শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার গারো পাহাড় থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে বিক্রির প্রতিবাদ করায় বালুদস্যুদের আক্রমণে গুরুতর আহত হয়েছেন জুলাই যোদ্ধা মো. আরিফ রেজা (২১)। 

শুক্রবার (২৭ জুন) সন্ধ্যা ৭টার দিকে শ্রীবরদী উপজেলার কর্ণঝোড়া এলাকার মেঘাদল বাজার (শয়তান বাজার) এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। রেজা বর্তমানে শেরপুর জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। 

অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসের প্রতিবাদ করায় বালুদস্যু বিপ্লব ও তার অনুসারীদের হাতে নির্যাতনের ঘটনায় জেলা জুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। 

এ ঘটনায় ভুক্তভোগী মো.

আরিফ (২১) বাদি হয়ে শ্রীবরদী থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। আরিফ উপজেলার গোসাইপুর ইউনিয়নের গিলাগাছা গ্রামের মো. রজব আলী ছেলে।

আসামিরা হলো- মো. বিপ্লব মিয়া, মো. রুমান, মো. রমজান, মো. মোশারফ, মো. ইউনুছ মহাজনেরদ ছেলে মো. ইস্রাফিল, সোহাগ, মো. ইউসুফ আলী, মো. নয়ন, মো. ইদ্রিস আলী, মো. আলমাছ খান বাহাদুর, মো. স্বপন মিয়া ও মো. মোস্তফা।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, শ্রীবরদী উপজেলার কর্ণঝোড়া এলাকায় প্রকাশ্যে বালু উত্তোলন করায় বার বার বাধা দেয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যরা। এর আগে বেশ কয়েকবার তারা বিভিন্ন স্থানে বালুর গাড়ি আটক করে প্রশাসনের নজরে এনেছেন। এদিনও কর্ণঝোড়া শয়তান বাজারে দুটি বালুভর্তি মাহেন্দ্র ট্রাক্টর দেখতে পায়। 

এসময় আরিফসহ অন্যরা ট্রাক দুটি থামিয়ে চালককে বালুর বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে। বাবেলাকোনা এলাকা হতে এসব বালু উত্তোলন করে তা বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে জানান মাহেন্দ্র চালক। রাষ্ট্রীয় সম্পদ অবৈধ পাচার হচ্ছে দেখে তারা বিষয়টি শ্রীবরদী থানা পুলিশসহ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সহকারী কমিশনার ভূমিকে মুঠোফোনে অবগত করে।

সেই খবর পেয়ে বালুদস্যু বিপ্লব ও তার অনুসারীরা চারদিক থেকে আরিফসহ অন্যদের ঘেরাও করে প্রথমে গালাগালি করে। পরে কিল, ঘুষি ও লাথি মেরে গুরুতর আহত করে। মারধরের এক পর্যায়ে আরিফ অজ্ঞান হয়ে যায়। পরে এলাকাবাসীরা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে শ্রীবরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। তারপর উন্নত চিকিৎসার জন্য শেরপুর জেলা সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়।

আরিফ বলেন, “বিগত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ডান হাতের কনুইয়ে ও বুকে গুলিবিদ্ধসহ শরীরে বিভিন্ন জায়গায় ২৫০ এর অধিক ছররা গুলি নিয়ে বেঁচে আছি। মৃত্যুর জন্য ভয় পাই না। বিপ্লব একাই পাহাড় ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই সিন্ডিকেটটি দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ি বালু অবৈধভাবে উত্তোলন করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করছে। আমি বাধা দিয়ে আহত হলাম। আমি এর বিচার চাই এবং সম্পূর্ণরূপে বালু উত্তোলন বন্ধ চাই।”

শ্রীবরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. আরিফুর রহমান বলেন, “রেজার শরীরে অনেক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। আমরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়েছি। কিন্তু তার আরও উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। তাই তাকে শেরপুর জেলা সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তবে তার অবস্থা আশঙ্কামুক্ত।”

এ ব্যাপারে শ্রীবরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আনোয়ার জাহিদ বলেন, “আমি নিজে হাসপাতালে গিয়ে আহতের সাথে কথা বলেছি। পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা চলমান রয়েছে। তবে অপরাধী কেউ ছাড় পাবে না।”

ঢাকা/তারিকুল/এস

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর উপজ ল র শ র বরদ

এছাড়াও পড়ুন:

ইরান বনাম পশ্চিমা বিশ্ব : সভ্যতার ভণ্ডামির পাঠ

ইরান কেবল একটি রাষ্ট্র নয়, বরং গোটা এক সভ্যতা। প্রাচীন ও আত্মসচেতন এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে শত শত বছর ধরে দর্শন, শিল্প ও আধ্যাত্মিকতার চর্চার মধ্য দিয়ে। এই সভ্যতাগত চরিত্রই যুগে যুগে ইরানের রাজনৈতিক ও নৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে। 

আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক ছিল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বচ্ছ। তবে তা আত্মসম্মানবোধ থেকে, আত্মসমর্পণ থেকে নয়। তবু পশ্চিমা গণমাধ্যম ও তাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকেরা ইরানকে এক ‘দুষ্ট রাষ্ট্র’ হিসেবে তুলে ধরেছে। যেন পশ্চিমের নৈতিকতার মিথ ধরে রাখার জন্য ইরান এক সুবিধাজনক ‘অপর’। 

ইরানের পররাষ্ট্রনীতি বরাবরই দাঁড়িয়ে আছে প্রতিরোধের নীতির ওপর। হিজবুল্লাহ ও হামাসকে ইরানের সমর্থন কখনোই অন্ধ সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ ছিল না। সেই সমর্থন মূলত এমন এক আঞ্চলিক শক্তির বিরুদ্ধে, যারা আজও ফিলিস্তিনিদের পিষ্ট করে চলেছে গণহত্যার মতো নির্যাতনের মাধ্যমে। 

আরও পড়ুনআরব দেশগুলো এখন বুঝছে—ইরান নয়, ইসরায়েলই তাদের জন্য বড় হুমকি১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

যেখানে ইসরায়েল শরণার্থীশিবির ও হাসপাতাল বোমাবর্ষণকেও নিজেদের ‘আত্মরক্ষা’ হিসেবে দাবি করে, সেখানে ইরানের সংহতি আক্রমণ নয়, বরং নৈতিক দায়িত্ব। পশ্চিমা গণমাধ্যমে যেভাবে ইরানকে রহস্যঘেরা ও গোপনীয়তার আড়ালে ঢেকে রাখা এক রাষ্ট্র হিসেবে দেখানো হয়, বাস্তবতা তার থেকে অনেক জটিল এবং ভিন্ন। 

ওয়াশিংটনের নৈতিক চশমা দিয়ে ইরানের আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে বোঝা যায় না। পারস্যের উত্তরসূরি হিসেবে এই ইসলামি প্রজাতন্ত্র এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে, যেখানে সম্পর্কের ভিত্তি সততা আর শক্তি মানেই সংযম। আধুনিক ইতিহাসে ইরান কোনো দেশে আক্রমণ বা উপনিবেশ স্থাপন করেনি। বরং আক্রমণ, নিষেধাজ্ঞা ও বিশ্বের থেকে একঘরে হয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা সয়েছে। তবু ইরান আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থেকে সরে দাঁড়ায়নি। 

ইরানের অভ্যন্তরীণ জটিলতা যা–ই থাকুক, এই নৈতিক উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তারা প্রতিরোধ করেছে। ওয়াশিংটনের কথামতো না চলার জন্যই ইরানকে শাস্তি দেওয়া হয়, নিজের জনগণকে দমন করার কারণে নয়। 

ইরান পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের পথে হাঁটতে চাইলে (যদি সত্যিই সেই পথ বেছে নেয়) তাকে আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিতের বাইরে বিচার করা যায় না। ইসরায়েলের একটি অঘোষিত পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার আছে। দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে সই করেনি এবং আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার কাছেও তাদের কোনো জবাবদিহি নেই। 

তাহলে ইরান কেন প্রতিরোধক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হবে? বিশেষ করে এমন এক পরিবেশে, যেখানে পশ্চিমের নৈতিকতা প্রয়োগ হয় বেছে বেছে। আর আন্তর্জাতিক আইন ব্যবহৃত হয় দুর্বলদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে। সেখানে তো প্রতিরোধই টিকে থাকার উপায়। 

পশ্চিমা দেশগুলো মানবাধিকার নিয়ে দুনিয়াকে নসিহত করে, কিন্তু অস্ত্র বিক্রি করে ইসরায়েল ও সৌদি আরবের কাছে। গাজায় ‘সন্ত্রাসীদের’ নিন্দা করে, অথচ শিশুদের অনাহারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়াকে ক্ষমা করে দেয়। ইরানকে তারা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মানার দাবি জানায়, কিন্তু নিজেরা সুযোগ পেলেই তা লঙ্ঘন করে। এই ভণ্ডামি ব্যক্তিগত নয়, এর শিকড় গাথা আছে ঔপনিবেশিক ঔদ্ধত্যের শত শত বছরের অভ্যাসে। যে শক্তিগুলো একসময় এশিয়া ও আফ্রিকা লুট করে বেরিয়েছে, আজ তারাই গণতন্ত্র ও শান্তি নিয়ে জ্ঞান দেয়। 

আরও পড়ুনইরান–আমেরিকা ‘দ্বিতীয় যুদ্ধ’ যে চার কারণে আসন্ন৩১ আগস্ট ২০২৫

ইরানের অভ্যন্তরীণ জটিলতা যা–ই থাকুক, এই নৈতিক উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তারা প্রতিরোধ করেছে। ওয়াশিংটনের কথামতো না চলার জন্যই ইরানকে শাস্তি দেওয়া হয়, নিজের জনগণকে দমন করার কারণে নয়। 

গাজায় ইসরায়েলের চলমান কর্মকাণ্ড পশ্চিমা দ্বিমুখিতার সর্বোচ্চ অশ্লীল প্রদর্শন। বিশ্ব তাকিয়ে দেখেছে শিশুরা ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ছে, হাসপাতালে বোমা হামলা হচ্ছে, শরণার্থীরা অনাহারে মরছে। আর এসবই ন্যায্যতা পাচ্ছে ‘নিরাপত্তার’ নামে। আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিটি নীতি পায়ের তলায় পিষ্ট করা হচ্ছে, তবু কোনো নিষেধাজ্ঞা আসে না। যে সরকারগুলো একসময় ইউক্রেনের দুর্দশায় চোখের জল ফেলেছিল, তারাই এখন ফিলিস্তিনে গণহত্যার অর্থ জোগাচ্ছে। 

পার্সেপোলিস থেকে তেহরান পর্যন্ত, কবি থেকে বিপ্লবী পর্যন্ত ইরান এমন এক ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে, যা কোনো সাম্রাজ্যই মুছে দিতে পারেনি। ইরানের রাজনীতি বিতর্কিত হতে পারে, শাসনব্যবস্থা অপূর্ণ হতে পারে কিন্তু তার সভ্যতাগত মনন অটুট। এর বিপরীতে পশ্চিমারা অস্ত্র চুক্তি ও তেল-স্বার্থের বিনিময়ে বিসর্জন দিয়েছে নিজেদের নৈতিক দিশা। 

রঞ্জন সলোমন গোয়াভিত্তিক রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও মানবাধিকারকর্মী

মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজিতে থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ