বিশ্বজুড়ে এক নৈতিক জাগরণ দেখা দিচ্ছে। ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের লাগাতার যুদ্ধ, বিশেষ করে গাজায় চলমান গণহত্যা, ইসরায়েলকে দিন দিন আরও একঘরে করে দিচ্ছে।

এ হত্যাযজ্ঞের প্রতিক্রিয়ায় একের পর এক দেশ দাঁড়িয়ে বলছে, ‘যথেষ্ট হয়েছে’। ইউরোপ থেকে শুরু করে লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকা পর্যন্ত দেশগুলো অভূতপূর্বভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির এ ঢেউ কোনো শূন্য জায়গা থেকে আসেনি। এটি ইসরায়েলের গাজায় বর্বর অপরাধের সরাসরি প্রতিক্রিয়া।

এ ঐতিহাসিক মুহূর্তের সামনের সারিতে রয়েছে মিসর। মিসর বিশ্বকে আহ্বান জানাচ্ছে—ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দাও, ইসরায়েলকে জবাবদিহির আওতায় আনো আর গণহত্যা বন্ধ করো। বার্তাটি স্পষ্ট—ইসরায়েলের দায়মুক্তি বিশ্বজনমতকে ক্লান্ত করে দিয়েছে। সবাই মনে করছে, ন্যায়বিচারের সময় এখনই।

আরও পড়ুনইসরায়েল এখনো বুঝতে পারছে না, তারা যুদ্ধে হেরে গেছে১৯ মে ২০২৫

বর্তমানে বিশ্বের তিন-চতুর্থাংশের বেশি দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে এ বছর পর্যন্ত ১৪৭টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইসরায়েলের গাজায় আগ্রাসনের পর এ সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। শুধু গত এক বছরেই একাধিক দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি ইসরায়েলের নিষ্ঠুরতার প্রতি সরাসরি প্রতিবাদ। নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড ও স্পেন ২০২৪ সালে ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়, যা ইউরোপের দীর্ঘদিনের দ্বিধাকে ভেঙে দেয়।

ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া তার একঘরে অবস্থানকেই স্পষ্ট করেছে। তারা ক্ষোভে ফেটে পড়ে, এমনকি ওই দেশগুলো থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতদের ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু এতে বিশ্ব ভয় পায়নি; বরং ইসরায়েলের একগুঁয়েমিই বিশ্বজনমতকে আরও দৃঢ় করেছে।

ইতিমধ্যে আরও কয়েকটি দেশ, যেমন স্লোভেনিয়া, মাল্টা ও বেলজিয়াম এ স্বীকৃতি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। আসলে নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড ও স্পেনের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ক্যারিবীয় দেশ (বাহামা থেকে শুরু করে ত্রিনিদাদ ও বার্বাডোজ) এখন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ গতিপ্রবাহ এখন সব মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

এমনকি ইসরায়েলের কিছু ঐতিহ্যগত মিত্রও এখন অবস্থান বদলেছে। এটি এক বিশাল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি দেখাচ্ছে, বিশ্ব সম্মানে ইসরায়েলের পতন কত গভীর। যে যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া দশকের পর দশক ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছিল, তারাও এখন আনুষ্ঠানিকভাবে তা করেছে।

তাদের এ পদক্ষেপ এসেছে সমন্বিত প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে, দ্বিরাষ্ট্র সমাধানকে নতুন করে এগিয়ে নিতে। ফ্রান্সও ঘোষণা দিয়েছে যে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে।

এটি কোনো ছোটখাটো কূটনৈতিক পরিবর্তন নয়, পশ্চিমা এই স্বীকৃতিগুলো অতীত নীতির সঙ্গে ঐতিহাসিক বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে। এর পেছনে রয়েছে গাজার গণহত্যার প্রতি তীব্র ক্ষোভ।

আন্তর্জাতিক স্রোত বদলে গেছে। আজ ইসরায়েল নিজেকে প্রায় বন্ধুহীন অবস্থায় খুঁজে পাচ্ছে। কেবল অল্প কয়েকটি দেশ এখনো দেশটিকে সমর্থন করছে। আরব ও মুসলিম বিশ্ব থেকে শুরু করে আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা এবং এখন ইউরোপের বড় অংশ—সব জায়গায় ফিলিস্তিনের পক্ষে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুনগাজা নিয়ে ট্রাম্পের বিশ দফা যেন বিশটি ‘বিষের বড়ি’০১ অক্টোবর ২০২৫

এখন এত দেশ কেন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসছে? কারণ, গাজার ভয়াবহ নৃশংসতা দেখে নিরপেক্ষ থাকা বা দোটানায় থাকার আর কোনো জায়গা নেই। ইসরায়েলের গাজায় যুদ্ধ নিছক যুদ্ধ নয়, এটি সরাসরি গণহত্যা। জাতিসংঘের একটি কমিশন স্পষ্টভাবে বলেছে, ইসরায়েল গাজার ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাচ্ছে। পুরো মহল্লা মুছে ফেলা হয়েছে। পরিবারগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। নিহত মানুষের সংখ্যা অকল্পনীয়। এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় ৬০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এটি ইতিহাসে নজিরবিহীন হত্যাযজ্ঞ, যা বিশ্ববাসী সরাসরি চোখের সামনে টেলিভিশনের পর্দায় দেখছে।

গাজায় যা ঘটছে, তা আসলে একটি জাতিকে মুছে ফেলার ইচ্ছাকৃত চেষ্টা—এটাই গণহত্যার সংজ্ঞা।

যেকোনো বিবেকবান দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে আগের মতো স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে পারে না। তাই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া কেবল প্রতীকী পদক্ষেপ নয়; বরং এটি ন্যায়বিচার ও জবাবদিহির পক্ষে দাঁড়ানো। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আসলে ইসরায়েলকে বলছে, তুমি জাতিগত নিধন চালিয়ে যেতে পারবে না, এসব করে বিশ্বের সাধারণ সদস্য হয়ে থাকতে পারবে না।

বিশ্বব্যাপী এ আন্দোলনের মধ্যে মিসর এক নৈতিক নেতৃত্বের আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছে। গাজার প্রতিবেশী দেশ হিসেবে, ফিলিস্তিনি অধিকার রক্ষায় দীর্ঘদিনের অবস্থানের কারণে এবং আরব ও আফ্রিকান বিশ্বে সম্মানজনক কণ্ঠস্বর হিসেবে মিসরের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আর সেটাই এখন মিসর করছে।

মানবাধিকার সংগঠন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক আইনি প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সবাই এখন জবাবদিহির দাবি তুলছে। এমনকি আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশের উদ্যোগে ইসরায়েলকে নির্দেশ দিয়েছেন গাজায় গণহত্যা ঠেকানোর ব্যবস্থা নিতে। বার্তাটি একদম স্পষ্ট—মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য ইসরায়েলকে জবাবদিহি করতে হবে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া মানে হলো দেশগুলো একদিকে ফিলিস্তিনিদের বেঁচে থাকার অধিকারকে সমর্থন করছে, অন্যদিকে ইসরায়েলের একটি জাতিকে মুছে ফেলার চেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করছে।

বিশ্বব্যাপী এ আন্দোলনের মধ্যে মিসর এক নৈতিক নেতৃত্বের আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছে। গাজার প্রতিবেশী দেশ হিসেবে, ফিলিস্তিনি অধিকার রক্ষায় দীর্ঘদিনের অবস্থানের কারণে এবং আরব ও আফ্রিকান বিশ্বে সম্মানজনক কণ্ঠস্বর হিসেবে মিসরের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আর সেটাই এখন মিসর করছে।

গাজায় যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিন থেকেই মিসর স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, ফিলিস্তিনিদের তাঁদের ভূমি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না।

কূটনৈতিক অঙ্গনেও কায়রোর প্রচেষ্টা ছিল নিরলস। যুদ্ধবিরতি ও মানবিক করিডরের জন্য মিসর গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছে। দিনরাত অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে গেছে যাতে যুদ্ধ কিছুটা থেমে যায় এবং সাহায্যসামগ্রী গাজায় পৌঁছাতে পারে। মিসরীয় কর্মকর্তারা রাফাহ সীমান্তপথ দিয়ে শত শত সাহায্যবাহী ট্রাক গাজার ভেতরে প্রবেশের সমন্বয় করেছেন। ইসরায়েল যাতে গাজার জনগণকে অনাহারে না রাখে, সে ব্যাপারে মিসর দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে মিসর হয়ে উঠেছে নিঃশব্দদের কণ্ঠস্বর।

ইব্রাহিম নেগম মিসরের গ্র্যান্ড মুফতির জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা

আল আহরাম থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ফ ল স ত ন র ষ ট রক ইসর য় ল র অবস থ ন গণহত য

এছাড়াও পড়ুন:

শেখ হাসিনার ফাঁসি কার্যকরের দাবি শহীদ রাকিবুলের মা-বাবার

শেখ হাসিনার ফাঁসির রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া ঝিনাইদহের রাকিবুল হোসেনের মা ও বাবা। 

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। 

আরো পড়ুন:

ফ্যাসিবাদ ও জুলুমের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক রায়: খেলাফত মজলিস

রায়ে খুশি শহীদ আবু সাঈদের বাবা-মা

সোমবার (১৭ নভেম্বর) দুপুরে বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন—বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

রায়ের পর সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টায় শহীদ রাকিবুল হোসেনের বাবা আবুবকর সিদ্দিক ও মা হাফিজা খাতুন সাংবাদিকদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের কাছে উল্লিখিত দাবি জানান।

হাফিজা খাতুন বলেছেন, শেখ হাসিনা তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ছাত্র-জনতাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল। আদালতে আজ সব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। শহীদের মা হিসেবে আমি আজ আংশিক সন্তুষ্ট। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ, আল্লাহ যেন আমাকে হায়াত দেন। আমি যেন শেখ হাসিনার ফাঁসি কার্যকর দেখে যেতে পারি।

আবুবকর সিদ্দিক বলেন, শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আছাদুজ্জামান খান কামালসহ জুলাই গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত সকলের ফাঁসি নিশ্চিত করতে হবে। যারা গণহত্যা চালিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছে, তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। দেশের মাটিতে ফিরিয়ে এনে তাদের ফাঁসির রায় কার্যকর করতে হবে। আজ আমরা খুশি। শেখ হাসিনা বহু মায়ের বুক খালি করেছে। একজন নারী হয়েও সে কীভাবে এত মায়ের সন্তানকে হত্যার আদেশ দিয়েছে, তা আমরা ভেবে পাই না।

ঢাকা/সোহাগ/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এ রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়েছে
  • শেখ হাসিনার ফাঁসি কার্যকরের দাবি শহীদ রাকিবুলের মা-বাবার
  • ফ্যাসিবাদ ও জুলুমের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক রায়: খেলাফত মজলিস
  • মৃত্যুদণ্ড শেখ হাসিনার উপযুক্ত বিচার: আখতার হোসেন
  • জামিনের পর মামলা নিয়ে মেহজাবীনের বিবৃতি
  • আধুনিক টিভির যত আধুনিক সুবিধা
  • যুক্তরাষ্ট্রে দুই কিশোরের মৃত্যু: পেশি ক্ষয়রোগে থেরাপি ব্যবহারে গুরুতর সতর্কতা