ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ চীন কেন দূরে বসে দেখেছে
Published: 27th, June 2025 GMT
কয়েক বছর আগে আমি সাংহাই সফরে গিয়েছিলাম। সেই সফরে গিয়ে চীনের এক শীর্ষ কৌশলবিদকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ বাধলে বেইজিং সেই যুদ্ধকে কীভাবে দেখবে? তখনো এ ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা ছিল প্রবল। আমি ভেবেছিলাম, তিনি বলবেন তেলের দাম বেড়ে কীভাবে চীনের উৎপাদন খাতের ওপর হুমকি তৈরি করবে, সে বিষয়ে।
কিন্তু এর পরিবর্তে তিনি যেটা বললেন, সেটা আমাকে বিস্মিত করেছিল। তিনি ব্যাখ্যা দিলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি মধ্যপ্রাচ্যে আবারও একটি ব্যয়বহুল যুদ্ধে জড়ায়, তাহলে সেটি চীনের জন্য লাভজনক হবে। কারণ, এ ধরনের যুদ্ধ ‘যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক আধিপত্য অবসানের’ সূচনাবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। চীনারা বরাবরই মধ্যপ্রাচ্যকে ‘সম্রাজ্যের কবরস্থান’ হিসেবে বিবেচনা করে।
বর্তমানে বৈরিতা কিছুটা স্তিমিত হলেও ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার বড় ধরনের আশঙ্কাও রয়েছে। সেটা ঘটলে যুক্তরাষ্ট্র আবারও ইসরায়েলের পক্ষে লড়াইয়ে নামতে বাধ্য হতে পারে। আর চীন যদি ইরানকে (যেমনটা তারা পাকিস্তানকে করেছে) যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধ ব্যবস্থাপনার প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করে, তাহলে পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে যাবে।
আরও পড়ুনইরান, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র—কে জিতল এই যুদ্ধে২৪ জুন ২০২৫কিন্তু এখন পর্যন্ত চীন অন্য কোনো দেশে তার সামরিক শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা বজায় রেখে চলেছে। এরপরও যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে বৈরিতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে এর ভূরাজনৈতিক সুফল চীন ঘরে তুলতে পারে।
ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার কড়া নিন্দা জানিয়েছে চীন সরকার। বিবৃতিতে চীন বলেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইনের লক্ষ্য ও নীতির মারাত্মক লঙ্ঘন। এটা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি আরও বাড়িয়ে তুলেছে।’
২২ জুন চীনের দ্য গ্লোবাল টাইমসে প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ‘যুদ্ধের আগুনে ঘি ঢালছে এবং ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষকে আরও অনিয়ন্ত্রিত অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে’।
এটাও ঠিক যে মধ্যপ্রাচ্যে চীন তাদের উপস্থিতি ক্রমে বাড়াচ্ছে। মাসখানেক আগে চীনের বিমানবাহিনী মিসরে এক যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নেয়। প্রথমবারের মতো যৌথভাবে আকাশে জ্বালানি ভরার মহড়াও অনুষ্ঠিত হয়।
এই মুহূর্তে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে সম্পূর্ণরূপে ব্যস্ত। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব খাটানোর সক্ষমতা অনেকটাই কমে গেছে। একইভাবে চীনও মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক দিক থেকে সক্রিয় না হওয়ায় পথে হাঁটছে। এটা এক দিক থেকে আশার কথা। কেননা, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভেঙে গেলে চীনের এই সংযমী অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়ার আশঙ্কা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে রাখবে।এক দশক ধরেই চীনের যুদ্ধজাহাজগুলো নিয়মিতভাবে মধ্যপ্রাচ্যে আসছে। গত মার্চে রাশিয়া, ইরান ও চীনের নৌবাহিনীর মধ্যে এক ত্রিপক্ষীয় মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা এখন প্রতিবছরের নিয়মিত আয়োজন।
অবশ্য এই সামরিক মহড়াগুলো ছোট পরিসরে হয়েছে। এই মহড়াকে শক্তি প্রদর্শনের হুমকি হিসেবে দেখা যায় না। সামগ্রিকভাবে চীন তার মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক পররাষ্ট্রনীতিতে সামরিক শক্তি প্রদর্শনের নীতি নেয়নি।
২০১৯ সালের মাঝামাঝি ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন চীনের নৌবাহিনীকে হরমুজ প্রণালিতে টহল দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, সে সময় দেশটির নীতিনির্ধারকেরা সরাসরি সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিল।
একইভাবে হুতিদের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক অভিযানে অংশ নিতে বেইজিং অস্বীকৃতি জানিয়েছে; বরং হুতিদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে চীন লোহিত সাগরে নিজেদের জাহাজগুলোর নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করতে চেয়েছে।
আরও পড়ুনইরানে ইসরায়েল যেভাবে ধরা খেল২৫ জুন ২০২৫চীন তার পররাষ্ট্রনীতিতে সামরিক শক্তির বদলে কূটনীতিকে প্রাধান্য দেয়। তবে এটা সত্য যে জিবুতিতে একটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে চীনের। তবে জিবুতি এমন একটি স্থানে অবস্থিত, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জাপানেরও সামরিক ঘাঁটি আছে। ফলে জিবুতি বৈশ্বিক ক্ষমতা প্রদর্শন বা আঞ্চলিক আগ্রাসন বিস্তারের কেন্দ্র নয়।
এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীন মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক কূটনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছে। আরব দেশগুলোর মধ্যে চীনের অবস্থান ধীরে ধীরে জোরালো হচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের প্রতি চীনের সহানুভূতির এখানে ভূমিকা রেখেছে। তবে চীন শুধু কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। মরক্কো ও ওমানের মতো তুলনামূলক শান্ত দেশগুলোতেও উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি ঘটেছে ২০২৩ সালে। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দেয় চীন। এটা পারস্য উপসাগরের ভূকূটনৈতিক রাজনীতিতে একটি বড় অর্জন হিসেবে দেখা হয়।
আরও পড়ুনচীন কেন চায় না ইউক্রেন যুদ্ধ থামুক১৩ মে ২০২৫যাহোক, এ পরিস্থিতি যে যেকোনো সময় খারাপ দিকে মোড় নিতে পারে, সেটা ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা থেকেই স্পষ্ট। এ সময়ে ইরানে চীন গোপনে ফ্লাইট পরিচালনা করেছে—এমন গুজবও রটে।
আবার যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে এমন খবর আসে যে তেহরানে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সরবরাহ করেছে চীন। ইরানে চীনের সামরিক সহায়তা পৌঁছনোর পথ হতে পারে পাকিস্তান—এমন কল্পনাও কেউ সহজেই করতে পারেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটন এ বিষয়কে সতর্কতার সঙ্গে নিতে পারে।
এসব জল্পনার মধ্যে আমরা যেন মূল বিষয়টা ভুলে না যায়। সেটা হলো চীনের সঙ্গে ইরানের কোনো সামরিক জোট নেই। মধ্যপ্রাচ্যে দশকের পর দশক ধরে বড় শক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। ১৯৯০-এর দশকের শুরু থেকে এ পর্যন্ত চীন ইরানের কাছে বড় কোনো অস্ত্রব্যবস্থা বিক্রি করেনি।
আরও পড়ুনমধ্যপ্রাচ্য আর হয়তো ইসরায়েলের ছকে চলবে না২৫ জুন ২০২৫এটি বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে একটি প্রশংসনীয় সংযমের নজির। ওয়াশিংটনকে অবশ্যই এটাকে বিবেচনায় নেওয়া উচিত, কেননা, তারা আবারও মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক শক্তি প্রদর্শন করতে চাইছে।
এই মুহূর্তে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে সম্পূর্ণরূপে ব্যস্ত। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব খাটানোর সক্ষমতা অনেকটাই কমে গেছে। একইভাবে চীনও মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক দিক থেকে সক্রিয় না হওয়ায় পথে হাঁটছে। এটা এক দিক থেকে আশার কথা। কেননা, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভেঙে গেলে চীনের এই সংযমী অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়ার আশঙ্কা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে রাখবে।
সম্ভবত বেইজিং ‘পাহাড়ে বসে বাঘের লড়াই দেখার’ নীতি নিয়েছে।
লাইল গোল্ডস্টিন ডিফেন্স প্রায়োরিটিজ প্রোগ্রামের এশিয়া কর্মসূচির পরিচালক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ইসর য় ল য পর স থ ত ক টন ত ক র আশঙ ক অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
কাছের মানুষ পাশে থাকলে কঠিন যুদ্ধেও জেতা যায়, তার প্রমাণ বিসিএস ক্যাডার মালিহা
মালিহার মা আসমা বেগমের কথা না বললেই নয়। জন্ম মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার কলমা গ্রামে। ঢাকায় বড় হয়েছেন। বেগম বদরুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন।
১৯৯৩ সালে জগন্নাথ কলেজে (সে সময় কলেজ ছিল, ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় হয়) ভর্তি হন। এর এক বছর পর তাঁর বিয়ে হয়ে যায়।
একঝটকায় ঢাকার শিক্ষার্থী থেকে ঝিনাইদহের হরিশংকরপুর ইউনিয়নের বাকড়ি গ্রামের গৃহবধূ হয়ে গেলেন। আসমা বেগমের খুব ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করার।
স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার পাট চুকে গেল। চাকরির স্বপ্নের সমাপ্তি। মালিহা তাঁর মাকে সারাটা জীবন কেবল অন্যের জন্য করে যেতে দেখেছেন। বিনিময়ে মা পেয়েছে কেবল উপেক্ষা আর অবহেলা।
নতুন জীবন নতুন সংগ্রামউচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরই বিয়ে হয়ে যায় মালিহার। বিয়েতে মালিহার মায়ের কেবল একটা অনুরোধ ছিল পাত্র ও তাঁর মা-বাবার কাছে—তাঁর কন্যার লেখাপড়ার যাতে কোনো ত্রুটি না হয়। বিয়ের পর মায়ের ইচ্ছায়, স্বামীর পরামর্শে মালিহা ভর্তি হন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন ঝিনাইদহ সরকারি ভেটেনারি কলেজে।
মালিহা এই কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী। তখন কলেজটি ছিল শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। বর্তমানে কলেজটি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
২০১৯ সালের মার্চে ইন্টার্ন চলাকালীন মা হন মালিহা। মা হয়েও ভালোভাবে পড়াশোনা শেষ করেন। তারপর সময় নষ্ট না করে শুরু করেন চাকরির পড়াশোনা।
সারা জীবন কেবল চেয়েছি মায়ের কষ্টের ভাগ নিতে। কী করলে আমার মা একটু স্বস্তি পাবে। আমার স্বামী সব সময় আমার পাশে ছিলেন। আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। বলেছেন, “তুমি কেবল আবেগ নিয়ে কখনোই মায়ের পাশে দাঁড়াতে পারবা না। এ জন্য তোমার পায়ের নিচের মাটি শক্ত হতে হবে।” আমাকে আরও বলত, “আমার মতো স্টুডেন্টের যদি সরকারি চাকরি (ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার) হয়, তোমার কেন হবে না। তুমি আমার চেয়ে বেশি যোগ্য, বেশি পরিশ্রমী, তোমার আরও ভালো চাকরি হবে।”মুলকে সাদ মালিহা, লাইভস্টক ক্যাডার, ৪৪তম বিসিএসযে কান্না আনন্দেরমালিহার মামি শিক্ষা ক্যাডার হন। সে সময় থেকে তাঁর রঞ্জু মামা তাঁকে বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেন। মালিহা ২০২০ সাল থেকে চাকরির পড়াশোনা শুরু করেন। ২০২৫ সালে এসে প্রথম সরকারি চাকরি পান। যোগ দেন সরকারি ব্যাংকের অফিসার পদে।
এর কিছুদিন পর ৩০ জুন ৪৪তম বিসিএসের ফল প্রকাশ করে। তবে তখন ক্যাডার পদ আসেনি মালিহার। বেশ হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন।
লাইভস্টক ক্যাডারে ৬৮জন ‘রিপিট ক্যাডার’ ছিল। সেসব পুনর্মূল্যায়ন করে আবার যখন ৬ নভেম্বর নতুন ফল প্রকাশ করা হয়, তাতে নাম আসে মালিহার। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নপূরণ হয় তাঁর।
মালিহার মা আসমার নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন যেন মেয়ের ভেতর দিয়ে সত্য হয়ে ধরা দেয়। মালিহা যখন চাকরির সুখবর জানাতে মাকে ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে ‘আম্মুউউউ’ বলে একটা চিৎকার দিয়েছেন, মা আসমা বেগম ভয়েই অস্থির! নিশ্চয়ই মেয়ের কোনো বিপদ হয়েছে। এরপরই শুনলেন খবরটা। মা-মেয়ে দুজনেই ফোনের দুই পাশে কাঁদছেন, যে কান্না আনন্দের, প্রাপ্তির, সফলতার।
মামির শাড়ি আর ব্লেজার পরে বিসিএসের ভাইভা দিয়েছেন মালিহা