আমাদের নবীজি (সা.) যে সময়টাতে পৃথিবীতে এসেছিলেন, সেই সময়টা ছিল আরবের সাহিত্যের যুগ। কবিতার জন্য এতটা উন্মাদ জাতি খুব বেশি আসেনি পৃথিবীতে। ওকাজের মেলায় কাব্য প্রতিযোগিতার আসর বসত। বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতাকে মিশরীয় বস্ত্রে সোনার পানিতে লিখে ঝুলিয়ে রাখা হতো কাবার দেয়ালে। যত দিন না এর চেয়ে উৎকৃষ্ট মানের কোনো কবিতা কেউ লিখতে পারছেন, তত দিন সেই কাবিতাটিই দখল করে থাকত কাবার দেয়াল।

কবিতার প্রতি আরবদের এই অন্ধ ভালোবাসা ও পক্ষপাতিত্ব দেখে এক পারস্য মনীষী বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, আরবদের ত্বকের নিচের শিরা দিয়ে রক্ত নয়, কবিতার স্রোত প্রবাহিত হয়।

এমন একটি সাহিত্যপাগল সমাজে আল্লাহ যখন নবী প্রেরণ করবেন, স্বাভাবিকভাবেই বুঝে নিতে হবে, উৎকৃষ্ট মানের সাহিত্যের ভাষা নিয়েই তিনি আবির্ভূত হবেন। নবীজি (সা.

)–এর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। কোরআন তো ছিলই চ্যালেঞ্জ জানানোর জীবন্ত মোজেজা হিসেবে, এর বাইরে নবীজির মুখনিঃসৃত বাণীও ছিল কোরআনময়।

একটি সাহিত্যপাগল সমাজে আল্লাহ যখন নবী প্রেরণ করবেন, স্বাভাবিকভাবেই বুঝে নিতে হবে, উৎকৃষ্ট মানের সাহিত্যের ভাষা নিয়েই তিনি আবির্ভূত হবেন। নবীজি (সা.)–এর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল।

নবীজি (সা.) নিজেই বলেন, ‘আমি প্রেরিত হয়েছি সারসমৃদ্ধ সংক্ষিপ্ত কথক হিসেবে।’ নবীজি (সা.)–এর এই কথার সত্যতা পাওয়া যায় হাদিসগ্রন্থগুলো ঘাঁটলে, নবীজি (সা.)–এর মুখনিঃসৃত বাণীগুলোয় অবগাহন করলে। সারা জীবনে একটাও তিনি দুর্বল গাঁথুনির বাক্য ব্যবহার করেননি। কথায় কথায় তিনি যে পরিমাণ উপমা ব্যবহার করেছেন, তার তুলনা মেলে না।

আরও পড়ুনআয়েশা (রা.) রাগ করলে নবীজি (সা.) কী করতেন১২ জুন ২০২৫

বিশুদ্ধ গ্রন্থগুলোতে নবীজি (সা.)–এর উপমাসমৃদ্ধ যত হাদিস রয়েছে, সব কটিকে যদি এক জায়গায় আনা যায়, বৃহৎ কলেবরের একটি বই হয়ে যাবে।

নবীজি (সা.) বলেন, ‘সৎ ও অসৎ বন্ধুর উপমা হলো আতর বিক্রেতা ও হাপরে ফুঁ দেওয়া কামারের মতো। আতরওয়ালা হয়তো তোমাকে আতর হাদিয়া দেবে, নতুবা তার কাছ থেকে তুমি আতর ক্রয় করবে, তা না হলে অন্তত তার কাছ থেকে তুমি সুঘ্রাণই পাবে। আর কামার হয় তোমার পোশাক জ্বালিয়ে দেবে নতুবা তার কাছ থেকে তুমি দুর্গন্ধ পাবে।’

নবীজি (সা.) বলেছেন, কোরআন তিলাওয়াতকারী মুমিনের বৈশিষ্ট কমলালেবুর মতো। এর স্বাদ উৎকৃষ্ট এবং গন্ধও সুমিষ্ট। আর যে মুমিন কোরআন তিলাওয়াত করেন না, তাঁর দৃষ্টান্ত খেজুরের মতো। খেজুর খেতে সুস্বাদু কিন্তু গন্ধ নেই। আর পাপাচারে লিপ্ত কোরআন তিলাওয়াতকারীর দৃষ্টান্ত সুগন্ধি ফুলের মতো। যার গন্ধ আছে কিন্তু খেতে বিস্বাদ। আর যে পাপাচারে লিপ্ত এবং কোরআনও পড়েন না, তাঁর দৃষ্টান্ত মাকাল ফলের মতো। যার স্বাদও নেই, গন্ধও নেই।

নবীজি (সা.) বলেন, ‘আমার এবং অন্যান্য নবীদের দৃষ্টান্ত হলো একটি সুরম্য প্রাসাদের মতো, যার প্রাচীর খুবই সুসজ্জিত ও মনোলোভা। কিন্তু একটি ইটের স্থান ফাঁকা রাখা হয়েছে। দর্শনার্থীরা প্রাসাদটি ঘুরে ঘুরে দেখেন, ফাঁকা জায়গাটুকু ব্যতীত এর নির্মাণশৈলীতে বিস্ময়াভিভূত হন। আমি এসে ওই ইটের শূন্যস্থান পূরণ করেছি, আমার দ্বারা প্রাসাদের পূর্ণতা দেওয়া হয়েছে।’

আমার এবং অন্যান্য নবীদের দৃষ্টান্ত হলো একটি সুরম্য প্রাসাদের মতো, যার প্রাচীর খুবই সুসজ্জিত ও মনোলোভা। কিন্তু একটি ইটের স্থান ফাঁকা রাখা হয়েছে। আমি এসে ওই ইটের শূন্যস্থান পূরণ করেছিমহানবী হজরত মুহম্মাদ (সা.)আরও পড়ুনপরিবেশ নিয়ে নবীজি(সা.) এর ১০ শিক্ষা১৯ এপ্রিল ২০২৫

নবীজি (সা.) বলেছেন, ইসলাম ধীরে ধীরে বিবর্ণ হতে থাকবে, যেভাবে বিবর্ণ হয় কাপড়ের নকশা। একপর্যায়ে কিছু বৃদ্ধ-অথর্ব লোক অবশিষ্ট থাকবেন। তাঁরা বলবেন, আগে এক জাতি ছিল যাঁরা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করতেন। কিন্তু তাঁরা নিজেরা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করবেন না।

নবীজি (সা.) বলেন, ‘বনি ইসরাইলের যা হয়েছিল, অচিরেই আমার উম্মতেরও তা-ই হবে, যেভাবে এক পায়ের জুতা অপর পায়ের জুতার সমান হয়।’

নবীজি (সা.) বলেছেন, ফিতনা অন্তরে এমনভাবে প্রবেশ করে, যেভাবে বুনানো চাটাইয়ের একাংশ অপরাংশের মধ্যে প্রবেশ করে। সুতরাং যে অন্তরসমূহে ফিতনা প্রবেশ করে, সেখানে কালো একটি দাগ পড়ে। আর যে অন্তর ফিতনাকে স্থান দেয় না, সে অন্তরে সাদা দাগ পড়ে। ফলে অন্তর হয়ে যায় দুই ধরনের। একটি হলো মর্মর পাথরের মতো সাদা অন্তর, যত দিন আকাশ–পৃথিবী অবশিষ্ট থাকবে, তত দিন এই অন্তরে ফিতনা প্রবেশ করতে পারবে না। আরেকটি হলো উপুড় করা হাঁড়ির তলার মতো কুচকুচে কালো অন্তর। এই ধরনের অন্তর ভালোমন্দ বোঝে না। সে বোঝে শুধুই প্রবৃত্তির অনুসরণ।

নবীজি (সা.) বলেছেন, যখন গনিমতকে দৌলত মনে করা হবে, যখন আমানতকে গনিমত ভাবা হবে, যখন জাকাতকে মনে করা হবে জরিমানা, যখন ইলম অর্জন করা হবে দুনিয়ার জন্য, যখন পুরুষেরা আনুগত্য করবে নারীর, যখন মায়ের অবাধ্য হবে সন্তান, যখন বন্ধুকে আপন ভেবে বাবাকে ঠেলা হবে দূরে, যখন মসজিদে শোরগোল বাড়বে, যখন পাপাচারীরা হবে কওমের নেতা, যখন অনিষ্টের ভয়েই কেবল মানুষ মানুষকে সম্মান করবে, যখন গায়িকা এবং বাদ্যযন্ত্রের সয়লাব হবে, যখন প্রকাশ্যে পান করা হবে মদ, যখন উম্মতের পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের অভিশাপ দেবে, তখন তোমরা লুহাওয়া, ভূমিকম্প, ভূমিধস, রূপান্তর, পাথর বর্ষণসহ কেয়ামতের অন্যান্য আলামত সুতাছেঁড়া পুঁতির মতো একের পর এক সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা কর।

আরও পড়ুনমসজিদে আকসা ভ্রমণে নবীজি (সা.)০৬ জুন ২০২৫নবীজি (সা.) বলেন, ‘বনি ইসরাইলের যা হয়েছিল, অচিরেই আমার উম্মতেরও তা-ই হবে, যেভাবে এক পায়ের জুতা অপর পায়ের জুতার সমান হয়।’

নবীজি (সা.) বলেছেন, যার ভেতর কোরআনের কোনো অংশ নেই, তা যেন এক বিরান ঘর।

নবীজি (সা.) বলেছেন, নিশ্চয় অন্তরে মরিচা পড়ে, যেভাবে পানির সংস্পর্শে এলে লোহায় মরিচা ধরে। জিজ্ঞাসা করা হলো, মরিচা দূর করার উপায় কী? নবীজি (সা.) বললেন, মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করা এবং কোরআন তিলাওয়াত করা।

নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কোরআন সংরক্ষণের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে। ওই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, নিশ্চয় কোরআন রশিতে বাঁধা উটের চেয়েও অধিক পলায়নপর।’

উপমাসমৃদ্ধ অল্প কয়েকটি হাদিসের ভাষ্য এখানে উল্লেখ করা হলো। নিমগ্ন কোনো পাঠক যদি নবীজি (সা.)–এর হাদিসগুলো পড়তে থাকেন, এমন অসংখ্য হাদিসের দেখা তিনি পেতে থাকবেন, যেখানে ভোরের শিশিরের মতো জ্বলজ্বল করে ফুটে আছে উপমার মুক্তা।

কোনো বিষয়ের পরপর ঘটে যাওয়াকে যখন নবীজি (সা.) সুতাছেঁড়া পুঁতির দানার সঙ্গে তুলনা দেন, যখন দুই জাতির সমপরিণতির তুলনা দেন দুই পায়ের জুতার মাপের সঙ্গে, যখন সৎ বন্ধুকে রাখেন আতরওয়ালার সঙ্গে আর অসৎ বন্ধুকে বানান আগুন এবং ধোঁয়া ছড়ানো কামার; আবার যখন তিনি খতমে নবুয়তকে বোঝানোর স্বার্থে কল্পনায় একটি সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করেন, যার একটি ইট খোলা এবং নিজেকে সেই খোলা ইটের সঙ্গে তুলনা দেন, তখন নবীজি (সা.)–এর প্রতি আমাদের বিস্ময় ও মুগ্ধতা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এই বিস্ময় ও মুগ্ধতা নতুন করে ভালোবাসতে শেখায় নবীজিকে (সা.)।

সূত্র: প্রজ্ঞায় যার উজালা জগৎ

আরও পড়ুননবীজি (সা.)–এর দোয়া০১ মে ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: উৎক ষ ট হয় ছ ল বল ছ ন র র মত

এছাড়াও পড়ুন:

শেখ হাসিনার রায় নিয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়া

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের ঘটনা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভারত।

সোমবার (১৭ নভেম্বর) সন্ধ্যায় এক্স হ্যান্ডেলে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিষয়ের যে রায় ঘোষণা করা হয়েছে, ভারত সেটি লক্ষ্য করেছে।” খবর বিবিসির।

আরো পড়ুন:

বিচার স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিকমানের, প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই: জামায়াত

হাসিনার মৃত্যুদণ্ড: সাভারে বিএনপির আনন্দ মিছিল, মিষ্টি বিতরণ

“একজন কাছের প্রতিবেশি হিসেবে, বাংলাদেশের শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষায় ভারত কাজ করবে। এ লক্ষ্য আমরা সবসময়, সব ধরনের অংশীদারের সঙ্গে কাজ করে যাব।”

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। সোমবার (১৭ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। 

ঢাকা/এসবি

সম্পর্কিত নিবন্ধ