মহাবিশ্বের সবকিছুই বিস্ময়কর। সেই বিস্ময়কর মহাবিশ্বের কোনো কেন্দ্র আছে কি না, তা নিয়ে অনেক বছর ধরে ভাবছেন বিজ্ঞানীরা। বর্তমান প্রচলিত বিশ্বতত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিশ্বের কোনো নির্দিষ্ট স্থানিক কেন্দ্র বা প্রান্ত নেই। বিগ ব্যাং কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে ঘটে যাওয়া কোনো বিস্ফোরণ ছিল না। এটি ছিল মহাবিশ্বের সব স্থানকে নিয়ে একযোগে প্রসারণ। গ্যালাক্সি কোনো কেন্দ্রীয় বিন্দু থেকে সরে যাচ্ছে না। গ্যালাক্সির মধ্যবর্তী স্থান নিজেই প্রসারিত হচ্ছে।
অনেকেই অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, যদি মহাবিশ্ব প্রসারিত হয়, তাহলে এর কেন্দ্র হিসেবে কোনো নির্দিষ্ট স্থান আছে কি না? কোনো নির্দিষ্ট সূচনা না থাকলে কোনো কিছু কীভাবে প্রসারিত হতে পারে, এমন অনেক ভাবনা আমাদের যুক্তির ধাঁধায় ফেলে দেয়। আধুনিক বিশ্বতত্ত্ব অনুযায়ী, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে স্পেস বা স্থান নিজেই প্রসারিত হচ্ছে। যার ফলে বিভিন্ন গ্যালাক্সি একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই প্রসারণ সুষম বা ইউনিফর্ম। বিষয়টিকে বেলুন ফোলানোর সঙ্গে তুলনা করা যায়। বেলুন ফোলানোর সময় সব দিকে সমানভাবে ফুলে ওঠার মতো অবস্থা চলছে মহাবিশ্বে।
মহাবিশ্ব শুরু হয়েছিল প্রায় ১৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এ ঘটনা কোনো একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে ঘটেনি। বিগ ব্যাং বিস্ফোরণের পর অত্যন্ত ঘন ও উষ্ণ অবস্থার স্থান বা স্পেসের দ্রুত প্রসারণ ঘটছে। যেহেতু মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে, তাই বিভিন্ন গ্যালাক্সি কোনো কেন্দ্রীয় স্থান থেকে বাইরের দিকে সরে যাচ্ছে না বরং তাদের মধ্যবর্তী স্থান প্রসারিত হচ্ছে। প্রতিটি গ্যালাক্সি থেকে অন্য গ্যালাক্সিকে দূরে সরে যেতে দেখা যায়, যার কারণে মনে হয় মহাবিশ্ব সব দিকে সমানভাবে প্রসারিত হচ্ছে।
যেহেতু এই প্রসারণ সব জায়গায় একযোগে ঘটে, তাই মহাবিশ্বের কোনো নির্দিষ্ট কেন্দ্র নেই। স্থান নিজেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কোনো কেন্দ্রীয় উৎসের দিকে লক্ষ্য না রেখেই গ্যালাক্সিকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই ধারণার গভীর প্রভাব রয়েছে। এই ধারণার ওপর নির্ভর করে রেডশিফট, কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড ও মহাবিশ্বের বৃহৎ স্কেলের গঠনের মতো ঘটনা বোঝার চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায় যে মহাবিশ্ব বৃহৎ স্কেলে সমসত্ত্ব বা হোমোজেনাস ও সমকেন্দ্রিক বা আইসোট্রপিক। আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, এর প্রসারণ একই রকম দেখা যাবে। এ কারণে বলা যায় যে মহাবিশ্বের স্থানিক কোনো কেন্দ্র নেই।
মহাবিশ্ব অসীম। এর কোনো সীমানা বা কেন্দ্রীয় বিন্দু নেই। এমনকি বিভিন্ন সসীম মডেলে বাঁকা, বদ্ধ বা বহুসংযুক্ত মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে, পর্যবেক্ষণযোগ্য স্থানের মধ্যে কোনো প্রকৃত স্থানিক কেন্দ্র দেখা যায় না। মহাবিশ্বের প্রসারণ সমানভাবে ঘটে বলে প্রতিটি অঞ্চল অন্য প্রতিটি অঞ্চল থেকে দূরে সরে যায়। সব স্থানকে স্থানীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কেন্দ্রীয় বলে মনে হয়। কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড, গ্যালাক্সির বিতরণ ও রেডশিফট পরিমাপ থেকে প্রাপ্ত প্রমাণ এই ধারণাকে সমর্থন করে। বিগ ব্যাং কোনো একটি বিন্দু থেকে হওয়া বিস্ফোরণ ছিল না।
কেন্দ্র নেই, এমন ধারণার প্রভাব অনেক। যেহেতু কোনো বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত অবস্থান নেই, তাই মহাবিশ্বে কোনো বিশেষ স্থান নেই। প্রতিটি অঞ্চলে একই রকম প্রসারণ হয়। কসমোলজিক্যাল প্রিন্সিপাল অনুসারে মহাবিশ্ব বৃহৎ স্কেলে সমসত্ত্ব অর্থাৎ সব জায়গায় মোটামুটি একই রকম। এ ছাড়া সমকেন্দ্রিক অর্থাৎ সব দিকে মোটামুটি একই রকম দেখতে। গাণিতিক তত্ত্ব ও বাস্তব পর্যবেক্ষণ এই ভাবনাকে সমর্থন করে।
মহাবিশ্বের অবস্থা নিয়ে বেশ কিছু ভুল ধারণা আছে। মনে করা হয় যে বিগ ব্যাং মহাকাশের একটি বিন্দু থেকে একটি বিস্ফোরণ ছিল। আসলে সেটি ছিল একযোগে সব জায়গায় প্রসারণ। মহাবিশ্বের একটি কেন্দ্র আছে। সব গ্যালাক্সি দূরে সরে যাচ্ছে। বাস্তবে প্রতিটি পর্যবেক্ষকই অন্যান্য গ্যালাক্সিকে দূরে সরে যেতে দেখেন। এ ছাড়া আমরা মনে করি, পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বই সমগ্র মহাবিশ্বকে সংজ্ঞায়িত করে। আসলে পর্যবেক্ষণযোগ্য অংশ সীমিত। মহাবিশ্ব এর চেয়ে অনেক বড় বা অসীম হতে পারে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, স্থানিক অর্থে মহাবিশ্বের কোনো কেন্দ্র বা প্রান্ত নেই বলে মনে করে বর্তমান বৈজ্ঞানিক ধারণা। বিগ ব্যাং সব জায়গা নিয়ে ঘটেছে এবং তার পর থেকে স্থান সর্বত্র প্রসারিত হচ্ছে। আমরা যাকে প্রসারণ হিসেবে দেখি, তা কেবল বিভিন্ন বস্তুর মধ্যবর্তী দূরত্ব বৃদ্ধি। যদিও আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের সীমা রয়েছে, সেই সীমা কোনো সীমানা বা কোনো কেন্দ্রীয় উৎসকে বোঝায় না।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: একই রকম ই প রস র অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
ঐহিক অমরতায় রণদা প্রসাদ সাহা
দানবীর রণদা প্রসাদ সাহাকে তাঁর গ্রামের ছোট–বড় সবাই ডাকে জেঠামনি। অবিভক্ত ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া উপাধি ছিল রায়বাহাদুর। সে নামেও তাঁকে ডাকতেন অনেকে। কিন্তু তিনি সেই অভিজাত সম্বোধন পছন্দ করতেন না। তবে আর পি সাহা নামটিই ছিল সাধারণের মধ্যে অধিক পরিচিত। দাতা বা দানবীর এই মানুষটি মির্জাপুরবাসীর কাছে আজও জেঠামনি হিসেবেই যেন ঘরের মানুষ, প্রাণের ভালোবাসার মানুষটি। এক উচ্চতর মূল্যবোধের অধিকারী, বিস্ময়কর রকম শক্তিমান মানুষ ছিলেন দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা। তাঁর প্রাণশক্তি, শ্রমশক্তি ও চিন্তাশক্তি ছিল বিস্ময়কর। আর বোধের জায়গাটিতে—মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করাকে তিনি মানবীয় কর্তব্য মনে করতেন। পৃথিবীকে সবার জন্য সুখকর করে তোলা সম্ভব এই বিশ্বাসেই তিনি জনহিতকর কাজ করে যেতেন অক্লান্তভাবে। এই ব্রত থেকেই লাভ করেছিলেন ‘দানবীর’ অভিধা। তাঁর কীর্তির চেয়ে অনেক বড় ছিলেন তিনি।
রণদা প্রসাদ সাহার জন্ম ১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর, টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা নারায়ণগঞ্জের কুমুদিনী কম্পাউন্ড থেকে পুত্র ভবানী প্রসাদসহ তাঁকে রাতের গভীরে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তারপর তাঁদের আর কোনো খোঁজ মেলেনি। ৭৪ বছরের কর্মময় জীবন রণদা প্রসাদ সাহার।
মির্জাপুর তখন একেবারেই অজপাড়াগাঁ। পিতা দেবেন্দ্র সাহার নির্দিষ্ট কোনো পেশা ছিল না। রুটিরুজির সন্ধানে বারবার তাঁকে পেশা বদল করতে হয়েছে। বেশির ভাগ সময়ে দলিল লেখকের কাজ করেছেন তিনি।
প্রসবকালে ধনুষ্টঙ্কারে অকালে মারা যান মা কুমুদিনী দেবী। তিনি রোগশয্যায় না পেয়েছেন এতটুকু ওষুধ-পথ্য, না পেয়েছেন সেবাযত্ন। শৈশবের এই অসহ্য স্মৃতি রণদা প্রসাদকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এমনভাবে যে পরবর্তীকালে তাঁকে তা একজন সেবকে পরিণত করেছিল। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দুস্থ মানুষের সেবাপ্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী’।ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অতুলনীয় মাতৃভক্তির কথা আমরা সবাই জানি। রণদা প্রসাদ বিদ্যাসাগরের মতো মাতৃভক্তি দেখানোর সুযোগ পাননি। তিনি মাকে হারান মাত্র সাত বছর বয়সে। মায়ের স্নেহের আঁচল জড়িয়ে ধরতে না ধরতে তিনি বিদায় নেন। অভাবের সংসারে প্রসূতি মায়ের যত্ন দূরে থাকুক, উপযুক্ত আহারই সময়মতো জোটেনি। চিকিৎসার জন্য সারা গ্রাম খুঁজে একজন ডাক্তারও সেদিন মেলেনি কিংবা অর্থাভাবে কোনো ডাক্তার আনা যায়নি। প্রসবকালে ধনুষ্টঙ্কারে অকালে মারা যান মা কুমুদিনী দেবী। তিনি রোগশয্যায় না পেয়েছেন এতটুকু ওষুধ-পথ্য, না পেয়েছেন সেবাযত্ন। অশৌচের অসিলায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুই ছিল তখনকার দিনে মেয়েদের এক মর্মান্তিক নিয়তি। মায়ের এই মৃত্যুদৃশ্যের নীরব দর্শক ছিল সাত বছরের অবোধ বালক রণদা প্রসাদ। শৈশবের এই অসহ্য স্মৃতি রণদা প্রসাদের নিদ্রা-জাগরণের প্রতিটি মুহূর্ত আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এমনভাবে যে পরবর্তীকালে তাঁকে তা একজন সেবকে পরিণত করেছিল। নিজের মায়ের জীবন দেখে তিনি নারী জীবনের অসহায়ত্ব উপলব্ধি করেন এবং নারী জাতির কল্যাণ্যে কিছু করার সংকল্প গ্রহণ করেন। সামর্থ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই দুঃখ-স্মৃতিকে রূপ দিয়েছিলেন দুস্থ মানুষের সেবাপ্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী’তে—স্থাপন করেছিলেন মাতৃভক্তির এক অনন্য নজির।
রণদা প্রসাদ সাহা কোলাজ