চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাজেট ব্যর্থ
Published: 22nd, June 2025 GMT
জুলাই অভ্যুত্থানের পর একটা বড় প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। তবে দেশের চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট। কিছু রাজস্ব পদক্ষেপ বাজেটের মূল প্রতিপাদ্যের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বাজেটে ভৌত অবকাঠামোর পরিবর্তে মানুষের উপর অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এসব লক্ষ্যকে বাস্তবায়নে যথাযথ বরাদ্দ বা পদক্ষেপ নেই। তবে বাজেটে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ রয়েছে। এগুলো হলো কর ছাড়, বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ ও প্রণোদনা এবং ক্ষতিকর কার্যক্রমে উচ্চ কর আরোপ।
আজ রোববার রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) সংলাপে এসব কথা বলা হয়। অনুষ্ঠানে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড.
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জুলাই বিপ্লবের পর সবার মধ্যে একটা বড় পরিবর্তনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিলো। তবে অন্তবর্তী সরকারের বাজেট তা পূরণ হয়নি। বাজেটের মূল দর্শন যাদের বেশি আয় তাদের থেকে বেশি কর নিয়ে তুলনামূলক পিছিয়ে পড়াদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তায় ব্যয় হবে। তবে আমাদের বাজেটের তিন ভাগের দুই ভাগই পরোক্ষ কর।
মূল প্রবন্ধে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া রাজস্ব বাড়বে না। সংস্কারের ক্ষেত্রে একটা সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দরকার। তিনি বলেন, ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেট আকারে ব্যতিক্রম। এটি চলতি অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় ছোট। বাজেটে প্রবৃদ্ধির পরিবর্তে সামগ্রিক উন্নয়নে এবং ভৌত অবকাঠামোর পরিবর্তে মানুষের উপর অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এসব লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ বাজেট বরাদ্দ বা পদক্ষেপ নেই। বাজেটে কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ প্রস্তাব করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে কর ছাড়, বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ ও প্রণোদনা এবং ক্ষতিকর কার্যক্রমে উচ্চ কর আরোপ। তবে, প্রস্তাবিত বাজেট সামগ্রিকভাবে চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারলে জনগণ ও ব্যবসায়ীদের জন্য স্বস্তি আনতে পারত। অন্যদিকে কিছু রাজস্ব পদক্ষেপ বাজেটের মূল প্রতিপাদ্য– ‘একটি সমতাভিত্তিক ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গঠন’ – এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেহেতু ২০২৬ অর্থবছরের বাজেট অনুমোদনের পথে।
তিনি বলেন, সিপিডি বাজেট বাস্তবায়নকে দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করছে। এই প্রেক্ষাপটে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধির জন্য বাজেট বাস্তবায়নের মধ্যমেয়াদি পর্যালোচনা এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনের ব্যবস্থা থাকা দরকার।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাস্তবতার নিরিখে এই বাজেট বড়। তবে অর্থনৈতিক প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। এছাড়াও বাজেটে পরোক্ষ করের উপর নির্ভরশীল। এটি বাজেটের মূলদর্শনের সঙ্গে সাংর্ঘষিক। কারণ, বাজেটের লক্ষ্য সম্পদ পূর্ণবন্টন। অর্থাৎ ধনীদের কাছ থেকে কর নিয়ে গবিবদের দেওয়া হবে। কিন্তু পরোক্ষ কর বাড়লে দরিদ্রদের ওপর করের বোঝা চাপে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
শিক্ষা নিয়ে নাগরিকদের উদ্বেগ আমলে নিন
গত ২ জুন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজেট বক্তৃতায় অতীতের রাজনৈতিক সরকারগুলোর অর্থমন্ত্রীর মতোই দক্ষ, আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। এ জন্য ইউনেস্কোর যে সুপারিশ বাস্তবায়ন প্রয়োজন, তা তিনি মনে রাখেননি। ইউনেস্কোর সুপারিশ জাতীয় বাজেটে জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশ অথবা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ ধারাবাহিকভাবে খরচ হলে একটা দেশ কাঙ্ক্ষিত দক্ষ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সমৃদ্ধ জনশক্তি পাবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী শিক্ষা কাঠামোর জন্য এ বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সংবাদমাধ্যমের খবর, ২০২১-২২ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে জাতীয় আয়ের দুই দশমিক ০৮ শতাংশ ব্যয় বরাদ্দ করা হয়। পরের বছর ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেটি নামিয়ে আনা হয় ১ দশমিক ৮৩ শতাংশে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা আরও হ্রাস করে জাতীয় আয়ের ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ করা হয়। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তা হয়েছে ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অর্থাৎ শিক্ষা খাতে জাতীয় আয়ের ব্যয় বৃদ্ধির পরিবর্তে হ্রাস করার প্রবণতাকেই সরকার ধরে রেখেছে।
এর মধ্যে আরও একটি দুঃসংবাদ জাতির জন্য অপেক্ষা করছে। এ বছরের বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতের মতো খুবই অতি প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় হ্রাস করা হয়েছে। বিগত বছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। বর্তমান বছরে তা হ্রাস করে নিয়ে আসা হয়েছে ৩৫ হাজার ৪০৩ কোটি টাকায়। অথচ গ্রাম ও শহরাঞ্চলের দরিদ্র জনগণের সন্তানরাই সরকারি প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হয়।
প্রায়ই একটি আক্ষেপ প্রাইমারি শিক্ষকদের কাছ থেকে পাওয়া যায়– দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বড় অংশ তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় ভর্তি করছে। এর ফলে সাধারণ শিক্ষাক্রমের প্রাইমারি স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী সংকট দেখা দিয়েছে। অভিভাবকরা সন্তানদের মাদ্রাসায় দেওয়ার প্রতি আগ্রহী হওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণ– সেখানে শিক্ষার্থীদের দুই–আড়াই হাজার টাকার বিনিময়ে তিনবেলা খাবার, বইপত্র, খাতা-কলম দেওয়া হয়। ধর্মীয় শিক্ষা ইহকাল ও পরকালের নিশ্চয়তা দেয়– এমন জোরদার প্রচারণাও আছে।
মাদ্রাসা শিক্ষা শত শত বছর ধরে এ ভূখণ্ডে আছে; ভবিষ্যতেও তা নিশ্চয় থাকবে। তবে একটি দেশের উন্নয়নে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় শিক্ষা মূল শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত না; তা যে ধর্মই হোক না কেন। একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠন এবং আসন্ন চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে হলে সাধারণ ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার বিকল্প নেই। তাই সাধারণ শিক্ষায় সরকারি ব্যয় না বাড়িয়ে অন্তর্বর্তী সরকার তার পূর্বসূরিদের মতো জাতিকে উল্টো দিকে চালিত করছে।
এমনিতেই উচ্চ-মধ্যবিত্ত থেকে ধনিক শ্রেণি তাদের সন্তানদের জন্য ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেছে নিচ্ছে। সেখানে শিক্ষা ব্যয় এতটাই বেশি, নিম্ন-মধ্যবিত্ত এই জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানদের ভর্তি করার কথা কল্পনাই করতে পারে না। উপরন্তু বিষয়বস্তুর দিক থেকে এই শিক্ষাও বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত নয়। এর মধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাদ্রাসার দিকে ঠেলে দিলে তা হবে বাড়তি আশঙ্কার বিষয়। কারণ দুটো ধারার কোনোটিই শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের জন্য সহায়ক নয়। বড় বিষয়, এই দুই ধরনের শিক্ষাতেই মাতৃভাষা বাংলা হয় উপেক্ষিত, নয় সংকুচিত।
শিক্ষা কমিশন গঠন না করার কারণে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
৫ আগস্টের পর দেশের স্কুল-কলেজে যেভাবে শিক্ষকদের হেনস্তা করা হয়েছে, তা একটি ক্ষত হয়ে থাকবে। অটো পাসের দাবি এবং পুরো সেক্টরে বিশৃঙ্খল অবস্থা চলায় বহু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক দেশ ছেড়েছেন। অনেকে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। এই ক্ষত শুকিয়ে কবে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়াবে, তা নিয়ে শঙ্কিত আমরা সবাই।
জাতীয় বাজেটেও এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি যাতে মনে করা যেতে পারে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শিক্ষা খাতে বিশেষ কোনো গুরুত্ব দিয়েছেন। আমরা চাইব, সামনে যখন উপদেষ্টা পরিষদে নতুন বাজেটটি চূড়ান্ত করা হবে তখন এসব উদ্বেগ বিবেচনায় নেওয়া হবে।
রুস্তম আলী খোকন: সদস্য সচিব, জাতীয় শিক্ষা সংস্কৃতি আন্দোলন