ইরানের সর্বোচ্চ নেতার ঘনিষ্ঠ সহযোগীর মেয়ের বিয়ে পশ্চিমা ধাঁচে, চলছে সমালোচনা
Published: 21st, October 2025 GMT
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার জ্যেষ্ঠ একজন সহকারীর মেয়েকে তেহরানের একটি বিলাসবহুল হোটেলে স্ট্র্যাপহীন বিয়ের গাউন পরিহিত অবস্থায় দেখা গেছে। ওই বিয়ের অনুষ্ঠানের একটি ভিডিওতে তাঁকে স্ট্র্যাপহীন পোশাকে দেখা যাওয়ার পর তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সমালোচকেরা বলছেন, ইরান সরকার কঠোর হিজাব আইনপ্রয়োগের ক্ষেত্রে ভণ্ডামি দেখাচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের ডেইলি মেইলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ভিডিও ফুটেজটি ১৭ অক্টোবর এক্সে (সাবেক টুইটার) ফাঁস হয় বলে জানা গেছে। ভিডিওতে ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সাবেক সেক্রেটারি এবং আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির শীর্ষ উপদেষ্টা আলী শামখানিকে তাঁর মেয়ে ফাতেমাহকে এসপিনাস প্যালেস হোটেলে নিয়ে যেতে দেখা যায়।
কনে ফাতেমাহ যখন একটি সাদা স্ট্র্যাপবিহীন, নিচু গলার গাউন পরে হোটেলের অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করেন, তখন অতিথিদের উল্লাস করতে দেখা যায়।
পশ্চিমা ধাঁচের এই অনুষ্ঠান ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে। সাধারণ নারীদের ক্ষেত্রে শালীনতা ও হিজাবের নিয়ম বহাল রাখা হয়েছে। কিন্তু এই অনুষ্ঠানে ঠিক উল্টো জিনিস দেখা গেছে। শামখানি একসময় হিজাববিরোধী প্রতিবাদ–বিক্ষোভ দমনে সরকারের কঠোর অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এখন তাঁর বিরুদ্ধে হিজাবের নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে।
স্ট্র্যাপবিহীন পোশাকে জমকালো বিয়ে
নির্বাসিত অধিকারকর্মী মসিহ আলিনেজাদ এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ইসলামিক রিপাবলিকের অন্যতম শীর্ষ আইনপ্রয়োগকারী আলী শামখানির মেয়ের বিয়ে হলো স্ট্র্যাপহীন পোশাকে। হয়েছে জমকালো অনুষ্ঠান। অথচ ইরানে নারীরা চুল দেখানোর জন্য প্রহৃত হচ্ছেন।
আলিনেজাদ আরও যোগ করেন, তাঁরা ‘শালীনতার’ উপদেশ দেন, অথচ তাঁদের নিজেদের মেয়েরা ডিজাইনার পোশাকে ঘুরে বেড়ান। বার্তাটি এর থেকে স্পষ্ট হতে পারে না: নিয়মগুলো আপনার জন্য, তাদের জন্য নয়।
ক্ষমতা আছে বলেই তিনি স্বাধীন
ইরানি বংশোদ্ভূত সুইডিশ পার্লামেন্ট সদস্য আলী রেজা আখুন্দিও শামখানির মেয়ের এমন পরিবেশে বিয়ের অনুষ্ঠানের সমালোচনা করে এটিকে ‘ভণ্ডামি, দুর্নীতি ও ভয়ের বহিঃপ্রকাশ’ বলে অভিহিত করেছেন।
আলী রেজা আরও বলেন, ইসলামিক রিপাবলিকের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ও দমনমূলক কর্মকর্তাদের একজনের মেয়ে স্বাধীন পোশাকে এক জমকালো অনুষ্ঠানে বিয়ে করছেন। তাঁর বাবা ক্ষমতাবান বলেই তিনি স্বাধীন।
নতুন হিজাব আইন
ইরান ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন অনুসারে, শামখানির মেয়ের এই বিয়ে ২০২৪ সালের এপ্রিলে হয়েছিল। এই বিয়ের অনুষ্ঠানে ইরানের বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা উপস্থিত ছিলেন।
ওই অনুষ্ঠানের ভিডিও এবং তীব্র প্রতিক্রিয়া এমন এক সময়ে এল, যখন কর্তৃপক্ষ হিজাবের নিয়ম কঠোরভাবে কার্যকর করতে তেহরানে ৮০ হাজার নতুন নীতি পুলিশ মোতায়েন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আলী শামখানি কে
৭০ বছর বয়সী শামখানি খামেনির দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ। তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং জ্যেষ্ঠ সামরিক কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিনি সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের নেতৃত্ব দেন।
শামখানি দায়িত্বে থাকাকালে সরকার ২০২২ সালে মাসা আমিনির মৃত্যুর পর শুরু হওয়া প্রতিবাদ–বিক্ষোভ দমনে সহিংস অভিযান চালায়। হিজাবের নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগে আটক হওয়ার পর পুলিশ হেফাজতে ২২ বছর বয়সী মাসা মারা যান।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ প্রতিবাদ চলাকালে ৬৮ জন শিশুসহ ৫০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন এবং ২০ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
পরে জাতিসংঘের একটি তথ্যানুসন্ধান দল জানায়, ইরান সরকার নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে ‘ব্যাপক, ধারাবাহিক ও চলমান’ মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।
শামখানি এর আগে জুনে তেহরানের নিজ বাসভবনে ইসরায়েলি বিমান হামলায় বেঁচে গিয়েছিলেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র অন ষ ঠ ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
কালো পতাকার মানুষ
সব গমনাগমনে কি তৈরি পথ লাগে! আলো, হাওয়া, শব্দ নিজেরা পথ তৈরি করে ছুটে চলে দিগ্বিদিক, যাদের ধরার তারা ধরে ফেলে। শব্দ আসার সম্ভাব্য ক্ষীণ পথগুলো কাপড়ের টুকরা বা কাগজের দলা দিয়ে বন্ধ করতে থাকেন ‘আম্মা’। বিছানায় ছেলেমেয়েরা ঘুমাচ্ছে। ওরা এভাবে গাদাগাদি করে শুতে অভ্যস্ত নয়। বড় ছেলেদের ঘর আলাদা, তারা নিজ নিজ বিছানায় হাত–পা ছড়িয়ে ঘুমায়। মেয়ে দুটো ছোট, তারা মায়ের ঘরে শুলেও তাদের আলাদা খাট। কিন্তু বড় মেয়েটা ভীতু হওয়ায় ও প্রায় সময় মায়ের কাছে ঘুমায়। আজও সে ছটফট করছে। ওর জন্যই জানালার পাল্লার চিকন, ক্ষুদ্র, ফাঁকও বন্ধ করার চেষ্টা করছেন তিনি। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ঝমঝমানি ছাপিয়ে বাইরের খানকাঘরের বারান্দার সামনের তর্জন–গর্জন আর আর্তনাদের মিহিন ছিটেফোঁটা নিশুতি রাতে দ্বিগুণ হয়ে ঘরে আসছে। সেসব শব্দে তীব্র আতঙ্কে বাচ্চা মেয়েটা কেবল চমকে চমকে উঠছে। সন্তানের জন্য আম্মা শব্দের পথ একটা একটা করে বন্ধ করে চলেছেন।
শহর থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থী দিয়ে বাড়ি ভরা। এত এত ঘর, প্রতিটি ঘরে মানুষ, বিপন্ন মানুষ, যুদ্ধাক্রান্ত মানুষ। খাটে জায়গা হচ্ছে না বলে মেঝেতে বিছানা পাতা হয়েছে। আম্মারা নিজেরাও শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে এসেছেন। এটি তাঁর শ্বশুরবাড়ি। বিশাল বড় বাড়ি। সারি সারি ঘর। অন্য সময়ে খালি পড়ে থাকলেও আজ এই চরম বিপর্যয়ের দিনে কাজে লাগছে। তাঁরা নিজেদের শোবার ঘর, বসার ঘর, পড়ার ঘর ছেড়ে দিয়ে নিজেরা একটি ঘরে কোনো রকমে থাকছেন।
তাঁর স্বামী এলাকার মান্যগণ্য প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, নানা মানুষের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। তাঁর বাড়িতে আশ্রয়ের জন্য মানুষ আসবে, এটাই স্বাভাবিক।
রাত বেড়ে গভীর হচ্ছে। চেয়ারম্যান সাহেব মেয়ের পাশে উদ্বিগ্ন আধশোয়া স্ত্রীকে বলেন, ‘দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, আমি বাইরে যাচ্ছি, কখন ফিরব ঠিক নেই।’
যুদ্ধের পুরো সময়টা ফেরার ঠিক নেই, খাওয়া, ঘুমের ঠিক নেই। এভাবেই কাটছে তাঁদের।
শহর থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থী দিয়ে বাড়ি ভরা। খাটে জায়গা হচ্ছে না বলে মেঝেতে বিছানা পাতা হয়েছে। বিশাল বড় বাড়ি। সারি সারি ঘর। অন্য সময়ে খালি পড়ে থাকলেও আজ এই চরম বিপর্যয়ের দিনে কাজে লাগছে।২.বাড়িতে দিনের বেলা খানসেনারা আসে মুক্তির খোঁজে। চেয়ারম্যান সাহেব তাদের নানাবিধ কথা দিয়ে, ভালো খাবারদাবার দিয়ে তুষ্ট রাখার চেষ্টা করেন, শান্ত করে বিদায় দেন। রাতের অন্ধকারে সুপ্ত আতশবাজির মতো আসে মুক্তির ছেলেরা। চেয়ারম্যান সাহেব এবং বাড়ির আম্মা তাদের বুক দিয়ে সহায়তা দিতে চেষ্টা করেন। তারা খেয়েদেয়ে কিছু রসদ, কিছু পরামর্শ নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। এসব কাজে পাশে থাকেন তাঁর স্ত্রী, সবাই যাঁকে ‘আম্মা’ বলে ডাকে। এভাবে সস্ত্রীক মানুষটি তাঁর নিজের এলাকা, এলাকার আতঙ্কিত মানুষগুলোকে রক্ষা করেন। যখন চারপাশের এলাকা যুদ্ধ নামক আগুনের করালগ্রাসে ভস্মীভূত হয়ে যাচ্ছে, তখন তাঁরা নিজেদের সবটুকু দিয়ে নিজ এলাকাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন প্রাণপণে।
মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা আজ একজন স্থানীয় রাজাকারকে ধরে এনেছে। তারা বাইরের আঙিনায় সেই কুলাঙ্গারের বিচার করছে। বরাবরের মতো বিচারিক দায়িত্ব দিয়েছে বিজ্ঞ চেয়ারম্যান চাচাকে। আবার নিজেরাও শান্ত থাকতে না পেরে নানাবিধ শাস্তির কথা উল্লেখ করছে।
রাজাকারের নাম মকবুল। সে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজনকে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলা মানুষদের ধরিয়ে দিত। আরেকটা কাজ সে নিষ্ঠার সঙ্গে করত, মিলিটারির হাতে নিহত মানুষদের শেষ সময়ে সবাইকে নিজের পেশাব খাওয়াত, সরাসরি মুখে পেশাব করে দিত। এ জন্য তার নাম হয়েছে ‘মুতিয়া মকবুল’। এ নাম পাওয়াতে সে এতই খুশি যে কেউ এ নামে ডাকলে খুশিতে খ্যাক খ্যাক করে হাসে। মনে হয় সে খান বাহাদুর উপাধি পেয়ে গেছে। আজ আর মুখে হাসি নেই।
জসিম স্টেনগানের নলটা মাথায় ঠেকিয়ে বলে, ‘দেই? ওই শালা হারামি দেই ট্রিগার টিপে?’ ঘোড়েল মকবুল আজ অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। ধরা সে পড়েছে কয়েক দিন আগে। লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। ধরা পড়ার পরপরই চাচার কাছে খবর যায়। তিনি জানিয়ে দেন, একেবারে মেরে না ফেলে শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায় কি না। তাঁর কড়া নির্দেশ—অহেতুক কোনো প্রাণ যেন নষ্ট না হয়। দুরন্ত ছেলেরা তাঁর নির্দেশ মেনে চলে।
তবে ছেলেরা মকবুলকে ভালো রকম শিক্ষা দিচ্ছে। মারধর তো করেছেই, ক্ষণে ক্ষণে গুলি করার হুমকি, এ ছাড়া খাবার, পানীয় কিছুই দেয়নি, ঠিক করেছে ওকে পানি দেওয়া হবে না। মিলিটারিরা এই বর্ষণমুখর রাতে আসবে না জেনে তারা এই বিচার বসিয়েছে। তাদের চাচা বাড়ি থেকে এখনো বের হননি। তিনি আসার আগেই ছেলেরা ওকে যা করার তা–ই করছে। হঠাৎ দেখা যায়, এক যুবক হনহন করে আসছে। এসে হিসহিস করে বলে, ‘খবরদার, এই কুত্তার বাচ্চাক গুলি কইরবা না। অরে আমি ধারালো ছুরি দিয়া কুচি কুচি কইরব। অরে পানি দেব না। অর মুখত মুতি দেব। শালা আমার ভাইয়ের মুখত মুতি দিছিল। পাকি কুত্তারা আমার ভাইটাকে গুলি করে ঝাঁঝরা করি দিছিল, আর এই হামার পড়শি, এই জানোয়ার, শেষ সময়ে তার মুখে মুতি দিছে।’
মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা আজ একজন স্থানীয় রাজাকারকে ধরে এনেছে। তারা বাইরের আঙিনায়। বরাবরের মতো বিচারিক দায়িত্ব দিয়েছে বিজ্ঞ চেয়ারম্যান চাচাকে। আবার নিজেরাও শান্ত থাকতে না পেরে নানাবিধ শাস্তির কথা উল্লেখ করছে।এই বলে সে মাটিতে থেবড়ে বসে হু হু করে কেঁদে ওঠে। আরও একবার সবাই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। মন্টু বলে ওঠে, ‘আরে এত কথায় কাজ কী, দেই শালাক শেষ করে। এই এক বালের জন্য এত সময় নষ্ট।’ সোহরাব ফিসফিস করে ওঠে, ‘এই চাচা আসতেছে।’ গুঞ্জন থেমে যায়। এর মধ্যেই একজন সর্বশক্তি দিয়ে একটা লাথি কষলে হাত বাঁধা মকবুল একদিকে কাত হয়ে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে একজন ঘুষি মেরে সোজা করে দেয়, ‘হারামজাদা, সোজা হয়া বসি থাক।’
চেয়ারম্যান সাহেব এসে বসে সব কথা শোনেন। তিনি গম্ভীর স্বরে বলেন, ‘একে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও। তোমাদের যা ভালো মনে হয় তাই করো।’ তিনি এখন জানেন, এই গাদ্দার এলাকার নারীদের ক্যাম্পে নিয়ে গেছে, এলাকার তরুণ–যুবকদের ধরিয়ে দিয়েছে। যে বাড়ির ছেলেরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে সে বাড়ির মানুষজনকে মিলিটারির কাছে ধরিয়ে দিয়েছে। এমনকি তার পড়শিকেও নানাভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে, হেনস্তা করেছে। চেয়ারম্যান সাহেব ওর দিকে একটা ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভেতরে চলে যান।
এবারে ছেলেরা চাপা উল্লাসে জেগে ওঠে। ওরা ওকে হাত বাঁধা অবস্থায় হাঁটিয়ে নিতে থাকে।
মকবুল ঘাড়ের ওপর প্রেশার কুকারের সিটির মতো মৃত্যুর গরম নিশ্বাস অনুভব করে। পানির তৃষ্ণায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে; কিন্তু এরা তো পানি দিচ্ছে না।
চেয়ারম্যান চাচার বাড়ির পেছন দিয়ে বয়ে গেছে একটি শান্ত নদী। পাড় দিয়ে অগণন বৃক্ষের সারি। সেখানে সবাই এসে হাজির হয়। বৃষ্টি থেমে গেছে। মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ বের হয়ে এসেছে।
মকবুলের হাত বাঁধা ছিল। এবারে পা–ও বেঁধে ওকে পানির কিনারে বসিয়ে দেওয়া হয়। তার নড়াচড়া করার শক্তিও নেই, উপায়ও নেই। তবে খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। মনে মনে ভাবে, এরা কি একটু পানি দেবে না! আবার ভাবে, সে এত মানুষকে প্রস্রাব খাইয়েছে, কীভাবে এরা পানি দেবে।
একজন গলা তুলে বলে, ‘ফায়ার কিন্তু আমি করব।’ আরেকজন বলে ওঠে, ‘না, আমি ধরছি, ফায়ার আমি করব।’ আরেকটি কণ্ঠ শোনা যায়, ‘তার আগে হারামজাদার মুখটা কেউ তুলে ধর তো, আমি অর মুখত পেচ্ছাব করে দেই, তারপর গুলি না করে জবাই করা হোক।’
মকবুলের হাত বাঁধা। তার নড়াচড়া করার শক্তিও নেই, উপায়ও নেই। তবে খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। মনে মনে ভাবে, এরা কি একটু পানি দেবে না! আবার ভাবে, সে এত মানুষকে প্রস্রাব খাইয়েছে, কীভাবে এরা পানি দেবে।মকবুল নিজের অবস্থা বুঝে কেঁপে কেঁপে ওঠে। এরা তো মারবেই। তা মরার সময় একটু পানিও খেতে পারবে না? ওর মনে পড়ে, ওরই বয়সের হামিদুলের কথা। হামিদুল মুক্তি। সে এসেছিল বাবা–মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। সে নিজে মিলিটারি ডেকে এনে ধরিয়ে দিয়েছে। গুলি খেয়ে পড়ার পর হামিদুল পানি পানি করছিল। তখন সে লুঙ্গি তুলে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা খেলার সাথি হামিদুলের মুখে ছরছর করে প্রস্রাব করে দিয়েছিল। হামিদুল কী গভীরতর ঘৃণা নিয়ে ওর দিকে শেষবারের মতো তাকিয়েছিল।
আজ এরা ওকে প্রস্রাবই দেবে। কিন্তু বুকটা তো ফেটে যাচ্ছে। একটু পানি, হিমশীতল একটু পানি না খেলে হবে না। শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে পানির জন্য হাহাকার জেগে উঠছে। জিবটা শুকনা খড়ের মতো রুক্ষ হয়ে গেছে, ঠোঁট ফেটে গেছে, ভেতরে একটু থুথুও জমছে না। গলার ভেতরটা মরুভূমির বালুর মতো খসখসে, ঢোক গিলেতে গেলে কাঁটার মতো বিঁধছে। বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে, এক ফোঁটা পানি, এক বিন্দু তরল যেন জীবনটাকে শীতল করে দিত। চোখ দুটো জ্বালা করতে থাকে, মাথার ভেতর হালকা ধোঁয়ায় ভরে যায়, ঘোর লাগে, মনে হয় এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিলে জীবনের সব যন্ত্রণা মুছে যেত। পানির পিপাসা যে এমন, তা মকবুল আগে বোঝেনি।
সে গুঙিয়ে ওঠে, ‘ভাই রে, তোমার আল্লাহর দোহাই, আমাক এনা পানি দেও। আমাক গুলি করো, জবাই করো, কিন্তু এক ফোঁটা পানি আমাক দেও। আমাক দয়া করো, তোমার পাও ধরি একনা পানি দেও...’
বৃষ্টি থেমে গিয়ে মেঘের আড়াল থেকে চাঁদটা বেরিয়ে এসে সবার ওপর সমানভাবে জ্যোৎস্না ছড়াতে থাকে।
ঠিক সে সময় বাড়ির খাস কাজের লোক স্বচ্ছ কাচের জগ ভর্তি টলটলে পানি আর ঝকঝকে একটি গ্লাস নিয়ে এসে দাঁড়ায়। বলে, ‘আম্মা কয়া দিছে অরে পানি খাওয়াইতে। যা করমেন করেন, কিন্তক পানি খাওয়ান।’
মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ওদের মতোই আরেক যোদ্ধা এই আম্মাকে ভালোভাবে চেনে, জানে। আম্মা ঘরের ভেতর থেকে লড়াই করে যাচ্ছেন নানাভাবে। তারা সবাই থির হয়ে যায়। জগের গায়ে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা জমে ওঠে। সবার চোখ জগের দিকে।
মুতিয়া মকবুলের খড়খড়ে জ্বলুনি চোখেও কি পানি জমে! সে পানি ভরা চোখে জগটার দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন একটা অপার্থিব দৃশ্য। সবার জোড়া জোড়া চোখের সামনে দৃশ্যটা একটা ঐশ্বরিক ফ্রেমে আটকা পড়ে।