নবীজি (সা.) যেভাবে উপমা ব্যবহার করতেন
Published: 27th, June 2025 GMT
আমাদের নবীজি (সা.) যে সময়টাতে পৃথিবীতে এসেছিলেন, সেই সময়টা ছিল আরবের সাহিত্যের যুগ। কবিতার জন্য এতটা উন্মাদ জাতি খুব বেশি আসেনি পৃথিবীতে। ওকাজের মেলায় কাব্য প্রতিযোগিতার আসর বসত। বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতাকে মিশরীয় বস্ত্রে সোনার পানিতে লিখে ঝুলিয়ে রাখা হতো কাবার দেয়ালে। যত দিন না এর চেয়ে উৎকৃষ্ট মানের কোনো কবিতা কেউ লিখতে পারছেন, তত দিন সেই কাবিতাটিই দখল করে থাকত কাবার দেয়াল।
কবিতার প্রতি আরবদের এই অন্ধ ভালোবাসা ও পক্ষপাতিত্ব দেখে এক পারস্য মনীষী বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, আরবদের ত্বকের নিচের শিরা দিয়ে রক্ত নয়, কবিতার স্রোত প্রবাহিত হয়।
এমন একটি সাহিত্যপাগল সমাজে আল্লাহ যখন নবী প্রেরণ করবেন, স্বাভাবিকভাবেই বুঝে নিতে হবে, উৎকৃষ্ট মানের সাহিত্যের ভাষা নিয়েই তিনি আবির্ভূত হবেন। নবীজি (সা.
নবীজি (সা.) নিজেই বলেন, ‘আমি প্রেরিত হয়েছি সারসমৃদ্ধ সংক্ষিপ্ত কথক হিসেবে।’ নবীজি (সা.)–এর এই কথার সত্যতা পাওয়া যায় হাদিসগ্রন্থগুলো ঘাঁটলে, নবীজি (সা.)–এর মুখনিঃসৃত বাণীগুলোয় অবগাহন করলে। সারা জীবনে একটাও তিনি দুর্বল গাঁথুনির বাক্য ব্যবহার করেননি। কথায় কথায় তিনি যে পরিমাণ উপমা ব্যবহার করেছেন, তার তুলনা মেলে না।
আরও পড়ুনআয়েশা (রা.) রাগ করলে নবীজি (সা.) কী করতেন১২ জুন ২০২৫বিশুদ্ধ গ্রন্থগুলোতে নবীজি (সা.)–এর উপমাসমৃদ্ধ যত হাদিস রয়েছে, সব কটিকে যদি এক জায়গায় আনা যায়, বৃহৎ কলেবরের একটি বই হয়ে যাবে।
নবীজি (সা.) বলেন, ‘সৎ ও অসৎ বন্ধুর উপমা হলো আতর বিক্রেতা ও হাপরে ফুঁ দেওয়া কামারের মতো। আতরওয়ালা হয়তো তোমাকে আতর হাদিয়া দেবে, নতুবা তার কাছ থেকে তুমি আতর ক্রয় করবে, তা না হলে অন্তত তার কাছ থেকে তুমি সুঘ্রাণই পাবে। আর কামার হয় তোমার পোশাক জ্বালিয়ে দেবে নতুবা তার কাছ থেকে তুমি দুর্গন্ধ পাবে।’
নবীজি (সা.) বলেছেন, কোরআন তিলাওয়াতকারী মুমিনের বৈশিষ্ট কমলালেবুর মতো। এর স্বাদ উৎকৃষ্ট এবং গন্ধও সুমিষ্ট। আর যে মুমিন কোরআন তিলাওয়াত করেন না, তাঁর দৃষ্টান্ত খেজুরের মতো। খেজুর খেতে সুস্বাদু কিন্তু গন্ধ নেই। আর পাপাচারে লিপ্ত কোরআন তিলাওয়াতকারীর দৃষ্টান্ত সুগন্ধি ফুলের মতো। যার গন্ধ আছে কিন্তু খেতে বিস্বাদ। আর যে পাপাচারে লিপ্ত এবং কোরআনও পড়েন না, তাঁর দৃষ্টান্ত মাকাল ফলের মতো। যার স্বাদও নেই, গন্ধও নেই।
নবীজি (সা.) বলেন, ‘আমার এবং অন্যান্য নবীদের দৃষ্টান্ত হলো একটি সুরম্য প্রাসাদের মতো, যার প্রাচীর খুবই সুসজ্জিত ও মনোলোভা। কিন্তু একটি ইটের স্থান ফাঁকা রাখা হয়েছে। দর্শনার্থীরা প্রাসাদটি ঘুরে ঘুরে দেখেন, ফাঁকা জায়গাটুকু ব্যতীত এর নির্মাণশৈলীতে বিস্ময়াভিভূত হন। আমি এসে ওই ইটের শূন্যস্থান পূরণ করেছি, আমার দ্বারা প্রাসাদের পূর্ণতা দেওয়া হয়েছে।’
আমার এবং অন্যান্য নবীদের দৃষ্টান্ত হলো একটি সুরম্য প্রাসাদের মতো, যার প্রাচীর খুবই সুসজ্জিত ও মনোলোভা। কিন্তু একটি ইটের স্থান ফাঁকা রাখা হয়েছে। আমি এসে ওই ইটের শূন্যস্থান পূরণ করেছিমহানবী হজরত মুহম্মাদ (সা.)আরও পড়ুনপরিবেশ নিয়ে নবীজি(সা.) এর ১০ শিক্ষা১৯ এপ্রিল ২০২৫নবীজি (সা.) বলেছেন, ইসলাম ধীরে ধীরে বিবর্ণ হতে থাকবে, যেভাবে বিবর্ণ হয় কাপড়ের নকশা। একপর্যায়ে কিছু বৃদ্ধ-অথর্ব লোক অবশিষ্ট থাকবেন। তাঁরা বলবেন, আগে এক জাতি ছিল যাঁরা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করতেন। কিন্তু তাঁরা নিজেরা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করবেন না।
নবীজি (সা.) বলেন, ‘বনি ইসরাইলের যা হয়েছিল, অচিরেই আমার উম্মতেরও তা-ই হবে, যেভাবে এক পায়ের জুতা অপর পায়ের জুতার সমান হয়।’
নবীজি (সা.) বলেছেন, ফিতনা অন্তরে এমনভাবে প্রবেশ করে, যেভাবে বুনানো চাটাইয়ের একাংশ অপরাংশের মধ্যে প্রবেশ করে। সুতরাং যে অন্তরসমূহে ফিতনা প্রবেশ করে, সেখানে কালো একটি দাগ পড়ে। আর যে অন্তর ফিতনাকে স্থান দেয় না, সে অন্তরে সাদা দাগ পড়ে। ফলে অন্তর হয়ে যায় দুই ধরনের। একটি হলো মর্মর পাথরের মতো সাদা অন্তর, যত দিন আকাশ–পৃথিবী অবশিষ্ট থাকবে, তত দিন এই অন্তরে ফিতনা প্রবেশ করতে পারবে না। আরেকটি হলো উপুড় করা হাঁড়ির তলার মতো কুচকুচে কালো অন্তর। এই ধরনের অন্তর ভালোমন্দ বোঝে না। সে বোঝে শুধুই প্রবৃত্তির অনুসরণ।
নবীজি (সা.) বলেছেন, যখন গনিমতকে দৌলত মনে করা হবে, যখন আমানতকে গনিমত ভাবা হবে, যখন জাকাতকে মনে করা হবে জরিমানা, যখন ইলম অর্জন করা হবে দুনিয়ার জন্য, যখন পুরুষেরা আনুগত্য করবে নারীর, যখন মায়ের অবাধ্য হবে সন্তান, যখন বন্ধুকে আপন ভেবে বাবাকে ঠেলা হবে দূরে, যখন মসজিদে শোরগোল বাড়বে, যখন পাপাচারীরা হবে কওমের নেতা, যখন অনিষ্টের ভয়েই কেবল মানুষ মানুষকে সম্মান করবে, যখন গায়িকা এবং বাদ্যযন্ত্রের সয়লাব হবে, যখন প্রকাশ্যে পান করা হবে মদ, যখন উম্মতের পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের অভিশাপ দেবে, তখন তোমরা লুহাওয়া, ভূমিকম্প, ভূমিধস, রূপান্তর, পাথর বর্ষণসহ কেয়ামতের অন্যান্য আলামত সুতাছেঁড়া পুঁতির মতো একের পর এক সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা কর।
আরও পড়ুনমসজিদে আকসা ভ্রমণে নবীজি (সা.)০৬ জুন ২০২৫নবীজি (সা.) বলেন, ‘বনি ইসরাইলের যা হয়েছিল, অচিরেই আমার উম্মতেরও তা-ই হবে, যেভাবে এক পায়ের জুতা অপর পায়ের জুতার সমান হয়।’নবীজি (সা.) বলেছেন, যার ভেতর কোরআনের কোনো অংশ নেই, তা যেন এক বিরান ঘর।
নবীজি (সা.) বলেছেন, নিশ্চয় অন্তরে মরিচা পড়ে, যেভাবে পানির সংস্পর্শে এলে লোহায় মরিচা ধরে। জিজ্ঞাসা করা হলো, মরিচা দূর করার উপায় কী? নবীজি (সা.) বললেন, মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করা এবং কোরআন তিলাওয়াত করা।
নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কোরআন সংরক্ষণের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে। ওই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, নিশ্চয় কোরআন রশিতে বাঁধা উটের চেয়েও অধিক পলায়নপর।’
উপমাসমৃদ্ধ অল্প কয়েকটি হাদিসের ভাষ্য এখানে উল্লেখ করা হলো। নিমগ্ন কোনো পাঠক যদি নবীজি (সা.)–এর হাদিসগুলো পড়তে থাকেন, এমন অসংখ্য হাদিসের দেখা তিনি পেতে থাকবেন, যেখানে ভোরের শিশিরের মতো জ্বলজ্বল করে ফুটে আছে উপমার মুক্তা।
কোনো বিষয়ের পরপর ঘটে যাওয়াকে যখন নবীজি (সা.) সুতাছেঁড়া পুঁতির দানার সঙ্গে তুলনা দেন, যখন দুই জাতির সমপরিণতির তুলনা দেন দুই পায়ের জুতার মাপের সঙ্গে, যখন সৎ বন্ধুকে রাখেন আতরওয়ালার সঙ্গে আর অসৎ বন্ধুকে বানান আগুন এবং ধোঁয়া ছড়ানো কামার; আবার যখন তিনি খতমে নবুয়তকে বোঝানোর স্বার্থে কল্পনায় একটি সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করেন, যার একটি ইট খোলা এবং নিজেকে সেই খোলা ইটের সঙ্গে তুলনা দেন, তখন নবীজি (সা.)–এর প্রতি আমাদের বিস্ময় ও মুগ্ধতা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এই বিস্ময় ও মুগ্ধতা নতুন করে ভালোবাসতে শেখায় নবীজিকে (সা.)।
সূত্র: প্রজ্ঞায় যার উজালা জগৎ
আরও পড়ুননবীজি (সা.)–এর দোয়া০১ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উৎক ষ ট হয় ছ ল বল ছ ন র র মত
এছাড়াও পড়ুন:
গাজায় ত্রাণ সরবরাহ স্থগিত করেছে ইসরায়েল
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ত্রাণ সরবরাহ আবারও স্থগিত করেছে ইসরায়েল। এর ফলে ত্রাণবাহী কোনো ট্রাক গাজায় প্রবেশ করতে পারছে না। বিতরণ করা ত্রাণসামগ্রী হামাস সদস্যদের হাতে চলে যাচ্ছে, এমন অভিযোগে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে ইসরায়েলের গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ত্রাণসামগ্রী যাতে হামাসের হাতে না যায়, সে জন্য ইসরায়েলি সেনাবাহিনী একটি পরিকল্পনা করবে। সেটি না হওয়া পর্যন্ত গাজায় কোনো ত্রাণ ঢুকতে দেবে না ইসরায়েল।
এর আগেও দীর্ঘদিন ধরে গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ রেখেছিল ইসরায়েল। চার সপ্তাহ ধরে সেখানে ত্রাণ বিতরণ করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল পরিচালিত বিতর্কিত সংস্থা গাজা ‘হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ)। সংস্থাটির ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে ত্রাণ আনতে যাওয়ার পথে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৪৯ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। গাজা সরকারের গণমাধ্যম দপ্তর গতকাল বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রগুলোকে ‘মৃত্যুফাঁদ’ বানিয়ে চালানো হামলায় এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৬৬ ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন। নিখোঁজ রয়েছেন অনাহারে থাকা ৩৯ ফিলিস্তিনি।
মিডল ইস্ট আইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী নেতা ও জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী বেন গভির গাজায় ত্রাণ বিতরণ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এর আগে ইসরায়েলের সরকার দাবি করে, গাজায় সরবরাহ করা পণ্য ও খাদ্যের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে হামাস।
এএফপির খবরে বলা হয়েছে, গাজার প্রভাবশালী কিছু পরিবারের প্রতিনিধিত্বকারী একটি কমিটি গতকাল এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা জানিয়েছে, এ ধরনের দাবি ভিত্তিহীন। এটি গাজায় প্রবেশ করা মানবিক সহায়তাকে বাধাগ্রস্ত করার একটি অজুহাত মাত্র।
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলেছেন, গাজা এখন গণহত্যার ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। এমন অবস্থায় ইসরায়েলের সঙ্গে বিদ্যমান সহযোগিতা চুক্তি অবিলম্বে স্থগিত করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।