জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমাদের ধ্যানজ্ঞান একটাই– ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রযন্ত্রে যেন আর কখনোই কোনো স্বৈরাচার মাথা তুলতে না পারে। বাংলাদেশ হবে একটি স্বৈরাচারমুক্ত রাষ্ট্র। সেই আকাঙ্ক্ষায় আমাদের মিশন হচ্ছে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতাকে যতটা সম্ভব সীমিত করা। আমরা এমন সংবিধান বানানোর কথা বলি, যা ভবিষ্যতে আর যেন সংশোধন না করা যায়। তাই এমনভাবে সংসদ নির্বাচন করতে চাই, যাতে কোনো দলই সংবিধান সংশোধনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়। আমরা ভুলে যাই বর্তমান সংবিধানের ৭খ অনুচ্ছেদের বয়ান। যে বয়ানে বলা আছে– ‘সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।’ এ বিধানের জন্য আমরা গোটা সংবিধানকেই ছুড়ে ফেলতে চাচ্ছি। ভবিষ্যতে সংসদের নতুন বিন্যাসের কারণে সংবিধান সংশোধনের পথ বন্ধ হলে কেউ যদি ভাবে, পরিবর্তনই যখন করা যায় না তখন ছুড়েই ফেলা যাক এ সংবিধান, তাহলে কী হবে?
দেশের চিন্তাশীল অনেকেই বলছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সরকারের আজ্ঞাবহ। এক দল রোমান্টিক চিন্তার ধারক মনীষী দুর্নীতি দমন কমিশনকে সরকারের আজ্ঞাবহতা থেকে দূরে রেখে একটি স্বাধীন সংস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট। এটি অবশ্যই মহৎ চিন্তা। কিন্তু বাস্তবতা কী? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে আমরা এবার দুদক থেকে চোখ একটু এনবিআরের দিকে নিই।
গত ১২ মে আচমকা এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দুই ভাগে বিভক্ত করার পর সেখানে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, এ বিভক্তিকরণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হিসেবে তাদের মত নেওয়া হয়নি। তারা মনে করেন, এনবিআরকে সরকার কাজের সুবিধার জন্য বিভক্ত করতেই পারে। তবে নতুন দুই প্রতিষ্ঠানে অন্য ক্যাডারের প্রাধান্য থাকতে পারবে না। তাদের ভাষায়, বিশেষ দক্ষতার কাজ করতে হয় বলে এ দুই প্রতিষ্ঠান তাদেরই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দিয়ে চালাতে হবে। সরকার বিষয়টি বিবেচনা করবে– এমন আশ্বাসের ফলে ২৫ মে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। বাস্তবে কোনো সমাধান আসেনি। এ পরিপ্রেক্ষিতে খোদ এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবিতে ২২ জুন থেকে আবার আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের মাত্রা তীব্র হয়ে শুরু হয় কমপ্লিট শাটডাউন। মানুষের শরীরের রক্ত চলাচল বন্ধ থাকলে মানুষ বাঁচে না। এনবিআরের কাজ রাষ্ট্রের রাজস্ব আহরণ, যা রাষ্ট্রের রক্তস্বরূপ। রাষ্ট্র যুদ্ধে লিপ্ত হলেও শুল্ক ও কর আহরণের কাজ ব্যাহত হয় না। যেমন বর্তমানে আরাকানের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কার– সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও আরাকানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে। অথচ কোনো যুদ্ধাবস্থা ছাড়াই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। কমপ্লিট শাটডাউনের কারণে এক গার্মেন্টস খাতেই প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
অতএব, এই আন্দোলন বা কমপ্লিট শাটডাউন বন্ধ করা সরকারের জন্য জরুরি হয়ে পড়ল। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সরকার তা করতে পারত। কিন্তু সরকার কী করল? সংবাদমাধ্যমে ঠিক তখনই দেখা গেল, দুদক এনবিআরের আন্দোলনের শীর্ষ ৬ নেতার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এনবিআরের অটল আন্দোলন থেমে গেছে দুদকের একটি তদন্তের সিদ্ধান্তে। মনে পড়ছে মহাভারতে পাণ্ডবদের সঙ্গে কৌরবদের পাশা খেলায় পরাজিত পাণ্ডবদের ১২ বর্ষব্যাপী নির্বাসনের কথা। ক্ষুব্ধ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে দুর্যোধন এই বলে সাফাই গায়– ‘যার যাহা বল/ তাই তার অস্ত্র, পিতঃ, যুদ্ধের সম্বল।/ ব্যাঘ্রসনে নখে দন্তে নহিকো সমান,/ তাই বলে ধনুঃশরে বধি তার প্রাণ/ কোন্ নর লজ্জা পায়?’ (গান্ধারীর আবেদন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
এনবিআরের আন্দোলন ন্যায়সংগত, নাকি ভুল– সে বিবেচনার ভার আমার নয়। আমি সে ব্যাপারে মোটেও কোনো জ্ঞান রাখি না। কিন্তু যেটা বুঝি সেটা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় স্বার্থে কমপ্লিট শাটডাউন থেকে এনবিআরকে মুক্ত করা সরকারের নির্বাহী বিভাগের কর্তব্য হয়ে পড়েছিল; সরকার তা-ই করেছে। এটি করার জন্য সরকারের যে অস্ত্র ব্যবহার করলে কাজ হবে, সেটিই ব্যবহার করেছে। দুর্যোধন যেমন বলছিল, বাঘের সঙ্গে লড়াই করতে গেলে মানুষের নখ বা দাঁত দিয়ে নয়, তীর-ধনুক দিয়েই লড়তে হবে। তাতে লজ্জার কিছু নেই। আজ যদি দুদক জনআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখে স্বাধীন হতো, তাহলে কি ওই অস্ত্র ব্যবহার করতে পারত? সে ক্ষেত্রে কমপ্লিট শাটডাউন আরও দীর্ঘ হতে পারত, রাষ্ট্রও হয়তো নতুন এক জটিলতায় পড়ত।
রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত ভুল হলে রাষ্ট্র তা সংশোধন করতে পারে। কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা না করে রাষ্ট্রকে পঙ্গু করার কর্মসূচি চলতে পারে না। তাই এই কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির মুখে সরকার বসে থাকেনি; ভবিষ্যতেও কোনো সরকার বসে থাকবে না। আমরা স্বৈরাচারের পুনরুত্থান ঠেকাতে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে চাই; জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনে সংস্কার আনতে চাই। ভালো কথা। কিন্তু আমরা কাউকে স্বাধীন করতে গিয়ে খোদ রাষ্ট্রকে যেন ঠুঁটো জগন্নাথ না করে ফেলি।
শুধু আইনকানুন কাউকে স্বৈরাচার বানায় না। এ ব্যাধির অন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ উৎস আছে। শুধু আইন দিয়ে এ ব্যাধি দূর করতে গেলে রাষ্ট্র দুর্বল হতে পারে, আখেরে যার ভালো ফল আসে না। এনবিআর আন্দোলন আমাদের জন্য একটি বড় শিক্ষা। এই আন্দোলনের ইতিবৃত্ত বিবেচনায় রেখে রোমান্টিকতাকে দূরে সরিয়ে বরং রাষ্ট্রাচারকে সুশৃঙ্খল করাই হোক সবার প্রচেষ্টা।
আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী: কলাম লেখক; অবসরপ্রাপ্ত
অতিরিক্ত সচিব
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সমক ল ন প রসঙ গ অন চ ছ দ সরক র র ক ত কর র জন য হ র কর
এছাড়াও পড়ুন:
গোমস্তাপুরে ২ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর রহস্যজনক মৃত্যু
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে মধ্যরাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে একটি আবাসিক মাদ্রাসার দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে।
শুক্রবার (১৫ আগস্ট) দিবাগত রাতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পথে তাদের একজন এবং সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অপরজনের মৃত্যু হয়।
নিহতরা হলো- গোমস্তাপুর উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের লেবুডাঙ্গা গ্রামের তরিকুল ইসলামের মেয়ে তানিয়া খাতুন (১২) ও একই ইউনিয়নের বেগপুর গ্রামের সবুর আলীর মেয়ে জামিলা খাতুন (১০)।
স্থানীয়রা জানান, তানিয়া ও জামিলা ‘শেফালী বেগম মহিলা নুরানি ও হাফিজিয়া মাদ্রাসা’র শিক্ষার্থী। শুক্রবার দিবাগত রাতে হঠাৎই তারা অসুস্থ হয়ে বমি করে। সহপাঠীরা বিষয়টি শিক্ষককে জানান। সেসময় স্থানীয়দের সহযোগিতায় তাদেরকে গোমস্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। পথেই একজনের মৃত্যু হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরেকজন মারা যায়।
মাদ্রাসার শিক্ষক শাহিদা খাতুন বলেন, “রাতে খাবার খাওয়ার পর সব শিক্ষার্থী সুস্থই ছিল। হঠাৎ করে রাত আড়াইটার দিকে জামিলা বমি করে। সঙ্গে রক্তও বের হয়। এরপর তানিয়াও বমি করতে শুরু করে। আমরা তাদের দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাই। কীভাবে তাদের মৃত্যু হলো, তা আমরা বুঝতে পারছি না।”
রাধানগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান বলেন, “রাতে হঠাৎ মহিলা মাদ্রাসার দুজন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেসময় মাদ্রাসার শিক্ষকরা তাদেরকে হাসপাতালে নেন। পথেই একজনের মৃত্যু হয়। আরেকজন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যায়। সাপের কামড়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানতে পেরেছি।”
এ বিষয়ে গোমস্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসার আব্দুল আলিম জানান, দুজনের মধ্যে একজনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। আরেকজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। প্রাথমিকভাবে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর কারণ জানা যাবে।
গোমস্তাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওয়াদুদ আলম বলেন, ‘‘মধ্যরাতের দিকে মাদ্রাসায় থাকা অবস্থায় তাদের বমি হয়। পরে তাদের হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুর কারণ এবং ঘটনা সম্পর্কে জানতে তদন্ত শুরু হয়েছে।”
ময়নাতদন্তের জন্য ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালে মরদেহ নেওয়া হবে বলে জানান গোমস্তাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওয়াদুদ আলম।
ঢাকা/শিয়াম/এস