প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৬ বছর পর আবার প্রাথমিক স্তরের বৃত্তি পরীক্ষা ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০০৯ সালে পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা চালুর পর থেকে বহুল প্রতীক্ষিত এই বৃত্তি পরীক্ষা বন্ধ ছিল। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বার্ষিক পরীক্ষার পর প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে আলাদাভাবে বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে, যেখানে প্রতি বিদ্যালয় থেকে শীর্ষ সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিতে পারবে। সরকার মনে করছে, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে মেধাবীদের উদ্দীপনা বাড়বে এবং প্রাথমিক শিক্ষায় মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতা ফিরে আসবে। এতে অনেক অভিভাবক সন্তুষ্ট, অন্তত  একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা থাকবে। তাদের অভিযোগ, এতদিন কোনো বড় পরীক্ষা না থাকায় শিশুরা পড়ার টেবিলে বসার অভ্যাস হারাচ্ছিল। 

অন্যদিকে শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের বড় অংশ এই হঠাৎ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাতে পারছে না। ২০২২ সালে ৩০ জন বিশিষ্ট নাগরিক বৃত্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বলেছেন, পুরোনো পদ্ধতির এই বৃত্তি পরীক্ষা চালু হলে শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপ তৈরি হবে এবং সচ্ছল ও অনগ্রসর শিক্ষার্থীদের মধ্যকার বৈষম্য আরও বাড়বে। এই উদ্যোগ জাতীয় শিক্ষানীতির আধুনিক চেতনা ও নতুন পাঠ্যক্রমের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা।

প্রাথমিক স্তরে বৃত্তি পরীক্ষার বিরোধিতায় গবেষণালব্ধ একাধিক কারণ তুলে ধরা যায়। প্রথমত, শিশুমনের ওপর মানসিক চাপ ও আতঙ্ক সৃষ্টির বিষয়টি। শিক্ষাবিদদের মতে, পরীক্ষা শব্দটাই শিশুদের মনে এক প্রকার ভীতি উদ্রেক করে এবং একে জয়-পরাজয়ের লড়াই হিসেবে দেখা হয়, যা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। অনেক শিশু পরীক্ষার পরিবেশ ও ফলাফলের দুশ্চিন্তায় প্রত্যাশিত ভালো ফল করতে পারে না। পরীক্ষার ভয় তাদের মধ্যে তীব্র উদ্বেগ তৈরি করে, যা শেখার আগ্রহ ও আত্মবিশ্বাস দুটোই কমিয়ে দেয়। ইউনেস্কোর বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণায়ও বলা হয়েছে, প্রচলিত লিখিত পরীক্ষার চাপ শিক্ষার্থীদের স্মৃতিধারণ ও শেখার প্রক্রিয়াকে বিপরীতভাবে প্রভাবিত করে। পরীক্ষা ঘিরে সৃষ্ট মানসিক চাপ দীর্ঘ মেয়াদে শেখার কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ এ বয়সে কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার বোঝা শিশুদের মানসিক বিকাশ ও শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যা শিক্ষাবিজ্ঞান সমর্থন করে না।

দ্বিতীয়ত, এ ধরনের বাছাইমূলক পরীক্ষা সামাজিক ও শিক্ষাগত বৈষম্যকে উস্কে দেয় বলে সমালোচকদের অভিমত। সাধারণত শহর বা সম্পদশালী পরিবারের শিশুরা বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে এসব পরীক্ষায় এগিয়ে থাকার প্রবণতা দেখা যায়, অন্যদিকে পিছিয়ে পড়া ও গ্রামীণ এলাকার অনেক মেধাবী শিশু উপযুক্ত নির্দেশনা বা পরিবেশের অভাবে অংশগ্রহণেই নিরুৎসাহিত হয়। বিশিষ্ট নাগরিকদের যৌথ বিবৃতিতেও উল্লেখ করা হয়েছে, এই পরীক্ষা ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বাড়িয়ে দেবে এবং অসচ্ছল শিক্ষার্থীরা আরও পিছিয়ে পড়বে। শিক্ষাবিদদের আশঙ্কা, বৃত্তি পরীক্ষার ফলে বিদ্যালয়গুলোতে কিছু নির্দিষ্ট মেধাবী শিক্ষার্থী ঘিরে আলাদা প্রস্তুতির আয়োজন হবে, আর বাকি সাধারণ শিক্ষার্থীরা উপেক্ষিত হবে। এতে শ্রেণিকক্ষের সার্বিক সহযোগিতামূলক পরিবেশ নষ্ট হয়ে প্রতিযোগিতার বিষাক্ত বাতাবরণ তৈরি হতে পারে।
তৃতীয়ত, শৈশবে পরীক্ষাভিত্তিক প্রতিযোগিতা শেখার চেয়ে মুখস্থ বিদ্যা ও কোচিং-নির্ভরতা বাড়ায়। দীর্ঘ বিরতির পর আকস্মিকভাবে বৃত্তি পরীক্ষা চালু করায় কোচিং সেন্টার ও গাইড বই ব্যবসা আবার মাথাচাড়া দেবে বলে বিশ্লেষকদের উদ্বেগ। অভিভাবকরাও হয়তো সন্তানকে ভালো করতে বাধ্য হয়ে বাড়তি কোচিংয়ে পাঠাবেন, যাতে শিশুর শৈশবের স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হতে পারে। পাশাপাশি বিদ্যালয়গুলোর মধ্যেও কে কত বেশি বৃত্তি পেল, এই নিয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতা শুরু হবে, যা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির চেয়ে সংখ্যাতত্ত্বকেই প্রাধান্য দেবে। নতুন জাতীয় পাঠ্যক্রম যেখানে ক্রমাগত মূল্যায়ন ও শিখনঘনিষ্ঠ মূল্যবোধ গড়ে তোলার ওপর জোর দিচ্ছে, সেখানে পুরোনো ধাঁচের এই পরীক্ষামুখী প্রবণতা সেই সংস্কারমূলক প্রয়াসকে বানচাল করতে পারে। সর্বোপরি প্রাথমিক স্তরের কোমল শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি পরীক্ষার পুনঃপ্রবর্তন মানসিক স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব, শিক্ষাগত বৈষম্য বৃদ্ধি এবং শিক্ষা ব্যবস্থাকে আবার মুখস্থ বিদ্যাকেন্দ্রিক সংকীর্ণ পথে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করবে বলে গবেষক ও শিক্ষাবিদরা সতর্ক করেছেন। 

মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাছাই ও প্রণোদনা দেওয়ার উদ্দেশ্য সাধনে পরীক্ষাভিত্তিক বৃত্তি প্রক্রিয়া ছাড়া অন্য গঠনমূলক উপায়ও রয়েছে। পুরো বছরের বিভিন্ন পরীক্ষণ, ক্লাস অ্যাসাইনমেন্ট, প্রকল্প ও উপস্থাপনার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীর সামগ্রিক মূল্যায়ন করা যেতে পারে। তা ছাড়া প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকরা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর শক্তি, দুর্বলতা ও সম্ভাবনা সবচেয়ে ভালো জানেন। প্রতিটি বিদ্যালয় থেকে অভিজ্ঞ শিক্ষকরা তাদের পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ডের ভিত্তিতে সত্যিকার মেধাবী এবং পরিশ্রমী শিক্ষার্থীদের একটি তালিকা প্রস্তাব করতে পারেন। শ্রেণিশিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকের যৌথ সুপারিশের ভিত্তিতে উপজেলা বা জেলা পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তারা সেই শিক্ষার্থীদের বৃত্তির জন্য বিবেচনা করতে পারেন। 

মেধার বিকাশে পরীক্ষা ছাড়াও অনেক বিকল্প পদ্ধতি রয়েছে। যেমন কুইজ প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞান মেলা, গণিত অলিম্পিয়াড বা রচনা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মেধাবীদের চিহ্নিত করা যায়। এসব আয়োজনে শিশুদের মধ্যে চাপ না দিয়ে খেলার ছলে শেখার প্রবণতা বেড়ে যায় এবং প্রকৃত প্রতিভা উন্মেষের সুযোগ পায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় অঞ্চলভিত্তিক এমন সৃজনশীল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে সেরা প্রতিভাধরদের পুরস্কৃত ও শিক্ষাবৃত্তি দিতে পারে। এতে যারা সত্যিকার অর্থে সৃজনশীল ও মেধাবী, তারা স্বীকৃতি পাবে, আবার নিয়মিত পড়ালেখার ধারা থেকেও বিচ্যুত হতে হবে না।
ইতোমধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন নতুন উদ্যোগ, যেমন ধারাবাহিক মূল্যায়ন, প্রকল্পভিত্তিক শিখন শুরু হয়েছে। তাই বৃত্তি দেওয়ার জন্যও এ ধরনের মূল্যায়ন ব্যবস্থাকে কাজে লাগানো গেলে শিশুদের অতিরিক্ত পরীক্ষাভীতি ছাড়া স্বাভাবিক শেখার পরিবেশে মেধা অন্বেষণ করা যাবে।

মো.

সাব্বির হোসেন: শিক্ষাপ্রযুক্তি 
বিশেষজ্ঞ এবং সহকারী অধ্যাপক, 
শিক্ষা, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
sabbir.ict@bou.ac.bd 
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শ ক ষ ব যবস থ পর ক ষ র ক পর ক ষ র জন য প রক র পর ব শ র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

ডাকসু–জাকুসতে জিতে কি জামায়াত–শিবির রাজনীতিতে হারল

ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের অভূতপূর্ব ফলের কারণ এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আলোচনার মধ্যেই কিছু প্রশ্ন উঠে আসা জরুরি—স্বল্পমেয়াদি অর্জনের জন্য জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির কি দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি নিল? ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবির জিতল, কিন্তু তারা কি রাজনীতিতে হারল?

ছাত্রশিবির তো নিজ নামে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, তাই তারা যা যা করেছে, সেগুলোর দায় পুরোপুরি ছাত্রশিবিরকে দেওয়া যাবে না—এই নিবন্ধের আলোচনায় এ-জাতীয় অহেতুক আলাপকে বিবেচনায় রাখা হয়নি। 

ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখে ছাত্রশিবিরের ৩৬ দফা ইশতেহার মূলত ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক মান বাড়ানোসহ ক্যাম্পাসে ছাত্রদের জন্য নানা রকম কল্যাণমুখী পদক্ষেপকে ভিত্তি করে। অথচ ছাত্রশিবিরের গঠনতন্ত্রের প্রস্তাবনার পুরোটাই ইসলামে বিশ্বাস এবং সেটা প্রতিষ্ঠিত করা-সংক্রান্ত। এ ছাড়া দেখে নেওয়া যাক গঠনতন্ত্রের কিছু অংশ—

আরও পড়ুনডাকসুতে ছাত্রদলের হার—বিএনপিকে যা ভাবতে হবে১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য: এই সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুল (সা.) প্রদর্শিত বিধান অনুযায়ী মানুষের সার্বিক জীবনের পুনর্বিন্যাস সাধন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।

কর্মসূচি: ১. তরুণ ছাত্রসমাজের কাছে ইসলামের আহ্বান পৌঁছে তাদের মধ্যে ইসলামিক জ্ঞান অর্জন এবং বাস্তব জীবনে ইসলামের পূর্ণ অনুশীলনের দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করা; ২. যেসব ছাত্র ইসলামি জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশ নিতে প্রস্তুত, তাদের সংগঠনের অধীন সংঘবদ্ধ করা; ৩. এই সংগঠনের অধীন সংঘবদ্ধ ছাত্রদের ইসলামি জ্ঞান প্রদান এবং আদর্শ চরিত্রবান রূপে গড়ে তুলে জাহেলিয়াতের সমস্ত চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী হিসেবে গড়ার কার্যকর ব্যবস্থা করা; ৪. আদর্শ নাগরিক তৈরির উদ্দেশ্যে ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে সংগ্রাম এবং ছাত্রসমাজের প্রকৃত সমস্যা সমাধানের সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান; ৫. অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক গোলামি থেকে মানবতার মুক্তির জন্য ইসলামি সমাজ বিনির্মাণে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো।

বলা বাহুল্য, এসব লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচির কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি ইশতেহারে। এটা একেবারেই স্পষ্ট—ছাত্রশিবির তাদের সংগঠনের নামের পাশে থাকা ‘ইসলাম’ নিয়ে অন্তত খুব বেশি ভাবছে না। 

আরও পড়ুনডাকসুর কী প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়তে যাচ্ছে১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের প্রার্থী বাছাই বেশ আলোচিত ছিল। একজন অমুসলিম (চাকমা) প্রার্থী এবং হিজাব করেন না—এমন একজন নারী প্রার্থী অনেকের কাছেই চমক হিসেবে এসেছে। এমনকি একটি সংবাদ সম্মেলনে ভিপি ও জিএস প্রার্থীর মধ্যে সেই নারী প্রার্থীকে বসিয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে।

শুধু তা-ই নয়, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থীকে দেখা গেছে হিজাব পরিধান করছেন না—এমন নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে এমনভাবে চলাফেরা করছেন, যেটা আগে ছাত্রশিবিরের নেতাদের ক্ষেত্রে দেখা যেত না। শুধু সেটাই নয়, পোশাক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ছাত্রশিবিরের কর্মী-সদস্যরা যেভাবে ইসলামের অনুশাসন মেনে চলেন, সেটাও অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।

ছাত্রশিবিরের যে গঠনতন্ত্র আছে, তাতে একজন সদস্য এটা করতে পারেন কি না—এ প্রশ্ন আসবেই। গঠনতন্ত্রে সদস্যদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘...তাঁর জীবনে ইসলাম নির্ধারিত ফরজ ও ওয়াজিবসমূহ যথাযথভাবে পালন করেন, কবিরা গুনাহসমূহ থেকে দূরে থাকেন এবং সংগঠনের লক্ষ্য ও কর্মসূচির বিপরীত কোনো সংস্থার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রাখেন, তাহলে তিনি এ সংগঠনের সদস্যপদ লাভ করতে পারেন।’ 

অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলগুলো এমন সব কৌশল অবলম্বন করে, যেটা তাদের দলের নীতি-আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়। সেটা গ্রহণ করার একধরনের মানসিকতা আমাদের মতো দেশের নাগরিকদের মধ্যে থাকে। তবে এ কথা অন্য সব রাজনৈতিক দলের জন্য প্রযোজ্য হলেও আদর্শভিত্তিক (বিশেষ করে ইসলামিক) রাজনৈতিক দলের জন্য বিষয়টা এত সরল নয়। 

নানা দিকে ছাত্রশিবিরের এই নির্বাচনী কৌশল খুবই প্রশংসিত হয়েছে। অনেকেই বলছেন, এর মাধ্যমে ছাত্রশিবির অনেকটা লিবারেল রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রদর্শন করেছে, যা স্বাগত জানানো উচিত। নির্বাচন কৌশলের খেলা, সন্দেহ নেই।

অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলগুলো এমন সব কৌশল অবলম্বন করে, যেটা তাদের দলের নীতি-আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়। সেটা গ্রহণ করার একধরনের মানসিকতা আমাদের মতো দেশের নাগরিকদের মধ্যে থাকে। তবে এ কথা অন্য সব রাজনৈতিক দলের জন্য প্রযোজ্য হলেও আদর্শভিত্তিক (বিশেষ করে ইসলামিক) রাজনৈতিক দলের জন্য বিষয়টা এত সরল নয়। 

আর সব ধর্মের মতো ইসলামেরও নানা রকম ‘স্কুল অব থট’ আছে। সাংবিধানিক ধারায় রাজনীতি করা ইসলামি দলগুলোর মধ্যেও চিন্তাগত দুস্তর ব্যবধান আছে। এ ছাড়া এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ইসলাম থেকে পুরোপুরি খারিজ করে দেওয়ার প্রবণতাও রয়েছে।

আরও পড়ুনডাকসু-জাকসুতে শিবির জিতেছে, বাকিরা কি জিততে চেয়েছে১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কিন্তু কোনো একটি ইসলামি দল যখন ধর্মের ব্যাপারে তার অবস্থান নির্দিষ্ট করে ফেলে, তখন সেটা থেকে খুব বেশি বিচ্যুতি বড় প্রশ্ন তৈরি করবে। যেমন জামায়াতে ইসলামীর বক্তব্য অনুযায়ী তাদের মতবাদ মানবরচিত নয়। সুতরাং একটা মানবরচিত মতবাদের দলের গঠনতন্ত্র ও অন্যান্য আচরণ ভাঙা যতটা প্রশ্ন তৈরি করার কথা, ইসলামের অনুশাসনকেই একমাত্র ভিত্তি করে তোলা জামায়াতে ইসলামী কিংবা ছাত্রশিবিরের একই কাজ করা অনেক বেশি কঠোর প্রশ্ন তৈরি করবে।

বাংলাদেশের মানুষের জীবনে ধর্ম একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। অনেক মানুষের মধ্যেই ব্যক্তিজীবনে ইসলামি জীবনবিধান মেনে সচ্চরিত্রবান হবার প্রবণতা খুব বেশি না থাকলেও ধর্মের আচার ও ধর্মের অনুভূতি নিয়ে বেশ সংবেদনশীলতা আছে। সেই বিবেচনায় ইসলামি দলগুলো বাংলাদেশের নির্বাচনে ভালো ফল করার কথা ছিল। কিন্তু যে কারও এ ধরনের যৌক্তিক অনুমানের বিরুদ্ধে গিয়ে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মানুষ এই ধারার রাজনীতিকে বরং প্রত্যাখ্যান করেছে। 

শেখ হাসিনার সময়ে দেশে অন্তত তিনটি নির্বাচন হয়নি। ফলে জনগণের ভোট দেওয়ার প্রবণতা আমরা বুঝতে পারিনি। কিন্তু রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এই আলোচনা আছে, এই সময়টাতে দেশের মানুষের ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা বেড়েছে। ফলে ইসলামি রাজনৈতিক দলের ভোট অনেক বাড়বে।

আরও পড়ুনডাকসুতে ছাত্রদলের হার—বিএনপিকে যা ভাবতে হবে১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

যেকোনো বিবেচনায় ডাকসু বা জাকসু নির্বাচন দেশের জাতীয় নির্বাচনের ভোট দেওয়ার প্রবণতার প্রতিনিধিত্ব করে না। তারপরও এই নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় নির্বাচনকে কতটা প্রভাবিত করবে, সেই আলোচনা-বিশ্লেষণ চলমান।

অনেকে অনুমান করছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ভালো ফল অনেককে চমকে দিতে পারে। ওপরে উল্লেখিত দুই ছাত্র সংসদের নির্বাচনের পরপরই ব্যবসায়ী নেতাদের জামায়াতের আমিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে অনেকে এ প্রবণতার পূর্বাভাস হিসেবেই দেখতে চান।

জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী কতটা ভালো বা কতটা খারাপ ফল করবে, সেটা এই নিবন্ধে বিশ্লেষণের বিষয় নয়।

তবে এটা যৌক্তিকভাবেই অনুমান করা যায়, ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ফলাফলের পর জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী জনগণের সামনে ছাত্র সংসদগুলোর মতো একই ধরনের কল্যাণমুখী পদক্ষেপকে সামনে নিয়ে আসবে। তাদের ইশতেহার ও প্রচারণায় ধর্ম নিয়ে ‘পবিত্র কোরআন-সুন্নাহর বাইরে কোনো আইন প্রণয়ন হবে না’—এমন দায়সারা গোছের বক্তব্যের (বিএনপি বা আওয়ামী লীগও এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছে) চেয়ে খুব বেশি কিছু থাকবে না।

আরও পড়ুনডাকসু ও জাকসু: জাতীয় নির্বাচনে কী করবে এনসিপি১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

অথচ দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা মাঝেমধ্যেই বলছেন, ক্ষমতায় গেলে তাঁরা শরিয়াহ আইন কায়েম করবেন। মুখে যা-ই বলুন না কেন, জামায়াতে ইসলামীর নেতারা এটা সম্ভবত বিশ্বাস করেন না, এ নির্বাচনেই তাঁরা জিতে ক্ষমতায় যাবেন। কিন্তু তাঁদের মুখে এমন বক্তব্য এবং এমন শরীরী ভাষা দেখা, যা তাঁদের নির্বাচনে খুবই ভালো করার আত্মবিশ্বাস প্রদর্শন করে।

আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে, এটাই ছিল মোক্ষম সময়, যখন জামায়াতে ইসলামী তাদের শরিয়াহর রূপরেখা জনগণের সামনে আনবে এবং সেটাকেই তাদের প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি করে তুলবে। এখন পর্যন্ত অন্তত সেই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। 

দুটি ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রশিবির অভাবনীয় সাফল্য পেলেও সেটা তাদের রাজনীতির মাধ্যমে হয়নি। তারা তাদের এমনভাবে পরিবর্তন করছে, যেটা আসলে ভোটের মাঠের বাস্তবতা এবং চাহিদা। তারা নির্বাচনে জিতলেও পরাজিত হয়েছে তাদের রাজনীতি। ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো প্রমাণ করল, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এখনো মধ্যপন্থী কল্যাণমুখী রাজনীতি চায়; ধর্মভিত্তিক পরিচয়বাদী রাজনীতি তারা আগের মতোই প্রত্যাখ্যান করে।

আরও পড়ুনডাকসু নির্বাচন, ফলাফল ও তরুণ মনের চাওয়া১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এই নিবন্ধের আলাপ এখানেই শেষ। কিন্তু একটা নতুন প্রশ্ন করে রাখতে চাই পরবর্তী আলোচনার জন্য। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি দেখলে মনে হয়, তাদের গঠনতন্ত্রে যা-ই লেখা থাকুক না কেন, তারা বেশ খানিকটা বিএনপি হয়ে উঠছে। তাহলে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কেমন হওয়া উচিত বিএনপির রাজনীতি?

জাহেদ উর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

* মতামত লেখকের নিজস্ব

[২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে প্রথম আলোর ছাপা সংস্করণে এ লেখা ‘ডাকসুতে জিতে কি জামায়াত–শিবির আদতে হারল’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।]

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ডাকসু–জাকুসতে জিতে কি জামায়াত–শিবির রাজনীতিতে হারল