মা ফাতেমাতুজ জোহরাকে (৬২) চিকিৎসক দেখিয়ে ফিরছিলেন একটি বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হাফেজুল ইসলাম (৪২)। পথে রেলক্রসিংয়ে রেলগেট পড়লে অটোরিকশার চালক সংকেত অমান্য করে পাশের রাস্তা দিয়ে পার হয়ে যেতে চেয়েছিলেন। রেললাইনের ওপর অটোরিকশাটি আটকে যায়। অল্প দূরে ট্রেন দেখে অটোরিকশা থেকে নেমে পড়েছিলেন হাফেজুল। পেরিয়েও গিয়েছিলেন রেললাইন। কিন্তু মাকে বাঁচাতে ফিরে আসেন তিনি। আর এ সময় ট্রেনটি অটোরিকশাসহ তাঁদের দুজনকে ধাক্কা দেয়। মৃত্যু হয় মা, ছেলে দুজনেরই।

গতকাল শনিবার রাতে ফেনী শহরের রেলগেট গোডাউন কোয়ার্টার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলেই ছেলে হাফেজুলের মৃত্যু হয়। গুরতর আহত মা ফাতেমাতুজ জোহরাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে গতকাল রাত ১২টার দিকে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী ও রেলওয়ে পুলিশ সূত্র জানায়, গতকাল রাত আটটার দিকে নোয়াখালী থেকে ফেনীর পাঠাননগর এলাকায় ফিরছিলেন মা-ছেলে। রেলগেট গোডাউন কোয়ার্টার এলাকায় তাঁদের বহনকারী সিএনজিচালিত অটোরিকশাটি সিগন্যাল অমান্য করে দ্রুত পার হওয়ার জন্য রেললাইনে উঠে যায়। এ সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে চলাচলকারী চট্টলা এক্সপ্রেস ট্রেন অটোরিকশাটিকে ধাক্কা দেয়।

গোডাউন কোয়ার্টার রেলগেটের গেটম্যান মোহাম্মদ বাবু বলেন, ‘রেলস্টেশন থেকে নির্দেশনা পেয়ে চট্টলা এক্সপ্রেস ট্রেন গোডাউন কোয়ার্টার এলাকা অতিক্রম করার জন্য আমি গেট বন্ধ করি। নির্দেশনা অমান্য করে রং সাইড দিয়ে রেললাইন অতিক্রম করার চেষ্টা করলে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা রেললাইনের ওপর আটকে যায়। বারবার সরাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। একপর্যায়ে ট্রেনটিকে লাল সিগন্যাল দিয়ে থামাতে চাইলেও কম দূরত্বের কারণে থামানো সম্ভব হয়নি। অটোরিকশায় থাকা দুই যাত্রী নামার চেষ্টা করলেও মাকে বাঁচাতে গিয়ে ছেলে আহত হন। পরে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালককে ধরে পুলিশে হস্তান্তর করা হয়।’

ছেলের পর মৃত্যু হলো গুরুতর আহত মা ফাতেমাতুজ জোহারারও.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গ ড উন ক র এল ক

এছাড়াও পড়ুন:

শিশুদের হাড্ডিসার দেহ ইসরায়েলের নৃশংসতার সাক্ষ্য

ছোট্ট দেহটির প্রায় সব হাড় দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, কঙ্কালের ওপর শুধু চামড়াটাই রয়ে গেছে। গাজায় খাদ্যাভাব কতটা তীব্র পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ এই শিশুরা। তাদের হাড্ডিসার দেহ যেন ইসরায়েলের নৃশংসতারই সাক্ষ্য।

ইসরায়েলের আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত অনাহার ও অপুষ্টিতে ফিলিস্তিনের গাজায় অন্তত ৬৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। এ জন্য তারা গাজায় ইসরায়েলের সর্বাত্মক অবরোধকে দায়ী করেছে।

গাজার স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের ওপর চাপ বাড়াতে উপত্যকাটিতে কোনো ধরনের ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ইসরায়েল। এমনকি খাবার, পানি ও ওষুধের মতো জীবনরক্ষাকারী ত্রাণও প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।

গত শনিবার গাজার সরকারি গণমাধ্যম কার্যালয়ের এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের প্রাণঘাতী অবরোধকে যুদ্ধাপরাধ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গাজার বেসামরিক মানুষকে নির্মূল করতে ইসরায়েল ক্ষুধাকে যে অস্ত্র হিসেবে ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহার করছে, সেটা এখন দিবালোকের মতো সত্য।

গাজা উপত্যকায় চলমান পরিস্থিতিকে ‘শৈশবের বিরুদ্ধে অব্যাহত অপরাধ’ বলে বর্ণনা করে এর নিন্দা জানিয়েছে সরকারি দপ্তরটি। পাশাপাশি ক্ষুধা, রোগ ও ধীরে ধীরে মৃত্যুর শিকার হওয়া শিশুদের দুর্দশা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের লজ্জাজনক নীরবতারও তীব্র সমালোচনা করেছে তারা।

বিবৃতিতে এ বিপর্যয়ের জন্য ইসরায়েল ও তাদের মিত্রদের দায়ী করেছে সরকারি দপ্তরটি। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি। পাশাপাশি জাতিসংঘকে অবিলম্বে গাজার সীমান্ত পথগুলো খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে।

এ বিবৃতির কয়েক দিন আগে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ সতর্ক করে বলেছিল, গাজায় অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা ‘উদ্বেগজনক হারে’ বাড়ছে। ইউনিসেফ জানিয়েছে, শুধু মে মাসে ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী অন্তত ৫ হাজার ১১৯ শিশুকে তীব্র অপুষ্টির চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

ইউনিসেফ আরও বলেছে, এ সংখ্যা এপ্রিল মাসে ভর্তি হওয়া ৩ হাজার ৪৪৪ শিশুর তুলনায় ৫০ শতাংশের মতো বেশি আর ফেব্রুয়ারির তুলনায় প্রায় ১৫০ শতাংশ বেশি। ফেব্রুয়ারিতে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর ছিল। এতে সে সময়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ত্রাণসহায়তা গাজায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়।

ইউনিসেফের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের পরিচালক এডওয়ার্ড বেইগবেদার বলেন, শুধু এ বছর মে পর্যন্ত মাত্র ১৫০ দিনে গাজা উপত্যকায় ১৬ হাজার ৭৩৬ শিশুকে অপুষ্টির চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সে হিসাবে গড়ে দিনে ১১২টি শিশুকে অপুষ্টির জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

শিশুদের এ দুর্দশা ও মৃত্যুর মিছিল খুব সহজে থামানো সম্ভব বলে মনে করেন বেইগবেদার। তিনি বলেন, প্রতিটি ঘটনা প্রতিরোধযোগ্য। তাদের কাছে অত্যাবশ্যক খাবার, পানি ও পুষ্টি চিকিৎসা পৌঁছে দিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এতে মানুষ মারা যাচ্ছে। ইসরায়েলকে জরুরি ভিত্তিতে সব সীমান্ত পথ দিয়ে ব্যাপক পরিমাণ জীবনরক্ষাকারী সহায়তা গাজায় পৌঁছানোর সুযোগ দিতে হবে।

শিশুদের অনাহারে মৃত্যুর আশঙ্কা প্রকাশ করে শনিবার যখন এসব কথা বলা হচ্ছিল, তখন গাজা নগরীর তুফাহ এলাকায় দুই দফায় ইসরায়েলের বিমান হামলায় কয়েকটি আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়ে অন্তত ২০ জন নিহত হন। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৯টি শিশু রয়েছে।

ত্রাণের আটার ব্যাগে মাদক

এদিকে গাজার সরকারি গণমাধ্যম কার্যালয় গত শুক্রবার জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল–সমর্থিত একটি ত্রাণ সংস্থার ত্রাণকেন্দ্রগুলো থেকে বিতরণ করা আটার ব্যাগে ‘অক্সিকোডোন’ নামের মাদক বড়ি পাওয়া গেছে। সরকারি দপ্তরটি এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে।

এক বিবৃতিতে সরকারি দপ্তরটি বলেছে, ‘আমরা এখন পর্যন্ত চারজনের সাক্ষ্য পেয়েছি। তাঁরা আটার ব্যাগের ভেতরে এই বড়িগুলো পেয়েছেন।’ তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, কিছু মাদক ইচ্ছাকৃতভাবে গুঁড়া বা দ্রবীভূত করে আটার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অক্সিকোডোন একটি শক্তিশালী মাদক, যা মূলত ক্যানসার রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি ও তীব্র ব্যথা উপশমে ব্যবহার করা হয়। এ মাদক অত্যন্ত আসক্তিকর এবং এর জীবননাশক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। এর মধ্যে শ্বাসপ্রশ্বাসে জটিলতা, বিভ্রম ইত্যাদি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু পোস্টে গাজায় বিতরণ করা আটার ব্যাগে বড়ি পাওয়ার ছবি প্রকাশ হয়েছে। পরে গাজা কর্তৃপক্ষ ওই বিবৃতি দেয়। গাজার একজন ফার্মাসিস্ট ওমর হামাদ এ ঘটনাকে ‘গণহত্যার সবচেয়ে জঘন্য রূপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) নামের একটি বিতর্কিত সংস্থা বর্তমানে দক্ষিণ গাজার কয়েকটি জায়গায় ত্রাণ বিতরণ করছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকার অভিযোগে জিএইচএফের তীব্র সমালোচনা করে আসছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র থেকে ত্রাণ আনতে গিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে ৫৫০ জনের বেশি ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

এদিকে নতুন করে যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টার মধ্যেই গাজায় হামলা আরও তীব্র করেছে ইসরায়েল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গতকাল রোববার জানিয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নিহত ৮৮ জনের মরদেহ গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালগুলোয় আনা হয়েছে। এ সময় আহত ৩৬৫ জনকেও হাসপাতালে আনা হয়।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের হামলার জবাবে ইসরায়েল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় নির্বিচার হামলা শুরু করে। প্রায় ২০ মাস ধরে চলা এ যুদ্ধে গাজায় কমপক্ষে ৫৬ হাজার ৫০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৩৩ হাজার ৪১৯ জন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ