালনা করছে সংগঠনটি। খোলা আকাশের নিচে বসে পথশিশুরা সেখানে শেখে অক্ষর আর জীবনের নতুন দিশা।

আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পথশিশুরা
‘এলইইডিও’র উদ্যোগে এই শিশুরাই অংশ নিয়েছে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও। ২০২২ সালে কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপে, আর ২০২৩ সালে ভারতে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে। সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলার গৌরবও অর্জন করেছে তারা।

বিশেষ শিশুর গল্প: মালেকা আক্তার
কুড়িগ্রামের রাজারহাট থেকে ট্রেনে উঠে ঢাকায় চলে এসেছিল বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু মালেকা আক্তার। স্মৃতিশক্তি দুর্বল, জন্মগতভাবে এপিলেপসিতে আক্রান্ত। তাকে উদ্ধার করে ‘এলইইডিও’।

এখন সে সংগঠনের পিস হোমে থাকে, স্কুলে যায়। শেখানো হয়েছে সেলাই ও ক্রাফটের কাজ। একসময় হাঁটতেও কষ্ট হতো তার, এখন নিয়মিত চিকিৎসায় অনেকটা সুস্থ। হাসতে হাসতে বলল, “এখানে আমি নিরাপদ, নিজের মতো করে বাঁচতে পারি।”

যে স্কুলে পড়েছেন, এখন সেই স্কুলেই শিক্ষক
মো. নিজাম হোসেনের গল্প যেন এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। রায়েরবাজারের ছেলেটি বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর ঘরহারা হয়। একসময় ভাসমান জীবনে জড়িয়ে পড়ে। ‘এলইইডিও’র কর্মীরা খুঁজে পেয়ে তাকে ভর্তি করান স্কুলে। এরপর পঞ্চম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়।

বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগে পড়ছেন নিজাম। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডের লর্ডস স্টেডিয়ামে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলেছেন। এখন ‘এলইইডিও’র স্ট্রিট স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।

নিজামের ভাষায়, “আমি যে স্কুলে পড়েছি, আজ সেই স্কুলেরই শিক্ষক। এখানে ভাসমান শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে সরকারি স্কুলে ভর্তি করাই।”

তার আঁকা ছবি সংগ্রহ করেছেন ফুটবলার হামজা চৌধুরী, ছাপা হয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ক্যালেন্ডারেও। ভবিষ্যতে জাতিসংঘে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।

দিনভর হাসি, আনন্দ
বিকেলের দিকে মঞ্চে পুরস্কার বিতরণ। মাইকে নাম ঘোষণা হতেই শিশুদের উল্লাস-পিলো পাসিংয়ে কমলাপুরের বিজয়, চকলেট দৌড়ে হাবিবা, পিস হোম থেকে শামীম। মাঠ জুড়ে হাততালি আর হাসি।

প্রতি বছরই এমন আয়োজন করে ‘এলইইডিও’। অংশ নেয় ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’-এর শিক্ষার্থী, শেল্টার ও পিস হোমের শিশুরা।

এদিন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন, বোর্ড সদস্য তুষার আহমেদ ইমরান, এবং ফ্রেন্ডস অব স্ট্রিট চিলড্রেনের চেয়ারম্যান মাইক শেরিফ।

ফরহাদ হোসেন বলেন, “আড়াই দশক ধরে আমরা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে আছি। এবার ৩০০ শিশুকে নিয়ে এসেছি। রাষ্ট্র যদি আমাদের সঙ্গে এগিয়ে আসে, এই শিশুরাই ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের সম্পদ হয়ে উঠবে।”

শেষে সাংস্কৃতিক পর্বে শিশুরা গেয়েছে দেশাত্মবোধক ও জনপ্রিয় গান। অতিথি মাইক শেরিফ গাইলেন ‘আমার হাড় কালা করলাম রে’ শিশুদের করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে পুরো মাঠ। বিকেলের রোদে সবার যৌথ ছবি তোলার মধ্য দিয়ে শেষ হয় উৎসবের দিনটি- ভাসমান শিশুরা ফিরল মুখভরা হাসি নিয়ে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে।

ঢাকা/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভাসমান পথশিশুদের নিয়ে এলইইডিও-র অন্যরকম আয়োজন