প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৬ বছর পর আবার প্রাথমিক স্তরের বৃত্তি পরীক্ষা ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০০৯ সালে পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা চালুর পর থেকে বহুল প্রতীক্ষিত এই বৃত্তি পরীক্ষা বন্ধ ছিল। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বার্ষিক পরীক্ষার পর প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে আলাদাভাবে বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে, যেখানে প্রতি বিদ্যালয় থেকে শীর্ষ সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিতে পারবে। সরকার মনে করছে, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে মেধাবীদের উদ্দীপনা বাড়বে এবং প্রাথমিক শিক্ষায় মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতা ফিরে আসবে। এতে অনেক অভিভাবক সন্তুষ্ট, অন্তত  একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা থাকবে। তাদের অভিযোগ, এতদিন কোনো বড় পরীক্ষা না থাকায় শিশুরা পড়ার টেবিলে বসার অভ্যাস হারাচ্ছিল। 

অন্যদিকে শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের বড় অংশ এই হঠাৎ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাতে পারছে না। ২০২২ সালে ৩০ জন বিশিষ্ট নাগরিক বৃত্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বলেছেন, পুরোনো পদ্ধতির এই বৃত্তি পরীক্ষা চালু হলে শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপ তৈরি হবে এবং সচ্ছল ও অনগ্রসর শিক্ষার্থীদের মধ্যকার বৈষম্য আরও বাড়বে। এই উদ্যোগ জাতীয় শিক্ষানীতির আধুনিক চেতনা ও নতুন পাঠ্যক্রমের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা।

প্রাথমিক স্তরে বৃত্তি পরীক্ষার বিরোধিতায় গবেষণালব্ধ একাধিক কারণ তুলে ধরা যায়। প্রথমত, শিশুমনের ওপর মানসিক চাপ ও আতঙ্ক সৃষ্টির বিষয়টি। শিক্ষাবিদদের মতে, পরীক্ষা শব্দটাই শিশুদের মনে এক প্রকার ভীতি উদ্রেক করে এবং একে জয়-পরাজয়ের লড়াই হিসেবে দেখা হয়, যা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। অনেক শিশু পরীক্ষার পরিবেশ ও ফলাফলের দুশ্চিন্তায় প্রত্যাশিত ভালো ফল করতে পারে না। পরীক্ষার ভয় তাদের মধ্যে তীব্র উদ্বেগ তৈরি করে, যা শেখার আগ্রহ ও আত্মবিশ্বাস দুটোই কমিয়ে দেয়। ইউনেস্কোর বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণায়ও বলা হয়েছে, প্রচলিত লিখিত পরীক্ষার চাপ শিক্ষার্থীদের স্মৃতিধারণ ও শেখার প্রক্রিয়াকে বিপরীতভাবে প্রভাবিত করে। পরীক্ষা ঘিরে সৃষ্ট মানসিক চাপ দীর্ঘ মেয়াদে শেখার কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ এ বয়সে কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার বোঝা শিশুদের মানসিক বিকাশ ও শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যা শিক্ষাবিজ্ঞান সমর্থন করে না।

দ্বিতীয়ত, এ ধরনের বাছাইমূলক পরীক্ষা সামাজিক ও শিক্ষাগত বৈষম্যকে উস্কে দেয় বলে সমালোচকদের অভিমত। সাধারণত শহর বা সম্পদশালী পরিবারের শিশুরা বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে এসব পরীক্ষায় এগিয়ে থাকার প্রবণতা দেখা যায়, অন্যদিকে পিছিয়ে পড়া ও গ্রামীণ এলাকার অনেক মেধাবী শিশু উপযুক্ত নির্দেশনা বা পরিবেশের অভাবে অংশগ্রহণেই নিরুৎসাহিত হয়। বিশিষ্ট নাগরিকদের যৌথ বিবৃতিতেও উল্লেখ করা হয়েছে, এই পরীক্ষা ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বাড়িয়ে দেবে এবং অসচ্ছল শিক্ষার্থীরা আরও পিছিয়ে পড়বে। শিক্ষাবিদদের আশঙ্কা, বৃত্তি পরীক্ষার ফলে বিদ্যালয়গুলোতে কিছু নির্দিষ্ট মেধাবী শিক্ষার্থী ঘিরে আলাদা প্রস্তুতির আয়োজন হবে, আর বাকি সাধারণ শিক্ষার্থীরা উপেক্ষিত হবে। এতে শ্রেণিকক্ষের সার্বিক সহযোগিতামূলক পরিবেশ নষ্ট হয়ে প্রতিযোগিতার বিষাক্ত বাতাবরণ তৈরি হতে পারে।
তৃতীয়ত, শৈশবে পরীক্ষাভিত্তিক প্রতিযোগিতা শেখার চেয়ে মুখস্থ বিদ্যা ও কোচিং-নির্ভরতা বাড়ায়। দীর্ঘ বিরতির পর আকস্মিকভাবে বৃত্তি পরীক্ষা চালু করায় কোচিং সেন্টার ও গাইড বই ব্যবসা আবার মাথাচাড়া দেবে বলে বিশ্লেষকদের উদ্বেগ। অভিভাবকরাও হয়তো সন্তানকে ভালো করতে বাধ্য হয়ে বাড়তি কোচিংয়ে পাঠাবেন, যাতে শিশুর শৈশবের স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হতে পারে। পাশাপাশি বিদ্যালয়গুলোর মধ্যেও কে কত বেশি বৃত্তি পেল, এই নিয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতা শুরু হবে, যা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির চেয়ে সংখ্যাতত্ত্বকেই প্রাধান্য দেবে। নতুন জাতীয় পাঠ্যক্রম যেখানে ক্রমাগত মূল্যায়ন ও শিখনঘনিষ্ঠ মূল্যবোধ গড়ে তোলার ওপর জোর দিচ্ছে, সেখানে পুরোনো ধাঁচের এই পরীক্ষামুখী প্রবণতা সেই সংস্কারমূলক প্রয়াসকে বানচাল করতে পারে। সর্বোপরি প্রাথমিক স্তরের কোমল শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি পরীক্ষার পুনঃপ্রবর্তন মানসিক স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব, শিক্ষাগত বৈষম্য বৃদ্ধি এবং শিক্ষা ব্যবস্থাকে আবার মুখস্থ বিদ্যাকেন্দ্রিক সংকীর্ণ পথে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করবে বলে গবেষক ও শিক্ষাবিদরা সতর্ক করেছেন। 

মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাছাই ও প্রণোদনা দেওয়ার উদ্দেশ্য সাধনে পরীক্ষাভিত্তিক বৃত্তি প্রক্রিয়া ছাড়া অন্য গঠনমূলক উপায়ও রয়েছে। পুরো বছরের বিভিন্ন পরীক্ষণ, ক্লাস অ্যাসাইনমেন্ট, প্রকল্প ও উপস্থাপনার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীর সামগ্রিক মূল্যায়ন করা যেতে পারে। তা ছাড়া প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকরা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর শক্তি, দুর্বলতা ও সম্ভাবনা সবচেয়ে ভালো জানেন। প্রতিটি বিদ্যালয় থেকে অভিজ্ঞ শিক্ষকরা তাদের পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ডের ভিত্তিতে সত্যিকার মেধাবী এবং পরিশ্রমী শিক্ষার্থীদের একটি তালিকা প্রস্তাব করতে পারেন। শ্রেণিশিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকের যৌথ সুপারিশের ভিত্তিতে উপজেলা বা জেলা পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তারা সেই শিক্ষার্থীদের বৃত্তির জন্য বিবেচনা করতে পারেন। 

মেধার বিকাশে পরীক্ষা ছাড়াও অনেক বিকল্প পদ্ধতি রয়েছে। যেমন কুইজ প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞান মেলা, গণিত অলিম্পিয়াড বা রচনা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মেধাবীদের চিহ্নিত করা যায়। এসব আয়োজনে শিশুদের মধ্যে চাপ না দিয়ে খেলার ছলে শেখার প্রবণতা বেড়ে যায় এবং প্রকৃত প্রতিভা উন্মেষের সুযোগ পায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় অঞ্চলভিত্তিক এমন সৃজনশীল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে সেরা প্রতিভাধরদের পুরস্কৃত ও শিক্ষাবৃত্তি দিতে পারে। এতে যারা সত্যিকার অর্থে সৃজনশীল ও মেধাবী, তারা স্বীকৃতি পাবে, আবার নিয়মিত পড়ালেখার ধারা থেকেও বিচ্যুত হতে হবে না।
ইতোমধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন নতুন উদ্যোগ, যেমন ধারাবাহিক মূল্যায়ন, প্রকল্পভিত্তিক শিখন শুরু হয়েছে। তাই বৃত্তি দেওয়ার জন্যও এ ধরনের মূল্যায়ন ব্যবস্থাকে কাজে লাগানো গেলে শিশুদের অতিরিক্ত পরীক্ষাভীতি ছাড়া স্বাভাবিক শেখার পরিবেশে মেধা অন্বেষণ করা যাবে।

মো.

সাব্বির হোসেন: শিক্ষাপ্রযুক্তি 
বিশেষজ্ঞ এবং সহকারী অধ্যাপক, 
শিক্ষা, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
sabbir.ict@bou.ac.bd 
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শ ক ষ ব যবস থ পর ক ষ র ক পর ক ষ র জন য প রক র পর ব শ র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা পুনঃপ্রবর্তন কেন

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৬ বছর পর আবার প্রাথমিক স্তরের বৃত্তি পরীক্ষা ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০০৯ সালে পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা চালুর পর থেকে বহুল প্রতীক্ষিত এই বৃত্তি পরীক্ষা বন্ধ ছিল। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বার্ষিক পরীক্ষার পর প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে আলাদাভাবে বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে, যেখানে প্রতি বিদ্যালয় থেকে শীর্ষ সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিতে পারবে। সরকার মনে করছে, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে মেধাবীদের উদ্দীপনা বাড়বে এবং প্রাথমিক শিক্ষায় মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতা ফিরে আসবে। এতে অনেক অভিভাবক সন্তুষ্ট, অন্তত  একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা থাকবে। তাদের অভিযোগ, এতদিন কোনো বড় পরীক্ষা না থাকায় শিশুরা পড়ার টেবিলে বসার অভ্যাস হারাচ্ছিল। 

অন্যদিকে শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের বড় অংশ এই হঠাৎ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাতে পারছে না। ২০২২ সালে ৩০ জন বিশিষ্ট নাগরিক বৃত্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বলেছেন, পুরোনো পদ্ধতির এই বৃত্তি পরীক্ষা চালু হলে শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপ তৈরি হবে এবং সচ্ছল ও অনগ্রসর শিক্ষার্থীদের মধ্যকার বৈষম্য আরও বাড়বে। এই উদ্যোগ জাতীয় শিক্ষানীতির আধুনিক চেতনা ও নতুন পাঠ্যক্রমের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা।

প্রাথমিক স্তরে বৃত্তি পরীক্ষার বিরোধিতায় গবেষণালব্ধ একাধিক কারণ তুলে ধরা যায়। প্রথমত, শিশুমনের ওপর মানসিক চাপ ও আতঙ্ক সৃষ্টির বিষয়টি। শিক্ষাবিদদের মতে, পরীক্ষা শব্দটাই শিশুদের মনে এক প্রকার ভীতি উদ্রেক করে এবং একে জয়-পরাজয়ের লড়াই হিসেবে দেখা হয়, যা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। অনেক শিশু পরীক্ষার পরিবেশ ও ফলাফলের দুশ্চিন্তায় প্রত্যাশিত ভালো ফল করতে পারে না। পরীক্ষার ভয় তাদের মধ্যে তীব্র উদ্বেগ তৈরি করে, যা শেখার আগ্রহ ও আত্মবিশ্বাস দুটোই কমিয়ে দেয়। ইউনেস্কোর বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণায়ও বলা হয়েছে, প্রচলিত লিখিত পরীক্ষার চাপ শিক্ষার্থীদের স্মৃতিধারণ ও শেখার প্রক্রিয়াকে বিপরীতভাবে প্রভাবিত করে। পরীক্ষা ঘিরে সৃষ্ট মানসিক চাপ দীর্ঘ মেয়াদে শেখার কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ এ বয়সে কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার বোঝা শিশুদের মানসিক বিকাশ ও শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যা শিক্ষাবিজ্ঞান সমর্থন করে না।

দ্বিতীয়ত, এ ধরনের বাছাইমূলক পরীক্ষা সামাজিক ও শিক্ষাগত বৈষম্যকে উস্কে দেয় বলে সমালোচকদের অভিমত। সাধারণত শহর বা সম্পদশালী পরিবারের শিশুরা বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে এসব পরীক্ষায় এগিয়ে থাকার প্রবণতা দেখা যায়, অন্যদিকে পিছিয়ে পড়া ও গ্রামীণ এলাকার অনেক মেধাবী শিশু উপযুক্ত নির্দেশনা বা পরিবেশের অভাবে অংশগ্রহণেই নিরুৎসাহিত হয়। বিশিষ্ট নাগরিকদের যৌথ বিবৃতিতেও উল্লেখ করা হয়েছে, এই পরীক্ষা ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বাড়িয়ে দেবে এবং অসচ্ছল শিক্ষার্থীরা আরও পিছিয়ে পড়বে। শিক্ষাবিদদের আশঙ্কা, বৃত্তি পরীক্ষার ফলে বিদ্যালয়গুলোতে কিছু নির্দিষ্ট মেধাবী শিক্ষার্থী ঘিরে আলাদা প্রস্তুতির আয়োজন হবে, আর বাকি সাধারণ শিক্ষার্থীরা উপেক্ষিত হবে। এতে শ্রেণিকক্ষের সার্বিক সহযোগিতামূলক পরিবেশ নষ্ট হয়ে প্রতিযোগিতার বিষাক্ত বাতাবরণ তৈরি হতে পারে।
তৃতীয়ত, শৈশবে পরীক্ষাভিত্তিক প্রতিযোগিতা শেখার চেয়ে মুখস্থ বিদ্যা ও কোচিং-নির্ভরতা বাড়ায়। দীর্ঘ বিরতির পর আকস্মিকভাবে বৃত্তি পরীক্ষা চালু করায় কোচিং সেন্টার ও গাইড বই ব্যবসা আবার মাথাচাড়া দেবে বলে বিশ্লেষকদের উদ্বেগ। অভিভাবকরাও হয়তো সন্তানকে ভালো করতে বাধ্য হয়ে বাড়তি কোচিংয়ে পাঠাবেন, যাতে শিশুর শৈশবের স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হতে পারে। পাশাপাশি বিদ্যালয়গুলোর মধ্যেও কে কত বেশি বৃত্তি পেল, এই নিয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতা শুরু হবে, যা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির চেয়ে সংখ্যাতত্ত্বকেই প্রাধান্য দেবে। নতুন জাতীয় পাঠ্যক্রম যেখানে ক্রমাগত মূল্যায়ন ও শিখনঘনিষ্ঠ মূল্যবোধ গড়ে তোলার ওপর জোর দিচ্ছে, সেখানে পুরোনো ধাঁচের এই পরীক্ষামুখী প্রবণতা সেই সংস্কারমূলক প্রয়াসকে বানচাল করতে পারে। সর্বোপরি প্রাথমিক স্তরের কোমল শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি পরীক্ষার পুনঃপ্রবর্তন মানসিক স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব, শিক্ষাগত বৈষম্য বৃদ্ধি এবং শিক্ষা ব্যবস্থাকে আবার মুখস্থ বিদ্যাকেন্দ্রিক সংকীর্ণ পথে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করবে বলে গবেষক ও শিক্ষাবিদরা সতর্ক করেছেন। 

মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাছাই ও প্রণোদনা দেওয়ার উদ্দেশ্য সাধনে পরীক্ষাভিত্তিক বৃত্তি প্রক্রিয়া ছাড়া অন্য গঠনমূলক উপায়ও রয়েছে। পুরো বছরের বিভিন্ন পরীক্ষণ, ক্লাস অ্যাসাইনমেন্ট, প্রকল্প ও উপস্থাপনার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীর সামগ্রিক মূল্যায়ন করা যেতে পারে। তা ছাড়া প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকরা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর শক্তি, দুর্বলতা ও সম্ভাবনা সবচেয়ে ভালো জানেন। প্রতিটি বিদ্যালয় থেকে অভিজ্ঞ শিক্ষকরা তাদের পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ডের ভিত্তিতে সত্যিকার মেধাবী এবং পরিশ্রমী শিক্ষার্থীদের একটি তালিকা প্রস্তাব করতে পারেন। শ্রেণিশিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকের যৌথ সুপারিশের ভিত্তিতে উপজেলা বা জেলা পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তারা সেই শিক্ষার্থীদের বৃত্তির জন্য বিবেচনা করতে পারেন। 

মেধার বিকাশে পরীক্ষা ছাড়াও অনেক বিকল্প পদ্ধতি রয়েছে। যেমন কুইজ প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞান মেলা, গণিত অলিম্পিয়াড বা রচনা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মেধাবীদের চিহ্নিত করা যায়। এসব আয়োজনে শিশুদের মধ্যে চাপ না দিয়ে খেলার ছলে শেখার প্রবণতা বেড়ে যায় এবং প্রকৃত প্রতিভা উন্মেষের সুযোগ পায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় অঞ্চলভিত্তিক এমন সৃজনশীল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে সেরা প্রতিভাধরদের পুরস্কৃত ও শিক্ষাবৃত্তি দিতে পারে। এতে যারা সত্যিকার অর্থে সৃজনশীল ও মেধাবী, তারা স্বীকৃতি পাবে, আবার নিয়মিত পড়ালেখার ধারা থেকেও বিচ্যুত হতে হবে না।
ইতোমধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন নতুন উদ্যোগ, যেমন ধারাবাহিক মূল্যায়ন, প্রকল্পভিত্তিক শিখন শুরু হয়েছে। তাই বৃত্তি দেওয়ার জন্যও এ ধরনের মূল্যায়ন ব্যবস্থাকে কাজে লাগানো গেলে শিশুদের অতিরিক্ত পরীক্ষাভীতি ছাড়া স্বাভাবিক শেখার পরিবেশে মেধা অন্বেষণ করা যাবে।

মো. সাব্বির হোসেন: শিক্ষাপ্রযুক্তি 
বিশেষজ্ঞ এবং সহকারী অধ্যাপক, 
শিক্ষা, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
sabbir.ict@bou.ac.bd 
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ