আশির দশকের কথা। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের গাড়াদহ গ্রাম। ছিমছাম, সাজানো–গোছানো আমার গ্রামটি। দুই পাশে দুই নদ–নদী। পূর্ব পাশে করতোয়া নদী, পশ্চিম পাশে ফুলজোড় নদ। গ্রামের লোকজন সারা দিন কাজকর্ম করে বিকেলে দুই নদীর তীরে সময় কাটায়, গল্প করে। গ্রামে একটি জিনিসের অভাব ছিল হাট। হাট করার জন্য বাইরের গ্রামে যেতে হয়। গ্রামে আছে সুবিশাল মাঠ। একদিন পুরো গ্রামের লোক ডাকা হলো। সলিমুল্লাহ চাচা এই গ্রামের মুরব্বি। তাঁর কথা সবাই মানে।
চাচা বললেন, এই গ্রামে একটি হাট দরকার, কী বলেন সবাই?
সমস্বরে সবাই বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ। গ্রামের একেবারে উত্তর পাশে হাটের জায়গা ঠিক করা হলো।
একটি বিশাল বটগাছ, বটগাছের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সরু নদী। সপ্তাহের বুধবারে হাট বসে। হাটের জৌলুশ ছিল, প্রাণ ছিল। মানুষের সমাগমে প্রতি বুধবার সারা গ্রাম মেতে থাকত। বটগাছের পাশেই বসত মাছের বাজার। নদী ও বিলের মাছে ভরে উঠত মাছবাজার। তার আরেক পাশে সন্দেশ, মটকা, গজা, চিটকা খাজা ও জিলাপি। জিলাপি দিত পদ্মপাতায়। আরেক পাশে মাটির হাঁড়িপাতিল, পুতুল, খেলনা। যখন কোনো হাঁড়িপাতিল কিনতে যেতাম, পালেরা ঠন ঠন করে হাঁড়িপাতিল বাজাতেন। মাঝখানে বসত টাটকা সবজির বাজার। তার এক পাশে বস্তায় করে ধান বিক্রি হতো।
সবচেয়ে ভালো লাগত গণেশ নাপিতকে। টুলে বসে চুল কাটতেন। সারা গ্রামের তথ্য থাকত তাঁর কাছে। চারপাশে বসে লোকজন তাঁর গল্প শুনত। বেশির ভাগ গল্পই মেয়েদের নিয়ে। কার মেয়ের কার সঙ্গে প্রেম, কার মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, গ্রামটা রসাতলে গেল, কোনো বিচার নেই ইত্যাদি।
কোনো কোনো বিকেলে লোকজনের দৌড়াদৌড়ি শুরু হতো, যেদিন ইলিশ মাছ খুব সস্তা যেত। তখন টাকাপয়সার খুব অভাব ছিল। আমরাও সস্তায় আস্ত একটি ইলিশ মাছ নিয়ে এসে রাতে মজা করে খেতাম। যখন শর্ষের মৌসুম আসত, তখন বুধবারের হাট নতুন রূপে সাজত। হাটটি ছোট হওয়ায় রাস্তার দুই পাশে বিক্রেতারা চাটাই বিছিয়ে বসতেন, শর্ষে বিক্রেতাদের কাছে থাকত একটি করে টাকার তহবিল। অনেকেই শর্ষে কিনে খাঁটি শর্ষের তেল খেতেন। আমরাও শর্ষে কিনে ঘানিতে শর্ষে ভাঙাতাম।
হাটের একেবারে দক্ষিণ পাশে বসত ধানের বাজার। একেক মৌসুমে একেক রকম ধান। যখন আমন ধান উঠত, তখন গ্রামের লোকজনের পিঠা খাওয়ার আয়োজন শুরু হতো।
ঠিক বটগাছের নিচেই বসত সুরেশ কাকার পানের দোকান। সুরেশ কাকার ছিল বিশাল ভুঁড়ি। অধিকাংশ সময়ই খালি গায়ে থাকতেন। দোকানের চারপাশে পান, সুপারি, জর্দা সাজানো থাকত। আমরা দোকানের পাশে গেলেই সুরেশ কাকা বলতেন, ‘পান নিবা খোকা?’ নানার জন্য প্রতি বুধবারেই পান–সুপারি নিয়ে আসতাম। সুরেশ কাকা শহর থেকে সবচেয়ে বড় পান এনে বুধবারের হাটে বিক্রি করতেন।
হাটের একেবারে রাস্তার পাশে ছিল দু–তিনটি মনিহারি দোকান। এই দোকানগুলো হাটকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল। এই মনিহারি দোকানগুলোতে সারা বছরই বেচাবিক্রি হতো। বছর শেষে হালখাতা হতো, যারা বাকিতে খেত, তাদের বাকি টাকা তোলার এই এক সুন্দর ব্যবস্থা। হালখাতায় খাওয়ানো হতো লুচি, পায়েস, রসগোল্লা।
যখন সন্ধ্যা নেমে আসত, তখন বুধবারের হাটে জীবনের লেনদেন কমে আসত। দোকানিদের শরীর ক্লান্ত–শ্রান্ত হতো, তখন অনেকেই নদীতে গোসল করে ক্লান্তি দূর করত। গোসল সারার জন্য অনেক দোকানদার একটি গামছা ও লুঙ্গি সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন।
সন্ধ্যার পরও লন্ঠনের আলোয় বুধবারের ছোট হাটখানি আলোতে ভরে উঠত। অনেক কর্মব্যস্ত মানুষ সন্ধ্যার পরেও হাটে ছুটে আসতেন। কেউ কিছু কিনুক না কিনুক, বুধবারের এই হাটে যেন আসতেই হবে। এই হাটখানি যেন সবার সুখ–দুঃখের সাথি।
হাট যখন একেবারে শেষ হয়ে যেত, সব দোকানদার বাড়ি ফিরে যেতেন। তখন জ্যোৎস্নার আলোয় অনেকেই গোল হয়ে বসে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করত। তারপর যে যার মতো সুখ–দুঃখ ভাগাভাগি করে বাড়ি ফিরে যেত। যেন আনন্দ–বেদনার সাক্ষী এই মমতাভরা ছোট হাট।
এখন বুধবারের হাট আর বসে না। কয়েকটি ভগ্নপ্রায় দোকান কালের সাক্ষী হয়ে আছে এই হাটের। সেই শর্ষের ঘ্রাণ, সেই আমন ধান, সেই ইলিশ মাছ, গণেশ কাকা, লন্ঠনের আলো, পদ্মপাতায় জিলাপি আবার কি ফিরে পাব কোনো দিন!
অনেকেই বলছে, এই হাট আবার চালু করা দরকার। কবে চালু হবে এই হাট জানি না।
খন্দকার ফারুক আহমেদ, সহকারী শিক্ষক, হলদিঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এক ব র এই হ ট অন ক ই ল কজন বটগ ছ
এছাড়াও পড়ুন:
শাহরুখের ব্যাপারে সাবধান করলেন জুহি চাওলা
বলিউড বাদশা শাহরুখ খান। অভিনয় গুণে কোটি কোটি ভক্তের হৃদয়ে দোলা দিয়েছেন তিনি। দীর্ঘ অভিনয় ক্যারিয়ারে যশ-খ্যাতি যেমন পেয়েছেন, তেমনি আয় করেছেন মোটা অঙ্কের অর্থও। রবিবার (২ নভেম্বর) ৬০ বছর পূর্ণ করে একষট্টিতে পা দেবেন এই তারকা।
অভিনয় ক্যারিয়ারে অনেক নায়িকার সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন শাহরুখ খান। তাদের মধ্যে অন্যতম জুহি চাওলা। ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’, ‘রামজানে’, ‘ডর’, ‘ইয়েস বস’, ‘ডুপ্লিকেট’সহ আরো কিছু জনপ্রিয় সিনেমা উপহার দিয়েছেন এই জুটি। একসঙ্গে অভিনয় ছাড়াও, এই দুই তারকা বাস্তব জীবনে খুবই ভালো বন্ধু। কেবল তাই নয়, ব্যবসায়ীক অংশীদারও তারা।
আরো পড়ুন:
শাহরুখের অজানা এই সাত তথ্য জানেন?
পাকিস্তানের সন্ত্রাসী তালিকায় সালমান খান কেন?
বন্ধু শাহরুখের জন্মদিন উপলক্ষে হিন্দুস্তান টাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন জুহি। এ আলাপচারিতায় স্মৃতিচারণ তো করেছেনই, পাশাপাশি শাহরুখের বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছেন এই অভিনেত্রী।
শাহরুখের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের বিষয়ে জুহি চাওলা বলেন, “আমি যখন প্রথম ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’ সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হই, তখন সহপ্রযোজক বিবেক ভাসওয়ানি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার নায়ক দেখতে আমির খানের মতো।’ আমি শাহরুখকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। দেখি, শাহরুখের চুল চোখের ওপরে নেমে এসেছে। আর সে একেবারেই আমার কল্পনার সেই ‘চকলেট বয়’ নয়! যখন কাজ শুরু করি, তখন বুঝতে পারি, সে একদম নতুন অভিনেতাদের মতো নয়, সে পরিশ্রমী, দিনে তিন শিফটে কাজ করছে।”
একটি ঘটনা বর্ণনা করে জুহি চাওলা বলেন, “আমার মনে আছে, ‘ইয়েস বস’ সিনেমার শুটিংয়ের সময়, কোনো দৃশ্য ঠিকমতো লেখা না থাকলে পরিচালক আজিজজি (আজিজ মির্জা) বলতেন, ‘শাহরুখ আসুক, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ রোমান্স আর মজার মিশেলে থাকা দৃশ্যগুলো আমাদের সবচেয়ে ভালো ছিল। সেই সূত্রেই আমরা অনেকগুলো সিনেমায় একসঙ্গে কাজ করেছি।”
শাহরুখের পাশে অবস্থান করলে সাবধান থাকার কথার কথা বলেছেন জুহি। হাসতে হাসতে এ অভিনেত্রী বলেন, “শাহরুখের আশেপাশে থাকলে সাবধানে থাকবেন। কারণ সে কথা দিয়ে আপনাকে যেকোনো কিছু করাতে রাজি করিয়ে ফেলতে পারে। ওর কথাবলার ভঙ্গি এমন যে, আপনি ‘না’ বলতেই পারবে না। আমি ‘ডুপ্লিকেট’ সিনেমা করতে চাইছিলাম না, কারণ সেখানে আমার তেমন কিছু করার ছিল না। আমরা তখন আরেকটি সিনেমার শুটিং করছিলাম, আর শাহরুখ আমাকে সিঁড়িতে বসিয়ে দুই ঘণ্টা বোঝায় এবং আমি সিনেমাটিতে চুক্তিবদ্ধ হই। সে আপনাকে যেকোনো কিছু করতে রাজি করাতে পারে, তাই সাবধানে থাকবেন।”
শাহরুখ খানের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়ে জুহি চাওলা বলেন, “অফস্ক্রিনে আমাদের সম্পর্কেও উত্থান-পতন রয়েছে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা কোনো না কোনোভাবে আমাদের যুক্ত রেখেছেন, এমনকি আইপিএলের মাধ্যমেও। আমাদের বন্ধন কোনো পরিকল্পনার ফল নয়, এটা একেবারেই ভাগ্যের ব্যাপার।”
শাহরুখ খানের সঙ্গে আইপিএল দল কলকাতা নাইট রাইডার্সের (কেকেআর) সহ-মালিক জুহি ও তার স্বামী জয় মেহতা। এই দলের পেছনে জুহি বিনিয়োগ করেছেন ৬২৯ কোটি রুপি। বর্তমানে এই দলটির মূল্য আছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি রুপি। শাহরুখ খানের সঙ্গে ‘রেড চিলিস গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করেন জুহি।
১৯৬৫ সালে ২ নভেম্বর ভারতের নয়াদিল্লিতে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শাহরুখ খান। তার শৈশবের প্রথম পাঁচ বছর কেটেছে ম্যাঙ্গালুরুতে। শাহরুখের দাদা ইফতিখার আহমেদ স্থানীয় পোর্টের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। যার কারণে সেখানে বসবাস করেন তারা। শাহরুখের বাবার নাম তাজ মোহাম্মদ খান, মা লতিফ ফাতিমা।
দিল্লির হংসরাজ কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন শাহরুখ খান। তারপর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতে গণযোগাযোগ বিষয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হন। কিন্তু অভিনয় জীবন শুরু করার কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দেন তিনি। তবে বলিউডে ক্যারিয়ার শুরুর দিকে দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-তে ভর্তি হন এই শিল্পী।
১৯৯২ সালে ‘দিওয়ানা’ সিনেমার মাধ্যমে বলিউডে পা রাখেন শাহরুখ খান। রোমান্টিক ঘরানার এ সিনেমায় অভিনয় করে নজর কাড়েন তিনি। সিনেমাটিতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে সেরা নবাগত অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন শাহরুখ।
একই বছর ‘চমৎকার’, ‘দিল আসনা হে’ ও ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’ সিনেমায় অভিনয় করেন শাহরুখ। তার পরের বছর ‘ডর’ ও ‘বাজিগর’ সিনেমায় অভিনয় করে নিজের জাত চেনান শাহরুখ। তার অভিনয়ের জাদুতে মুগ্ধ হন কোটি ভক্ত; পৌঁছে যান সাফল্যের চূড়ায়। তার অভিনয়ের খ্যাতি আরো বাড়তে থাকে যশরাজ ফিল্মসের সিনেমায় ধারাবাহিকভাবে অভিনয় করে। একের পর এক হিট সিনেমা দিয়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করেন শাহরুখ। যদিও তার এই সফলতার জার্নির গল্প মোটেও সহজ ছিল। আর সে গল্প সবারই জানা।
অভিনয় ক্যারিয়ারে অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন শাহরুখ খান। তার মধ্যে মোট পনেরোবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। এর মধ্যে আটবার সেরা অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। হিন্দি সিনেমায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০০২ সালে তাকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করে ভারত সরকার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণ করেছেন মোট পাঁচবার। তবে শাহরুখ খানের ৩৩ বছরের অভিনয় ক্যারিয়ারে অধরা ছিল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। চলতি বছর ‘জওয়ান’ সিনেমার জন্য সেরা অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন শাহরুখ।
ঢাকা/শান্ত