বাংলাদেশের উপকূল বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক বৈচিত্র্যময় ভূখণ্ড। একদিকে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য আর অন্যদিকে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির মিতালি। নির্মল এই ছবির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক নীরব অভিশাপ। তার নাম লবণাক্ততা।

সমুদ্রের লোনাজল আজ শুধু পানিতে সীমাবদ্ধ নেই। এটি মিশে গেছে এই অঞ্চলের মানুষের রক্ত, ঘাম আর প্রতিদিনের সংগ্রামে। সেই সংগ্রামের অগ্রভাগে রয়েছেন অদম্য নারীরা। জলবায়ু পরিবর্তন আর মানবসৃষ্ট সংকটকে সঙ্গী করে তাঁরা কীভাবে টিকে থাকেন, সেই গল্পগাথাই আজ আমাদের উপজীব্য।

আশির দশকে চিংড়িকে ‘ব্লু গোল্ড’ বা ‘সোনালি সম্ভাবনার’ স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রণোদনা আর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় হাজার হাজার হেক্টর ধানখেত রূপান্তরিত হয়েছিল চিংড়ির ঘেরে। রপ্তানি আয় বাড়ার এই লোভনীয় হাতছানিতে লবণাক্ত পানি সচেতনভাবে প্রবেশ করানো হয় মিঠাপানির অঞ্চলে।

স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক চক্রের ছত্রচ্ছায়ায় কৃষকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই আগ্রাসন চলতে থাকে। যে জমিতে একসময় সোনার ধান ফলত, তা ধীরে ধীরে বন্ধ্যা হয়ে পড়ে। এর সামাজিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ক্ষমতা আর অর্থের জোরে কৃষকের জমি দখল হয় এবং একটি ভূমিহীন শ্রেণির জন্ম হয়। এই সামাজিক ভাঙনের প্রথম ও সবচেয়ে বড় শিকার হন নারী ও শিশুরা। যে চিংড়িকে ভাবা হয়েছিল আশীর্বাদ, তা-ই যেন আজ উপকূলের জন্য এক দীর্ঘমেয়াদি অভিশাপের নাম। এই পরিবর্তিত বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে নারীদের।

উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির তীব্র অভাব। একটি ওয়াটার ট্যাংক হয়তো একটি গ্রামের পানির চাহিদা মেটাতে পারে, কিন্তু যখন পুরো একটি অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে যায়, তখন প্রয়োজন হয় সমন্বিত ও বৃহৎ আকারের পরিকল্পনার। যার অভাবে সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হয় নারীদের। কারণ, এখানকার প্রায় সব পরিবারের খাওয়ার পানি নারীদেরই সংগ্রহ করতে হয়।

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ফাতেমা বেগমের কথাই ধরা যাক। তাঁর দিন শুরু হয় ভোরের আলো ফোটার আগে। পরিবারের সবাই যখন ঘুমে, তাঁকে ছুটতে হয় নিরাপদ পানির সন্ধানে। প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরের একটি পুকুর থেকে তাঁকে পানি বয়ে আনতে হয়। লবণাক্ততার কারণে গ্রামের বেশির ভাগ নলকূপ আর পুকুর এখন ব্যবহারের অযোগ্য। কাঁখে ভারী কলসি আর পায়ে কাদা মেখে এই পথ পাড়ি দেওয়া তাঁর প্রতিদিনের রুটিন। তাঁর এই যাত্রায় সঙ্গী হয় গ্রামের অন্যান্য বাড়ির নারীরা।

পানি এনেই শেষ নয়, এখানকার অনেক নারীকেই ছুটতে হয় নদীতে অথবা চিংড়ির ঘেরে। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোনাপানিতে চিংড়ির পোনা ধরে সেগুলো ঘেরে ছাড়া বা মাছের খাবার দেওয়ার কাজ করতে হয়। পায়ের আঙুলের ফাঁকে লবণাক্ত পানির কারণে ঘা হয় অনেকেরই। এ ছাড়া অন্যান্য শারীরিক সমস্যা তো লেগেই থাকে। তীব্র যন্ত্রণা হলেও কাজ থামানোর উপায় নেই। কারণ, তাঁদের আয়ের ওপর সংসারের অনেকটা নির্ভর করে। দিন শেষে বাড়ি ফিরে আবার রান্নাবান্না আর সংসারের হাজারো কাজ। নিজের শরীরের দিকে তাকানোর ফুরসতটুকুও তাঁর মেলে না। এই গল্প কোনো বিচ্ছিন্ন গ্রামের ঘটনা নয়, এটিই উপকূলের অনেক গ্রামের হাজারো নারীর প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিচ্ছবি।

উপকূলীয় নারীর জীবন এক অনন্ত সংগ্রামের নাম। দিনের বড় একটি সময় তাঁদের লবণাক্ত পানিতে নেমে কাজ করতে হয়, যা তাঁদের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। লবণাক্ত পানির আগ্রাসন শুধু মাটির গভীরে নয়, নারীর শরীরের গভীরেও পৌঁছেছে। দীর্ঘক্ষণ লোনাপানিতে কাজ করার ফলে নারীদের মধ্যে চর্মরোগ, খোসপাঁচড়া ও চুলকানি একটি সাধারণ সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এর চেয়েও ভয়াবহ হলো জরায়ুর সংক্রমণ। অপরিষ্কার ও লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে বহু নারী মাসিকের সময় জটিলতায় ভোগেন এবং জরায়ুর ইনফেকশনসহ দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত হন। সামাজিক লজ্জা ও দারিদ্র্যের কারণে তাঁরা সহজে চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেন না।

এই প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অপ্রতুলতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ফলে একটি নিরাময়যোগ্য রোগও দীর্ঘস্থায়ী ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই শারীরিক সংকট কেবল নারীদের একার নয়, এটি প্রভাব ফেলে পরবর্তী প্রজন্মের ওপরও। অসুস্থ মায়েদের সন্তানেরা প্রায়ই অপুষ্টি আর নানা জটিলতা নিয়ে জন্মায়।

তবে উপকূলের এসব নারী শুধু পরিস্থিতির শিকার হয়ে বসে থাকেননি। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কাজের সন্ধানে শহরে পাড়ি জমালে সংসারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে নারীর ওপর, যা তাঁদের জীবনসংগ্রামকে আরও কঠিন করে তোলে। তাঁরা এই লবণাক্ততাকে সঙ্গী করেই খুঁজে নিয়েছেন নতুন পথের দিশা। প্রতিকূলতাকে শক্তিতে রূপান্তর করে তাঁরা হয়ে উঠেছেন একেকজন সফল উদ্যোক্তা।

যে লবণাক্ততা তাঁদের ধান চাষ কেড়ে নিয়েছে, সেই লোনাজলেই তাঁরা শুরু করেছেন কাঁকড়া চাষ। পরিবারের পুরুষ সদস্যের পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এসব নারী কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছেন। এর মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পরিবারের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ দেখাচ্ছে। ফাতেমার মতো নারীরাও এখন চিংড়ি ঘেরের কাজের পাশাপাশি বাড়ির উঠানে ছোট খাঁচায় কাঁকড়া চাষ করছেন।

এর পাশাপাশি গৃহস্থালির সার্বিক দায়িত্বও তাঁরা সামলান। বাড়ির উঠানে হাঁস-মুরগি পালন কিংবা গবাদিপশু চরানো তাঁদের দৈনন্দিন কাজের অংশ। এসব থেকে যা আয় হয়, তা দিয়ে সন্তানের পড়াশোনার খরচ বা পরিবারের ছোটখাটো চাহিদা মেটানো হয়। অনেকে আবার হস্তশিল্পের মতো সৃজনশীল কাজেও নিজেদের যুক্ত করেছেন। নকশিকাঁথা বোনা বা স্থানীয় উপকরণ দিয়ে শোপিস তৈরি করে তাঁরা বাড়তি আয়ের সংস্থান করছেন। এই অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা তাঁদের শুধু আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে না, পরিবারে তাঁদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও বাড়িয়ে দিচ্ছে। যে নারী আগে নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারতেন না, তিনিই আজ পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তপ্রণেতা।

জলবায়ু পরিবর্তনের এই সংকটে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনেক এলাকায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য বড় ট্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। লবণাক্ততা-সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন ও তা চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।

বিভিন্ন এনজিও নারীদের দক্ষতা উন্নয়নে সেলাই ও অনেক বিকল্প পেশার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এসব উদ্যোগ প্রশংসার যোগ্য হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল। উপকূলীয় অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় লাখো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। বিচ্ছিন্নভাবে নেওয়া প্রকল্পগুলো অনেক সময়ই সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছায় না অথবা দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হয় না। নারীদের জন্য নেওয়া প্রশিক্ষণগুলোও অনেক সময় বাজারজাতকরণের অভাবে পুরোপুরি সফল হতে পারে না। ফলে এসব নারীর টিকে থাকতে হয় মূলত নিজেদের অদম্য ইচ্ছাশক্তির ওপর ভর করেই।

এসব নারীর এই সংগ্রাম কেবল বেঁচে থাকার জন্য নয়। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিত করার লড়াই। তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছেন, কীভাবে লবণ-সহনশীল সবজির চাষ করতে হয়। বাড়ির পাশে ছোট্ট এক টুকরা জমিতে তাঁরা পুঁইশাক, লাউ বা ঢ্যাঁড়সের মতো সবজি ফলিয়ে পরিবারের পুষ্টির জোগান দেন।

উপকূলের এসব হার না–মানা নারী শুধু টিকে থাকার যোদ্ধা নন, তাঁরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সম্মুখসারির পথিকৃৎ। তাঁদের জীবনগাথা কেবল বঞ্চনা আর কষ্টের নয়; বরং সাহস আর ঘুরে দাঁড়ানোর এক জীবন্ত দলিল। বড় বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যখন জলবায়ু ন্যায্যতা নিয়ে আলোচনা হয়, তখন উপকূলের এসব নারী তাঁদের দৈনন্দিন সংগ্রামের মাধ্যমে সেই ন্যায়ের বাস্তব রূপটি দেখিয়ে দেন।

একেকটি নতুন দিন তাঁদের জন্য নিয়ে আসে একেকটি নতুন লড়াইয়ের আহ্বান। আর সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁরা প্রমাণ করেন, জীবন যতই কঠিন হোক না কেন, সংগ্রামের মাধ্যমে জয়ী হওয়া সম্ভব। তাঁদের এই অদম্য মানসিকতা আর অভিযোজনের ক্ষমতা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং সারা বিশ্বের জন্য এক অশেষ অনুপ্রেরণার উৎস।

আল শাহারিয়া

শিক্ষার্থী

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

মেইল: [email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: লবণ ক ত প ন পর ব র র র জন য ন উপক ল র এসব ন র র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় ৩ পুলিশ নিহত

যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যে বন্দুক হামলায় তিন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন আরো দুই পুলিশ। 

পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) স্থানীয় সময় দুপুর ২টার কিছু পর এক পারিবারিক বিরোধের তদন্তে গিয়ে হামলার মুখে পড়ে পুলিশ। খবর বিবিসির। 

আরো পড়ুন:

শেরপুরে পুলিশের উপর হামলা: থানায় মামলা, গ্রেপ্তার ৪

ভাঙ্গা উপজেলা পরিষদ ও থানায় হামলা, ভাঙচুর-আগুন

পেনসিলভানিয়া স্টেট পুলিশের কমিশনার কর্নেল ক্রিস্টোফার প্যারিস জানান,  অভিযুক্ত বন্দুকধারী পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছে।

গুলির ঘটনার পর ইয়র্ক কাউন্টির নর্থ কোডোরাস টাউনশিপের স্প্রিং গ্রোভ এলাকার একটি স্কুল জেলা সাময়িকভাবে ‘শেল্টার ইন প্লেস’ ঘোষণা করে। তবে পরে জানানো হয়, স্কুল কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জনসাধারণের জন্য বর্তমানে কোনো সক্রিয় হুমকি নেই। এ ঘটনা ঘটে ফিলাডেলফিয়া থেকে প্রায় ১০০ মাইল (১৬০ কিমি) পূর্বে অবস্থিত ইয়র্ক কাউন্টির এক গ্রামীণ এলাকায়। 

তারা বলছে, আগের দিন শুরু হওয়া একটি তদন্তের অংশ হিসেবে কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন। তবে তদন্ত চলমান থাকায় বিস্তারিত কিছু প্রকাশ করা হয়নি।

পেনসিলভানিয়ার গভর্নর জোশ শাপিরো বিকেলে ঘটনাস্থলে পৌঁছে নিহতদের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বলেন, “আমরা তিনজন মহামূল্যবান প্রাণ হারালাম, যারা এই দেশকে সেবা দিয়েছেন। এই ধরনের সহিংসতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সমাজ হিসেবে আমাদের আরো ভালো করতে হবে।”

নিহত তিন কর্মকর্তার সম্মানে গভর্নর শাপিরো রাজ্যের সব সরকারি ভবন ও স্থাপনায় পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ দেন।

ঢাকা/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ